নয় পরিচ্ছেদ
জয়গুন ও হাসু আজ সকাল সকালই বেরিয়ে গেছে।
মায়মুন হাঁস দুটো খাঁচা থেকে বের করে পানিতে ছেড়ে আসে।
এবার সে হাঁসের বাচ্চা দুটো বের করে ঘরের মেঝের ওপর ছেড়ে দেয়। নিজেও হাত দুটো মাটিতে রেখে উপুড় হয়ে চেয়ে থাকে। হলুদ রঙের বাচ্চা দুটো কেমন সুন্দর হাঁটে আর চিপচিপ করে। মায়মুনের আনন্দ হয়।
কাল,মায়মুন বাচ্চা দুটো নিয়ে এসেছে। সোনাচাচী বলে দিয়েছে—আমারে এক আলি আণ্ডা দিবি। আমারে না খাওয়াইলে পাতিহিয়ালে ধইর্যা লইয়া যাইব তোর আঁস, কইয়া রাখলাম।
মায়মুন স্বীকার করে এসেছে। সোনা চাচীকে প্রথম দুই দিনের ডিম সে দেবে। তাকে আগে না খাইয়ে নিজেরা ছোবেও না ডিম।
কাল বাচ্চা দুটোকে নিয়ে আসার পর থেকে মায়মুন এগুলোকে নিয়েই কাটিয়ে দেয়। কখনও মাটির ওপর ছেড়ে দেয়, আবার কখনো বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। রাতে শুতে যাওয়ার সময়ও সে বাচ্চা দুটো কাছ ছাড়া করতে চায় না।
জয়গুন ধমক দিয়ে বলে—সুখে থাকতে ভূতে কিলায়? খাঁচার নিচে রাইখ্যা আয় জলদি। না’ লে চুল ছিঁড়া ফ্যালাইমু ট্রাইন্যা।
মায়ের ধমকের কাছে মায়মুন এতটুকু হয়ে যায়।
বাচ্চাদুটো খাঁচার নিচে রেখেই সে শুয়ে পড়ে। কিন্তু তার ঘুম আসে না। অনেক রাত পর্যন্ত সজাগ থেকে সে শুনতে পায় বাচ্চা দুটোর ডাক। মাঝে মাঝে চিপচিপ করে ওঠে ওগুলো। শিশুর কান্নায় অসহায় মায়ের মত অবস্থা হয় মায়মুনের।
মা চলে যাওয়ার পর মায়মুনের পূর্ণ স্বাধীনতা। এবার তাকে বলবার কেউ নেই। বাচ্চা দুটোকে খাঁচার মধ্যে রেখে সে উঠানের দক্ষিণ পাশে লাউ মাচার নিচে একটা জায়গা বেছে নেয়। কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ে চৌকা একটা গর্ত করে। পানি ঢেলে সেটাকে ভরে। তারপর বাচ্চা দুটোকে ছেড়ে দেয় তার মধ্যে।
হাঁসের বাচ্চা দুটোর নতুন অভিজ্ঞতা। জন্মাবার পর এই প্রথম তারা পানির পরশ পায়। সেজন্যে পানিতে ছেড়ে দিতেই ভয় পেয়ে ওপরে উঠে আসে। মায়মুন ভাবে—দু’দিন গেলেই ঠিক হয়ে যাবে। বড় হাঁসের মতই সঁতরাবে তখন।
মায়মুন গতটার চারদিকে কতগুলো লম্বা পাটখড়ি পুঁতে দেয়। এমনি ভাবে লাউ মাচার। সমান উঁচু করে সে একটা বেড়া বানিয়ে ফেলে। চিল বা বাজ ছো মেরে নিয়ে যেতে না পারে, সে জন্যে এ সতর্কতা।
মায়মুন বাড়ীর চারপাশ ঘুরে ছোট বড় নানা রকমের শামুক কুড়িয়ে আনে। দা দিয়ে সেগুলোর খোসা ছাড়ায়। তারপর কুচি কুচি করে কাটতে কাটতে গান গায়–
শামুক খাজারে, আমার বাড়ী আয়,
কুচি কুচি শামুক দিমু হলদি দিমু গায়,
ওরে শামুক খাজারে।
তোর বাড়ী অনেক দূরে, সাত পাক ঘুইরে ঘুইরে
আমার বাড়ী আয়।
শফি এসে পাশে দাঁড়ালে মায়মুনের গান বন্ধ হয়ে যায়।
শফি বলে—এগুলা দিয়া কি করবি?
