পনের পরিচ্ছেদ
আজকাল করিম বক্শ কাসুকে কড়া নজরে পাহারা দেয়। যত দিন মাঠ-ভরা পানি ছিল ততদিন কালাপানির বন্দীর মত ছিল কাসু। কিন্তু মাঠে পথ পড়ার সাথে সাথে করিম বক্শ চিন্তিত হয়। তার মনে আশকা জাগে—কাসু হয়তো একদিন ফুড়ুত করে ওর মা-র কাছে চলে যাবে। সেদিন আর একটু আগে দুধ বেচতে বেরিয়ে গেলে সর্বনাশ হয়েছিল আর কি!
করিম বক্শ আঞ্জুমনকে সতর্ক করে দেয়—কানা বুড়ী আমার বাড়ীতে পাও বাড়াইলে ঠাগা মাইর খোড়া কইরা দিবা। আমার তিরিসীমানায় দ্যাখতে পাইলে, ওর আর এট্টা চোখ কানা কইর্যা ছাইড়া দিমু। আমার তুমড়ীবাজি অহনও দ্যাহে নাই বুড়ী!
আঞ্জুমন করিম বকশের হৃদয় জয় করার মতলব নিয়ে বলে—বুড়ীরে দ্যাখলে ভাল। মানুষ বুইল্যা মনে হয়। কতাও কয় যেন মিছরির শরবত। দিলের মধ্যে এত কালি কে জানে!
কানা বুড়ীর দোষকীর্তন করায় আমনের ওপর করিম বক্শ মনে মনে খুশী হয়। কিন্তু সে তাকে বিশ্বাস করে না। সন্দেহ হয়—কাসুর মাথাটা হয়ত ইতিমধ্যেই আঞ্জুম বিগড়ে দিয়েছে। ঘরে-বাইরে এ রকম ষড়যন্ত্র অসহ্য। কোন রকমে মনের গোস্বা মনে চাপা দিয়ে সে কাসুকে পাহারা দেয়। বাইরে গেলেও সে কাসুকে সাথে করে নিয়ে যায়। যেদিন সাথে নেয়া সম্ভব হয় না, সেদিন গরুর দড়ি দিয়ে খুঁটির সাথে বেঁধে রাখে কাসুকে।
কয়েকদিন ধরে ধান কাটার ধুম পড়েছে। করিম বকা তার নারকেলের কোটা কাসুর হতে দেয়, আর আগুনের মালসাটা নিজের হাতের তালুতে বসিয়ে অপর হাতে দুটো কাস্তে নিয়ে মাঠে রওয়ানা হয়।
কাসুর হাতে একটা কাস্তে দিয়ে বলে—আমার লগে থাইক্যা ধান কাটতে হিগ। বড় অইলে এই কইর্যা খাইতে অইব।
কাসু তার ডান হাতের ছোট্ট মুঠোর মধ্যে কাস্তের মোটা হাতল ভালো করে সামাল দিতে পারে না। কোন রকমে হাতলটা চেপে ধরে সে দু’একটা করে ধানের ছড়া কাটতে আরম্ভ করে।
মাঠে আরো অনেক জমিতে ধান কাটা শুরু হয়েছে। দুরের একটা জমি থেকে কৃষাণদের সমবেত গান ভেসে আসে–
কচ-কচ কচ কচ-কচা-কচ
ধানরে কাটি,
মুঠা মুঠা ধান লইয়া বান্দি আঁটি-রে।
(ও ভাই) ঝিঙ্গাশাইলের হুড়ুম ভালা
বাঁশফুলেরই ভাত,
লাহি ধানের খইরে ভালা,
দইয়ে তেলেসমাত—রে।
কস্তুরগন্ধী চাউলরে আলা,
সেই চাউলেরি পিঠা ভালা,
সেই না পিঠায় সাজিয়ে থালা
দাও কুটুমের হাত—রে।
আল্লাদি বউ কোটে চিড়া
মাজায় রাইখ্যা হাত,
সেই না চিড়ায় কামড় দিয়া
বুইড়ার ভাঙে দাঁত—রে।
মিয়া বাড়ী ঘটক আসে
কন্যা-বিয়ার কথার আশে,
বোরো ধানের ভাত খাওয়ানে
মিয়ার গোল জাত—রে।
পাশের একটা জমিতে আলোচনা হচ্ছে। একজন বলে—আমরা হেদিন বৈঢকে ঠিক করলাম, সাতভাগা অইলে কেও ধান কাটতাম না। কিন্তুক দ্যাখ, ছমিরদ্দির দল সাতভাগায় গদু পরধানের ধান কাটতে শুরু করছে।
আর একজন বলে—আবার গানও লাগাইছে ফূর্তির ঠেলায়।
—হেইয়া করব না! বেয়াক্কেলরা এড়কও বোঝে না, এই বারের যেই প্রান, তা সাত ভাগের এক ভাগ নিয়া কি ওগ বাপ-মার ফত্তা করব?
