» » ছয় পরিচ্ছেদ

বর্ণাকার

ছয় পরিচ্ছেদ

১৫ই আগষ্ট শুক্রবার, ১৯৪৭ সাল।

হাসু মা-কে মোড়ল পাড়ায় নামিয়ে দিয়ে রেল-রাস্তার পাশে আসে। রোজ সেখানে কোষা ডুবিয়ে রেখে সে কাজে যায়।

রাস্তায় উঠেই সে চমকে ওঠে। চারদিক থেকে চিৎকারের ধ্বনি শোনা যায়। হিন্দু-মুসলমানে কাটাকাটি শুরু হল না ত!

রেল-রাস্তা ধরে সে ভয়ে ভয়ে পা ফেলে। মারামারি বাধলে কোন কাজই হবে না আজ। গত বছর এমন দিনে মারামারি বেধেছিল। পনেরো দিন সে ঘরের বার হতে পারেনি। তিনদিন না খেয়ে কাটাতে হয়েছে।

একটা গাড়ী আসছে নারায়ণগঞ্জ থেকে। ইঞ্জিনের সামনে একটা নিশান পতপত করছে। বাতাসে। সবুজ রঙের বড় নিশান। মাঝে চাঁদ ও তারা।

গাড়ীর মাঝেও চিৎকার। চারদিকের চিৎকারে আকাশ-বাতাস মুখর হয়ে উঠেছে। গাড়ীটা কাছাকাছি আসতে স্পষ্ট বোঝা যায়—

আজাদ পাকিস্তান—জিন্দাবাদ!

কায়েদে আজম—জিন্দাবাদ!

হাসুর গা রোমাঞ্চিত হয় আনন্দে। সে চেয়ে থাকে। গাড়ীর প্রত্যেকটি লোক আনন্দ-চঞ্চল। অনেকের হাতেই নিশান। বাইরে মুখ বাড়িয়ে নিশান নেড়ে তারা চিক্কার করছে। প্রত্যেক কামরায় ঐ একই আওয়াজ।

হাসু হাত উঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে আওয়াজ তোলে ঐ সাথে।

মানুষের বিরাট মিছিল চলছে শহরের রাস্তা দিয়ে। হিন্দু-মুসলমান ছেলে বুড়ো—সবাই আছে মিছিলে।

হাসু দাঁড়িয়ে দেখছিল। মিছিল সে বহু দেখেছে। কিন্তু এরকম আর দেখেনি। একজন কাগজের একটা নিশান ওর হাতে দিয়ে দাড় করিয়ে দেয় লাইনে। হাসু মিছিলের সাথে মিশে যায়। কাজের কথা তার মনেই হয় না।

মিছিল শহরের সমস্ত রাস্তা ঘোরে। চিৎকার করে জানায় স্বাধীনতার বার্তা।

মিছিল ভাঙে দেড়টায়। হাসু তাড়াতাড়ি স্টেশনে আসে। মেল স্টীমার এখনও আসেনি। হাসুর ভাগ্য ভালো। আর দিন আসে একটার মধ্যেই।

তিনটার সময় মেল আসে। জাহাজের সামনে ঠিক ছাদের ওপর উড়ছে সবুজ নিশান। জাহাজের ডেকে লোক ঠাসাঠাসি হয়ে আছে। ছাদেও উঠেছে অনেক লোক, সেখান থেকে আওয়াজ ওঠে–

পাকিস্তান জিন্দাবাদ!

কায়েদে আজম—জিন্দাবাদ!

পাড়ের থেকে একদল তাদের ধ্বনির প্রতিধ্বনি করে। জাহাজখানা যেন কেঁপে ওঠে। সমস্ত মিলে একটা নতুন অনুভূতির সঞ্চার হয় হাসুর মনে।

দুটো মোট বয়ে আজ দশ আনা পায় হাসু। অন্য দিন দর কষাকষি হয়। তিন আনা বড় জোর চার আনার বেশী মোট পিছু দিতে চায় না। কিন্তু আজ আর পয়সার দিকে যেন খেয়াল নেই কারো।

আজ আর কাজ করবে না হাসু।

পথে আসতে আসতে সে দেখে, শহরের প্রত্যেক বাড়ীতে নিশান উড়ছে বড় বড়। সে তার হাতের কাগজের নিশানটার দিকে চায়, আবার চায় দুই পাশে। ডানে হিন্দু পাড়া, বাঁয়ে মুসলমান পাড়া। সব বাড়ীতেই আজ সবুজ নিশান।

হাসু বাড়ী আসে। চিৎকার করে সে গলা ভেঙেছে আজ। ভাঙা গলায় সে সমস্ত দিনের কথা বলে যায় মা-র কাছে। জয়গুন হাসুর হাত থেকে নিশানটা নিয়ে দেখে আর শুনে যায়। হাসুর কথা এক মনে।

হাসু বলে—আর আমাগ কষ্ট অইব না, কেমুন গো, মা? মাইনষে কওয়াকওয়ি করতে আছে ঘাডে পথে। দ্যাশ স্বাদীন অইল। এইবার চাউল হস্তা আইব। মানুষের আর দুখ থাকব না।

—হুঁ। জয়গুন সায় দেয়। সে-ও সেদিন গাড়ীতে শুনেছে, দেশ স্বাধীন হবে। ভাত-কাপড় সস্তা হবে। কেউ না খেয়ে মরবে না।

জয়গুনের সুখের স্বপ্ন আজ সফল হলো। সত্যি সত্যি স্বাধীনতা এল আজ।

হাসু বলে—টাউনে আইজ বেবাক বাড়ীতে নিশান ওড়তে আছে, মা। কি সোন্দর বড় বড় নিশান! তুমি একটা বানাইয়া দ্যাও, মা।

জয়গুন হাতের নিশানটা দেখিয়ে বলে—এই যে আছে একটা। আর দিয়া কি অইব?

