বার পরিচ্ছেদ
বিকেল বেলা ঘুরে ঘুরে জয়গুন অনেক গন্ধভাদাল পাতা যোগাড় করে আনে। শহরের গিন্নিরা এ জংলী শাকের বড়া খেতে ভালবাসে। পাতাগুলো শুকিয়ে ওঠে বলে রাত্রিবেলা ওগুলো সাজিয়ে ঘরের চালার ওপরে রেখে দেয়া হয়।
রাত্রির শিশির-ভেজা হয়ে ভোর বেলায় পাতাগুলো সতেজ ও সজীব হয়ে ওঠে। রোদ উঠবার আগে জয়গুন চালার ওপর থেকে চাঙারিটা নামিয়ে নেয়। তারপর বসে বসে চার পয়সায় কতটা, তা আলাদা করে সে চাঙারির ভেতর সাজিয়ে নেয়।
খাওয়া সেরে জয়গুন তুষের হাঁড়ির থেকে আটটা ডিম নিয়ে গন্ধভাদাল পাতার মাকে বসিয়ে দেয়। তারপর চাঙ্গারিটা কাঁধে নিয়ে হাসু ও শফির সাথে কোষায় এসে বসে।
সবুজ মাঠের মাঝ দিয়ে কোষা চলে। ধান খেতের দিকে চেয়ে জয়গুনের চোখ জুড়ায়। নতুন শীয় মাথা বের করেছে। শীষের ভাবে ঈষৎ নুয়ে পড়েছে ধানগাছগুলো। মাঝে মাঝে ঝিরঝিরে বাতাস এসে সবুজ খেতে ঢেউ খেলিয়ে দিয়ে যায়।
জয়গুন বলে—-এই বচ্ছর খোদায় দিলে পান অইব খুব। আর না খাইয়া মরতাম না। এই সময় বিষ্টি রইয়া-সইয়া আইলে অয়। শীষমোখে বিষ্টি পাইলে বরবাদ অইয়া। যাইব।
হাসু বলে—কেমন মোটা মোট্টা ছড়া বাইর অইছে, দ্যাহ মা। বেবাক জায়গায় এইবার ভালা ধান অইব। উজান দেশেও হুনছি খুব বরাদ্দ দ্যাহা যায়।
—অউক। বরাদ্দ অইলেই খাইয়া বাঁচতে পারমু। এইবার পরা ফসল না অইলেও, বারো আনা ফসল অইব, অহন যেই রহম ভাওবরাদ্দ দাহা যায়। গেল বছর আধা ফসলও অয় নাই।
শফির হাতে লগি। সে একটা ধানখেতের ভেতর কোষা চালাতেই জয়গুন বাধা দেয়—এই কি করস, শফি? এমন ভরা খেতের মইদ্যে দিয়া নাও বাইতে আছে?
—ক্যান? এইডা তো আর আমাগ খেত না।
-অলক্ষ্মী ছেঁড়ার কথা হোন। আমাগ খেত নাই বুইল্যা তুই অমন ফুলে ভরা ধানের উপর দিয়া কোষা চালাবি? যা খাইয়া মানুষ বাঁচে, হেইয়া লইয়া খেলা! খেতের আইল। দিয়া যা।
——আইল দিয়া গেলে, কিন্তুক দেরী অইব।
—অউক দেরী। ধানের ছড়া বাইর অইছে। খেতের মাঝ দিয়া আর যাওন যাইব না। এট্ট টোক্কা লাগলেই কাইত অইয়া পড়ব, আর মাথা খাড়া করতে পারবো না।
শফি খেতের আল ধরে কোষা চালায়।
যে খেতে পাট ছিল সেগুলো কচুরিপানায় ছেয়ে গেছে। চার পাশের ধানখেতগুলোরও অনেকটা জায়গা গ্রাস করেছে কচুরীপানায়। কচুরির ঝাড়ে বিচিত্র ফুলের মেলা।
দু’একজন নিরলস কৃষক খেতের চারপাশে বাঁশের বেড়া দিয়ে কচুরিপানার আক্রমণ ঠেকিয়েছে।
দু’একটা জলা-খেতে যেখানে কচুরিপানার উৎপাত নেই, সেখানে আধবোজা শাপলার ল। রোদের তেজ বাড়লে বুজে যাবে।
যেতে যেতে জয়গুন বলে কয়েকটা শাপলা তুইল্যা লইয়া যাই। উকিল বাবুর বউ। হেদিন কইয়া দিছিল।
শাপলা তুলে গোটা কয়েক তাড়া বেঁধে নেয় জয়গুন।
একটা ট্রেন সবেমাত্র যাচ্ছে স্টেশন থেকে। হাসু ও শফি দৌড়ে গিয়ে চলতি গাড়ীর হাতল ধরে লাফিয়ে ওঠে পাদানের ওপর। হাসু চেঁচিয়ে বলে—তুমি ধীরে-হস্তে আহ মা। আমরা গেলাম।
জয়গুন শাপলার তাড়া কয়টা কুনইর সাথে ঝুলিয়ে, চাঙারি কাঁধে নারায়ণগঞ্জের দিকে যায়।
মসজিদের মৌলবী সাহেব আসছেন। তার মুখোমুখি হওয়ায় সঙ্কুচিত হয় জয়গুন। তার হাত দু’খানাই আটকা থাকায় সে মাথার কাপড়টাও টেনে দিতে পারে না। পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে যায় সে। আড়চোখে চেয়ে মৌলবী সাহেব অস্পষ্ট স্বরে বলে ওঠেন—তওবা তওবা!