—এই বচ্ছর যে ধানের অবস্থা, এই রহম অইব কে কইছিল? জুইতের ধান অইলে না অয় সাত ভাগায় কিছু অইত। কিন্তু একটা ধানের ছড়ার মধ্যে চাইর আনাই মিছা।
বর্ষার সময় ধানগাছের রকম দেখে অনেকেই অনেক আশা করেছিল। কিন্তু সবুজ ধান যখন সোনালী রঙ ধরতে শুরু করে, তখন চাষীরা ধানের ছড়া দেখে মাথায় হাত দেয়। এক একটা ছড়ার মধ্যে চার আনা ধানই অপুষ্ট—চালশূন্য চিটে। এখানে সেখানে ধানগাছ মরে যাওয়ায় জমিগুলো টাক পড়া মাথার মত হয়ে আছে।
করিম বক্শ কয়েক ‘ঘোপ কেটে আলের ওপর এসে পা ছড়িয়ে বসে। পাশের জমি থেকে ধানকাটা রেখে লেদু মিয়া আলের দিকে আসতে আসতে বলে—ভালা কইর্যা তামুক সাজ, চাচা। একটা দম দিয়া যাই।
করিম বক্শ বাশের ডিবা হতে তামাক নিয়ে সাজতে থাকে। অদূরে বসে কাসু ধানগাছের ডগা দিয়ে বাশী তৈরী করার চেষ্টা করছে। সুর্য-দীঘল বাড়ীর তালগাছটা বেশী দুরে নয় এখান থেকে। গাছটা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে।
লেদু বলে—কাসুরে এই মাথা-ফাড়া রউদের মইদ্যে লইয়া আইছ কাঁ, চাচা? ওরে বাড়ীতে রাইখ্যা আইলেই পার।
—এহন এন্টু আধটু রউদ মাথায় না নিলে অইব ক্যাঁ? নোয়াব সাইজ্যা বইয়া থাকলে ত কাম অইত না। আর এই শীতের মিডাম রউদে তেজ নাই।
—তেজ নাই। তয় বড় হুকনা রউদ। দ্যাই না, চউখ-মোখ টানতে শুরু করছে। কাসুর হাত থেকে ধানগাছের নলটা নিয়ে লেদু বলে—দে, বানাইয়া দেই। বাশী তৈরী করতে করতে লেদু বলে—মাইয়ার বিয়াতে গেলা না যে চাচা? তোমার পরাণ কি দিয়া বানাইছে খোদায়? পাথর না পোড়া মাড়ি দিয়া কও দেহি? মায়া-দয়া কি এক্কেরেই নাই তোমার পরাণে? কাসুর মা–
করিম বশের ভ্রূকুটি ক্ষণেকের জন্য লেদুর মুখ বন্ধ করে রাখে। সে কাসুর দিকে বাঁশীটা ছুঁড়ে দিয়ে আবার শুরু করে—তুমি অমুন কর ক্যাঁ, চাচা? কাসু বড় অইয়্যা ওর মা-রে বিচরাইয়া–
করিম বক্শ সাজানো কল্কেটা হুঁকোর মাথায় না বসিয়ে ছুড়ে মারে লেদুর দিকে, চচিয়ে ওঠে—চুপ কর শয়তানের বাচ্চা! মশকারির জাগা পাস না? মানুষ চিনস না তুই?
লেদু ঘাড় নিচু করে আত্মরক্ষা করে। তার মাথার ওপর দিয়ে শো করে কল্কেটা ধানগাছের ঝোপের মধ্যে গিয়ে পড়ে।
আশেপাশের জমি থেকে কুষাণরা ছুটে আসে—কি অইল? কি অইল?
