জিতেও মুক্তো অনেক রাত পর্যন্ত কাঁদল।
ঠিক কান্না নয়, ফোঁপানির মতো। আমি চাপা গলায় বললাম, অ্যাই মুক্তো, মুক্তো চুপ কর। চুপ কর বলছি! তোর মা কিন্তু শুনতে পেলে ঘুম থেকে উঠে এসে আবার মারবে।”
মুক্তো একটুখানি চুপ করে রইল। কিন্তু বেশিক্ষণ পারল না। ফোঁপাতে লাগল। একঘেয়ে, একটানা সেই ফোঁপানি শুনতে শুনতে একটা সময় আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। যখন ঘুম ভাঙল, চোখ খুলে দেখি সকাল! মাথার পাশ থেকে সাঁই সাঁই করে গাড়ি ছুটছে। রোজ যেমন ছোটে। মুখ ঘুরিয়ে দেখি ভূজিয়া, পাতলুনরা কেউ নেই। ফুটপাথ ফাঁকা। শুধুও পাশে গুঁড়িসুড়ি মেরে শুয়ে আছে মুক্তো। পার্কের রেলিঙের দিকে মাথা করে। মেয়েটা নিশ্চয় অনেক রাত পর্যন্ত কেঁদেছে। গায়ের কাঁথাটা টেনে দিতে গিয়ে দেখি, তখনও ফোঁপাচ্ছে। মেয়েগুলোর এই এক দোষ। এরা কান্না থামালেও ফোঁপানি থামাতে পারে না। আমি ফিরে এসে বিছানা গোটাতে লাগলাম। ফুটপাথের বিছানার মজা হল, পাততে গোটাতে একদম সময় লাগে না।
মুক্তোর কান্নাকাটির কারণ কালকের ঘটনা।
কাল রাতে পার্কে আমি, ভুজিয়া, পাতলুন আর মুক্তো মারপিট মারপিট খেলছিলাম। এটা আমাদের প্রিয় খেলা। সুবিধের কথা হল, এই খেলাতে বল-ব্যাট লাগে না। খরচ নেই। দিনে-রাতে যে কোনও সময় খেলা যায়। এই কারণেই আমাদের প্রিয়।
কালকের মারপিট খেলাটা ছিল একটু অন্যরকম। খেলা হয়েছে তিন কায়দায়। শুয়ে, বসে এবং ছুটে ছুটে। আমি ছুটে খেলায় খুব ওস্তাদ। তবে সব ধরনের মারপিটে আসল ওস্তাদ হল আমাদের মুক্তো। ও জিতবেই। কালও জিতেছে। মুক্তোর বয়স মোটে সাত। রোগা, পিংলে, হাড় জিরজিরে চেহারা। মাথায় গাদাখানেক জট পাকানো চুলের জন্য আরও রোগা দেখায় মেয়েটাকে। কিন্তু তা হলে কী হবে, লড়তে পারে সাঙ্ঘাতিক! ওই চেহারাতেই অনেক জোর। কোথা থেকে যে পায়? দু’হাতে মুঠি পাকিয়ে যখন ঘুষি চালায়, তখন আমরা ছুটে পালাই। পালানো ছাড়া উপায় থাকে না কোনও। ঘুষি ছাড়া মারপিটের আরও অনেক কায়দা জানে মুক্তো। চুল খামচানো, চিমটি, কাতুকুতু। সেগুলো ও অবশ্য মারপিট খেলায় কাজে লাগাতে চায় না। জাপটে বা চেপে ধরলে তবেই খামচি মারে। মুক্তোর সবথেকে পছন্দ ঘুষি। রোগা হাত ছুড়বে সাঁই সাঁই করে। ওপরে, নিচে, দু’পাশে। মাথা নামিয়ে জাপটে ধরতে গেলে খামচি দেবে কাঁধে। মুখে বলবে, ‘ধুয়ো, হেরো। ঘুষিতে পারে না, তাই ধরতে আসে। সাহস থাকলে আয় না দেখি।” বলে ঘুষি দেখায়। কী আর করা? লজ্জায় আমরাও ঘুষি বাগাই। পুঁচকে মেয়েটা এ পাশে ও পাশে, ধাই ধুই করে ছুট লাগায়। খেলায় জিতে যায়। আমরা, ছেলেরা হেরে ভূত হয়ে যাই।
সেদিন পাতলুন বলল, “দেখবি মুক্তো বড় হয়ে ঘুষিওয়ালি হবে।’
ভুজিয়া বলল, ‘ঘুষিওয়ালি। সেটা আবার কী?”