মায়মুন কিছু না বলে হাঁসের বাচ্চা দুটো আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
—দে আমি কাইট্যা দেই।
—উহু আমিই পারি কত কাটতে।
মায়মুন একটা পাতায় করে কুচি কুচি করে কাটা শামুক নিয়ে বাচ্চা দুটোর সামনে ধরে। বাচ্চা দুটো কয়েকবার ঠোঁট দিয়ে নেড়ে খেতে শুরু করে।
শফি বলে—বাহ খাইতে শিখছে রে! কেমন ক্যাং ক্যাৎ কইরা খায়! দ্যাখ চাইয়া।
—দেখছি।
মায়মুন বসে বসে দেখে।
শফি বলে—আমারে একটা বাচ্চা দিবি?
—ইশ!
—পয়সা দিমু আষ্ট খান।
—উহু এক ট্যাহা দিলেও না।
—ফুলঝুরি দিমু। আর চুলের কিলিপ।
মায়মুন বলে—উহু সাত রাজার ধন মাণিক্য দিলেও না।
—না দিলে চুরি কইর্যা লইয়া যাইমু তোর আঁস, কইয়া রাখলাম।
মায়মুন এবার চেঁচিয়ে ওঠে—মামানি, ও মামানি, দ্যাখ তোমার পোলা কেমুন লাগাইছে। তারপর হাঁসের বাচ্চা রাখবার গর্ত থেকে পানি ছিঁটিয়ে দেয় শফির চোখেমুখে।
শফির মা-ও শফিকে ডাক দেয়—অ্যাঁরে শফি, কি শুরু করলি? আমি আইলে ঠ্যাঙ ভাঙুম কিন্তু।
—না মা, ফাঁকিজুকি দিলাম আমি।
কলাগাছের ভেলায় চড়ে শফি ও মায়মুন মোড়লদের ছাড়া ভিটয় যায় লাকড়ি কুড়াতে। শফি জঙ্গলের ভেতর দিকে নিয়ে যায় মায়মুনকে। শফি গাছে উঠে শুকনো ডাল ভেঙে নিচে ফেলে। মায়মুন কুড়িয়ে জড়ো করে এক জায়গায়।
শফি গাছে চড়তে বেশ ওস্তাদ। এক গাছের ডাল বেয়ে সে আর এক গাছে চলে চায়। মায়মুন বলে—আর ওই মুহি যাইও না শফি ভাই, ওই গাবগাছে—
—কি ঐ গাবগাছে?
—আলেক মোড়লের বউ গলায় দড়ি দিছিল ঐ গাবগাছে, তুমি বুঝিন জান না?
—হেতে কি অইছে?
—উঁহু, আমার ডর করে। তুমি নাইম্যা আহ হবিরে। শফি গাছ থেকে নেমে বলে—মায়মুন চাইয়া দ্যাখ দেহি, ঐ দিক ঐ গাবগাছে কালা একটা কি দ্যাহা যায়।
মায়মুন ঐ দিকে না চেয়েই ওগো মাগো বলে শফিকে জড়িয়ে ধরে। শফি জোরে হেসে ওঠে। বলে—আরে কিছু না, ফাঁটকি একদম ফাঁটকি। দিনে-দুপরে কিয়ের ডর? চাইয়া দ্যাখ। দ্যাখ না ছেড়ি। কিছুই না, চউখ মেল এইবার।
মায়মুন তবু চোখ খোলে না।
শফি ওকে কোলে তুলে ভেলার কাছে নামিয়ে দেয়। মায়মুন এতক্ষণে চোখ মেলে। সে বলে তুমি কি ফাজিল। খামাখা ডর দেহাইলা।
শফি হাসে হিঁ-হিঁ করে।
মায়মুন বলে—তুমি গিয়া লাকড়ি লইয়া আহ। আমি আর যাইতে পারতাম না।
শফি বাগানে যায়। শুকনো ডালগুলো একটা লতা দিয়ে বেঁধে মাথায় করে নিয়ে আসে। তারপর বাড়ী এসে দুটো ভাগ করে। নিজের ভাগের থেকে কয়েকটা ডাল মায়মুনকে দিয়ে। বলে—তোরা মানুষ বেশী। এই কয়ডা বেশী নে তোরা।
বিকেল বেলায় মায়মুন তেঁতুল তলায় বড়শী নিয়ে বসে। তার কোলের কাছে হাঁসের বাচ্চা লুটো। আবার শফি এসে জোটে সেখানে। একটা ছিল ওর বড়শীর কাছে ছুঁড়ে শফি তেঁতুল গাছের আবডালে পালায়।
মায়মুন কিছু দেখতে না পেয়ে দাঁড়াতেই হেসে ওঠে শফি— হিঁ-হিঁ-হিঁ!