লেদুই বলে–কিছুই না। যাও তোমরা।
লেদু কল্কেটা তুলে গামছা দিয়ে মুছতে মুছতে বলে—রাগ করলা নি, চাচা? আর কোনোদিন কিছু কইমু না। এই কান ডলা খাইলাম দশবার।
করিম বক্শ তখনও রাগে গর গর করছে।
লেদু নিজেই এবার তামাক সেজে হুঁকোটা করিম বকশের হাতে দেয়। তারপর বলে—তোমার জমিনে এইবার ধানে বরাদ্দ নাই। আমাগ লগে ধান কাটতে যাইবা? খুরশীদ মোল্লার বটতলার ক্ষেতে ধান মন্দ অয় নাই। দিবও ছয় ভাগা।
করিম বকশের রাগ থামে। তার বদমেজাজের জন্য কেউ তাকে দলে নিতে চায় না। লেদুর এ প্রস্তাবে সে খুশী হয়। বলে—কবে যাইবা তোমরা?
—এই জমিনের ধান কাডা অইলে। তুমিও তোমার জমিনের ধান কাইট্যা কাবার কর।
–কাবার আমার কাইল অইব। পাতলা পাতলা ধান কাটতে দেরী লাগে না। এইবার তিন মাসের খোরাকীও অইব না। গেল বছর ছয় মাসের ধান পাইছিলাম। এহন তোমরা যদি দলে নেও, তয়ই না বাঁচতে পারমু।
—তোমারে দলে নিতে ত আপত্তি নাই! আপত্তি কিয়ের লেইগ্যা জানো? তোমার মেজাজের লেইগ্যা দলের কেউ রাজী হয় না। যাউকগ্যা, আমি বেবাকেরে বুঝাইয়া ঠিক কইর্যা নিমু। তুমি তোমার মেজাজ খান ঠাণ্ডা কর। আর একটু অইলে আইজ আমার। মাথাডা ফাড়াইয়া দিছিলা আর কি!
করিম বকশের নিজের জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে। খুরশীদ মোল্লার বটতলার খেতে ধান কাটতে যাবে সে। কিন্তু কাসুকে আর পেছনে টানতে ভাল লাগে না। বটতলার খেত অনেক দূরে। রোদের মধ্যে এত দূরে নিয়ে ছেলেটাকে বসিয়ে কষ্ট দেয়া তার ইচ্ছে নয়। এ কয় দিনে ছেলেটা শুকিয়ে গেছে। তার চোখ-মুখের দিকে তাকালে মায়া হয়। আর যে ভয়ে সে কাসুকে সাথে সাথে নিয়ে বেড়ায়, সে ভয় সব জায়গায়ই দেখা দিয়েছে। কাসূকে ওর ফুফুর বাড়ী থেকে নিয়ে আসার পর যতগুলো ঘটনা ঘটেছে তাতে কাসু হয়তো অনেক কিছুই বুঝতে পেরেছে। তবুও সে সাধ্যমত চেষ্টা করে। বাজার থেকে বিস্কুট, জিলিপি, কদমা, এনে কাসুকে খেতে দেয়। নিত্য-নতুন খেলনা দিয়ে তাকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে। কোনো লোককে ওর কাছে ঘেঁষতে দেয় না, পাছে কেউ ওর মা-র কথা বলে দেয়।
কাল পান্তা ভাত খেয়েই করিম বক্শ ধান কাটতে যাবে। কিন্তু কাসকে বাড়ীতে রেখে যেতে তার মন সরে না। আবার তাকে সাথে নিয়ে গিয়েও কোন লাভ নেই। সেখানে উস্কানি দেয়ার লোক আছে যথেষ্ট। জয়গুনের বাড়ীর কাছের কেরামত আছে লেদুর দলে। কে কখন কোন তাল দিয়ে বসে বলা যায় না। সে ভাবে–তাল দিতে পারে সব্বাই,মিডাই দিতে পারে না কেউ।
মহাসমস্যা করিম বকশের সামনে। চিন্তা করে সে কোন সমাধান খুঁজে পায় না। আমন তামাক দিয়ে যায়। তামাক টানতে টানতে সে চিন্তা করে। তার চিন্তা তামাকের ধোয়ার সাথে কুণ্ডলি পাকাতে আরম্ভ করে।
এক সময়ে হুঁকোয় টান দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায় করিম বক্শ। তারপরই তার চোখে-মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
হুঁকোটা বেড়ার সাথে ঠেকিয়ে রেখে সে এক লাফে বেরিয়ে পড়ে। পাশের বাড়ীর হারুনকে ডেকে চুপি চুপি যুক্তি করে দু’জনে।
হারুন বলে—সাদা চুল পাইমু কই?
