আমাদের ক্লাবের দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলে প্রতিবারই যে লোকটা ঢাক বাজাতে আসত তার নাম নটুরাম নট্ট। বড়রা নটু বলে ডাকত। আমরা বলতুম নটুদা। নটুদা প্রথম কবে আমাদের ক্লাবে ঢাক বাজাতে এসেছিল আমাদের তা মনে নেই। সত্যি কথা বলতে কী সেকথা কেউই জানে না। সবাই শুধু জানে যে আমাদের পুজোতে নটুদাই ঢাক বাজাবে।

নাটুদাকে কিছু বলতে হয় না। ষষ্ঠী পুজোর দিন সেই কাকভোরে সে চলে আসত। আমরা বাড়ি থেকেই শুনতে পেতাম ঢাক বাজাচ্ছে।

কাইনাড়া কাইনাড়া গিজগিনতা গিজগিনতা।

ব্যস, আমরা ধড়মড় করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়তাম। হুররে। পুজো এসে গেছে! যেন নটুদাই এসে ঠিক ভোরবেলা আমাদের জানিয়ে দিত, দুর্গাপুজো শুরু হয়ে গেছে! তাই নটুদা ছাড়া আমরা পুজোর কথা ভাবতেই পারতাম না।

কিন্তু নটুদার একটা বিচ্ছিরি স্বভাব ছিল। প্রতিবারই সে নিজের গ্রামে ফিরে যাওয়ার সময় আমাদের এখানে কিছু না কিছু ফেলে যেত। এই যেমন গামছাটা, জামাটা, ঢাক পেটাবার কাঠি দুটো। কখনও আবার যে টাকাটা ওকে দেওয়া হত সে টাকাটাই হয়তো পড়ে থাকতো। একেক বছর একেকটা জিনিস। আমরা ক্লাবের ছেলেরা জানতাম, নটুদা কিছু না কিছু ফেলে যাবেই। দশমীর দিন গঙ্গায় প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে এসে আমরা নটুদার ফেলে রাখা জিনিস যত্ন করে ক্লাবঘরে তুলে রাখতাম। আবার পরের বছর পুজোর সময় নটুদার হাতে তুলে দিতাম। এরকমই চলছিল। নটুদাকে যখন বলতাম, তখন সে হাসতে হাসতে বলত, ‘ওটা তো তোমাদের জন্য রেখে গিয়েছিলাম’।

বছরের পর বছর এরকম চলতে লাগল। আমরা বড় হয়ে গেলাম। বড়রা আরও বড় হয়ে গেল। অনেকে দূরে দূরে চলে গেল। তবে আমাদের ক্লাবের পুজোটাও রইল, আর রইল ঢাকী নটুদা। অনেক কিছু বদলালো কিন্তু নটুদার জিনিস ফেলে দেওয়ার স্বভাব বদলালো না। একবছর তো ঢাকটাই নটুদা নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিল। আমরা ওকে জিগ্যেস করেছিলাম, কি নটুদা ঢাকটাও কি আমাদের জন্য রেখে গিয়েছিলে’?

গত দু’বছর হল নটুদা আর আমাদের ক্লাবের পুজোতে আসছে না। শুনেছি, নটুরাম নট্ট নাকি মারা গেছে। সে আর আশ্চর্যের কথা কী? বয়স তো হয়েছিল। আমরা খবরটা শুনে দুঃখ পেয়েছিলাম। তবে নটুদার একটা রাখা জিনিস এখনও আমাদের পুজো প্যান্ডেলে রয়ে গেছে। কী সেটা? ঢাকের বাজনাটা। ওটা নটুদা সত্যি আমাদের জন্য রেখে গেল।

Leave a Reply