আঠার পরিচ্ছেদ
–কারা ওইখানে? কেডা, কেডারে? শফির মা চেঁচিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।–খবরদার, ফলগাছে কোপ দিলে আজগাই ঠাডা পড়ব মাতায়, কইয়া রাখলাম।
কে একজন বলে—আমরা কিনছি এই গাছ। জিগাও গিয়া হাসুর মা-রে।
শফির মা রাগে গরগর করতে করতে আসে—অ্যাই হাসুর মা, টিয়া-ঠুঁইট্যা আমগাছটাও বেচ্ছস?
—হ, গফুর শেখ নিছে ওডা, দশ টাকায় লাকড়ির লেইগ্যা।
—ওহুঁ, যেই নেউক, ওই গাছ আমি কাটতে দিতাম না।
—ক্যাঁ? ওই গাছ তো আমার ভাগের।
—ওই গাছ তোর তা মুল্লুকের মাইনষে জানে। কী সোন্দর আম অইছে গাছটায়। জষ্টি মাসে পাকব। তুই এই গাছ বেচ্লি কোন আক্কেলে? বাচ্চা-কাচ্চারা কি মোখে দিব?
এক সঙ্গে অনেকগুলো কথা চেঁচিয়ে বলে শফির মা হাঁপিয়ে ওঠে।
–কি মোখে দিব আবার? আগে ভাত খাইয়া বাঁচলে তারপর তো আম-জাম।
শফির মা ভেঙচিয়ে ওঠে—তারপর ও আম-জাম! আমের দিনে বেবাকে আম খাইব, আর ওরা মাইনষের মোখের দিক চাইয়া থাকব। কর যা তোর মনে লয়। তুই গলায় দড়ি দিলেও আর আমি না করতাম না।
দুইদিন বাদে গলায় দড়িই দিতে অইব। কি করতাম আর! তোমরাই হে-সুম ধইরা-বাইন্দা তোবা করাইলা। ঠ্যাং ভাইগা কতদিন ধইরা বইস্যা আছি। একটা না, দুইডা না, চাইরখান প্যাডের ভাত আহে কই তন?
শফির মা ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। বাড়ীর দক্ষিণ পাশ থেকে গাছ কাটার শব্দ আসে। জয়গুনের বুকের ভেতরেও যেন কুঠারের আঘাত পড়ছে বারবার।
টিয়াঠুঁটে আম গাছটায় আম ধরেছিল এবার খুব। আমও জাতের আম। দুধে মেশালে দুধ নষ্ট হয় না, এত মিষ্টি আমের তলার দিকটা টিয়ার ঠোঁটের মত বাকা। আর পাকলে ঐ ঠোঁটটাই শুধু লাল হয়।
হাসু ও মায়মুন গাছে বোল দেখে কত খুশী হয়েছিল! আর একটা মাস রয়ে সয়ে বেচলে ওরা খেতে পারত। কিন্তু এদিকে পেট তো আর ক্ষুধার জ্বালায় ‘র’ মানবে না।
করিম বক্শ দুধের হাঁড়ি মাথায় উঠানে এসে ডাকে–কাসু!
কাসু ততক্ষণে পিছ-দুয়ার দিয়ে পালিয়েছে।
আরো দু-তিন ডাক দিয়েও যখন কাসুর সাড়া পাওয়া যায় না, তখন সে মায়মুনকে ডাকে—একটা ঘড়ি লইয়া আয় মায়মুন।
জয়গুনের একবার বলতে ইচ্ছে হয়—আমরা দুধ খাই না। লইয়া যান দুধ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই বলা হয় না।
মায়মুন ঘটি নিয়ে আসে।
করিম বক্শ এক সের দুধ টিতে ঢেলে দিয়ে বলে—রোজ এমুন সুম আমি দুধ দিয়া যাইমু। আমাগ ধলা গাইড বিয়াইছে। কাসুর ভাগ্যে একটা দামড়ি বাছুর অইছে। বাছুর ঘাস ধরলে কাসুরে দিয়া যাইমু। কাসু কই গেছে রে?
মায়মুন উত্তর দেয়—পালাইছে।
করিম বক্শ আর দাঁড়ায় না। যেতে যেতে একবার পেছনে তাকায়। জয়গুনের চোখে চোখ পড়তে লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
জয়গুন ধমক দেয় মায়মুনকে—দুধ রাখলি, খাইব কে?