আমি বললাম, “তুই একটা গাধা। এগারো বছর বয়স হয়ে গেল এটা বুঝিস না? টিসুম টিসুম।”
আমি ডান হাতটা মুঠো করে ভুজিয়ার নাকের কাছে নিয়ে ঘুষি মারবার ভান করলাম।
ভুজিয়া রেগে বলল, “বেশি পণ্ডিত। তুই কোথা থেকে জানলি?”
আমি বললাম, “সে আছে।”
পাতলুন, বলল, “কে, তোর নন্দদা?” আমি মুখ ভেংচে বললাম, জানি না। তোর কী . তবে যতই মুখ ভেংচাই না কেন, কথাটা ঠিক বলেছে পাতলুন। জানাজানির কিছু হলে নন্দদাই আমার ভরসা। নন্দদার কলেজ টাইমে আমি মাঝেমধ্যে গলির মুখে দাঁড়াই। নন্দদা এলে সঙ্গে সঙ্গে যাই। একেবারে সেই বাস স্ট্যাণ্ড পর্যন্ত।
প্রথম দিন মজার ঘটনা হয়েছিল। গলির মোড় থেকে আমি তো নন্দদার পিছন পিছন যাচ্ছি। ভয়ে বুক ধুকপুক করছে। ভয় অন্য কোনও কারণে নয়, ময়লা ছেঁড়া জামা পরে আছি বলে ভয়। এরকম পোশাকের কেউ কাছাকাছি থাকলে সবাই ধমক লাগায়। দেখছিলাম এই মানুষটাও দেয় কিনা। এটাও আমার একটা খেলা। বকুনি খাওয়া বকুনি খাওয়া খেলা। একা একা খেলি। ‘পরিষ্কার জামা, চকচকে জুতো’ পরা কাউকে দেখলে পিছন পিছন যাই। ‘পরিষ্কার জামা, চকচকে জুতো’ বকুনি দিলে হাসতে হাসতে ছুটে পালাই। সেদিনও এরকম একজনের পিছু পিছু যাচ্ছিলাম। সেই মানুষটাই নন্দদা। নন্দদা হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে মুচকি হেসে বলল, “কী রে ছেলে, পয়সা চাই?” আমি মাথা নাড়লাম। নন্দদা তখন বলল, টিফিন খাবি?” আমি তখন জোরে জোরে মাথা নাড়লাম। নন্দদা এবার চোখ পাকিয়ে বলল, “তা হলে? অন্য মতলব নেই তো?” আমি মিনমিন করে বললাম, না, এমনি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি।”
ব্যস, সেই থেকে ভাব। ইচ্ছে হলেই সঙ্গে সঙ্গে যাই। এটা-সেটা কথা বলি। নন্দদা মোটে রাগ করে না। যা জানতে চাই বলে দেয়। হয় তখনই নয়ত পরে জেনে নিয়ে বলে। নন্দদা আমাকে ওদের বাড়িতে যেতেও বলে। আমার সাহস হয় না। ফুটপাথের ছেলেরা কারও বাড়ি যায় না।
ভুজিয়া বলল, “দূর, মেয়েরা কখনও ঘুষি মারতে পারে?”