মায়মুন বলে—তুমি বড় শয়তান। চাইঙ্গা মারলা ক্যান?
—কই চাইঙ্গা! মাছে ডাফ দিল ছেঁড়ি। জবর মাছ অইবরে! বোয়াল মাছ।
মায়মুন মাথা নেড়ে বলে—হুঁ, বোয়াল মাছ।
—হ রে হ। কি মাছ পাইছস?
—কিচ্ছুই না। একটা তিঁত পুডিও না।
—কিছুই না?
—উঁহু।
শফি আশ্চর্য হয়। তারপর গম্ভীরভাবে বলে—তোর বড়শীতে কার জানি মোখ লাগছে রে! কেও নষ্ট না করলে এমুন অয়? আমার মনে অয়, কেও ডিঙ্গাইয়া গেছে তোর ছিপ। হেই-এর লাইগ্যা মাছ ওঠতে আছে না।
মায়মন শফির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়।
শফি বলে—পোড়াইয়া নে আগুনে। ঠিক অইয়া যাইব।
শফি ও মায়মুন মাটির হাতায় আগুন নিয়ে বড়শীটা পোড়া দেয়।
তারপর একসঙ্গে সুর করে বলে—
বড়শী পুড়ি, বড়শী পুড়ি,
ট্যারা পড়শীর মোখ পুড়ি,
মাছ ধরমু দুই কুড়ি॥
লোয়ার বড়শী সুতার ডোর
পুঁডি পাবদা, শিং মাগুর॥
বড়শী আমার প্যাদা
ধইরা আনব ভ্যাদা–
ভ্যাদা মাছে ক্যাদা খায়,
পুডি মাছে পান চাবায়।
অ-হো-হো হি-হি-হি-হি!
শফি ও মায়মুন দুজনে হেসে লুটোপুটি। শফি মাটি খুঁড়ে কেঁচো তুলে দেয়। মাছ কেঁচোর টোপ খায় ভাল।
মায়মুন আবার বড়শী নিয়ে বসে।
সন্ধ্যার পর সে শফির মা’র ঘরে যায়।
শফির মা বলে—আমার পানডা ছেইচ্যা দে তো, ময়ম। তুই ভালা ছেঁচতে পারস। শফি পারে না। ও দিলে কোনদিন খর বেশী অয়, আবার কোনদিন চুনা বেশী পড়ে।
প্রশংসায় মায়মুন খুশী হয়। কলাপাতায় জড়ানো পান খুলতে খুলতে মায়মুন বলে—কতটুকু নিমুগো, মামানি?
—আধ খান নে। তয় অডুকে গাল ভরে না। গাল না ভরলে কি পান খাইয়া সুখ আছে? কিন্তু কি করমু আর। গাছের পাতা, হেই-এর যে দাম! হোনলে মাথা ঘোরে। দুইডা পান
একটা পয়সা। আগে এক পয়সায় এক বিড়া পাওয়া যাইত।
মায়মুন ঠনর ঠনর করে পান ছেচতে আরম্ভ করে।
শফির মা আবার বলে—আইজকাইল বেবাক জিনিসই আক্রা। আগে এক টাকায় আধামণ চাউল মিলত। আমার বয়সেই দেখছি। আর অহন বেবাক জিনিসের উপর তন খোদার রহমত উইট্টা গেছে। আগে এক টাকার বাজার কিনলে এক মরদের এক পোঝা অইত আর অহন এক টাকার বাজার আতের তালুতে লইয়া বোম্বাই শহর যাওয়ন যায়।
শফির মা বলেই চলে—তোর মামু একটা ইলশা মাছ আনছিল দুই পয়সা দিয়া কিন্যা। তহন শফি অয় নাই। মফি আমার পেড়ে। এই এত বড় মাছটা। হেইডার একজোড়া আণ্ডা যা অইছিল—এই এক বিঘৎ লমফা। তখন আমার বুক জুইড়্যা ওর ভাই বইনে চাইর জন। কত খুশী অইছিল হেই আণ্ডা দেইখ্যা!
