» » দশ পরিচ্ছেদ

বর্ণাকার

দশ পরিচ্ছেদ

এমন দিন পড়েছে, এক মুহূর্তের জন্যেও সূর্যের মুখ দেখা যায় না। সারাদিন টিপিরটিপির বৃষ্টি পড়ে। হাসু ঘরের বার হয় না। শরীরটাও ভালো নেই। শরীরের সমস্ত গিঁঠে গিঁঠে বিশেষ করে ঘাড়ে টনটনে ব্যথা হয়েছে।

হাসু মা-কে বলে—গর্দানডায় বেদনা করেগো, মা। শীত শীত লাগে।

হাসুর গায়ে হাত দিয়ে জয়গুন শঙ্কিত হয়। ছেলেটা জ্বরে পড়লে উপায় নেই আর। বৃষ্টি-বাদলের মধ্যে ছেলেটাকে যে ভাবে সে কাজে পাঠায় তাতে এই ছোট শরীরটার ওপর জুলুমই করা হয়। কচি ঘাড়টার ওপরেই জুলুমটা হয় বেশী। অথচ এই ঘাড়টা তাদের জীবন-মরণের কল-কাঠি। তিনটি প্রাণীর জীবনের বোঝা মাথায় নিয়ে হাসুর এই কাঁচা ঘাড়টা মাঝে মাঝে ব্যথাকাতর হয়ে পড়ে।

জয়গুন নিষেধ করে থাউক, আইজ আর কামে যাওন লাগব না। কথা গায়ে দিয়া হুইয়া থাক। তোরে পইপই কইর‍্যা নিযুধ করি ভারী পোঝা মাতায় নিস না। তা হুনবি না।

বেশী লোভ করার জন্য মাঝে মাঝে নিজেকে ধিক্কার দেয় জয়গুন। তের বছরের এতটুকু ছেলে কামাই করে খাওয়ায় এই ত বেশি।

রোজগার করে সব পয়সা তার হাতে এনে দেয়। একটা পয়সাও এদিক-ওদিক করে না। এমন কি এক পয়সার চিনেবাদাম খেলেও তার হিসেব দেয় তার কাছে।

জয়গুন সর্ষের তেলের শিশি থেকে একটু তেল নিয়ে হাসুর ঘাড়ে মালিশ করতে করতে বলে—পায়ে তুঁইত্যার পানি দিছিলি কাইল?

–উহুঁ।

—হেইয়া দিবি ক্যান। দেহি কেমুন অইছে?

জয়গুন পায়ের ওপর থেকে কাঁথা সরিয়ে বলে— দ্যাখ, ক্যাদায় চামড়া খাইয়া ঝাঁজরা কইরা দিছে।

একটা নারকেলের মালায় তুঁতে গোলা নিয়ে আসে জয়গুন। হাঁসের পালক ভিজিয়ে হাসুর পায়ের তলায়, আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে এঁতের পানির পো দেয়।

হাস উ-হু-হুঁ করে ওঠে। বলে—আর দিও না, মা। বড় পোড়ায়।

—না দিলে চামড়া পইচা যাইব এক্কেরে। আঁটতে পারবি না। রাস্তা-ঘাটে যেই ক্যাদা।

জয়গুন নিজের পায়েও পুঁতে গোলা দিয়ে প্রলেপ লাগায়। মায়মুনের পায়েও লাগিয়ে দেয়। বাড়ীর উঠানে পর্যন্ত কাদা হয়েছে। পায়ের পাতা অবধি ডুবে যায় কাদায়। তুঁতের প্রলেপ দিলে পায়ের তলা অত হেজে যেতে পারে না।

পরের দিন চমৎকার রোদ ওঠে। জয়গুন হাসুর কপালে ও বুকে হাত দিয়ে দেখে। তার মুখের ওপর থেকে সমস্ত দুশ্চিন্তার মেঘ কেটে যায়। প্রভাতী রোদের মত তার মুখ আনন্দে চিকচিক করে। হাসুকে ডেকে সে বলে—ওঠ, দ্যাখ আইজ কেমুন রউদ ওঠছে!

হাসু উঠে বসে।

জয়গুন বলে—আমার ত ডরেই ধরছিলো। কাইল যেই রহম গরম আছিল শরীল। জ্বর ওডে নাই কপালের ভাগ্যি। কেমুন লাগছে রে শরীল?