—ক্যাঁ? আমরা।
—হ, তোরা-ই খা। আমি ইতাম না ওই দুধ।
সকলকে চমকে দিয়ে টিয়া-ঠুঁটে আম গাছটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। দু’একটা পাখীর আর্ত চিৎকার ভেসে আসে পাশের ঝোপ থেকে।
নাবিক সিন্দাবাদের ঘাড়ের ওপর এক দৈত্য চেপে বসেছিল। বাঙলা তেরোশ’ পঞ্চাশ সালের ঘাড়েও তেমনি চেপে বসেছিল দুর্ভিক্ষ। হাত-পা শেকলে বাঁধা পরাধীন সে বুভুক্ষু তেরো’শ পঞ্চাশের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে, তার পরের আরো চারটি উত্তরাধিকারীর। কিন্তু দুর্ভিক্ষ আর ঘাড় থেকে নামেনি। ঘাড় বদল করেই চলেছে একভাবে। হাত-পায়ের। বন্ধনমুক্ত স্বাধীন তেরোশ’ পঞ্চান্নে এসেও সে আকাল-দৈত্য তার নির্মম খেলা খেলছে। তাকে আর ঘাড় থেকে নামান যায় না।
দেশে চালের দর কড়ি টাকার নিচে নামে না বছরের কোন সময়েই। ফালগুন মাস থেকে সে দর আরো চড়ে যায়। চড়ে যায় লাফিয়ে লাফিয়ে। চল্লিশ টাকায় গিয়ে ঠেকে। আউশ ধান ওঠার আগে এই দর আর নামে না। ফলে যারা টেনেটুনে দু’বেলা খেত, তারা এক বেলার চালে দু’বেলা চালায়। ফেনটাও বাদ দেয় না, ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে দুধ-ভাতের মত করে খায়। যারা দুবেলা আধপেটা খেয়ে থাকত, এ সময়ে তারা শাক-পাতার সাথে অপি চাল দিয়ে জাউ রেধে খায়। মুধিতের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যায়। পেটের জ্বালায় ভিক্ষার ঝলি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে অনেকে। আশা—দশ দুয়ারে মেগে এক দুয়ারে বসে খাবে। কিন্তু দশের দশা শোচনীয়। সমস্ত দেশ দিশেহারা। দুর্ভিক্ষে কে দেয় ভিক্ষে?
এ পৌনঃপুনিক দুর্ভিক্ষ শুধু কি ভাতের? কাপড়েরও। শত কপাল কুটলেও সরকার-নিয়ন্ত্রিত মূলের দ্বিগুণ দিয়েও একখানা কাপড় পাওয়া যায় না। অনেকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ কাটিয়ে দেয় একই কাপড়ে। তালি খেয়ে খেয়ে ময়লা জমে জমে ভারী হয়ে ওঠে সে কাপড়। বৃষ্টি ও ঘামে ভিজে বিদঘুটে বোটকা গন্ধ ছড়ায়।
জয়গুন অনেক ভেবেছে ভাল কাপড়ের ভাবনা। কিন্তু হাত-পা গুটিয়ে ঘরে বসে বসে এ ভাবনার অর্থ নেই, সে হাড়ে হাড়ে বুঝেছে। মায়মুনের বিয়ের সময়, ছমাস আগে তওবা করে সেই যে ঘরে ঢুকেছে, আজ পর্যন্ত সেই তওবারর অমর্যাদা সে করেনি।
—কিন্তু এমনি করেই কি আর দিন চলবে? এমনি করেই কি পেটের জ্বালা জুড়োবে? কাপড় জুটবে পরনের? জয়গুন প্রশ্ন করে নিজেকে।
পেটের জ্বালা এদিকে বেড়েই চলছে দিন দিন। দুই দিন এক রকম কিছুই খাওয়া হয়নি।
কাল রাত্রে খাওয়ার সময় কাসু জিজ্ঞেস করেছিল—তুমি খাইবা না, মা?