শফির মা আর পুরাতন স্মৃতি ঘাটতে সাহস পায় না। সে সব সময় ভুলে থাকতেই চেষ্টা করে। কিন্তু কথায় কথায় বা একা বসে থাকলে যখন সে স্মৃতি এসেই পড়ে, তখন সে আর সহ্য করতে পারে না। বিনিয়ে বিনিয়ে বিলাপ করতে শুরু করে। তার এই পঞ্চাশ বছর বয়সে সে নয় সন্তানের জননী। কিন্তু একমাত্র শফিই বেঁচে আছে—বাকী আটটির চারটি আঁতুড়েই শেষ হয়। এটি কলেরায় আর একটি বসন্তে মারা যায়। আর একটি—তার নাম মফি, শফির দুই বছরের বড় ছিল—দুর্ভিক্ষের বছর সে কোথায় হারিয়ে গেল! শফির মা আজও এ ছেলেটির আশা ছাড়ে নি। তার ধারণা মফি এখনও বেঁচে আছে।
মাঝে মাঝে শফির মা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলে—আমার ওরা বাঁইচ্যা থাকলে এই দশা আমার? আইজ আমি খরাত কইর্যা খাই! ওরা বাঁইচ্যা থাকলে আমার বাদশাই কপাল আছিল। ওরা কামাই করত। ও বউ আইত ঘরে। ওরা রাইন্দা-বাইড়া সামনে ধরত। সোনার খাটে বইস্যা, রূপার খাটে পাও রাইখ্যা আমি সব দ্যাখতাম আর হুকুম করতাম। নাতি-নাতকুড় ঘিরা বইত চাইর পাশে। ক্যাচম্যাচ করত কিচ্ছা হোননের লেইগ্যা।
শফির মা-র চোখ দিয়ে দরদর করে পানি গড়িয়ে পড়ে। মায়মুন দেখে আশ্চর্য হয় না। কারণ, এ আজ নতুন নয়। কখন সে কাঁদবে আর কখন কাঁদবে না—কেউ বলতে পারে। না। মায়মুন ছেচনীর থেকে ছেচা পান তুলে ধরে। শফির মা মুখে দেয়।
মায়মুন এবার বলে—একখান কিচ্ছা কও না, মামানি?
—না লো। আইজ আর পরাণড় ভালা ঠেকে না।
মায়মুন আর অনুরোধ করে না। শফির মা বলে—তুই একটু দেইখ্যা আয় তো শফি কি দিয়া কি রানদে। কয়ডা কলমীর শাক রানব আর ভাত। কাইল ভাত ফুটছিল কম। চাউল চাউল ভাত গিল্যা গিল্যা খাইছি। দাঁতদন্ত না থাকা আর এক জ্বালা।
মায়মুন রান্না ঘরে যায়। চুলোর ওপর বসানো ভাতের হাঁড়ি থেকে কয়েকটা ভাত। তুলতে তুলতে শফিকে বলে—একটা শোলক ভাঙ্গাও দেহি শফি ভাই–
মাছ করে ঝক ঝক ছোট্ট এক ঝিলে
একটা মাছে টিপ দিলে বেবাকগুলা মিলে।
ইশ, জবর শোলক ত। এইডা শিখা রাখছি কুট্টিকালে—ঝিল অইল আঁড়ি আর মাছ অইল ভাত! কেমুন? অইছে? এই বার একটা মাছে টিপ দিয়া দ্যাখ দেখি ফোটলনি?