—ভালা। আইজ কামে যাইমু, মা?

—আত-মুখ ধুইয়া আয়। খাইয়া তারপর চল যাই। আমিও যাইমু। চাউল ফুরাইছে। আহজ চাউল না আনলে ওই বেলা চুলা জ্বলব না।

হাসু, হাসুর মা কাজে বের হয়। হাসুর মা বার বার হাসুকে নিষেধ করে দেয়, খবরদার, ভারী পোঝা মাতায় নিবি না কিন্তুক। গর্দান ভাইগা যাইব।

কিন্তু হাসু দু’দিনের কাজ একদিনে করার সঙ্কল্প নিয়ে বাড়ী থেকে বেরিয়েছে। কাল কাজ হয়নি। আজ বেশী কাজ করে অন্তত কিছুটা পুষিয়ে নেওয়া তার চাই-ই।

হাসু নারায়ণগঞ্জ স্টেশনে আসে।

আজকাল যাত্রীর সংখ্যা খুবই বেড়েছে। বাইরের থেকে যেমন বহুলোক আসছে, আবার বাইরেও যাচ্ছে তেমনি। বিশ্রামঘরে গাদাগাদি হয়ে আছে লোক। জাহাজে গাড়ীতে জায়গা হয় না। অনেক যাত্রীকেই দু-তিন দিন স্টেশনে পড়ে থাকতে হয়। ছেলেমেয়ে মা-বউ নিয়ে আবার অনেক বিদেশী আশ্রয় নিয়েছে স্টেশনের চালা ঘরে।

হাসু মোটের সন্ধানে এদিক ওদিক ঘোরে আর এদের দিকে চায়। তার অদ্ভুত লাগে এদের পোশাক। এদের কথাও বোঝা যায় না—হাসু কাছে দাঁড়িয়ে শুনেছে! এক জায়গায় একটি স্ত্রীলোক রুটি সেঁকতে শুরু করেছে। দুটি ছেলেমেয়ের লোলুপ দৃষ্টি তার ওপর। রেল লাইনের পাশেও এক জায়গায় সে এরকম আরো অনেক লোক দেখেছে আজ। হাসুর মনে পড়ে দুর্ভিক্ষের বছরের কথা। এরকম ভাবে মায়ের সাথে সাথে গাছ তলায় কত রাত কেটেছে। বৃষ্টির মধ্যে আশ্রয় নিতে গিয়ে কত লোকের তাড়া খেয়েছে। হাসু অনুমান করে, নিশ্চয় ওদের দেশে আকাল এসেছে।

যাত্রীর সংখ্যা বাড়লেও হাসু সুবিধা করতে পারে না। নম্বরী কুলিদের জন্যে মোট ধরবার যো নেই। যাত্রী বেড়ে যাওয়ায় বরং অসুবিধা হয়েছে। ভিড়ের জন্যে ঘাটে জাহাজ। ধরবার আগেই জেটির গেট বন্ধ হয়ে যায়। নশ্বরী কুলি ছাড়া অন্য কুলিরা ঢুকতে পারে। না। সে পানি সাঁতরে স্টীমারে ওঠে। কিন্তু নম্বরী কুলিরা দেখতে পেলে মাথার ওপর গাট্টা মারে। হাসু এই কুলিদের খুবই ভয় করে।

ট্রেন ও স্টীমারের সময় হাসুর মুখস্থ হয়ে গেছে। একটা ট্রেন আসবে দশটায়। দশটা বাজবার এখনো দেরী। হাস রিক্সা স্ট্যান্ডের দিকে যায়। এগারোটার জাহাজে যারা যাবার তারা সাধারণত এখানেই নামে রিক্সা থেকে।

এক ভদ্রলোকের মালপত্র নিয়ে দু’জন নশ্বরী কুলির মধ্যে বচসা শুরু হয়েছে। হাসু দুরে দাঁড়িয়ে দেখে।

একটা কুলি বলেছোড়দে। আপনি কিসকো লিবেন, বাবুজি?

