» » কলের ওস্তাদী

বর্ণাকার

কলের ওস্তাদী

উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

আমাদের পাড়ায় যদু পোদ্দারের ভাইপো মার্কিন মুল্লুক থেকে কলকারখানা গড়বার ওস্তাদ হ’য়ে ফিরে এসেছে—এই কথা শোনা অবধি আমাদের শিরোমণি মশায়ের নাতিটির মুখে আর হাসি ধরে না! ছেলেটা আমার ভারি ন্যাওটো; সুবিধা পেলেই তালটা, বেলটা, কলাটা, নৈবিদ্যির মাথার সন্দেশটা বাড়ীতে না বলে আমায় এনে দেয়। ফলার ঘুসতে, ছাদা বাঁধতে, দক্ষিণে আদায় করতে তাকে এক রকম অদ্বিতীয় পুরুষ বললেই হয়। পূজোর সময় মাগ্যিগণ্ডার বাজারে এবার ফলারের ধুমটা ভারি কমে গিছলো বলে সে এতদিন মুখ শুকিয়ে শুকিয়ে বেড়াচ্ছিলো। যদু পোদ্দারের ভাইপো একটা দুধের না কিসের মস্ত বড় কারখানা বানাবে শুনে’ সে হাসতে হাসতে গড়াতে গড়াতে স্ফূর্ত্তির চোটে আকাশ পানে ঠ্যাং ছুড়তে আরম্ভ করে’ দিল। আমি ত ছেলেটার রকম সকম দেখে বললাম—“কি রে ক্যাবলা, ক্ষেপলি নাকি?” ক্যাবলা আরও খানিকটা ঠ্যাং ছুড়ে’ শেষে হাঁফাতে হাঁফাতে বললে—“না গো দাদা মশাই, ভারি মজা হয়েছে; সন্দেশ এবার সস্তা হবেই হবে। গয়লা বেটারা এবার যা জব্দ হবে! যদু পোদ্দারে ভাইপো এমনি একটা কল বানিয়েছে যে তা বসাবার জন্যে তিন কোশ জমি চাই। কলের এক মুখে থাকবে পঞ্চাশ হাত লম্বা চওড়া বাঘমুখে একটা প্রকাণ্ড দরজা, আর-একদিকে থাবে গোটা ২০/২৫ মোটা নল; আর ভিতরে রকম-বেরকমের এঞ্জিন। একদিক দিয়ে তাড়া করে’ তুমি একপাল গরু সেই কলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে’ দাও; খানিক পরে দেখবে ও-মুখের নলগুলো দিয়ে বেরুচ্চে-দুধ, দই, ছানা, ঘি, মাখন, কাঁচাগোল্লা, চটিজুতো আর শিঙের শক্ত চিরুণী। কল কি সাঙ্ঘাতিক চিজ, দাদামশাই। ওতে হয় না এমন জিনিস নেই।”

পণ্ডিত হৃষীকেশ এতক্ষণ ঘরের এক কোণে বসে’ খেলো হুঁকোটায় ভুড়ুক ভুড়ুক টান দিচ্ছিলেন। এইবার খুব একটা দমকা টান টেনে নাক দিয়ে খানিকটা ধোঁয়া বা’র করে’ দিয়ে বললেন— “এ আর তুই বেশী কি বললি, ক্যাবলা? আমাদের চোখের সামনেই ত এর চেয়ে আরও চমৎকার সব কল বসান রয়েছে। তোর৷ চোখ থাকতে দেখবিনে, তার আমি কি করব বল্?”

ক্যাবলা ত পণ্ডিতজীর মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল।

পণ্ডিতজী বললেন— “অত বড় হাঁ করিসনে, বাপ। কথাটায় দম্ আটকানর মত বিশেষ-কিছু নেই। আমিত চারিদিকে ঐ রকম কল ছাড়া আর-কিছু দেখতে পাচ্ছিনে। আচ্ছা, এই ধর-রঘুনন্দন কোম্পানীর পেটেন্ট ব্রহ্মচারিণী তৈরির কল। একটা বিধবা বা সধবা মেয়েকে ধরে’ তার নাক চুল কেটে, গয়নাগুলো কেড়ে নিয়ে ঐ কলের মধ্যে ফেলে দাও— দিন কতকপরে ঐ কল থেকে হয় একটা ত্রিশূলধারিণী ভৈরবী, নয় একটা যক্ষাকেশো ব্রহ্মচারিণী বেরিয়ে আসবেই আসবে। তার পর ধর কল নং দুই—পতিব্রতা তৈরির কল। খুব ছেলেবেলায় একটা কচি কাপড়ে-হেগো মেয়েকে ঘোমটা দিয়ে সাতপুরু মুড়ে ঐ কলের মধ্যে ফেলে দাও, মাঝে মাঝে কেবল এক একখানা গয়না ছুঁড়ে ঐ কলের মধ্যে ফেলে দিও—দেখবে বছর কতক পরে একটি খাসা নথ-নাকে, মিশি-দাঁতে, ঝাঁটা-হাতে সীতা বা সাবিত্রী তোমার ঘর উজ্জ্বল করে’ দাড়িয়ে আছে।

“এ সব না হয় সেকেলে মিস্ত্রীর গড়ন—তা বলে আজকালের মিস্ত্রীরাও ফেলা যায় না। ঐ আমাদের গোঁফেশ্বর মিস্ত্রী এমনি কল বানিয়েছে যে তার মধ্যে খানকত সরকারী ছাপমারা বই ভরে’ দিয়ে একটা গাধা হোক, ঘোড়া হোক, ভেড়া হোক, যা-হোক্ একটা তার মধ্যে পুরে’ দাও, বছর কতক না যেতে যেতেই কলের ও-মুখ থেকে একটা M. Sc. B. Sc. বেরিয়ে আসবেই আসবে। এ কি কম ওস্তাদি, বাবা!

“তারপর আমাদের টেক্‌ষ্টবুক কমিটি রায় বাহাদুর তৈরি করবার কি কলই না বানিয়েছে! একটা ছোট ছেলেকে ধরে দীনেশ বাবুর রাজারাণীর ছবিওয়ালা বইগুলোর খানকয়েক পাতা দিয়ে তাকে মুড়ে ঐ কলের মধ্যে ফেলে দাও—একেবারে মাথায় সামলা আঁটা একটা রায় বাহাদুর, না-হয় রায় সাহেব সেখান থেকে সেলাম ঠুকতে ঠুকুতে বেরিয়ে আসবে!

সাবাস জোয়ান! এমন না হলে কারিগর!!

❀                            ❀                            ❀

পণ্ডিতজী আবার থেলো হুঁকোটা তুলে নিলেন। ক্যাবলা কিন্তু হাঁ করে’ তাঁর মুখের পানে চেয়েই রইল।

১১ই অগ্রহায়ণ ১৩২৭