—এইড়া যে এক্কেরেই ছোড়। গাছের ডাইলে বাইন্দা উপরে তুলতাম, মা। গেরামের বেবাক মাইনষে দ্যাখতে পাইব। টাউনে কত বড় বড় নিশান ওড়তে আছে আইজ!

জয়গুন ঘরে যায়। একটা গাঁটরি নামায় মাচার ওপর থেকে। লাল কাপড়ের একটা টুকরো বের করে হাসুকে দেখায়।

উহুঁ, রাঙ্গায় অইব না, মা। এই রহম কচুয়া অওয়ন চাই। হাতের নিশানটা দেখিয়ে প্রতিবাদ করে হাসু।

—ক্যাঁ? রাঙ্গায় দোষ কি? কী সোন্দর খুনী রঙ! মীরপুরের শাহ সাবের দরগায় দেইক্যা আইলাম লাল নিশান।

—টাউনের এক বাড়ীতেও রাঙ্গা নিশান দ্যাখলাম না। বেবাক এই রহম কচুয়া।

আসমানী রঙ্গে অইব?

—উহুঁ, কইলাম যে এই রঙ। তোর লাইগ্যা এই রঙ বানাইলে পারি অহনে। জয়গুন রাগ করে। সে আর একটা গাঁটরির জন্যে উঠতেই হাসু খুশী হয়।

গাঁটরি খোলে জয়গুন। পুরাতন কাপড়ের গাঁটরি। কালিঝুলি মেখে বিশ্রী হয়ে গেছে টরিটা। খুলতে খুলতে তার হাত অবশ হয়ে আসে। বুকের ভেতর স্পন্দন বেড়ে যায় অসম্ভব রকম। জীর্ণ পুরাতন কাপড় ভাজ করে করে সাজান। জয়গুনের বিগত জীবনের অনেক কাহিনী কাপড়গুলোর মধ্যে পুঞ্জীভূত। ভাঁজ খুলতে খুলতে তার স্মৃতির ভাঁজও খুলে যায়। এই টুপিটা তার প্রথম স্বামীর—হাসুর বাপের। ঢোলা পাঞ্জাবীটাও তার। জয়গুনের চোখে ভাসে, কিশতি টুপি মাথায় পাঞ্জাবী গায়ে জবর মুনশীর চেহারাখানা।…এই বোম্বাই শাড়ীটা তার প্রথম বিয়ের। ঘোমটা-টানা বধু জীবনের সুমধুর স্মৃতি এখন শুধু ব্যথাই দেয়।…এই ছোট্ট জামাটা কাসুর। এই জামা আর কানটুপিটা ছোট খুকীর।

জয়গুনের চোখ আর বাধ মানে না। চোখের পানিতে গঁাটরির কাপড়গুলো ভিজে ওঠে।

ছোট খুকী!

তখন দুর্ভিক্ষ সবে দেখা দিয়েছে। দুর্নামের ভয়ে স্বামী পরিত্যক্তা জয়গুন তখনও ঘরের বার হয়নি। খেতে না পাওয়ায় তার বুকে দুধ ছিল না। দুধের শিশু দুধ না পেয়ে শুকনো পাটখড়ির মত হয়েছিল। শেষে ধুকতে ধুকতে একদিন মারা গেল। তাকে কবর দিতে কাফনের কাপড় জোটেনি। এই বোম্বাই শাড়ীটার অর্ধেক দিয়ে কাফন পরিয়ে যখন কবরে নামান হয় তখন জয়গুন বিলাপ করতে করতে বলেছিল—”আইজ তোরে বউ সাজাইয়া দিলাম।”

জয়গুন আর ভাবতে পারে না। একমাত্র সবুজ বোম্বাই শাড়ীটার অবশিষ্ট পাটটা হাসুর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে সে কাপড়গুলোর মধ্যে মুখ লুকায়।

হাসু ও মায়মুন অবাক হয়ে চেয়েছিল মা-র দিকে। তারা কিছু বুঝতে না পেরে শাড়ীর পাটটা নিয়ে বেরিয়ে যায়।

মায়মুন সুঁই নিয়ে আসে। সাদা কাপড়ের চাঁদ ও তারা কেটে নিশানের মাঝে জুড়ে দেয়।

বেশ সুন্দর নিশান হয়েছে। ঠিক সায়েব বাড়ীর নিশানটার মত। মায়মুন উৎফুল্ল হয়। হাসুর চোখে-মুখে হাসি ফোটে।

জয়গুন যখন বাইরে আসে, তখন হাসু আম গাছে উঠে নিশানটা বেঁধে দিয়েছে। মায়মুন ও শফি চেয়ে আছে ওপর দিকে। গাছের থেকে হাসু ডাকে—মায়মুন! শফি! আমি যা কই আমার লগে লগে আওয়াজ করবি, কেমন?

শফি বলে—কি কইমু?

—পাকিস্তান—জিন্দাবাদ!

হাসুর সাথে গলা মিলিয়ে শফি ও মায়মুন আওয়াজ তোলে। জয়গানের মনে ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে কথাগুলো।

জয়গুন নিশানটার দিকে তাকায়। সবুজ নিশান নতুন জীবনের আভাস দিয়ে যায়। মনে জাগে বাঁচবার আশা।