আর একটা রিক্সা এসে থামে। চড়নদার ভদ্রলোকের সাথে ছোট একটা স্যুটকেস ও বিছানা। বোঝাটা বেশী ভারী হবে না। হাসুর মাথার পক্ষে উপযুক্ত বোঝাই। হাসু এগিয়ে যায়। সুটকেস ধরে জিজ্ঞাসা করে—কলি লাগব নি, বাবু?

ঝগড়ায় রত কুলিদের একজন তার প্রতিদ্বন্দ্বী কুলিকে বোঝাটা ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে আসে। হাসুকে হাত দিয়ে সরিয়ে বলে—ভাগ ব্যাটা।

হাসু নিঃশব্দে সরে যায়। একটা লাইটপোস্টে পিঠ ঠেকিয়ে সে রাস্তার দিকে চেয়ে থাকে। রিক্সায় কোন যাত্রী এলে সে আগেই আন্দাজ করে, ঘাডে কুলাবে কিনা। তার উপযোগী মোট না হলে সে এক পা নড়ে না, লাইট পোস্টের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে সে দাঁড়িয়েই থাকে। অনেকক্ষণ পরে যদি বা মোট পাওয়া যায়, তাও নম্বরী কুলিদের ফাঁকি দিয়ে লওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।

দুরে হুইসিল শোনা যায়। একটা ট্রেন আসছে। হাসু স্টেশনে ঢোকে। ট্রেনেই যা কিছু সুবিধা করা যায়। এখানে নশ্বরী কুলিদের ফাঁকি দেওয়া যায়। পেছনের দিকের গাড়ীগুলোর থেকে মোট নিয়ে সরে পড়লে তারা দেখতে পায় না। কিন্তু এখান থেকে মোট বয়ে রিক্সায় তুলে মোট পিছু দু’আনার বেশী পাওয়া যায় না। পথ কম বলে দু’আনার বেশী আশাও করা যায় না। জাহাজের মোটে পয়সা বেশী। মোট পিছ চার আনা। এখানকার দুই মোটের সমান। কিন্তু খাটুনিও ডবল।

ট্রেন থামতেই হাসু চটপট উঠে পড়ে পেছনের একটা গাড়ীতে। একটা মোট দু’আনায় ঠিক করে। যাদের মালপত্র কম তারা এ রকম ছোট কুলিই খোঁজে। এদের দু’আনা দিলেই খুশী হয়। বড় কুলিরা চার আনার কমে রাজী হয় না।

হাসু গাড়ী থেকে নেমে দেখ-না-দেখ সরে পড়ে।

বারোটার মেল ও একটার স্পেশাল জাহাজ ধরে হাসু রোদে এসে দাঁড়ায়। তার সমান আকারের আরো পাচ-ছ’টি কুলিও গামছা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে আসে। ওভারব্রিজের রেলিং-এ সকলে সারি সারি গামছা রোদে দেয়।

গামছা পরে সাঁতার দিয়ে স্টীমারে উঠতে হয় তাদের। নশ্বরী কুলি ছাড়া জেটির দরজা দিয়ে অন্য কুলিরা ঢুকবার সুযোগ পায় না। তারা সাঁতার দিয়েই অনেক সময় স্টীমারে ওঠে।

হাসু ও অন্যান্য খুদে কুলিরা বসে বসে গল্প করে। একজন একটা বিড়ি ধরায়, কয়েকজন তার দিকে হাত বাড়িয়ে চেয়ে থাকে, কে কার আগে নিয়ে টানবে। একজন বলে—শীত লাগছেরে। দে দেহি বিড়িডা, একটা টান দিয়া লই।

আর একজন বলে-ওয়াক থু ওর মুখের বিড়ি টানিস না। ছি! ও মেথরের পোলা।

—মেথর বুঝি মানুষ না? রমজান বলে।—পয়সা পাইলে মেথর-গিরিও করতে পারি চাই পয়সা। রমজান হাতে তুড়ি দিয়ে দেখায়।

জনপ্রতি দুটো করে টান দেয়ার পর ফেলে দেয়া হয়েছিল বিড়িটা। যে ছেলেটা মেথর বলে থুক ফেলেছিল, সে এবার বিড়িটা তুলে টানতে আরম্ভ করে।

একটা ছেলে গলা ছেড়ে সিনেমার গানে টান দেয়–মালতী লতা দোলে—

রমজান হাসুকে ডাকে—ও দোস্ত খুব ভালা একটা সিনেমা আইছে। যাইবেন নি আইজ?