জয়গুনের প্রথম স্বামী জব্বর মুন্সী এই মৌলবী সাহেবের খুবই প্রিয়পাত্র ছিল। তার স্ত্রী সদর রাস্তায় হাঁটে তা তিনি বরদাস্ত করতে পারেন না। কতবার লোক পাঠিয়ে তিনি জয়গুনকে বাইরে যেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু জয়ন তা শোনেনি।
ডিম ও গন্ধ ভাদাল পাতা বেচতে বেশী সময় লাগে না। উকিলপাড়ায়ই আজ সমস্ত কাবার হয়ে যায়। ঝাকা নামান মাত্র চিলিবিলি করে নিয়ে যায় সব।
জয়গুন বাজারে গিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় লবণ, মরিচ, গরীবের বিলাসদ্রব্য পান-সুপারি এবং আরো কয়েকটা প্রয়োজনীয় সওদা কেনে। রাস্তার এক জায়গায় আখ বিক্রি হচ্ছে। গাছের সাথে বাঁশ বেঁধে উচ্চতা ও দামের ক্রমানুসারে সারি সারি আখ সাজিয়ে রাখা হয়েছে। মায়মুন কতদিন মাকে বোম্বাই আখ নিতে বলেছে। কিন্তু সে ইচ্ছে করেই এতদিন নেয় নি, অযথা পয়সা খরচ হবে বলে। মায়মুনকে ফাঁকি দিয়ে সে বলেছে—উখের কি খায়? অহনো মিড়া অয় নাই। পানসে উখ খাওয়ন আর ঘাস খাওয়ন সমান কথা।
কিন্তু আজ সারি সারি আখ দেখে তার মনে ব্যথা লাগে। সে ভাবে-মওসুমের একটা জিনিস কার না মুখে দিতে ইচ্ছে হয়? আর মায়মুন ত নেহায়েত কচি মেয়ে।
জয়গুন তিন আনা দিয়ে একটা আখ কেনে।
রাস্তায় রাজার মা-র সাথে দেখা হয়। রাজার মা জয়গুনের উত্তরে চাল কিনতে যাওয়ার সাথী। সে জিজ্ঞেস করে—কত দিয়া কিনলাগে! উখখান?
—বা-রো পয়সা।
রাজার মা মাথায় হাত দেয়। সে আবার বলে—তিন আঙুল উখ না, দাম তিন আনা! উহতু না—অষুধ। আস্তা পয়সা চাবাইয়া খাওয়ান।
-এই রহমই বইন। আমাগ ঘরের জিনিসের দর নাই। আমরা যা বেচতে যাই-হস্তা। এক্কেরে পানির দাম। বাজারে একটা আদনা চিজ কিনতে গিয়া দ্যাহ, গহটের পয়সায় কুল পাইবা না। একটু থেমে আবার বলে—এই চাঙারির এক চাঙারি শাক, এক্কেরে তরতাজা বেচলাম চাইব আনা। আর দ্যাহ, আষ্ট আনার বেহাতি কোন নিচে পইড়্যা আছে।
—দেখছি বইন। এই দশা। এহন যাই গো। দেহি চাউলেরনি যোগাড় করতে পারি। আইজ গাড়ীতে ওঠতে পারলাম না। যা ভিড়। মাগগো মা!