আমি বললাম, ‘কেন? আমাদের সঙ্গে মারপিটের সময় তো পারে। ওইটুকু মেয়ে তোকে কম ধোলাই দিয়েছে? বল তুই। সত্যি কথা বল।’
ভুজিয়া বলল, “আচ্ছা, তাই না হয় হল। এবার তুই একটা মেয়ে ঘুষিওলার নাম বল তো দেখি।”
আমি চুপ করে গেলাম। সত্যি তো। আমি তো কোনও মেয়ে ঘুষিওলার নাম জানি না। মেয়ে ঘুষিওলা আবার হয় নাকি? আমি কথা ঘুরিয়ে বললাম, ‘অ্যাই ভুজিয়া, ঘুড়ি ওড়াবি?”
“ঘুড়ি কোথায় পাব। ধরেছিস?”
‘না, ধরব। ধরে ওড়াব। চল ফড়েপুকুরে ঘুড়ি ধরতে যাই।’
পাতলুন বলল, “তোরা যা, আমি যাব না।’
আমি হেসে বললাম, ‘কেন, যাবি না কেন? তোর কি স্কুলে পরীক্ষা?’
কথাটা বলেই আমরা তিনজনে খুব জোরে হেসে উঠলাম। হাসবই তো। আমাদের তো স্কুলই নেই। স্কুল থাকলে তো পরীক্ষা। হি হি।
যাই হোক, এবার মুক্তোর কান্নার ব্যাপারটা বলি।
আমাদের সঙ্গে মারপিট খেলায় যতই জিতুক না কেন মুক্তো, ওর প্রাইজ একটাই। মায়ের কিল। একটা-দুটো কিল নয়, অনেকগুলো কিল। কিলের সঙ্গে মাথার চুল ধরে ঝাঁকানি। মুক্তোর মা খুব ভাল চুল ঝাঁকানি দিতে পারে। আমার মনে হয় ফুটপাথে সবার মধ্যে এক নম্বর। খেলায় ঘুষি মেরে ধরা পড়লেই মুক্তোর চুল ধরে বলে, ‘বল, বল আর করবি? আর করবি বল?’
মুক্তো কাতরে ওঠে। বলে ‘করব না মা, আর কোনওদিন করব না।’
“ছিছি। ছেলেদের মতো ঘুষোঘুষি! এ আবার কী? আঁ্যা, এতদিন বারণ করেছি, কথা কানে যায় না? আজ তোর পিঠ ভাঙব। দেখবি ঘুষি কাকে বলে।’
মুক্তো আরও জোরে কাতরায়। কিলের দাপটে পিঠ বেঁকে যায় তার। কঁকিয়ে ওঠে।
“আর ঘুষি মারব না মা। ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও তোমার পায়ে পড়ি।”
মুক্তোর মা ছাড়ে না। বলে, “বলেছি না, মেয়ে হয়েছিস, মেয়েদের মতো থাকবি, মেয়েদের সঙ্গে খেলবি। বলিনি? বল বলেছি কিনা?”
মুক্তো কাঁদতে কাঁদতে বলে, “বলেছ মা, অনেকবার বলেছ। হাজারবার বলেছ।”
“তা হলে? এ কেমন জিনিস? অ্যা! ঘুষি পাকিয়ে তেড়ে যাওয়া! ছি ছি।
‘আর খেলব না মা। আর কখনও খেলব না।’
খেলব না বলার পরও মুক্তোর মা মুক্তোকে ছাড়ে না। আরও কয়েক ঘা মারে। কাল রাতেও মেরেছে। এটা প্রায়ই হয়।
মুক্তোর ঘুষির লড়াই ওর মায়ের চোখে পড়লেই হল। মুক্তোটাও তেমনি। খেলার সময় হাত দুটো মুঠো পাকিয়ে এমন করবে যে ওর মার দূর থেকে ঠিক নজরে পড়ে। আবার ঘুষি! চুলের ঝুঁটি ধরে টেনে নিয়ে যায় ফুটপাথ বাড়িতে।
আমরা মুক্তোকে অনেক বারণ করি। আমি বলেছি, “তুই আমাদের সঙ্গে আর আসিস না মুক্তো।”
ভুজিয়া শান্ত গলায় বলে, “তোর তো অনেক খেলা আছে। যা না, ও তো রাস্তার ওপাশে চুমকি,ঝুমা, টুসিরা দাগ কেটে খেলছে। একাদোক্কা না কী যেন। ওখানে ভাগ।”
মুক্তো জিভ দেখিয়ে বলে, তুই যা। ছ্যা, ওটা আবার খেলা নাকি।”
আমি শান্ত করার জন্য বললাম, তা হলে পার্কে ঢুকে দোলনা চড় গে। স্কিপিং করতে পারিস? করবি? আমারটা দেব?”