হাসু বলেনা দোস্ত মা রাগ করব।

—চলেন না আইজ। তিন আনার পয়সা মোডে। আমার গাঁটের পয়সায়ই না অয় দেখবেন।

–উহুঁ।

রমজান আর পীড়াপীড়ি করে না।

রমজান হাসুর বন্ধু ও খুদে কুলিদের সরদার। রমজানকে সবাই ভয় করে। তার কথামত সবাইকে চলতে হয়। তবে হাসুকে খুবই খাতির করে সে।

রমজান বলে—তরশুর তন তোরা আমার লগে এক জায়গায় কামে লাগবি।

হাসু জিজ্ঞাসা করে—কোনখানে দোস্ত?

—হোসেন দালালের নাম হোনছেন? নতুন ধনী হোসেন দালাল?

একজন বলে—হ্যাঁ হ্যাঁ, চিনছি। পাডের দালালি কইর‍্যা বস্তাবস্তা ট্যাকা করছে ব্যাডা।

রমজান বলে–হ্যাঁ, হেই হোসেন দালাল! খানপুরে তেতলা দালান খিঁচব এইবার। হেই জায়গায় কাম আছে।

—ইট ভাঙ্গবি, ইট টানবি, পানি তুলবি। এক ট্যাকা কইর‍্যা রোজ।

সবাই রাজী হয়।

রমজান আবার বলে—আমারে মাথা পিছু সরদারি দিবি এক আনা কইর‍্যা। দ্যাখ, যদি মনে খাডে লাইগ্যা যা তোরা সবাই।

এখানে সারাদিনে দশ বারো আনার বেশী পাওয়া যায় না। কোনোদিন তার চেয়েও কম পাওয়া যায়। সুতরাং কেউ অমত করে না।

ছয়টার ট্রেন ধরে হাসু পয়সার হিসাব করে। মাত্র তেরো আনা হয়েছে। একটা টাকার কাজও হল না। কোমরে বাঁধা জালির মধ্যে পয়সাগুলো খুঁজে সে এক জায়গায় বসে। হাসুর সাথীরা সব চলে গেছে। রোজ এমন সময় সেও বাড়ীর দিকে পথ নেয়। কিন্তু আজ সাতটার স্টীমারটা দেখেই যাবে সে। মা হয়তো বসে থাকবে তার জন্যে। দেরী হলে রাগ করতে পারে। কিন্তু একটা টাকা পুরিয়ে নিলে রাগ না করে সে হয়তো খুশীই হবে।

ছড়ি হাতে এক ভদ্রলোক হাসুর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হাত থেকে সিগারেটের শেষাংশ ছুঁড়ে ফেলতেই হাসু মাটি থেকে তা কুড়িয়ে নিয়ে টানতে আরম্ভ করে। দোস্তের পাল্লায় পড়ে কয় দিন হয় সে বিড়ি টানতে শিখেছে। ঠাণ্ডার মধ্যে বিড়ি টানতে মন্দ লাগে না হাসুর।

সাড়ে সাতটার পরে স্টীমার আসতে দেখা যায়। হাসু তিন নম্বর জেটির দিকে দৌড়ায়। গেট বন্ধ হয়ে গেছে। হাসু ফিরে এসে গামছা পরে লুঙ্গিটা বেঁধে নেয় মাথায়।

স্টীমারটা ঘাটে ধরতেই সে তার দেয়। আজ একা একা তার ভয় করে। অন্য সময় ছয় সাত জন মিলে নদীর পানি তোলপাড় করতে করতে তারা জাহাজে ওঠে।

যে ফ্লাটের গায়ে স্টীমারটা ধরেছে তার একটা কাছি বেয়ে বেয়ে সে আগে ফ্লাটের ওপর ওঠে। লুঙ্গি পরে গামছার পানি নিঙরে সে শরীরটা মুছে নেয়। তারপর ফ্লাটের কিনারার সরু পথ ধরে ধরে স্টীমারে উঠবার সিঁড়িতে যায়। ভিড় গলিয়ে এবং নম্বরী কুলিদের চোখ এড়িয়ে সে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে।

