ছিরিচরণের ছুঁচো
উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
সেদিন সকালবেলা চা খাবার পর পণ্ডিতজীর একটু খোসমেজাজ দেখে গোপাল দা একবার এগিয়ে দুবার পিছিয়ে, শেষে একটু গলা খেঁকারি দিয়ে দুঃসাহসে ভর করে জিজ্ঞেস করলেন— “আচ্ছা পণ্ডিতজী, যদি রাগ না করেন, ত একটা কথা জিজ্ঞাসা করি—আপনি গুরু ঠাকুরদের পিছনে অত লেগেছেন কেন?”
আমি আরও এক কাপ চা ঢালছি দেখে পণ্ডিতজীর তাল-তোবড়া মুখখানিতে একটু হাসির আভাষ ফুটে উঠল। তিনি বললেন—“রাগ কেন করব ভাই; রাগ আমার শরীরে নেই বললেই হয়। যা দেখতে পাও ওটা রাগের আকার, ওতে মানসিক বিকারের গন্ধমাত্র নেই। দুর্ব্বাসা ঋষি মরার সময় আমার প্র-পরা-অপ-সম-নি-পিতামহকে যে আশীর্ব্বাদ করে গিছলেন, তারই যা-কিছু ছিটে-ফোটা পড়ে আছে । ওতে ভয় পাবার কিছু নেই।”
চায়ের কাপটা কোলের কাছে টেনে নিয়ে খুব আদরে-ভরা একটা চুমুক দিয়ে পণ্ডিতজী বলতে লাগলেন—“দেখ, ঐ গুরুগিরির কথা যদি জিজ্ঞেস করলে ত ব্যাপারটা গোড়া থেকেই বলি। জান ত, ডাক্তারেরা একটা জন্তু জানোয়ারের এক আধখানা হাড়ের টুকরো পেলেই তা দেখে বলে দিতে পারেন যে জন্তুটা ক’ হাত লম্বা, ক’ হাত চওড়া, তার কটা ঠ্যাং, সে কি খায়— ইত্যাদি। আমিও তেমনি অনেককেলে ওস্তাদ কিনা তাই কোন একটা সমাজের আধ-টুকরা অনুষ্ঠান দেখলেই তাদের চাষা-ভুষো থেকে আরম্ভ করে রাজারাজরার পর্য্যন্ত হাড়ির খপর বলে দিতে পারি। ঐ যে সেদিন দেখলুম গঙ্গার ধারে নেড়া বটগাছের তলায় জটাজুটওয়ালা বাবাজীটি ছাই মেখে বসে’ বসে’ গাঁজায় দম মারছেন আর গুপে বাগদীর ছেলে থেকে আরম্ভ করে পেশেনপ্রাপ্ত সব ডেপুটী পৰ্য্যন্ত মাদুলী ভরে’ ভরে’ তাঁর পায়ের ধুলো মাথায় ঠেকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে—এই থেকে যদি বল, ত আমি এদেশের সমাজতত্ত্ব, ভগবৎতত্ত্ব, রাজতত্ত্ব সব নিখুঁত করে’ তোমার সামনে কষে দিতে পারি।”
পণ্ডিতজীর কথা শুনতে শুনতে গোপালদাদার হাঁ-টা ক্রমে আকর্ণ বিস্তৃত হবার যোগাড় হচ্ছে দেখে পণ্ডিতজী চায়ের কাপটা তাঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বল্লেন—“গলাটা একটু ভিজিয়ে নাও ভায়া; কাণে শুনে কথাগুলো বোঝবার সুবিধে না হয় মুখে দিয়ে শোনা ছাড়া আর উপায় কি? তা, মুখ দিয়েই শোন; আর একটু চিবিয়ে বুঝো, তা’হলে নিতান্ত গুরুপাক না’ও হতে পারে।”
গোপাল দা নিৰ্ব্বিবাদে চা-টুকু গিলে ফেলে পণ্ডিতজীর মুখের দিকে চেয়ে বললেন—“তার পর?”