মুক্তো আরও তেজ দেখায়। বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলে, ‘বয়ে গেছে তোরটা নিতে। আমার নিজের দড়ি আছে। আমার ওসব খেলা ভাল লাগে না।’
ভুজিয়া রেগে গিয়ে বলে, “তা হলে কী ভাল লাগে? কোন খেলা?” মুক্তো ছোট ছোট দাঁত বের করে হাসে। মাথা ঝাঁকিয়ে দু’হাত মুঠো পাকিয়ে বলে, ‘ঘুষি। এমন মারব তোর মাথা বোঁ করে ঘুরবে। হি হি।” কথা বলে সে নিজেই এক চক্কর মারে আনন্দে। লড়াইয়ের আনন্দে চোখ-মুখ যেন জ্বলজ্বল করে ওঠে তার! মাথা ঝাঁকানোর সময় কানের দুল দুটো দুলে ওঠে। কদিন হল মুক্তোর মা মেয়ের কান বিঁধিয়েছে। কোথা থেকে দুটো চকচকে রিং এনে পরিয়ে দিয়েছে কানে। বেশ লাগে। কালো মুখে একটুখানি চকচকানি।
মুশকিল হল আমরা এত বারণ করার পরও মুক্তো আমাদের ছেড়ে যায় না। মায়ের হাতে মার খেয়েও শিক্ষা হয় না। তার। আবার এই কাজ করে। ঘুষি তাকে টানে। সেই টানে মারপিট খেলায় মেতে ওঠে ফের। ওইটুকু চেহারায় নেচে কুঁদে হাত ছোঁড়ে এমনভাবে যেন সত্যি সত্যি বিরাট ঘুষিওয়ালি এসেছে একটা। আমাদের ফুটপাথের লড়াইবাজ! খুঁটে খাওয়া আধাপেটায় কোথা থেকে যে এত শক্তি পায়!
নন্দদাকে ঘুষিওয়ালির কথা বলতে বলল, “ঘুষিওয়ালি! সেটা আবার কী? মেয়ে বক্সারের কথা বলছিস?”
আমি মাথা নাড়লাম।
নন্দদা হেসে বলল, ‘ওমা, কেন থাকবে না? অনেক আছে। কালই তোকে ইন্টারনেট ঘেঁটে বলে দেব।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, কী নেট!” নন্দদা হেসে বলল, “কম্পিউটার। ওই যে দোকানে দেখিস না? আচ্ছা, বাড়িতে আসিস, কম্পিউটার দেখাব। ও, তুই তো আবার বাড়িতে আসতে ভয় পাস। ঠিক আছে আমি গিয়ে একদিন নিয়ে আসব।”
আমি বললাম, নন্দদা, মেয়েরা ঘুষোঘুষি করে কেন? মেয়েদের কি মারপিট মানায়? ওরা পুতুল খেলবে। তাই না?”