এক মোটা ভদ্রলোক কুলির সাথে দরাদরি করছেন—চার আনায় যাবে? অল্প মাল আমার, সব শুদ্ধ দশ সেরও হবে না।

—ছয় আনা রেট আছে সাব। কমে অইব না।

—না, যাও। চার আনার বেশী দেব না আমি। কুলিটা চলে যেতেই হাসু এগোয়—কুলি লাগব নি, বাবু।

লাগবে ত। কত নিবি? —আপনে খুশী অইয়া যা দ্যান।

—তবে মাথায় নে। চল জলদি।

মোট মাথায় নিয়ে হাসু অনুমান করে—কোথায় দশ সের? স্যুটকেসটার ওজনই বিশ সেরের কাছাকাছি হবে। যেন সীসা ভরা আছে স্যুটকেসটায়। তার ওপর বিছানা। হাসুর মাথায় ভারী লাগে বোঝাটা। ভদ্রলোক এবার ওপর থেকে খবরের কাগজ ও একটা হাতব্যাগ নিয়ে হাসুর হাতে চাপিয়ে দেন।

জেটি পার হবার সময় একজন ডাকেন—আরে রশীদ, তোর জন্যে সাড়ে ছ’টা থেকে অপেক্ষা করছি। তোর বাড়ীতে খবর নিয়ে জানলাম তুই আজ আসছিস।

দু’জনের করমর্দন ও কুশলবার্তার পরে আলম সাহেব বলেন—তোর জন্যে অপেক্ষা করছি কেন জানিস?

—আরে হ্যাঁ—হ্যাঁ। কোথায় বল দেখি?

প্যারাডাইসে, হজ্জতুল্লা আর নির্মল বসে আছে। তুই না হলে যে জমেই না।

রশীদ সাহেব বলেন—যে রকম দেখছি তাতে পাকিস্তানে সোমরস পান বুঝি আর সম্ভব হবে নারে।

সব বে-রসিক।

আলম সাহেবের সাথে রশীদ প্যারাডাইস ক্যাফেতে গিয়ে ওঠেন।

হাসুকে বলে যান—তুই বোস এখানে বাইরে।

হাসু মোট নামিয়ে বসে থাকে। ক্যাফের ঘড়িতে ন’টা বাজে। কিন্তু সাহেবের বের হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যায় না। বসে থাকতে থাকতে হাসুর বিরক্তি ধরে যায়। একবার মনে হয়—স্যুটকেসটা নিয়ে ভেগে গেলে কেমন হয়? কিন্তু তারপরই সে নিজেকে শুধরে নেয়।

রশীদ সাহেব বাইরে এসে চলতে আরম্ভ করেন। হাসু অনুসরণ করে। ওভারব্রিজের কাছে আসতে হাসুর পা আর চলতে চায় না। বোঝা মাথায় সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠা খুবই কষ্টকর। ক্ষুধায় হাসুর শরীর দুর্বল। তার ওপর এমন ভারী বোঝা।

হাসু বলে—একটু ধরেন, জিরাইয়া লই।

—চলে আয়। এতটুকুর জন্যে জিরিয়ে কাজ নেই, বাবা। বেশী দূরে নয়, কাছেই আমার বাড়ী-রশীদ সাহেবের মুখ দিয়ে জড়িয়ে জড়িয়ে বের হয় কথাগুলো।

রশীদ সাহেব না থেমে ওভারব্রিজের ওপর দিয়ে এগিয়ে যান। হাসু এক সিঁড়ি দুই সিঁড়ি করে উঠতে থাকে। তার পা কাঁপে। ঘাড়টা চাপ খেয়ে মচকে যাবার মত হয়।

রশীদ সাহেবের আগমনে তার ছেলেমেয়েদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেছে। তাদের আনন্দ কোলাহলে মুখর হয়ে ওঠে বাড়ীখানা। ছোট ছেলেটিকে কোলে তুলে নিয়ে অন্য দুটির হাত ধরে তিনি অন্দরে ঢোকেন। একটি চাকরাণী এসে হাসুর মাথার মোট নামিয়ে নেয়। হাসু দাঁড়িয়ে থাকে বাইরে!

