» » স্বদেশী সেপাই

বর্ণাকার

স্বদেশী সেপাই

উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

সেদিন রাজনীতির বক্তৃতা শুনতে শুনতে গোটা দুই বেফাঁস কথা পণ্ডিত হৃষীকেশের মুখ থেকে বেরিয়ে পড়েছিল বলে আমাদের রায় বাহাদুর পার্ব্বতী দাদার বড় ছেলেটা আজ তাঁকে এসে পাকড়াও করেছে। আন্দোলনের জোরে ভারত স্বাধীন হবে শুনে কেন তিনি হেসেছিলেন, এ কৈফিয়ৎ আজ তাঁকে দিতেই হবে!

এবার কংগ্রেসের পর কলকাতা থেকে কলেজ বয়কট করে’ ফিরে আসা অবধি ছেলেটি ভীষণ রকমের স্বদেশী হয়ে উঠেছে। তার বুটের ফিতে থেকে আরম্ভ করে গলার নেক্‌-টাই, আর মাথার হ্যাটটি পর্য্যন্ত একেবারে ষোল আনা স্বদেশী কোম্পানীর তৈরি! গ্রামে এসে সে একটা “জাতীয় ইস্কুল” খুলবে বলে চাঁদার খাতাও খুলেছিল; তবে চিফ সেক্রেটারির কাছ থেকে তার বাপের নামে একখানা লম্বা চওড়া চিঠি আসার পর সেটা ধামা-চাপা পড়ে গেছে।

একে ত রায় বাহাদুর একজন দোর্দ্দণ্ডপ্রতাপ জমিদার; তাঁর জমীদারীর শুধু বাজে আদায়ই হবে ৫/৭ হাজার, আর সেই সেদিন পুন্যার নজর দিতে দেরী হয়েছিল বলে তাঁর কাছারীতে গুপে বাগ্দীর ছেলেটা মার খেয়ে এখনও নেংচে বেড়াচ্চে; আর তারপর—গোদের উপর বিষফোড়া—তাঁর দৌহিত্রীর সঙ্গে আমাদের পুলিশ সুপারিন্‌টেনডেন্টের ছেলের বিয়ের সম্বন্ধ হচ্ছে—আর এ দিকে তাঁর ছেলেটা পুরোদস্তুর স্বদেশী সেপাই; পাড়ার ছেলেগুলো ইস্কুলে গেলেই তাদের ঠ্যাং খোঁড়া করে’ দেবে বলে সে শাসিয়ে বেড়াচ্চে। বাপ বেটার এই দুই জাঁতা কলের মধ্যে পড়ে’ চাষাভূষোরা একেবারে পিষে যাবার যোগাড় হয়েছে।

পণ্ডিতজী ছেলেটার মুখখানির দিকে একটু চেয়ে থেকে বললেন—“দেখ, বাবা, অনেক দিন আগে— সেকালের স্বদেশী যুগেরও আগে—একবার পাড়াগাঁ অঞ্চলে ভারত-উদ্ধার প্রচার করতে গিয়েছিলুম। একটু চালাক চট্‌পটে রকমের এক চাষাকে ধরে প্রায় দেড় ঘণ্টা আন্দাজ বক্তৃতা ঝেড়ে যখন মনে হ’ল, তাকে কাৎ করে এনেছি, তখন সে অতি বিনীত ভাবে যোড়হাত করে’ আমায় বলে— ‘আমার একটি নিবেদন আছে।’

“আমি এই গরুড়ের মত ভক্তটি পেয়ে বিষম উৎফুল্ল হয়ে জিজ্ঞাসা কল্লুম— ‘কি, কি?’

“সে বল্লে— ‘দেখুন, আপনাদের হাতে দেশ স্বাধীন হবার ২/৪ ঘণ্টা আগে আমায় একটু খবর দেবেন; আমি সপরিবারে বিষ খেয়ে মরে থাকব।’

“তখন লোকটার কথা শুনে আমার পিত্তি পর্য্যন্ত জ্বলে গিয়েছিল। কিন্তু এখন তোমাদের দেখে-শুনে মনে হয় যে, লোকটার কথা একেবারে বাজে নাও হতে পারে।”

আমাদের স্বদেশী সেপাইটি বললেন— “আমি থাকলে তাকে চাবকে সোজা করে’ দিতুম।”

পণ্ডিতজী বললেন—“বাবা, চাবকানি অনেক দেখেছি; কিন্তু চাবুকের চোটে লোককে বেঁকে পড়তেই দেখেচি; একটাকেও সোজা হতে দেখিনি। তোমার দাদা-মশায় চাবুকের চোটে জমিদারীর আয় বিলক্ষণ বাড়িয়ে গেলেন, তোমার বাবাও শাস্ত্র-চর্চ্চার অবসরে যথেষ্ট চাবুক-চর্চ্চা করেন—আর ভবিষ্যতে সুবিধা পেলে তুমিও তা করবে—কিন্তু সোজা কটাকে করেছ?”