মায়মুন একটা ভাতে টিপ দিয়ে বলে—অইয়্যা গেছে। দ্যাখত কেমুন মজা! একটা ভাতে টিপ দিলে বুঝা যায় ফোটলনি না ফোটল না।
—আর একটু ফোটতে দে। মা আবার শক্ত ভাত খাইতে পারে না।
—কাইল তুমি শক্ত শক্ত চাউল চাউল ভাত রানছিলা, মামানি কইছে। ভাত রানতেও জান না?
—আমি জানি না, কে জানে রে? টিক্কাদার সাবের বাসায় এতকাল পাক করলাম আমি। আইজ তুই আমারে হিগাইতে আইছস?
রান্না সেরে শফি ও মায়মুন ঘরে এলে শফির মা বলে—তোর মা অহনো আইল না, ময়মন? রাইত যে অনেক অইল!
বাইরে চ্যাবর চার পায়ের শব্দ শোনা যায়। উঠানে কাদার মধ্যে দিয়ে কে যেন আসছে।
শফির মা ডাকে—হাসুর মা?
—হ ভাজ, আমি অই।
—আহো আমার ঘরে।
জয়গুন এসে দরজায় দাঁড়ায়। শফির মা বলে—তোর হায়াত আছে। অনেক দিন বাছবি তুই। এই এটটু আগেই তোর নাম নিছিলাম।
—অহন যাই বইন। আখা ধরাইতে অইব আবার।
-আইচ্ছা যাও। আখা ধরাইয়া এটটু এদিকে আইও, তোমার লগে কতা আছে।
—কি কতা?
—পরে কইমু। অহন যাও চাউল কি দর আনলাগে?
—দুই সের, বইন। দর চইড়া গেছে। আর যা মছিবত আইজ কাইল। টারেনে যা মানুষের ভিড়। জেরের এই দুই কিস্তি ধইর্যাই এই রহম। আগে এমন ভিড় আছিল না।
জয়গুন পাক চড়িয়ে শফির মার ঘরে আসে। শফির মা বলে—কয়দিন ধইরা একটা কথা কইমু কইমু করতে আছি। কিন্তু সময় মত এটটু একখানে বইতে পারি না। তুমি থাকলে আমি থাকি না, আমি থাকলে আবার তোমার দাহাই মিলে না।
—কি কতা?
—কই, সবর কর। পান খাইলে একটু খা, ঐ দ্যাখ তোর পিছে পাতার মধ্যে।
জয়গুন পান খেতে খেতে বলে–কি কতা এই বার কও দেখি ভাজ।
—রাখ না, কই। আমার এই কাপড়ভা একটু তালি দিয়া দিবি। আমি আবার সুঁইয়ে সূতা গাঁথতে পারি না। ছাই, চউখটা এক্কেবারে গেছে।
—আইচ্ছা।
—ছিঁড়া কাপড় পিন্দা বাইরে যাইতে লজ্জা করে। তুই একটু সিলাইয়া দিলে তবু বেড় দিয়া পিনতে পারমু। তোর আতে সিলাইডা অয় ভালা।
–শফিরে দিয়া পাড়াইয়া দিও। এই এর লাইগ্যা বোলাইছিলা? জয়গুন উঠতে উদ্যত হয়।
—না, আরো কত আছে, ব’।
-কও কি কতা।
–ফকিরের লগে তোর দেহা অয় না, আঁ? তোরা ত কত দূরে দূরে যাস। একদিনও চউখে পড়ে না?
–উঁহু।
—দ্যাখ দেখি কেমুন বে-য়াক্কেইল্যা! কতদিন গুজারিয়া গেল, বাড়ীর পাহারা আর বদলাইয়া দিয়া গেল না। আমার ত রাইতে ঘুমই আহে না ডরে। তুইও আমল দিবি না।
—উহুঁ, পাহারা বদলাইতে অইব না আর। পাহারা না ছাই। ফুক্কা দিয়া টাকা নেওনের ছল—চক্কর।
—ছল-চক্কর! তুই যে কী কস্! আইচ্ছা সূর্যু-দীগল বাড়ীতে থাকতে তোর কি পরাণে ডর-ভয় লাগে না?