নন্দদা আমার কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, “দূর বোকা, বক্সিং মানে কি মারপিট? বক্সিং একটা স্পোর্টস। খেলা। লড়াইয়ের খেলা। খেলায় আবার ছেলেমেয়ে কী? আজকাল মেয়েদের ক্রিকেট, ফুটবল সবই তো হচ্ছে। মহাকাশেও মেয়েরা যাচ্ছে। সেটাও খেলা। অ্যাডভেঞ্চারের মজায় বিজ্ঞান নিয়ে সিরিয়াস খেলা।”
পুরোটা বুঝতে না পারলেও, নন্দদার কথা আমার খুব ভাল লাগল।
উস, মুক্তোর মা শুনলে আরও ভাল হত। বুঝতে পারত, তার মেয়ে শুধু মারপিট করে না। এটা একটা খেলা। ভেবেছিলাম মেয়ে ঘুষিওয়ালাদের নাম জানলে পাতলুন আর ভুজিয়াকে বলব। এখন মনে হচ্ছে মুক্তোর মাকেও বলা দরকার। আমাকে ধমক দেবে না তো? মনে হচ্ছে দেবে। যা রাগী। আচ্ছা, আমায় যদি জিগ্যেস করে তোর কী রে? তুই কি চাস মুক্তো মারকুটে হোক? সত্যি তো। কী বলব তখন? আমি কী চাই? আচ্ছা একটা কাজ করলে কেমন হয়? নন্দদা বাসে উঠে যেতেই আমি পাতলুন আর ভুজিয়ার খোঁজে ছুটলাম। এই সময়টা ওরা গুলি খেলে। পরদিন নন্দদার সঙ্গে যখন দেখা করলাম তখন আমার সঙ্গে পাতলুন, ভূজিয়া দুজনেই আছে। মুক্তোও আসতে চেয়েছিল।
আমি বললাম, ‘একটা চড় খাবি। এটা ছেলেদের ব্যাপার।’
নন্দদা আমাদের দেখে হেসে বলল, ‘ওরে বাবা একেবারে ব্যাটেলিয়ান নিয়ে এসে গেছিস! ব্যাপারটা কী বলত?”
আমি বললাম, “তুমি নামগুলো এনেছ? ওই যে মেয়েদের? যারা ঘুষি মারে।”
পকেট থেকে কাগজ বের করে বলল, “বেশি বলব না। মাত্র পাঁচটা বলছি। আছে আরও অনেক। তবে অতি খটমটে নাম শুনে ঘাবড়ে যাবি।”
আমি বললাম, ‘তাই বল।’
ক্রিস্টি মার্টিন, ডেলিয়া গঞ্জলেস, মিয়া সেন্ট জন, লায়লা আলি আর ডেইড্রে গগার্টি। এই হল দুনিয়া কাঁপানো পাঁচ মেয়ে বক্সার। তোদের কথায় ঘুষিওয়ালি।”
ভুজিয়া বলল, ‘ওরে বাবা!’
নন্দদা হেসে বলল, “আগেই বলেছিলাম না? খটমটে লাগবে। মেয়ে হলে কী হবে এরা কিন্তু সব পৃথিবীর নাম করা বক্সার। লায়লা আলি তো মহম্মদ আলির মেয়ে।”
পাতলুন বলল, “মহম্মদ আলি কে?” তিনিও একজন বিরাট বক্সার। তাঁর মেয়ে ঘুষির লড়াইতে যে কতজনকে চিৎপটাং করেছে ভাবতে পারবি না। আর কয়েকজন মেয়ে বক্সারের নাম শুনবি নাকি?”
পাতলুন তাড়াতাড়ি বলল, “না, না, দরকার নেই, এতেই হবে।”
নন্দদা বলল, “তাও শুনে রাখ। সুমিয়া আনানি, ক্যারেন বিল,
বেকি গার্সিয়া। আর চাই?”
আমাদের দারুণ লাগছে। এত মেয়ে লড়াই করে! বাপরে। আমি বললাম, ‘এতেই হবে। নন্দদা, ঘুষি খেলায় টাকা-পয়সা হয়?’