ঐ বেতালা কথা কওয়া পণ্ডিতজীর কেমন রোগ! পাছে কথাটা রায় বাহাদুরের কাণে ওঠে সেই ভয়ে আমি তাড়াতাড়ি বললুম—“তা, ছেলেরা যা করছে, সে ত ভালর জন্যেই করছে। দেশটা স্বাধীন হ’লে গৌরবের ভাগীদার ত চাষাভূষোরাও হবে।”

পণ্ডিতজী আমার দিকে একটা এমনি বিতিকিচ্ছি রকমের চাউনি চাইলেন, যা তাঁর চোখেও বড়-একটা দেখিনি। তিনি একেবারে দাঁড়িয়ে উঠে বললেন—“দেখ, তোমাদের ঐ ন্যাকামি শুনতে শুনতে আমার হাড় ভাজা ভাজা হয়ে গেছে। তোমরা কথায় কথায় বল— ‘আহা দেশটা যদি আমাদের কথায় সাড়া দিত ত এতদিন আমরা কেষ্ট বিষ্ট হয়ে যেতুম। ছাপ্পান্ন পুরুষ ধরে যাদের গলায় এক পা আর পেটে এক পা দিয়ে চেপে রেখেছ— আজ টিকি ধরে হেঁচকা টান মারছ বলে কি তোমাদের ফরমাইস মত তারা নেচে উঠবে? ধৰ্ম্মে, কৰ্ম্মে, আচারে ব্যবহারে যাদের পরাধীন করে রেখেছ, যাদের ছুলে তোমাদের নাইতে হয়, যাদের বেগার খাটিয়ে তোমরা নবাবী কর, আজ তাদের স্বাধীনতার কথা বোঝাতে গিয়ে নিতান্তই বেহায়া না হলে তোমরা লজ্জায় মরে যেতে! মানুষের মনের আধখানা পরাধীন রেখে বাকি আধখানাকে স্বাধীন করে দেবে?—বলিহারী তোমাদের বুদ্ধি হে? তোমার রাজনীতির চর্চ্চা করবে কে?—যারা করবে তাদের যে মেরে রেখেছ! এ জাত যদি কখনো বেঁচে উঠে লড়ে, ত আগে লড়বে তোমাদের সঙ্গে।”

আমি দেখলাম, কেঁচো খুঁড়তে খুঁড়তে ক্রমে সাপ রেরিয়ে পড়বার জোগাড় হচ্চে। তাড়াতাড়ি পণ্ডিতজীর মুখ বন্ধ করবার জন্যে এক কাপ চা তৈরি করে বললাম—“থাক; এদিকে চা-টা যে জুড়িয়ে গেলো।”

পণ্ডিতজীর কাছে থেকে তাড়া খেয়ে আমাদের রায় বাহাদুরের ছেলে ওরফে স্বদেশী সেপাই মুখখানা বেজায় গম্ভীর করে’ বললে—“আপনি বলেন কি, আমরা দেশটাকে এত করে বলছি আমাদের সঙ্গে উঠতে—আর দেশটা উঠবে না?”

পণ্ডিতজী হোঃ হোঃ করে হেসে উঠে বল্লেন—“উঠবে বৈ কি! দেশের যদি একটু লজ্জা সরম থাকে, ত তোমরা পাঁচজন ইয়ার-বন্ধু মিলে, দুবার “Arise awake” বলে তুড়ী মেরে ডাকলেই তোমাদের জননী ভারতবর্ষ একেবারে হুড়মুড় করে লাফিয়ে উঠবে। আর তাও বলি বেটীরই কেমন আক্কেল! সেই যে হাজার বছর ধরে’ ঘাড়মুড় ভেঙ্গে পড়ে আছে, আর উঠবার নামটি নেই। রাণাসঙ্গ ডেকে খুন হয়ে গেল—বেটির মুখ দিয়ে একটি কথাও ফুটল না। শিবাজী, গুরু গোবিন্দ মায়ের অনেক আদরের ছেলে— তাদের ডাকে বুড়ী একবার চোখ চাইতে না চাইতেই আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। তাঁরা কেউ বা ডেকেছিলেন—হিন্দীতে, কেউ বা ডেকেছিলেন মারাঠিতে সে ডাক হয়ত মায়ের মনে ধরেনি। এইবার তোমরা সব স্বদেশী কাপ্তেন মিলে গোল দীঘির পাড় থেকে ইংরেজী ডাক ডাকলে হয়ত বেটী ভয়ে ডরে উঠতে পারে! তা বেয়ে চেয়ে দেখ একবার।”