—পুরুষ মাইনষেই ওঠতে পারে না গাড়ীতে। আমরা ত মাইয়া মানুষ। কাইল পরশু আবার যাইবা নি গো? গেলে লইয়া যাইও আমারে। দ্যাশের চাউলে প্যাট ভরে না। চাউলের দাম যেন রোজ রোজ ওঠতেই আছে।
রাজার মা এতক্ষণে কয়েক পা এগিয়ে গেছে। জয়গুন হাঁটতে হাঁটতে ভাবে, আর বুঝি উত্তরে যাওয়া হয় না। লোকের ভিড়ে গাড়ীতে ওঠবার যো নেই। কত লোক হাতল ধরে পা-দানের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। গাড়ীর ছাতে বসে যায় কত লোক। সেদিন তার চোখের সামনে একটা লোক গাড়ীর পা-দানের ওপর থেকে পড়ে গেল।
টিকেটর জন্যেও আবার খুব কড়াকড়ি শুরু হয়েছে। বিনা টিকেটে লুকিয়ে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সয়ে আর কত দিন যাওয়া যায়? জয়গুনদের গ্রামের জহিরুদ্দিন বিনা টিকেটে গাড়ী চড়ায় তিনদিন ফাটক খেঠে এসেছে।
পথে আসতে একটা উদলা নৌকার ওপর জয়গুনের দৃষ্টি পড়ে। রেল-রাস্তার পাশে গাছের সাথে বাধা ছোট নৌকাটি। একটি ছোট ছেলে বসে আছে নৌকার ওপর। যে কোন ছোট ছেলে হাতের কাছে পেলেই সে কোলে তুলে নেয়। তার মুখে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে। কাসুর নাক, কাসুর চোখ, তার কপাল, যুগল গায়ের রঙ কেমন ছিল আজও জয়গুনের চোখের সামনে ভাসে। কারও ছোট ছেলে কোলে নিয়ে তার মুখের দিকে স্থিরদৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে মন্তব্য করে—ওর নাকটা আমার কাসুর নাকের মতন। আমার কাসুরও এই রহম জোড়-ভুরু। জোড়-ভুরু ভাইগ্যমানের লক্ষণ। কিন্তু অইলে কি অইব? যে দশ মাস দশ দিন উদরে রাখল, তার বুক খালি।
একটা নিশ্বাস ছেড়ে সে আবার বলে—থাক আমি শাপ দিমু না কাউরে। আমার কাসু। “জান-ছালামতে বাঁইচ্যা থাউক-খোদার কাছে দিন-রাইত চবিবশ ঘটা এইডাই আরজ করি।
নৌকায় বসা ছেলেটার দিকে চেয়ে দ্রুয়গনের মনে হয়, তার কাসুও এতদিনে হয়তো এতটা বড় হয়েছে।
নৌকাটার দিকে আর একবার চেয়ে দেখে জয়গুন। এ রকম একটা নৌকা করিম বকশেরও ছিল। নৌকার মাঝে একটা কোঁচও দেখা যায় ঠিক করিম বকশের কোঁচটার মতই। সে ভালো করে দেখে। তাইত! করিম বকশের কোঁচটাই। কোন ভুল নেই।
জয়গুন থমকে দাঁড়ায়। তার মনে আনন্দ ও আবেগের মিলনসংঘাত আবর্তের সৃষ্টি করে। সে ভুলে যায়, আসমানে না জমিনে, স্বপ্নে না জাগরণে কোথায় কোন অবস্থায় সে আছে।
মুহূর্ত পরে নিজেকে সামলে নিয়ে কাখের ঝাকাটা রাস্তার ওপর ফেলে সে নৌকার দিকে ছুটে যায়।
নৌকায় পা দিতেই ছেলেটি বলে—উইট্য না আমাগ নায়।
জয়গুন উত্তর না দিয়ে নৌকায় ওঠে। ছে
লেটি বলে—ক্যাদা মাইখ্যা দিল যে! বাজান আমারে মারব।
জয়গুনের খেয়াল নেই। সে কাদা পায়েই উঠে পড়েছে।
জয়গুন ছেলেটির কাছে গিয়ে বসে। তার চিবুক ধরে বলে—তোমার নাম কি?