—“তারপর আর কি! গুপে বাগদীর ছেলেটাকে হাসতে হাসতে ফিরে যেতে দেখে আমার মনে হোলো—নিজের বিদ্যেটা ঠিক কি না একবার পরীক্ষা করে’ দেখি। ছেলেটাকে ডেকে জিজ্ঞেসা করলুম—‘হাঁরে খ্যাঁদা, আজ এখনি যদি সাক্ষাৎ কৃষ্ণ-ভগবান একেবারে ভেঁপু বাজাতে বাজাতে ধরা চূড়ো পরে ঐ আকাশ ফুঁড়ে তোর সামনে ঝুপ করে’ নেমে এসে তোকে বলে—খ্যাঁদা, বর নে–তা হোলে তুই কি চাস?”
খ্যাঁদা রাঙ্গা রাঙ্গা দাঁত বার করে’ এক গাল হেঁসে ফেলে বললে— “এঁজ্ঞে বাবাঠাকুর, আমরা শূদ্দর ক্ষুদ্দুর মানুষ, আমাদের কি সে ভাগ্যি হবার জো আছে?”
—— “ধর যদি বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েই যায়?”—
খ্যাঁদা আমতা আমতা করতে করতে মাথা চুলকুতে চুলকুতে বললে—“এজ্ঞে, আমি তা’হলে বলি, দেবতা, আমি যেন মরে বৈকুণ্ঠে গিয়ে আপনার ছিরিচরণের আশে পাশে ছুঁচো হ’য়ে কিচমিচ করে’ বেড়াই।”
“সেদিন জমীদারের নূতন নায়েবটা যখন গুপে বাগদীর ছেলেকে ধরে বাকি খাজনা আদায়ের জন্য মারতে মারতে একেবারে লম্বা করে’ ছেড়ে দিলে, আর ছোঁড়াটা শুধু নায়েবের হাতে পায়ে ধরে কাকুতি মিনতি করতে লাগলো, তখন আমার চোখে ব্যাপারটা বড় বিসদৃশ, এক-তরফা-রকমের বলে মনে হয়েছিল।
“আর তার পরদিন তার গায়ের ব্যাথা ঘুরতে-না-মরতে যখন দেখলুম যে সে ঐ বট-তলার গঞ্জিকানন্দ বাবাজীর পায়ের তলায় চৌদ্দপোয়া হয়ে পড়ে’ মাদুলী ভরে’ পদধূলি সংগ্রহ করছে, তখন বেশ দিব্য চক্ষে দেখতে পেলুম যে তার মনটা অনেক দিন থেকে লম্বা হয়ে পড়ে’ আছে বলেই সেদিন নায়েবের পায়ের কাছে তার শরীরটা অত শিগগির লম্বা হ’য়ে পড়েছিলো। তোমরা ভাবছ তিন বৎসর অন্তর লাটসভার সভ্য গড়বার জন্যে ভোট দিতে পেলেই তারা স্বাধীন হ’য়ে উঠবে। হায় রে পোড়া কপাল! মাথায় যার সাপে কামড়েছে তার পায়ের আঙ্গুলে বিষ পাথর লাগালে কি হবে।”
পণ্ডিতজীর বক্তৃতা শুনে আমারও একটু ভাবনা হ’য়ে গেল। গোপাল দা’ও একটু উসখুস করতে করতে জিজ্ঞেসা করলেন— “তাইত! তা’হলে উপায়?”
পণ্ডিত বল্লেন—“উপায় আর কি। ভগবানের খোলা হাওয়া লোকগুলোর মনে একটু লাগতে দাও; তাতে আধ্যাত্মিক সর্দ্দি, কাশি হবার কোনোই ভয় নেই। আর তোমার পেশাদার গুরু- ঠাকুরদের বলো একটু আওতা ছেড়ে দাঁড়াতে।”
২৫এ অগ্রহায়ণ, ১৩২৭