জয়গুন আবার উঠতে উদ্যত হয়।
শফির মা বাধা দেয়—ব’। আদত কথা তো অহনো কই নাই।
—কী আদত কতা, কও।
—তোরে আগেও কয়বার আমি কইছিলাম। তুই আমার কতা ঠেইল্যা দিলি।
—ঠেলমু না কি করুম?
—এইডা কি ঠেলুনের মত কতা!
–তয় কি?
—তোর ভাই বাইচ্ছা থাকলে তার কতা ঠেলতে পারতি? ধইরা বাইন্ধা কবে তোর নিকা দিয়া দিত।
—তুমি মোখ বোজ দেহি। তোমার ঐ এক বুলি আমার আর কানে সয় না।
—হেইয়া সইব ক্যাঁ? আমি তোর ভালার লেইগ্যা কই কি না। বয়স ত অহনো তিরিশ অয় নাই। অহনো গণ্ডা গণ্ডা বাচ্চা-কাচ্চা পেড়ে ধরনের বয়স আছে।
জয়গুন শ্রান্ত। সে মুখ নিচু করে বসে থাকে।
শফির মা বলে—দু পরধান মানুষ ভালা। তার পাঁচটা বলদ, তিনডা গাই। দশ মরাই ধান পায় বচ্ছর। জাগা-জমিনের ইসাব-কিতাব নাই। কাম আছে মানি। তয় আমি কই, যেইখানে কাম আছে হেইখানে ভাতও আছে। আর তোর ত একলা কাম করতে অইব না। আগের তিন জননা আছে পরধানের। চাইড্যা পোলার বৌ আছে। এক্কেরে সোনার বাগিচা হাজাইয়া রাখছে। ওরাই বেবাক কাম করব! তুই হুকুম দিয়া খাডাবি।
জয়গুনের মুখ ছাই-এর মত ফ্যাকাসে হয়ে যায়। সে কিছু বলতে পারে না।
শফির মা আবার বলে—পরধান কাইলও আমারে ধরছিল। আমি কইলাম, পোলা আর মাইয়াড়ার লেইগ্যাই যত মুস্কিল। হে কইল, তা পোলা আর মাইয়াডারে আমার বাড়ীতে লইয়া আইলেই ত অয়। কত মানুষ খাইয়া বাচে আমারডা। দুইডায় আর কি অইব! এইবার বিবেচনা কইরা তুই মোখ ফুইটা একটু হুঁ করলেই অইয়া যায়। সুখে থাকবি, কইয়া দিলাম।
খড়ের আগুনের মত দপ করে জ্বলে ওঠে জয়গুন—হুঁহ, আমারে তাড়াইতে পারলে লুইট্যা-লাপইট্যা ফলার কইর্যা খাইতে পারবা। তা মনেও জাগা দিও না, কইয়া দিলাম।
—তোবা! তোবা! তোর চীজ ছুঁইলে যেন আত খইয়া পড়ে, তোগ গাছের একটা পাতা ছিঁড়লে যেন রাইত না পোয়ায় আমাগ।
জয়গুন যেমন জ্বলে উঠেছিল, শফির মা-র কথায় আবার নিবে যায়। সে তার স্বাভাবিক কণ্ঠে এবার বলে—না বইন, বিয়া ত দুই খানেই অইল। অনেক দ্যাখলাম, অনেক শিখলাম, আর না। পোলা মাইয়ার মোখ চাইয়া আর পারুম না, মাপ করো। পোলা আর মাইয়াডার বিয়া দেইখ্যা যেন চউখ বুজতে পারি, দোয়া কইরো।
শফির মা নিরাশ হয়ে বলে—তোর ময়মনের বিয়া দে এইবার। একটা সম্বন্ধ আছে আতে।
—না, এত শিগগির কি অইল! যাউক আর দুই বচ্ছর।
—না, না। মাইয়া তোর বিয়ার লায়েক অইছে। আর ঘরে রাখন ঠিক না।
জয়গুন একটু চিন্তা করে বলে—কোথায় সম্বন্ধ আছে?
—সদাগর খাঁরে তুই ত চিনসই। তার নাতি-সোলেমানের ব্যাডা, নামড়া যেন কি! ভুইল্যা গেলাম বুঝিন, অহো মনে পড়ছে, ওসমান। ওসমান।
-ওঃ, ওসমান। ওসমান ত বিয়া করছে!