‘টাকা-পয়সা মানে! বলিস কী? একেবারে কাঁড়ি কাঁড়ি পুরস্কার।’
আমি বললাম, “তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে নন্দদা।”
“চটপট বলে ফেল। আমার কিন্তু কলেজে দেরি হয়ে যাবে। অনেক বকিয়েছিস তোরা।”
ভুজিয়া বলল, “আমাদের মুক্তো দারুণ ঘুষি মারে। ওর যদি একটা কিছু করা যায়…।”
নন্দদা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘মুক্তো! মুক্তোটা আবার কে? ঘুষি মারে মনে?’
আমি তাড়াতাড়ি বললাম, মুক্তো আমাদের ফুটপাথে থাকে। ছোট মেয়ে। কিন্তু ছোট হলে কী হবে মেয়েটা ঘুষিতে খুব ওস্তাদ। আমাদের সঙ্গে মারপিট খেলায় দুম দুম করে এমন হাত চালায় যে পালিয়ে বাঁচি না। তুমি যদি দেখতে নন্দদা…।”
“তাই নাকি!”
“আমাদের খুব ইচ্ছে বেচারি ঘুষি শিখুক। কিন্তু ভাবতাম মেয়েরা আবার এসব পারবে নাকি। তোমার মুখে এতজনের নাম শুনে নিশ্চিন্ত হলাম। এতগুলো মেয়ে যখন পেরেছে মুক্তোও পারবে না কেন? দাও না নন্দদা, কোথাও একটা ব্যবস্থা করে দাও। শুনেছি অনেক জায়গায় নাকি বালির বস্তা ঝুলিয়ে ঘুষি মারা শেখায়। মুক্তোও মারতে শিখুক।” নন্দদা একটুখানি সময় কী যেন ভাবল। তারপর বলল, “ওরে বাবা, তোরা দেখছি তোদের ওই মুক্তোকে বক্সার না বানিয়ে ছাড়বি না। দেখ, আমার এক কাকা এরকম একটা ক্লাবের সঙ্গে আছে। সেক্রেটারি না প্রেসিডেন্ট। ক্লাবটাও তোদের ওখান থেকে বেশি দূরে নয়। সেখানে বক্সিং, কুস্তি, মুগুর ভাঁজা সবই শেখানো হয়। কিন্তু মেয়েদের হয় কিনা তা বলতে পারব না। তাছাড়া অত ছোট মেয়ে….তবে আমি একবার বলে দেখব। কিন্তু ওর বাবা-মা কি রাজি হবে?”
পাতলুন বলল, “ওটা নিয়ে ভাববেন না দাদা। মুক্তোর বাবা নেই। মাকে আমরা সবাই মিলে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করাব ঠিক।”
ভুজিয়া গলায় জোর এনে বলল, করাবই।”
নন্দদা হেসে বলল, ‘ঠিক আছে, আমি খোঁজ নিচ্ছি। কাকার ওখানে যদি ব্যবস্থা থাকে তা হলে পয়সাকড়ি ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার। যা পালা এখন।’
আমরা পালাবার আগে নন্দদা আর একটা কাজ করল। ব্যাগ থেকে একটা ঝলমলে রঙিন ছবি বের করে আমার হাতে দিল। একটা মেয়ের ফটো। বলল, ইস, দিতেই ভুলে যাচ্ছিলাম। এর নাম ক্যাথি ডেভিস। ইনি একজন দারুণ বক্সার। ওনার এই ফটো বেরিয়েছিল রিং পত্রিকায়। রিং পত্রিকা কী জানিস? ওখানে শুধুমাত্ৰ বক্সিং নিয়েই লেখা থাকে। কালই তোর জন্য ইন্টারনেট থেকে ছবিটা নামিয়েছি। যা, ভালই হল, ছবিটা তোদের মুক্তোকে দিয়ে দিস। খুশি হবে।”