—আমি রোজা আছি। তোরা খাইয়া ওঠ। তোর ব্যারামের সময় মানতি করছিলাম তিনড়া রোজা রাখতাম বুইল্যা।
—রাইতেও খাইবা না তুমি? মায়মুন বলে।
—এই রোজায় দিন-রাইত না খাইয়া থাকতে অয়।
কাসু বিশ্বাস করলেও হাসু ও মায়মুন বিশ্বাস করে নি সে কথা। নিজের পাতের কয়েক মুঠো ভাত হাঁড়িতে তুলে রেখে হাসু উঠে গিয়ে বলেছিল—আইজ ভুখ নাই মা।
হাসুর দেখাদেখি মায়মুনও থালার ভাত রেখে বলে–আমারও ভুখ্ নাই। দু’দিনের মধ্যে সে ভাত ক’টাই পেটে দিয়ে আছে জয়গান।
বাড়ীর আমগাছ, তেঁতুলগাছ, কাডের বাঁশ কেটে ছাপ্পোনছাড়া’ করে দেয়া হয়েছে। চারটে ‘আণ্ডালু’ হাস বিক্রি করে দিয়েছে। বিক্রি করবার মত আর কিছুই নেই।
বিকেল হলেই কাসু খেলা ছেড়ে মা-র আঁচল ধরে তার পিছু পিছু ঘুরতে থাকে, তাগিদ দেয়—ভাত রানবা না, মা? আমার ভুখ লাগছে। এই দ্যাই না প্যাটটা কেমুন ছোড অইয়া গেছে।
কাসু হাত দিয়ে পেটটা দেখায়। জয়গুন দেখে, সত্যি পেটটা নেমেই গেছে। সে ফাঁকি দিয়ে বলে—তার মিয়াভাই মাছ আনলে তারপর পাক করমু। নিত্যি নিত্যি শাক পাতা ভাললাগে না।
—কি মাছ, মা? ইলশা মাছ?
—হ, ইলশা মাছ।
কাসু খুশী হয়।
সন্ধ্যা হয়ে আসে। হাসু এখনও এলো না। জয়গুন কাসুকে ভুলিয়ে রাখবার জন্যে মায়মনকে বলে—মায়মন, ওরে লইয়া যা। ঝিঁঝিঁ ধইর্যা দে গিয়া। ঐ দ্যাখ, হেন কেমুন ডাকে।
দুটো নারকেলের আঁইচা যোগাড় করে কাসুকে নিয়ে মায়মুন শফিদের ঘরের ছাঁচতলায় যায়। দু’হাতে আঁইচা দুটো নিয়ে ঠুকতে আরম্ভ করে—ঠর্র্ ঠর্র্।
এ রকম শব্দে ঝিঁঝিঁ পোকা আকৃষ্ট হয়! জঙ্গল থেকে বেরিয়ে শব্দকে কেন্দ্র করে উড়তে থাকে। যখন হাতের কাছের কোন কিছুর উপরে বসে, তখন ধরতে বেগ পেতে হয় না।
নিজের অসামর্থ্যের জন্য অবুঝ ছেলের কাছেও লজ্জিত হয় জয়গুন। পেটের ছেলে, তবুও নিজেদের দৈন্য ঢেকে রাখবার চেষ্টা করে সে সব সময়। হাসু ও মায়মুনকে কম করে খেতে দিলেও কাসুকে খেতে দিতে হয় পুরো। যেন সে অভাবের কথা জানতে না পারে।
কাসু হাঁড়ির খবর জানে না। জাবার বয়সও তার নয়। তা ছাড়া জানবার মত কোন কারণও জয়গুন ঘটতে দেয়নি আজ পর্যন্ত।
জয়গুন শুনতে পায় নারকেলের আঁইচা বাজিয়ে মায়মুন ও কাসু ঝিঁঝি ধরার ছড়া গাইতে শুরু করেছে?
ঝিঁঝি লো, মাছি লো,
বাঁশতলা তোর বাড়ী,
সোনার টুপি মাথায় দিয়া
রূপার ঝুমুর পায়ে দিয়া
আয়-লো তাড়াতাড়ি।
ঝিঁঝি ঝিঁঝি করে মায়,
ঝিঁঝি গেছে সায়বের নায়,
সাতটা কাউয়ায় দাঁড় বায়,
ঝিঝিলো তুই বাড়ীত আয়।
ঝিঝির বাপ মরছে
কুলা দিয়া ঢাকছে,
ঝিঁঝির মা কানছে,
আয়-লো ঝিঁঝি বাড়ীত্ আয়।
কিন্তু এ রকম ফাঁকি দিয়ে আর কত দিন? কাল রাত পোহালেই যখন এক মুঠো ভাত দিতে পারবে না ছেলের মুখে, তখন কি এ অভাবের কথা গোপন থাকবে ছেলের কাছে? ক্ষুধায় অস্থির হয়ে যখন সে ‘ভাত ভাত করে চিৎকার করবে, তখন মা হয়ে কি জবাব দেবে সে? জবাব না পেয়ে সে কি তখন বুঝবে না যে, তার মা অপদার্থ, খেতে দিতে পারে না। জয়গুন ভাবে এসব কথা। এ ভেবে আরো ব্যথিত হয় যে পেট ভরে খেতে দিতে না পারলে কাসুর কাছে তার বুকভরা স্নেহের কোন দামই আর থাকবে না। ছেলের আস্থা থাকবে না মা-র ওপর। মা-র স্নেহের ছায়ায় আসার জন্য একদিন সে অস্থির হয়ে উঠেছিল। এবার ক্ষুধার তাড়নায় করিম বুকশের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্যে সে অস্থির হয়ে উঠবে আবার।
সন্ধ্যার পর তিনপো চাল গামছায় বেঁধে হাসু বাড়ী আসে।
জয়গুন চোখ টিপে হাসুকে জিজ্ঞেস করে—মাছ কই হাসু? তোরে না কইছিলাম, ইলশা মাছ আনতে?