স্বদেশী সেপাই একটু যেন বিরক্ত হয়ে বললে—“দেখি দু-এক বছর নেড়ে চেড়ে। দেশটা উঠল ত উঠল, আর তা না হয় ত বাবার জমিদারীটা ত আর কোথাও যায়নি।”

পণ্ডিতজী বললেন—“এতক্ষণে একটা বুদ্ধিমানের কথা বলেছ! দেশে এরকম বুদ্ধিমানের দল যে রকম প্রবল বেগে বেড়ে উঠছে, তাতে দেশের ভবিষ্যত সম্বন্ধে এক রকম নিশ্চিন্ত হওয়া যেতে পারে। নেপালে বেড়াতে গিয়েও সাধুদের মহলেও একবার এ রকম একটি বুদ্ধিমান দেখেছিলুম। সেবার ভারি শীত পড়েছে । একে নেপালী শীত, মাটির উপর হাতখানেক বরফ জমে গেছে, তার উপর ভূরি ভোজনের ব্যবস্থাটাও বড় সুবিধে রকমের হচ্ছিল না। তাই আমরা ধরমশালার এক কোণে আগুন জ্বালিয়ে একেবারে টুপভুজঙ্গ অবস্থায় বসে আছি, এমন সময় বেঁটে খেটে জোয়ান গোছের এক সাধু পুরুষ দরজার কাছে উঁকি মেরে বল্লেন—ওঁ।

“আমরা তাড়াতাড়ি ‘নমো নারায়ণ’ বলে অভিবাদন করে তাঁর পাঞ্চভৌতিক দেহের কুশল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি চক্ষু বুজে বললেন—ওঁ।

সব কথার উত্তরেই সাধু এক ওঙ্কার ধ্বনি করেন দেখে আমরা ত ভ্যাবাচাকা লেগে যাবার যোগার হয়ে পড়েছি, এমন সময় আমার এক বন্ধু বললেন— “আরে হাঁ করে দেখেছিস কি? এটা আর বুঝতে পারছিস নে যে, বৈরাগ্য আর শীতের চোটে সাধুজীর মনটা একেবারে ত্রিকুটে লয় হয়ে যাবার জোগাড় হয়েছে! বেশ এক বাটা গরম চা কর দেখি; আর খানকতক মোটা মোটা রুটি বানিয়ে তার সঙ্গে ঐ কুমড়োটা কেটে খানিকটা ছক্কা করে দে। একবার দেখি চেষ্টা করে সাধুজীর মনটা যদি নেমে আসে। শাস্ত্রে বলে কুমড়োর মত এমন বৈরাগ্যনাশন দাওয়াই মেলাই মুস্কিল।” তাড়াতাড়ি একবাটি গরম চা করে সাধুজীর মুখের কাছে ধরতেই সাধুজী সেটুকু জঠর নিহত ব্রহ্মাগ্নিতে আহুতি দিয়ে আনন্দে দত্ত বিকশিত করে বল্লেন— ওঁ।

কুমড়োর ছক্কা দিয়ে দিস্তে খানেক রুটি খাবার পর সাধুজী ওঙ্কারলোক থেকে পার্থিব লোকে নেমে এসে আমার বন্ধুটির সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেললেন। তখন সাধুজীর এই পাঞ্চভৌতিক খোলসটি কোন কুল উজ্জ্বল করেছে, খোলসের মায়িক সম্বন্ধের কোনখানে কে আছে এই সম্বন্ধে সদালাপ আরম্ভ হল। ঘণ্টা খানেক পায়তারা কসবার পর, সাধুজীর মনটা যখন দু-তিনবাটি চায়ে গলে একেবারে থসথসে হয়ে গেছে তখন তিনি বললেন—“দেখ, গত বৎসর ধানটান কাটার পর প্রায় শ’খানেক টাকা হাতে পেয়েছিলুম; তা একটা বিয়ে করতেই সব খরচ হয়ে গেল। আর মেয়েটিও ছোট; বয়স বছর ১২/১৩; আমি ভাবলুম দূর ছাই আর কাজ নেই; ঘরে থাকলেই খরচ, তাই এক সাধুর কাছে ভেক নিয়ে বেরিয়ে পড়লুম। তা দেখি, দু-চার বছর, ব্রহ্ম মিল্‌ল ত ভাল; না হয় ঘর ত আছেই।”

পণ্ডিতজী হেসে বল্লেন—“দেখলে, ব্রহ্মচিন্তা করলে কি হয়, হিসেব বোধটি ঠিক আছে! তোমাদের দেশচিন্তাও ঐ রকম।”

২৯শে পৌষ ১৩২৭