কথা শেষ করে নন্দদা টক করে সামনের বাসটায় উঠে পড়ল। আমরা কিছুই বুঝতে না পেরে থ’ হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলাম খানিকক্ষণ। হাতে ছবি। ছবিতে হাসিমুখের একটা মেয়ে। হাতে লাল রঙের ইয়া বড় দুটো গ্লাভস। গ্লাভস কাকে বলে আমরা তিনজনই জানি। আমাদের ফুটপাথের পিছনে একটা গ্লাভস তৈরির কারখানা আছে। বড় কিছু নয়, ছোট কারখানা।
পাতলুন বলল, “মুক্তোর মাকে এই ছবিটা দেখালেই কাজ হয়ে যাবে। বলব, এই দেখ, মেয়েরাও ঘুষি মারে।”
ভুজিয়া বলল, “এখন কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। আগে নন্দদা ব্যবস্থা করুক।’
আমি বললাম, ঠিক কথা। মুক্তোও যেন কিছু জানতে না পারে।”
খাটের স্বপ্ন কেমন আমার জানা নেই, কিন্তু ফুটপাথের স্বপ্নে শুধু খাবার থাকে। ভাল খাবার কিছু নয়, এই ভাত, ডাল, তরকারি এই সব। তবে পরিমাণে অনেকটা। অনেকটা আর গরম। আমরা প্রায়ই সেই সব স্বপ্ন দেখি। সেদিন আমি খাবারের বদলে মুক্তোর ঘুষির স্বপ্ন দেখলাম। মুক্তো নন্দদার দেওয়া ছবির মেয়েটার মতো বড় বড় দুটো গ্লাভস পরে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে একটু নিচু হয়ে। পা দুটো সামান্য ফাঁক। মাথাটা তোলা। চোখগুলো জ্বলজ্বলে। মনে হচ্ছে, এখুনি ঘুষি চালাবে। মারবে ভীষণ জোরে!
নন্দদার খবর দিতে একটু দেরি হল। ঠিক পাঁচদিন। তবে দেরি হলেও ভাল খবরই দিল নন্দদা। ওর কাকার ক্লাবে মেয়েদের বক্সিং শেখানো হয় না। তবে কাকা বলায় ও ওখানকার একজন ঘুষি মাস্টার মুক্তোকে আলাদা করে শেখাতে রাজি হয়েছে। বলেছে সপ্তাহে একদিন করে দেখিয়ে দেবে বিনি পয়সায়। কিন্তু আগে মেয়ের বাবা-মাকে দেখা করতে হবে।
খবরটা দিয়ে নন্দদা বলল, “যাঃ, আমি তো অনেকটা করে দিলাম। এবার তোদের কাজ।”
না, আমাদের কোন কাজই নেই। নন্দদাকে কিছু বলিনি আমি। মাথা নেড়ে চলে এসেছি। মুক্তো, মুক্তোর মাকে কিছু বলতে হবে না। তারা আমাদের এই ফুটপাথ থেকে চলে গেছে তিনদিন হয়ে গেল। এটা অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়। ফুটপাথের মানুষজন বেশিদিন এক জায়গায় থাকে না। আমিও চলে যাব। ভুজিয়া, পাতলুনরাও যাবে। হঠাৎ একদিন ভোরে, কারও ঘুম ভাঙার আগেই পোঁটলা নিয়ে হাঁটা মারবে। এটাই নিয়ম। ভূজিয়া আর পাতলুন নন্দদার খবর শুনে খুব দুঃখ করল। ইস, এতদূর হয়েও হল না। মেয়েটা কোথায় গেল তাও যদি জানা যেত।
আমি এসব ভাবছি না। কারণ আমার মন বলছে মুক্তো যেখানেই থাকুক, সে নিশ্চয় লড়বে। একদিন সেও মস্ত বক্সার হবে। আমরা হয়ত চিনতে পারব না।
সব বক্সারকে কি আমরা চিনতে পারি?