রাত হয়ে যাচ্ছে অনেক। কিন্তু তাকে পয়সা দেয়ার কথা বোধ হয় মনে নেই কারো।

অনেকক্ষণ পরে হাসু সাহস করে বলে—আমারে বিদায় করেন সা’ব।

রশীদ সাহেবের ছেলে মজিদ হাসুকে ডেকে নিয়ে যায় ভেতরে।

রশীদ সাহেব তখন বিরাট বপু বিস্তার করে শুয়েছেন। মজিদকে বলেন, পকেট থেকে তিন আনা বের করে দিতে।

হাসু আপত্তি করে—তিন আনা কম অইয়া যায় সা’ব।

—কম! বলিস কী, অ্যাঁ!

—জাহাজের তন রিকসায় উড়াইয়া দিলেই ত চাইর আনা দেয়। আর এইডা ত অনেকখানি দূর। আবার দেরী অইল কত!

—নে তোল পয়সা।

—না সাব, পাঁচ আনার কম নিমু না।

মজিদ বলে—বাপরে! এখান থেকে এখানে পাঁচ আনা! এক মিনিটের পথ না, এত পেলে ত রাজা হয়ে যাবি।

হাসু নাছোড়বান্দা।

রশীদ সাহেব এবার ডাকেন—এই ছোঁড়া, আয় পাঁচ আনাই দেব। তবে হাত-পাগুলো টিপে দে ত আমার। ভালো করে তেল মালিশ করে দে।

–না সাব আমি পারতাম না। আমার দেরী অইয়া গেছে।

–অ্যাঁ, পারবিনে? গর্জে ওঠেন রশীদ সাহেব। বিছানার ওপর মেদবহুল শরীরখানা দুলিয়ে তিনি বলেন—এমনি এমনি তোমাকে পাঁচ পাঁচ গণ্ডার পয়সা দেব? আমি কন্ট্রাক্টর। কড়ায় গণ্ডায় কাজ আদায় করে পয়সা দিই। হ্যাঁ—হ্যাঁ—হ্যাঁ।

ইসু রশীদ সাহেবের পায়ের কাছে বসে তার পায়ে তেল মালিশ করতে শুরু করে।

তেল-মালিশ নেওয়া রশীদ সাহেবের অনেক দিনের অভ্যাস। শোবার আগে রোজ হাত পা টিপিয়ে না নিলে তাঁর ঘুম হয় না। কালকাতা থাকতে এ ব্যাপারে সুবিধে ছিল অনেক। চার আনা দিলে অব ঘটা বেশ হাত-পা বানিয়ে নেয়া যেত। রাত ন’টার সময় বাসার দরজায় এসে রোজ চীৎকার করে উঠত-মালিশ, তেল মালিশ। বাড়ীতে সে সুবিধে না। থাকায় কি-চাকর দিয়েই চলে সে কাজ।

দশটা বাজে। পা টিপতে টিপতে হাস অন্যমনস্ক হয়ে যায়। মা-র কথা মনে পড়ে। রেল-রাস্তার ধারে মা তার পথ চেয়ে আছে। এতক্ষণ এ লোকটার ব্যবহারে তার মনটা বিষিয়ে উঠেছিল। তাই ক্ষুধা-তৃষ্ণার কথা তার মনেই ছিল না। কিন্তু এখন ক্ষুধায় তার হাত-ল অবশ হয়ে আসে। পেটটা ব্যথা করতে আরম্ভ করে।

মা-র কথা ভাবতে ভাবতে পাটেপা এক সময়ে বন্ধ হয়ে যায়।

রশীদ সাহেব বলেন—কিরে, থামলি কেন? কি টেপা টিপিস? গায়ে কী জোর নেই বাপ? খোট্টারা এ কাজে ভারী ওস্তাদ। কলকাতায় ভুলুয়া বলে একটা খোট্টা রোজ আসত আমার বাসায়। চমৎকার টিপতে পারত সে। আর তুই টিপিস, আমার গায়েই লাগে না। মনে হয় পিপড়ে হাঁটছে শরীর বেয়ে।

কতক্ষণ পরে আবার বলে—এবার হাতের দিকে আয়।

রশীদ-গৃহিণী চা হাতে থমকে দাঁড়ান। তিনি রুক্ষস্বরে বলেন—ওঃ সব কাজেই ঠিকাদারী! আচ্ছা কি আক্কেল তোমার! কার ছেলেকে তুমি এ রকম করে আটকে রেখেছো?