—আমি যোগাড় কইরা দিমু। তুই এট্টা সাদা কাপড় যোগাড় করিস। আর খবরদার, কেও যেন না জানে। তুই আর আমি, বুঝালি কথা? তিন কান অইলেই সর্বনাশ।
একটু থেমে আবার বলে—আমার কাম যদি ফতে অয়, তয় তোরে একখান গামছা কিন্যা দিমু!
করিম বক্শ সন্ধ্যার সময় কাসুর কোমরের দড়ির বন্ধন খুলে দেয়। কড়া পাক-দেওয়া গরুর দড়িটার দাগ বসে গেছে কোমরে। করিম বক্শ আদর করে ডাকে—কাসু অ-কাশেম! চল্ বাজান, তোরে টিয়াপক্ষীর বাচ্চা ধইরা দিমু। ওই তেঁতুল গাছে টিয়ার বাসা আছে।
কাসু উৎফুল্ল হয়ে ওঠে।
—চল আমার লগে।
করিম বক্শ কাসুর হাত ধরে তেঁতুল গাছের দিকে নিয়ে যায়। পথে যেতে যেতে করিম বক্শ বলে—আমারে বাজান কইয়া ডাক দে।
দীর্ঘ চার বছর কাসু ফুফুর বাড়ীতে কাটিয়েছে। কেউ তাকে ঐ নামে ডাকতে শেখায়নি! অনভ্যস্ত বলে এখন বাজান ডাকতে কাসুর লজ্জা হয়। বাপের কাছে এসে সে আদর-স্নেহ যা পেয়েছে, তার চেয়ে মারধর খেয়েছে ঢের বেশী। করিম বক্শ ছেলের কাছে পিতার উপযোগী কোন ভক্তি-শ্রদ্ধাই অর্জন করতে পারেনি। সে যা অর্জন করেছে তা ভয়। কিছুটা ভয় আর বেশীর ভাগই লজ্জায় কাসু বাজান বলে ডাকতে পারে না। এ জন্য কতদিন মারও খেয়েছে। মার খেয়ে অনিচ্ছায় উচ্চারণ করেছে কয়েক বার। কিন্তু মুখ দিয়ে স্বতঃস্ফুর্ত হয়ে শব্দটি কোনদিন বের হয়নি।
করিম বক্শ আবার বলে…কিরে, ক। না কইলে টিয়াপক্ষীর বাচ্চা দিম না।
এত লোভ দেখানো সত্ত্বেও কাসু মুখ বুজে থাকে। কোন কথাই বের হয় না মুখ দিয়ে। করিম বক্শ আর পীড়াপীড়ি করে না।।
তেঁতুল গাছের কাছাকাছি যেতেই কি রকম এক গোঙানির শব্দ শুনে কাসু থমকে দাঁড়ায়।
করিম বক্শ বলে—কিরে, কি অইল?
—অইডা কি দোহা যায়? তেতুল গাছের টিকিতে বইয়া রইছে! করিম বক্শ কৃত্রিম বিস্ময় প্রকাশ করে বলে—সত্যই ত! পাকনা চুল ছাইড়া বইয়া রইছে! আবার গোঙায়!