করছিল। বউ মইরা গেছে চৈত মাসে ভেদের ব্যারামে।
—কিন্তু পোলার বয়স যে অনেকখানি।
—তোর মাইয়াড়ার বয়সই কম কি।
—কম না? আমার মাইয়ার বয়স মোড়ে দশ, ধরতে গেলে দুধের মাইয়া আমার।
—দুধের মাইয়া! কি যে কস তোরা ছাই-মুণ্ডু। মাইয়ারা এই বয়সে বাচ্চা বিয়ায়। আমার মা-র এগারো বছরের কালে আমার জর্ম অয়।
শফির মার সাথে কথায় পেরে ওঠে না জয়গুন। সে বলে—আইচ্ছা ভাইব্যা চিন্তা দেহি। পরে কইমু। নছিবে যদি ঐখানে ভাত লেইখ্যা থাকে, তয় অইব। কার কোনখানে দানাপানি লেহা আছে, খোদা জানে। অহন যাই। ওদিকে আবার ভাতের আঁড়ি না ভাইঙ্গা চালায়।
বাইরে নামতেই চোখে পড়ে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। সে চারদিকে চেয়ে বলে—উত্তরে আর পুবে যে মেঘা করছে, ভাজ! আইজ বুঝিন আসমান শুদ্ধ ভাইঙ্গা পড়ব। আইজ আর উপায় নাই। এই বষাকালডা ভিজতে ভিজতে গেল। তোমার ঘরের চাল ত ভালা আছে। আমার চালে ছনই নাই।
—আমার চালে আর কই আছে? হেই কবে, গেল বচ্ছরের আগে ঠিক করছিলাম। তব বিষ্টি পড়ে ছয় সাত জায়গায়।
—কি করমু আর! কপালে আছে ভিজতে অইব, ভিজমুই। পাচটা ট্যাকাও একখানে করতে পারলাম না। ঘরের চাল ছাওয়াই কি দিয়া। উদর লইয়া আর পারলাম না। উদরেই যায় বেবাক টাকা।
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করেছে। জয়গুন ধরে যায়। মায়মুন রান্না শেষ করেছে।
—চালাক কইর্যা ভাত খা তোরা। আসমানের দিগে চাইছিলি? কাউয়ার আণ্ডার মতন কালা অইছে আসমান। আইজ আবার ঘরের মধ্যে সোত ছুটব। খাইয়া লইয়া উত্তরমুখি বিছানা সরা।
অসংখ্য ছিদ্রপথে বৃষ্টির পানি ঝরতে থাকে ঘরের ভেতরে। তা ছাড়া দক্ষিণে বাতাসের জন্য বৃষ্টির ঝাপটা দক্ষিণ দিকটায় লাগে বেশী। তাড়াতাড়ি খেয়ে তারা বিছানা সরায় উত্তর দিকে।
জয়গুন বলে—একটা কাঁথাও পাইড়্যা নেগ্যা। তারপর কুঁকড়ি মুকড়ি অইয়া শুইয়া থাক ভাই-বইনে।
বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করে জোরে। সত্যি সত্যি আকাশটাই ভেঙে পড়ছে যেন। এশার নামাজ পড়ে ছেলেমেয়ের শিয়রের কাছে তসবী হাতে বসে জয়গুন। সে তসবীর দানা গুণছে কি সময় গুণছে বোঝা যায় না। অনেকক্ষণ পরে বৃষ্টির বেগ কমে। কিন্তু বৃষ্টি পড়া বন্ধ হয় না একেবারে। এখন যে রকম অলস বর্ষণ শুরু হয়েছে, তাতে সারা রাতেও বৃষ্টি থামবার কোন লক্ষণ দেখা যায় না। জয়গুন কাঁথার ওপর হাত দিয়ে দেখে, কথাটা ভিজে গেছে। সে এক পাশে শুয়ে পড়ে।
হাসু হঠাৎ জেগে উঠে বলে—পায়ের কাছটা একদম ভিজ্যা গেছে, মা।
—তুই অহনো ঘুমাস নাই?
–উহুঁ।
–আত-পা কাঁকড়ার মত গুডিসুডি মাইরা পইড়া থাক।