হাসু কথার ধরন বুঝতে পেরে বলে—ইলশা কাতলা কোন মাছই পাইলাম না বাজারে। মাছ মোডে নাই।
দু’দিনের না-খাওয়া জয়গুনের বুকের ভেতর ধড়ফড় করে। পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে মাঝে মাঝে, যেন নাড়ি-ভুড়িগুলোও হজম হয়ে যাচ্ছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। গামছায় বা ধা চাল দেখে তার ক্ষুধা আরো বেড়ে যায়।
জয় গুন সমস্তটা চাল নিয়ে হাঁড়ি বসায় আজ। ভোরের জন্যে রেখে দেয় না কিছুই। এই বেলা খেয়ে কিছু যদি বাঁচে তবে ছেলে-মেয়েরা পান্তা ভাত খেতে পাবে ভোরে। কিন্তু সে আশা কম। তার মনে হয়, একাই সে তিনপো চালের ভাত খেতে পারবে এখন।
কচুর লতির চচ্চড়ি ও ডাটা শাক দিয়ে পরম তৃপ্তির সঙ্গে ভাত খায় সকলে। অনাহারে শুকনো বুকে ভাত ঠেকে জয়গুনের। বাবার পানি খেয়ে সে বুক ভিজিয়ে নেয়।
জয়গুন বলে হাসুকে-কি চাউল রে! ফেনা যে ঘাডের পানি মতন। আবার চুকা। দেইখ্যা আনতে পারস না?
—চাউল পাওয়া যায় না বাজারে, তার আবার দেইখ্যা আনুমু। কত কষ্টে এই চাউল যোগাড় করলাম। বারো ছটাক বারে অনা। কাইল বাজারে ঢোল দিছিল ম্যাজিস্টর সাব—নয় আনার বেশী এক সেরের দাম নিলে জরিমানা অইব। এই-এর লেইগ্যা বাজারে চাউল নাই। মহাজনরা গোলায় গুঁজাইয়া থুইছে চাউল।
খাওয়া শেষে হাঁড়িতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
ছেলে-মেয়েরা মুমিয়ে পড়েছে সকাল সকাল। দু’দিনের অনাহারের পর ভাত খেয়ে জয়গুন আরো শ্রান্ত হয়ে পড়েছে। আজ তার শরীর ঝিমঝিম করে। চোখ দিয়ে পানি ঝরে
জয়গুন বসে বসেই এশার নামাজ শেষ করে। প্রতিদিনের মত তসবীহ নিয়ে জপতে আরম্ভ করে। কিন্তু সকাল কাজের মধ্যে ঐ এক চিন্তা–কাল রাত পোহালে ছেলে-মেয়েরা মুখে কী দেবে? হাসু কী খেয়ে কাজে যাবে? কার কাছে কৈফিয়ত দেওয়ার কিছু নেই।
জয়গুনের উত্তরে চাল কিনতে যাওয়ার সাথী লালুর মা দু’দিন এসেছিল। অনেক সাধাসাধি করেছিল ফতুল্লার ধান কলে কাজ করার জন্যে। কিন্তু জয়গুন তওবার কথা ভেলে নি। হাতে পায়ে যে শিকল সে পরেছিল সেদিন, তা খুলবার সাহস তার নেই। শক্তি পায় না। নিতান্ত অসহায়ভাবে সে লালুর মা-র প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আজ লালুর মা-র বলা কয়েকটি কথা বারবার তার মনে আসে। সে বলছিল-না খাইয়া জানেরে কষ্টে দিলে খোদা ব্যাজার সয়। মরলে পরে খোদা জিগাইব, তোর আত-পা ও দিছিলাম কিয়ের লেইগ্যা? আত দিছিলাম খাটবার লেইগ্যা, পাও দিছিলাম বিদ্যাশে গিয়া টাকা রুজি করনের লেইগ্যা।
লালুর মা কথায় কথায় গ্রাম্য গীতের কয়েকটা লাইনও গেয়ে উঠেছিল সেদিন:
আত আছিল, পাও আছিল,
আছিল গায়ের জোর,
আবাগী মরল ওরে
বন্দ কইর্যা দোর।
কথাগুলো আজ তার নতুন অর্থ, নতুন ব্যাখ্যা নিয়ে জনের চিন্তাকে নাড়া দেয়। লালুর মা-র প্রস্তাবকে সে বারবার বিবেচনা করে দেখে। ধান কলের কাজ এমন কিছু নয়। ধান ঘাটা, ধান রোদে দেয়া, চাল ঝাড়া—এই সব কাজ। রোজ পাচসিকা করে পাওয়া যায়। তা ছাড়া খুদ-কুড়াও পাওয়া যায় চেয়ে-চিন্তে।
মনের দুই বিরোধী চিন্তার সংঘর্ষের মধ্যে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলে।
মশার কামড় খেয়ে মায়মুন হাত-পা নাড়ছে। জয়গুন তাকায় ঐ দিকে। হাসু বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। সারাদিন খেটে তার আর হুঁশ নেই। মশার কামড়েও তার ঘুমের ব্যাঘাত হয় না। কাসু তার মিয়াভাইর গলা ধরে তার গায়ের ওপর একখানা পা চড়িয়ে দিয়ে ঘুমুচ্ছে। কুপির অস্পষ্ট আলোকে ছেলেমেয়েদের দিকে সে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তাদের কচি মুখ জয়গুনকে তার পথের সন্ধান বাতলে দেয়, তওবার কথা সে ভুলে যায়। লালুর মা-র। প্রস্তাব মাথায় নিয়ে কাল যাবে সে ধান কলে কাজ করতে। হাতে পায়ে তাকত থাকতে কেন সে না খেয়ে মরবে? ক্ষুধার অন্ন যার নেই, তার আবার কিসের পর্দা, কিসের কি? সে বুঝেছে, জীবন রক্ষা করাই ধর্মের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ মূলমন্ত্র। জীবন রক্ষা করতে ধর্মের যে কোন অপ-আক্রমণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে সে প্রস্তুত। উদরের আগুন নিবাতে দোজখের আগুনে ঝাপ দিতেও তার ভয় নেই।
জয়গুন সুঁই-সুতো নিয়ে কাপড় সেলাই করতে বসে। কাপড়টা অনেক জায়গায় ছিড়ে গেছে। এ কাপড় নিয়ে বেরোবার উপায় নেই। হাসুর গামছা বুকে জড়িয়ে গায়ের আঁচলটা আগে সেলাই করে। সেটা শেষ হলে বাকী আঁচলটা সেলাই করে তারপর।
ভোর হয়। ঘুম থেকে জয়গুন ওঠে নতুন প্রাণ, নতুন উদ্যম নিয়ে।
শফির মা-র কাছ থেকে চাল ধার করে রান্না হয়। ছেলেমেয়েকে খাইয়ে, নিজে খেয়ে জয়গুন বেরিয়ে পড়ে।
ধানখেতের আল ধরে পথ চলে জয়গুন। হাঁটু-সমান উঁচু ধান গাছে ভরা মাঠ। যেন সবুজ দরিয়া। ঝিরঝিরে বাতাস ঢেউ-এর নাচন তোলে। ছড়িয়ে দেয় মাঠের এক প্রান্ত হতে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত। দূরপ্রসারী মাঠের দিকে তাকিয়ে জয়গুনের চোখ জুড়ায়।
খেতের কাজে ব্যস্ত চাষীরা তাকায় জয়গুনের দিকে। কিন্তু তার ভ্রূক্ষেপ নেই। গদু প্রধান তার খেত তদারক করছিল। সকলের অলক্ষ্যে সে মাথা নাড়ে আর বলে—তোরে শাসন করতে পারতাম না! আমার নাম গদু পরধান। এটু সবুর কর।