করিম বক্শ চোখ দুটো বড় করে বলে-খাড়া, দেইখ্যা লই।
কাসু এবার করিম বকশের হাত ধরে তার গায়ের সাথে মিশে দাঁড়ায়। করিম বক্শ কাসুকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে।
—কাসু, শিগগির আমার কোলে ওঠ। বাপরে বাপ! এইডা ত আর কিছু না! এইডা যে। গোঙাবুড়ি! গলা টিপ্যা ধরব! আল্লা! আল্লা, বাঁচাও! আল্লা, আল্লা! কাসু, আল্লার নাম কর। আল্লা, আল্লা।
কাসু করিম বকশের বুকের মধ্যে মুখ লুকায়। ভয়ে চোখ বন্ধ করে। কাঁপে থরথর করে। করিম বক্শ কাসুকে কোলে নিয়ে দৌড় দেয়। বাড়ী এসেও কাসু চোখ খোলে না।
রাত্রে শুয়ে শুয়ে করিম বক্শ বলে—কাসু, আমারে বাজান কইয়া ডাক দে। বা’জান না ডাকলে গোঙাবুড়ী বোলাইমু।
অন্ধকারের মধ্যে শিউরে ওঠে কাসু। করিম বক্শকে জড়িয়ে ধরে দুই হাতে। তার চোখের সামনে তখনও যেন সে দেখছে গোঙাবুড়ীর বিকট মূর্তি।
করিম বক্শ কাসুকে দূরে সরিয়ে দেয়ার ভান করে বলে—সইর্যা যা আমার কাছতন। আমারে বাজান না কইলে এহনি গোঙাবুড়ী ডাক দিমু।
কাসুর ভীত-কম্পিত কণ্ঠ অস্ফুট শব্দ করে–বাজান।
করিম বক্শ সাড়া দেয়। তারপর বলে—কাসু, বাড়ীর বাইরে যাইস না কিন্তুক, খবরদার! ঐ গোঙাবুড়ী গলা টিপা ধরব! তেঁতুল গাছে আরো একটা পিচাশ আছে! হেইডার নাম ছালাবুড়ী। ছালার মইদ্যে ভইরা তোর মতন ডেগা পোলা পাইলে লইয়া যায়। তারপর তেঁতুল গাছে বইস্যা রক্ত খায়।
কাসু করিম বকশের বুকের মধ্যে শিউরে ওঠে। তার কাঁপুনি করিম বক্শও অনুভব করতে পারে।
সে আবার বলে—খরদার! কানাবুড়ীর সুরত ধইর্যা ছালাবুড়ী ধইরা লইয়া যাইব।
করিম বক্শ তার অদ্ভুত ফন্দির সফলতায় মনে মনে খুশী হয়। কাসুকে বাড়ীতে রেখে এখন নিশ্চিন্তে কাজ করা যাবে। কাসু ভুলেও জয়গুনের বাড়ীর দিকে পা বাড়াবে না। কারণ পথের ওপরেই তেঁতুল গাছ। আবার ছালাবুড়ীর চেহারা নিয়ে কানা বুড়ীও এসে আর সুবিধে করতে পারবে না।
করিম বকশের মতলব হাসিল হয়েছে। কাসু এখন আর বাড়ী থেকে বের হয় না। আগে বাড়ীর উত্তর পাশটায় গিয়ে দাঁড়াত সে। সূর্য-দীঘল বাড়ীর তালগাছটার দিকে চেয়ে চেয়ে সে
অনেক সময় কাটিয়ে দিত। রোজ ঐ তালগাছটা দেখে দেখে সে তার মা-র চিন্তাটাকে তাজা করে নিত মনের মধ্যে। মা-র অভাব তাতে অসহনীয় হয়ে উঠত। তেতুল গাছে গোঙাবুড়ী দেখার পর সে আর কোনো দিকে পা বাড়ায় না।
সে কখনও ফুলির বিছানার পাশে, কখনও উঠানে, কখনও বা রান্না ঘরে তার সৎমার পাশে বসে কাটিয়ে দেয়। এমন কি গোয়াল ঘরের পাশে যেতেও এখন তার সাহস হয় না।
মা-র মধুর চিন্তা তার মনে বার বার যে ছাপ রেখে গেছে, তা কখনও মুছবার নয়। সে স্থায়ী ছাপকে এখন ভুতের বীভৎস মূর্তি যেন রাহুর মত গ্রাস করছে। গোঙাবুড়ীর গোঙানি, ছালাবুড়ীর ছালা, তাদের নখর ও দাতের এলোমেলো কল্পনা কাসুকে সব সময়ে সন্ত্রস্ত করে রাখে। কোনো ঠুংঠাং শব্দ শুনলেই সে ভয়ে অস্থির হয়। রাত্রে ঘুমের ঘোরে সে চিৎকার করে ওঠে। করিম বক্শ সে চিৎকারে সজাগ পেয়ে কাসুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে–কিরে কাসু, অমুন করস ক্যান?