ছেলেটি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে তার দিকে। মুখ না নামিয়ে আস্তে বলে—কাসু।
–কাসু! কাসু! আমার কাস! জয়গুন পাগল হয়ে গেল বুঝি। সে দুই হাতে কাসুকে জড়িয়ে ধরতে যায়। কাসু সে হাত সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে।
জয়গুন ভাবে—আজ সে পেটের সন্তানের কাছে পর হয়ে গেছে।
জয়গুন কাসুকে কোলে নেয়। কিন্তু কাসু কোস্তাকুস্তি করে কোল থেকে নেমে যায়।
জয়গুন আখ খেতে দেয় কাসুকে। নিজের দাঁত দিয়ে চোকলা ছাড়িয়ে ছোট ছোট টুকরো করে তার মুখে দেয়। কাসু চিবোয়। জয়গুন অশেষ তৃপ্তির সাথে তার দিকে চেয়ে দেখে।
এক সময়ে জয়গুন বলে—তোমার বাজান কই?
—দুধ বেচতে গেছে।
—তোমার মুখখানা হুকনা যে? তোমার মায় তোমারে খাইতে দেয় নাই?
—আমার মা নাই, মইরা গ্যাছে।
জয়গুন সহ্য করতে পারে না। সে তাকে কোলে তুলে নেয়। আখ খেতে দেয়ায় কাসু বশ হয়েছে। এবার সে কোলে উঠতে আপত্তি করে না। জয়গুন পরম স্নেহে তার কপালে চুম্বন করতে থাকে। তার চোখের পানি কাসুর মুখখানা সিক্ত করে দেয়।
কাসুকে কোলে নিয়ে জয়গুনের অনেক সময় কাটে। করিম বক্শ দুধের হাঁড়ি মাথায় নৌকার কাছে এসে কখন দাঁড়িয়ে আছে জয়গুনের হুঁশ নেই। করিম বকশের ডাকে তার আবেশ ভেঙে যায়। মুখ তুলে দেখে—করিম বক্শ। তার চোখ দুটো রাঙা–জ্বলছে।
জয়গুন মাথার কাপড় আরো টেনে দিয়ে দাঁড়ায়। নৌকা থেকে নেমে শিথিল বিবশ পা দুটোয় স্বাভাবিক শক্তি ফিরিয়ে আনবার আগেই করিম বকশের গম্ভীর গলা শোনা যায়—খাড়, কথা আছে।
জয়গুন দাঁড়ায়। করিম বক্শ বলে—আমারে আর সুখে-শান্তিতে থাকতে দিবি না, দেখতে আছি। মায়ে-পুতে জোট কইর্যা আমারে পাগল বানাইয়া ছাড়বি তোরা। হাসুয়া হারামজাদা কদ্দিন জালাইছে, আবার তুইও–
জয়গুন নীরব।
—আমার সুখ তোগ চউখে সয় না? সাত সাতটা বচ্ছর দুধ ভাত খাওয়াইয়া ওরে অত ডার করছি। এহন চাও তৈয়ার আণ্ডায় উম দিতে।
জয়গুনের ইচ্ছে হয় বলে—আণ্ডা তুমি পাড় নাই। আমার আণ্ডায় আমি উম দিলে তোমার এত পোড়ানি কিয়ের লেইগ্যা? ওরে দশ মাস দশ দিন পেডে রাখছি, তিন বচ্ছর বুকের দুধ খাওয়াইছি। তুমিই তৈয়ার আণ্ডায়–
কিন্তু মুখ ফুটে একটি কথাও সে বলতে পারে না।
করিম বক্শ আবার বলে—তোগ ডরে ওরে বাড়ীতে রাইখ্যা আহি না। লেজুড়ে লেজুড়ে বাইন্দা রাখি সব সময়। নাওডা চোরে লইয়া যায় এই ডরে ওরে না বহাইয়া বাজারে যাই। এদিগেও তোগ উৎপাত শুরু অইছে! আমি এহন কোথায় যাই? তোগ যন্তন্নায় মুল্লুক ছাইড়্যা বনবাসে গেলে পারি অহন।—করিম বক্শ গুমরে ওঠে।
জয়গুন চলতে আরম্ভ করে।
করিম বক্শ বলেই চলে—দোহাই খোদার। ওরে ফুসলি দিস না আর। আমার পোলারে ফুসলি দিলে আল্লার কাছে ঠেকা থাকবি। রোজ কেয়ামত তক দাবী থাকবো তোর উপরে।
জয়গুন বেশ কিছু দূর এগিয়ে গেছে।
করিম বক্শ জোরে বলে—আবার যদি ফেউ-এর মতন আমার পিছু লাগস, আখেরি কথা হনাইয়া দিলাম, তয় তোরই একদিন কি আমারই একদিন।
জয়গুন কোনো দিন কাসুকে ফুসলি দেয়নি, আর দিবেও না—সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা।