» » ভবপারের নৌকা

বর্ণাকার

ভবপারের নৌকা

উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

গোপাল দাদার গুরুঠাকুর এসেছেন শুনে পণ্ডিত হৃষীকেশের হঠাৎ কি রকম ভক্তির উদ্রেক হোলো; তিনি তাড়াতাড়ি কোঁচার খুঁট গায়ে দিয়েই এই শীতকালের সন্ধ্যেবেলা গুরুজীকে দর্শন করতে বেরিয়ে পড়লেন। আমি ভাবলুম— হবেও বা, পণ্ডিতজীর বয়স ত প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি হ’য়ে এলো; সূৰ্য্য ত বিলক্ষণই পশ্চিমে হেলে পড়েছে; এইবার বুঝি পণ্ডিতজীর একটু পরকালের চিন্তা এসেছে। বিশেষতঃ গোপাল দাদার গুরু এক প্রকাণ্ড সিদ্ধপুরুষ বলে’ প্রসিদ্ধ, তাঁর চেলাও দশ-বিশ হাজারের কম হবে না।

প্রায় এক ঘণ্টা চুপ করে’ বসে’ আছি, দেখি না পণ্ডিতজী— আস্তে আস্তে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে’ দিয়ে তক্তাপোষের উপর বসে’ পড়লেন। মুখখানা খুব গভীর বটে, কিন্তু চোখের কোণে একটু চাপা চাপা দুষ্ট হাসি।

“কি পণ্ডিতজী, এরি মধ্যে সাধু-দর্শন শেষ হয়ে গেল যে!” বলে আমি হুঁকোটা পণ্ডিতজীর হাতের কাছে এগিয়ে দিলুম।

পণ্ডিতজী হুঁকোটা রেখে দিয়ে বললেন— “না, ভায়া, এ আর চলবে না। একে ত সাধুজী ভাব জগতের যে আধ্যাত্মিক ধোঁয়া ছেড়ে দিয়েছেন তা’তেই আমার দম্ আটকাবার যোগাড় হয়েছে; তার ওপর এই মায়িক, নশ্বর, পার্থিব ধোঁয়াটা এলে জুটলে আমার প্রাণে-বাঁচা দায় হবে।”

আমার একটু রাগ হোলো। সবাই বলে গোপাল দাদার গুরু মস্ত বড় সাধু; আর পণ্ডিতজী তাঁর ওপর টিপ্পনী কাটতে ছাড়লেন না! আমি বল্লুম— “দেখ, পণ্ডিতজী, তুমি একটি বিশ্বনিন্দুক। অত বড় একজন সাধু যাঁর চরণ পেয়ে কত লোক তরে যাচ্ছে, তাঁকে দেখে তোমার মন উঠল না।”

পণ্ডিতজী একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললেন— “কি করব, ভায়া,— আমার কেমন পাষণ্ড-নক্ষত্রে জন্ম, খুঁৎটাই আগে চোখে পড়ে। আমি দেখতে গেলুম একটা পুরো মানুষ আর দেখে এলুম পাঁচ-সাত হাত লম্বা জটাওয়ালা এক ভুড়েল সাধু বাঘ-ছালের ওপর বসে’ বসে’ সকলকার ভব-রোগ সারাবার পেটেন্ট দাওয়াই বাৎলাচ্ছেন। অনেক বোঝবার চেষ্টা করলুম, কিন্তু এই ‘ভব’টা যে একটা রোগ এটা কিছুতেই বুঝতে পারলুম না।

“আর একটা বড় মজার কথা মনে পড়ে গেল। সেকালে দময়ন্তী যখন স্বয়ম্বরা হন, তখন রাজ সভায় দেবতারা লোভে লোভে উপস্থিত হয়েছিলেন। কারও চোদ্দটা মাথা আঠারটা ঠ্যাং, কারও বা পনেরটা নাক, ত্রিশটা পাছা—সবাই এক-একটা কেউ বিষ্ট ধনুর্দ্ধর। কিন্তু দময়ন্তী সটান গিয়ে নলরাজার গলাতেই মালা দিয়ে বলেছিলেন— ‘আমি নারী, সুতরাং আমি নরই চাই। দেবতা নিয়ে আমার কি হবে?”

“আমার সেই কথাই মনে হ’তে লাগল— ভবপারে গিয়ে আমি করব কি? আমার এপারের যা-কিছু নিয়েই যে কারবার। এপারের তোমরা কেউ একটা ব্যবস্থা করতে পার?

সেই সেকালের বুদ্ধ শঙ্করের আমল থেকে আজকালকার ছোটখাট গুরুর গুরু পরম গুরু পর্য্যন্ত সবাই, নৌকো নিয়ে কূলে দাঁড়িয়ে হাঁকচেন—চলে আয় ভবপারের যাত্রী, সস্তা দরে পার দেব। কেউ বলছেন— ‘আমার নৌকোর গেরুয়া নিশান একেবারে পরম ধামের মুক্তি ঘাটায় গিয়ে লাগবে; নৌকায় বোস, হালুয়া পুরির অভাব হবে না।’ কেউ বা বলছেন— ‘আমার নৌকায় গাব মাখান হয়েছে। জল ঢোকবার কোন ভয় নেই, ঝড় লেগে তুফান লেগে যদি নৌকা এক পেশে হয় তবে আমাদের নাচন কোদনের ভরেই নৌকা সামলে উঠবে। ঐ বৈকুণ্ঠের উপরে গোলোক, তার উপরে শব্দ ব্রহ্মের ঢোলোক যেখানে বাজছে আমরা ‘বদর’ ‘বদর’ বলতে বলতে একেবারে তোমাদের সেইখানে পৌঁছে দেব।—বাপ জগৎটা যে দুঃখময় তা পারে যাবার যাত্রীদের এই জগৎ থেকে সরে পড়বার জন্য ঠেলিঠেলি দেখলেই বেশ বুঝতে পারা যায়।’

পণ্ডিতজীর মুখখানা যখন খুলে যায়, তখন লঘুগুরু জ্ঞান থাকে না। এক নিঃশ্বাসে সব মহাপুরুষদের মূর্ত্তিগত করতে দেখে আমি বল্লুম—“তোমার দুঃসাহস ত কম নয়। তুমিই শুধু ঠিক বুঝেছ আর সবারই ভুল?”

পণ্ডিতজী বললেন—“চটে যেয়ো না দাদা; বড় বড় নামের বোঝা আমার ঘাড়ে ফেলে দিয়ে আমায় চেপে মেরে কোন লাভ নেই। নিউটন মাথা ঘামিয়ে বিজ্ঞানের অনেক তত্ত্বই বার করে গিয়েছিলেন; কিন্তু আজ কালের কলেজের ছেলেরাও তাঁর চেয়ে বেশী জিনিস জানে। তা দিয়ে কি প্রমান হয় যে, ঐ সব ছেলেরা নিউটনের চেয়ে বুদ্ধিমান? শুধু এই টুকুই বোঝা যায় যে, মানুষের জ্ঞানের মাত্রা বেড়ে চলেছে। ধৰ্ম্ম সম্বন্ধেও তাই। আগেকার মহাপুরুষেরা যে অতীন্দ্রিয় সত্যের সন্ধান পেয়েছিলেন সেইটেই চরম সত্য, বা একমাত্র সত্য, এ কথা না মানলে আর তাদের পন্থা ভিন্ন অন্য পন্থা খুঁজলে যদি তাদের অপমান করা হয়, ত আমি নাচার। তাঁরা ভবপারে যাবার রাস্তা বাৎলে গেছেন বেশ কথা। গোলকের উপর ঢোলকই থাক আর আর নোলকই থাক, সে সংবাদে আমার দুঃখ ঘুচবে না। সেই যে সেদিন গুপে বাগদির ছেলেটাকে জমীদারের কাছরিতে টেনে নিয়ে গিয়ে বেদম মারলে, তার চীৎকারেই আমার কান ভরে আছে সেখানে শব্দব্রহ্মের ঢোলকের আওয়াজ একবারেই ঢুকছে না। আমি এ-পারের মাটি কামড়েই পড়ে’ থাকবো, এইখানেই গু ঘাঁটব। আমার দুঃখে যদি কোন দেবতার প্রাণ কাঁদে ত তাঁকে গোলোক ছেড়ে আমার কাছে আসতে হবে। ওপারে গিয়ে কি রকম দুগ্ধ মজা লুটবো তার লম্বা চওড়া বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাকে ভোলালে চলবে না! স্বর্গের দেবতা যদি স্বর্গেই থেকে যান, মর্তে যদি তার পা না পড়ে ত সে দেবতার কাছে মাথা খুঁড়ে আমার কোন লাভ নেই। সবাই যদি এখানে থেকে মরে, ত আমি একলা পালিয়ে গিয়ে বেঁচে কি করব?”

মহাপুরুষদের নিয়ে এইরকম খোঁচাখুঁচি দেখে আমার প্রাণটা আঁৎকে উঠছিল। আমি বললাম— “পণ্ডিতজী, অবতার কল্প মহাপুরুষ বা ভগবানের বিষয় নিয়ে এ রকম ঠাট্টা বিদ্রূপ কি ভাল?”

পণ্ডিতঙ্গী হোঃ হোঃ করে হেসে বলেন— “ও তাই বটে! ঐটে হজম করতে বেগ পেতে হচ্চে। তা, দেখ ভগবানের একটি নাম রঙ্গনাথ। তিনি যে sunday schoolএর হেডমাষ্টারের মত খুব একজন গম্ভীর পুরুষ, একথা আমার আদৌ মনে হয় না। তারা ভগবানকে নিয়ে পুঁটলি বেঁধে ভবপারের পেটেন্ট পিল তৈরি করেন তাদের ব্যবসার হানি হতে পারে বটে—কিন্তু ভগবান যদি নিতান্ত বেরসিক না হন, তা হলে ঐ জন্যে আমার উপর চটে যাবেন বলে ত মনে হয় না। আর মহাপুরুষদের কথা যদি তুললে ত বলি—সত্যের ভাঁড়ার যদি তাঁরা ওজার করে গিয়ে থাকেন, আর আমাদের পক্ষে তাঁদের এটো কাঁটা দু-এক-দানা খুটে খাওয়া ভিন্ন যদি উপায়ান্তর না থাকে তাহলে এই দুনিয়ার কলে চাবি বন্ধ করে দিয়ে ভগবানের এই সৃষ্টির ব্যবসা তুলে দেওয়াই উচিত।”

আমি বললুম—“একবার ভবনদীর ওপারে গিয়ে সেইজন্যে একখানা দরখাস্ত না হয় ভগবানের দরবারে পেশ করে আসি।”

পতিতজী ঘাড় নেড়ে বললেন—“ওরে গাধা, ওরে আদার ব্যাপারী— দরখাস্ত পেশ করবার জন্যে এবার আর তোকে ডিঙ্গিচড়ে ও-পারে যেতে হবে না। এবার ভরা ভাদরের বান ডেকে এপার ওপার সব একাকার করে দিয়ে যাবে। গুরুগিরির ব্যবসাটা এবার আর টিকিবে না।”

১৮ই অগ্রহায়ণ ১৩২৭