কাসু কোন উত্তর দেয় না। করিম বকশের বুকের মধ্যে গিয়েও সে কাঁপে থরথর করে।
হঠাৎ একদিন কাসুর জ্বর হয়। প্রথম দিন-দুই করিম বক্শ মোটেই গা করে না। তিন দিনের দিন বেশ তোড়জোড়ের সাথে জ্বর ওঠে। বিছানায় পড়ে পড়ে কাসু প্রলাপ বকে।
করিম বক্শ দাওয়ায় বসে মাটির ওপর আঁচড় কেটে বাকী খাজনার হিসেব করছিল। সে ঘরের মাঝে উঠে এসে বলে-কাসু, অ কাসু! কি অ্যাঁ? অমন করস ক্যাঁ?
—ছালাবুড়ী আইল! উঃ-উঃ-উঃ! না—না, বাজান কইতাম না।
করিম বক্শ কাসুর মাথায় কপালে হাত দিয়ে দেখে। হাত রাখা যায় না। মনে হয়, পুড়ে যাবে হাত।
—মা, মা, মাগো মা।
করিম বক্শ বলে—ম্যাও ম্যাও করস ক্যাঁ? আল্লা আল্লা কর। আল্লায় রহম করব।
কাসুর হুঁশ নেই। সে কখনও বিড় বিড় করে, কখনও বা টানিয়ে টানিয়ে প্রলাপ বকতে থাকে।
করিম বক্শ উদ্বিগ্ন হয়। সে তাড়াতাড়ি করে ফকির বাড়ী যায়। গ্রামের সেরা ফকির দিদার বক্শ এসে হাতের লাঠিটা বেড়ার সাথে ঠেকিয়ে রেখে কাসুর বিছানার পাশে বসে।
কাসু প্রলাপ বকছে—ওইডা কি? তেঁতুল গাছ!
কিছুক্ষণ বসে থেকে দিদার বক্শ চোখ বুজে ওপরের দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটে চাপ দিয়ে বিজ্ঞের মত কয়েকবার মাথা নাড়ে। তারপর গাম্ভীর্যের সাথে বলে—আর দ্যাখতে অইব না। মোখ দেইখ্যা আগেই আমি বোঝতে পারছি।
করিম বক্শ উদ্বেগভরা কণ্ঠে বলে-কি, পাগল ভাই?
দিদার বক্শকে সবাই পাগলা দিদার বলে।
সে বলে—আবার কি! কথা হুইন্যাও মালুম করতে পার না? দ্যাহ না কেন বিলকি-ছিলকি কয়?
—আমিও আগেই মালুম করছি কিছু। সব সময় খালি কয় গোঙাবুড়ী আইল। গলা টিপ্পা ধরল। আল্লা খোদার নাম নাই মোখে। আর কেবল ম্যাও ম্যাও করে। আমার দাদার মোখে হুনছি, ভূতে পাওয়া মানু আল্লার নাম ভুইল্যা যায়। এহন কি করা যায়, পাগল—ভাই?
—কিছু চিন্তা নাই! হোন, একখান ন্যাকড়া লইয়া আহ। আর এক চামুচ কডুতেল।
ফকিরের নির্দেশ মত করিম বক্শ ন্যাকড়া ও সর্ষের তেল নিয়ে আসে। ন্যাকড়া দিয়ে। দড়ি পাকিয়ে ফকির তার এক প্রান্ত ডুবিয়ে ধরে তেল-ভরা ঝিনুকের মধ্যে। তারপর বাতির শিখার ওপর দড়ির তেল-মাখন মাথাটা পোড়া দেয়। দড়ির প্রান্ত থেকে যখন ধোঁয়া বেরুতে শুরু করে, তখন ফকির কুণ্ডলায়িত ধোঁয়াসহ গরম প্রান্তটা কাসুর নাকের মধ্যে বারবার প্রবেশ করিয়ে দেয়। কাসু যন্ত্রণায় উঃ করে ওঠে প্রত্যেক বার। তার কোমরটা বিছানা ছেড়ে উঁচু হয়ে ওঠে। শক্তি নিঃশেষ করে হাঁচি দেয় কয়েক বার।