রশীদ সাহেব বলেন—আমার নাম রশীদ কন্ট্রাক্টর। কড়াক্ৰান্তি পর্যন্ত আদায় করা চাই আমার। এই ছোড়া, এবার হাতগুলো টিপে তারপর যাবি।

চায়ের কাপটা রেখে রশীদ-গহিণী বলেন—থাক আর হাত টেপাতে হবে না। কেন তুমি পরের ছেলেকে কষ্ট দেবে?

হাসুর দিকে ফিরে আবার বলেন—আয় ত বাবা। আহা! কার ছেলে গো! তোর কি মা-বাপ নেই?

সহানুভূতির কথায় এবার হাসুর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরে।

রশীদ—গৃহিণী হাসুর মুখ দেখে বিস্মিত হন। নিজের আঁচলে চোখ মুছিয়ে তিনি বলেন—দুপুরে খাসনি কিছু? আহা! মুখখানা শুকিয়ে কেমন হয়েছে।

মায়ের মন ক্ষুধাতুর সন্তানের জন্যে ব্যথিত হয়। তার চোখও শুকনো থাকে না।

তিনি হাসুকে খাবার ঘরে নিয়ে যান। একটা থালায় ভাত ও দুটো পেয়ালায় তরকারী দিয়ে হাসুর সামনে দেন।

ভাতের দিকে চেয়ে হাসর চোখে ভাসে—মা তার আশায় সন্ধ্যা থেকে বসে আছে। মায়মুন বাড়ীতে ক্ষুধায় কাতরাচ্ছে। বাড়ী গেলে রান্না হবে। তারপর খাওয়া হবে সকলের। হাসুর চোখ দিয়ে এবার বেশী করে পানি ঝরতে থাকে।

রশীদ-গৃহিণী বলে চলেন—খেয়ে নে বাছা আমার। কাঁদিস নে আর।

হাসু জোর করে এক মুঠো ভাত মুখে দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ভেতরে ক্ষুধার তাগিদ চাপা পড়ে গেছে।

সে হাত ধুয়ে উঠে পড়ে। বলে—আমি যাই।

—কিছুই তো খেলিনে। শান্ত হয়ে খেয়ে এখানেই থেকে যা আজ।

—উহুঁ, আমি যাই।

–বাড়িতে কে আছে তোর?

হাসু কোন উত্তর দিতে পারে না।

রশীদ-গৃহিণী একটা টাকা এনে হাসুর হাতে দেন। অনেক দ্বিধার সঙ্গে টাকাটা নিয়ে সে বেরিয়ে যায়। রশীদ-গৃহিণী চেয়ে থাকেন ছেলেটার মুখের দিকে। তার মেজ ছেলের কিছুটা ছাট আসে ওর মুখে। তখন কলকাতায় দাঙ্গা। ছেলেটি একদিন তার সাথে রাগ করে সামনের ভাত ফেলে বেরিয়ে গেল রাস্তায়। আর ফিরল না…

হাসু সিঁড়ির গোড়ায় নেমে একবার ফিরে তাকায়। রশীদ—গৃহিণীর চোখ থেকে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।

ঢং-ঢং, ঢং-ঢং–এগারোটার ঘণ্টা। পথে আসতে আসতে হাসু শোনে।

যেখানটায় রোজ কোষা রাখা হয়, সেখানে এসে দেখে, মা বসে নেই। কোষাটাও নেই।

মা তার উপর রাগ করেই চলে গেছে, সে বুঝতে পারে।

হাসু অন্ধকারের মধ্যে হাত কচলাতে শুরু করে। রাতটা কোথায় কাটান যায়? দোস্তের বাড়ী অনেক দূরে, তাও আবার নদীর ওপারে। এত রাতে খেয়া পাওয়া যাবে না।

নিরুপায় হয়ে হাসু কয়েক পা হেঁটে ছোট রেলস্টেশনটার চালা ঘরে গিয়ে ওঠে। রাতটা এখানে কাটান যাবে। কিন্তু ক্ষুধা পেয়েছে খুব। এত রাত্রে খাবার কিছু পাবার যো নেই। দু’মাইল হেঁটে চাষাড়া পর্যন্ত গেলে কিছু কিনে খাওয়া যেত। কিন্তু তার এক পা হাটতেও আর ভালো লাগে না।

