সূর্য দীঘল বাড়ী
বাংলা সাহিত্যের সার্থক উপন্যাসগুলোর অন্যতম আবু ইসহাকের ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’; উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে।
কুসংস্কার, দারিদ্র্যতা, সামাজিক অবহেলা ও ধনী-শ্রেণির শোষণের বিরুদ্ধে গ্রামীণ জনপদের মহিলা জয়গুণের জীবনযুদ্ধের কথা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এ উপন্যাসে।
বাংলা ১৩৫০ সনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে অবিভক্ত ভারতের বাংলায় ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে ‘পঞ্চাশের আকাল’ নামে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল তাতে লক্ষ লক্ষ দরিদ্র মানুষ প্রাণ হারায়। যারা কোনমতে শহরের লঙ্গরখানায় পাত পেতে বাঁচতে পেরেছিল তাদেরই একজন একালের সময় স্বামী পরিত্যক্ত জয়গুন। সঙ্গে তার মৃত প্রথম স্বামীর ঘরের ছেলে ও দ্বিতীয় স্বামীর ঘরের মেয়ে। আরো আছে মৃত ভাইয়ের স্ত্রী-পুত্র। তারা গ্রামে ফিরে এসে এমন এক খন্ড জমিতে ঘর তৈরী করে যেটি অপয়া ভিটে বলে পরিচিতি ছিল। জীবনযুদ্ধে যখন সে প্রাণপণ লড়ছে তখন তার প্রতি গায়ের মোড়লের দৃষ্টি পড়ে। দ্বিতীয় স্বামীও তাকে আবার ঘরে তুলতে চায়। সে কারো প্রস্তাবেই সায় দেয় না। কিন্তু এ দুজনের সাক্ষাত ঘটে এবং মোড়ল তার প্রতিযোগীকে হত্যা করে। ঘটনার একমাত্র দর্শক হিসেবে জয়গুনকেও মূল্য দিতে হয় অন্যভাবে।
…এই কাহিনীর বিচিত্রতার মধ্যে মূল বিষয় একটিই; তা হচ্ছে কুসংস্কার, সম্পদ, ধর্ম, প্রতিপত্তি, সামাজিক বাধা-নিষেধ, এমনকি জাতীয়তাবোধ- এ সব কিছুকেই কাজে লাগিয়ে শ্রমজীবী ক্ষুধার্ত মানুষকে ক্রমাগত শোষণ।
‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৭৯ সালে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, চলচ্চিত্রটি যৌথভাবে পরিচালনা করেছেন মসিহ উদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলী। সরকারি অনুদান প্রাপ্ত এই চলচ্চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোতে অভিনয় করেছেন ডলি আনোয়ার, রওশন জামিল, জহিরুল হক, কেরামত মাওলা, এটিএম শামসুজ্জামান। চলচ্চিত্রটি প্রধান চরিত্র ‘জয়গুন’– এই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রথমে ফেরদৌসী মজুমদারকে প্রস্তাব করা হয়েছিল, কিন্তু পারিবারিক ব্যস্ততার কারণে তিনি অভিনয়ে অস্বীকৃতি জানান। এবং তাঁরই প্রস্তাবে ‘জয়গুন’ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ডলি আনোয়ারকে নির্বাচন করা হয়।
চলচ্চিত্রটির শ্রেষ্ঠাংশে অভিনয় করেন– ডলি আনোয়ার – জয়গুন; রওশন জামিল – শফির মা; জহিরুল হক – গদু প্রধান; আরিফুল হক – খলিল; কেরামত মাওলা – করিম বক্স; এটিএম শামসুজ্জামান – জোবেদ ফকির; সৈয়দ হাসান ইমাম – ইমাম; ফখরুল হাসান বৈরাগী – লেদু; নাজমুল হুদা বাচ্চু – ডাক্তার রমেশ; সেতারা বেগম – লালুর মা; সুফিয়া – আঞ্জুমান; ইলোরা গহর – মায়মুন; সজিব – কাসু এবং লেনিন – হাসু।
এই চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেন আলাউদ্দীন আলী।
চলচ্চিত্রটি ১৯৮০ সালে পশ্চিম জার্মানীতে অনুষ্ঠিত ২৯তম ম্যানহেইম চলচ্চিত্র উৎসবে ‘ফিল্ম ডুকার্ট’ স্বর্ণপদক লাভ করে। এছাড়া একই উৎসবে ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ চলচ্চিত্র ‘মানবিক আবেদনে’র জন্য আন্তর্জাতিক ইভানজ্যালিক্যাল (প্রোটেস্ট্যান্ট) সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক ক্যাথলিক সংস্থা কর্তৃক দুটি বেশেষ পুরস্কার লাভ করে।
পর্তুগালে অনুষ্ঠিত ১৯৮০ সালের ‘নবম ফিগুয়েরা দ্য ফজ’ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজের ‘প্রিক্স ডন কুইকজোট’ পুরস্কার লাভ করে। একই বছর ২২তম কার্লোভিভেরি (চেকোশ্লোভাকিয়া) চলচ্চিত্র উৎসবে ডিপ্লোমা লাভ করে।
‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ও শ্রেষ্ঠ পরিচালকসহ মোট আটটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। পুরস্কারগুলো হল–
- শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র – মসিহউদ্দিন শাকের (প্রযোজক)।
- শ্রেষ্ঠ পরিচালক – শেখ নিয়ামত আলী ও মসিহউদ্দিন শাকের।
- শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী – ডলি আনোয়ার।
- শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য – শেখ নিয়ামত আলী ও মসিহউদ্দিন শাকের।
- শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রহণ – আনোয়ার হোসেন।
- শ্রেষ্ঠ সম্পাদনা – সাইদুল আনাম টুটুল।
- শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী – ইলোরা গহর ও সজিব।
- শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী (বিশেষ শাখায়) – লেনিন।
এছাড়া ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ চলচ্চিত্র ১৯৭৯ সালে ছয়টি বিভাগে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সংস্থা (বাচসাস)’ পুরস্কার লাভ করে।
উৎসর্গ
বাবার স্মৃতির উদ্দেশে