হাসু বসে পড়ে। যখন বসতেও খারাপ লাগে তখন এক সময়ে গামছা বিছিয়ে সে শুয়ে পড়ে। শুয়ে শুয়ে সে বাড়ীর কথা মনে করে।

মায়মুনকে খাইয়ে মা নিজে না খেয়ে শুয়ে শুয়ে তার কথাই ভাবছে। তাকে না খাইয়ে সে কোনদিন একমুঠো ভাত মুখে দেয়নি, আজও দিতে পারে না। মায়ের কথা ভাবতেই আরো একজনের কথা তার মনে পড়ে। মায়ের মুখের পাশে, মায়ের মর্যাদা নিয়ে যে একখানা মুখ। তার চোখের সামনে ভাসে, সে মুখখানা রশীদ-গৃহিণীর।

রাত বারোটার পরে আর কোনো ট্রেন নেই। ট্রেনটা চলে যাওয়ার পর স্টেশনে লোক দেখা যায় না।

সব নিস্তর। মাঝে মাঝে দুর থেকে সমবেত চিৎকার ভেসে আসে—আল্লা আল্লা বল ভাইরে মোমিন

কোথাও কলেরা-বসন্ত লেগেছে। তার জন্যেই খোদাই শিরণী হচ্ছে, হাসু বুঝতে পারে। চিৎকার শুনে তার শরীরের লোম কাটা দিয়ে ওঠে।

জয়গুন সন্ধ্যার পরেই এসেছিল। পথ চেয়ে চেয়ে তার মেজাজ গরম হয়ে ওঠে ছেলের ওপর। ন’টার সময় সে নিজেই কোষাটা বেয়ে বাড়ী চলে যায়। কিন্তু বাড়ীতে পা দিয়েই তার ধারণা পাল্টে যায়। হাসু তার সে ছেলে নয়! তার কাছে না বলে কোথাও সে যায় না। দোস্তের বাড়ী গেলে তার কাছে বলেই যেত।

জয়গুনের মাথার মধ্যে নানা রকমের দুশ্চিন্তা তাল পাকাতে আরম্ভ করে।

কাল শরীর গরম ছিল, আজ হয়তো জ্বর হয়ে কোন গাছতলায় পড়ে আছে। পানি সাঁতরে স্টীমারে উঠতে হয়। তবে কি স্রোতে ভেসে গেল? নদীতে কুমীর থাকে। কুমীরেও টেনে নিয়ে যেতে পারে। কিছুই অসম্ভব নয়।

জয়গুন কুপি জ্বালে। মায়মুন ভূতের ভয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে আছে।

জয়গুন কাঁথা সরিয়ে দেখে মায়মুন ঘুমিয়ে আছে। সে আর মায়মুনকে ডাক দেয় না। এখন ওকে তুললেই ভাতের জন্যে কাঁদবে। ঘুমিয়ে থাক, সেই ভালো। আজ জয়গুনের চুলো ধরাবার শক্তিটুকুও নিঃশেষ হয়ে গেছে। খাঁচার নিচে বড় ইসি দুটোও দেখা যায় না। বর্ষার দিনে পাতিশিয়ালে নেওয়ার কথাও নয়। বোধ হয়, কেউ ধরে রেখেছে কিম্বা জবাই করে খেয়েছে।

জয়গুনের কাছে সমস্ত দুনিয়াটা এলোমেলো মনে হয়।

মায়মুনের পাশ দিয়ে সে শুয়ে পড়ে। এবার দুশ্চিন্তার দুর্বার স্রোত মাথায় ঢুকবার সুযোগ। পায়। জয়গুন ভাবে—তবে কি গাড়ী চাপা পড়ল? হয়তো কিছু চুরি করায় পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে।

এমনি আরো অনেক চিন্তা তার মনে আসে। একটা কিছুক্ষণ ভাবার পর সেটাকে সরিয়ে আর একটা নতুন দুশ্চিন্তা এসে আঁকিয়ে বসে মনে।