মুখে হাসি টেনে ফকির বলে—আঁচি দিছে, আর চিন্তা নাই। এই অ্যাঁচির ঠেলায় আলাই-বালাই পলাইব। যদি একে না-ই পলায়, তয় মাগরিবের ওক্তে একবার খবর দিও। আইজ রাতেই বৈডক দিমু। হেইখানে বোলাইয়া ওর চৌদ্দ-গোষ্ঠির ছেরাদ্দ করুম। ভালয় ভালয় যদি না যায় তো ওস্তাদ শেখ ফরিদের নাম লইয়া এমুন মন্তর ঝাড়, যার তেজে সুড় সুড় কইর্যা আমার বোতলের মইদ্যে ঢুকব। আমি তহন চট কইর্যা বোতলের মোখ বন্ধ কইরা দিমু। তারপর আমার শিথানের নিচে মাড়িতে গর্ত কইর্যা বোতলডা উপড় কইর্যা বহাইয়া মাড়ি দিয়া ঢাইক্যা দিমু। আমার শিথানের নিচে কি একটা দুইডা! এই রহম কত ভূত-পেত্নী, দানা-পিচাশ জিন-আত কবর দিয়া থুইছি, লেখাজোখা নাই। কিন্তুক জাহিলগুলার মউয়ত নাই। রাইতে যহন বালিশে মাথা রাখি, তহন কত কান্দা-কাড়ি! কয়—আর কোন দিন আদমজাতের ক্ষেতি করতাম না। একবার ছাইড়্যা। দ্যাও। তোমার গোলাম অইয়া থাক। তোমারে পাকিস্তান জয় কইরা দিমু, পাকিস্তানের রাজা বানাইমু। আমিও কই—আমি রাজা অইতে চাই না। তোরা রোজকিয়ামত পর্যন্ত বোতলের মইদ্যে থাকবি। গোলমাল করলে উফায় নাই।
করিম বক্শ শোনে মনোযোগ দিয়ে। ফকিরের গল্প শুনে সে বিস্ময়ে হতবাক। একটা কুলোয় করে সে সোয়া সের চাল আর সোয়া পাঁচ আনা পয়সা এনে ফকিরের পায়ের কাছে রেখে দেয়।
রাত বারোটার পর বৈঠক। মোমবাতি-আগরবাতি জ্বালিয়ে লোকজন ও শাগরেদসহ দিদার বক্শ ফকির ‘ভারানে’ বসে!
আগেই সে জিজ্ঞেস করে—কার উপরে চালান দিমু, করিম বক্শ? তোমার উপরে?
—আমার উপরে! না—না—না খবরদার ভাই, খবরদার! আমার ডর করে।
—ভর করলে চলব ক্যাঁ? তোমার উপরে ত আর চিরজনম ভর অইয়া থাকব না। আমার কাম অইয়া গেলে আবার নামাইয়া দিমু।
—না! আর কেওরে কইয়া দ্যাহেন।
—কে আছে আর? রুস্তম, তুমি? সাদেক? হারুন? কিছু ভর নাই। এক্কেরে পান্তাভাত।
সবাই মাথা নেড়ে অস্বীকার করে! শেষে ফকির তার এক শাগরেদকে ঠিক করে। তার ওপরেই ভর করবে ভূত।
দিদার বক্শ মোমবাতি নিবিয়ে দিয়ে সবাইকে সাবধান করে দেয়— খবরদার, কেও চউখ উপর দিক কইর্য না! ভূতের চউখে চউখ পড়লে তোমাগ চউখ গইল্যা পানি অইয়া
ফকির এবার বাবরি চুল নাচিয়ে গলার মধ্যে কেমন ফাস ফাস শব্দ করে ‘জিকির’ আরম্ভ করে।
এক সময়ে ঘরের চালার ওপর ঢিল পড়তে শুরু করে।
ফকির বলে—চাইশা মারস ক্যাঁ? পিড়পিড়াইয়া ঘরে আয়। ঘরে আইতে অইবই।
কিছুক্ষণ পরে ঘরের চালাটা কড়কড় করে ওঠে। সাথে সাথে ফকিরের চেলাটিও দুলতে আরম্ভ করে আর গলার ভেতর অদ্ভুত ফ্যাঁস ফ্যাঁস শব্দ করে—হ্যাঁরে—হাঁই—হুম।
সবাই বুঝতে পারে, ওর ওপরে ভূত ভর করেছে। দিদার বক্শ এবার টানা সুরে বলতে আরম্ভ করে–
আমার নাম দিদার বক্শ শুইন্য মন দিয়া
আমার নামে ভূত-পত্নী সবাইর কাঁপে হিয়া!
শেখ ফরিদের নাম লইয়া যদি মন্তর ঝাড়ি,
হাজার গণ্ডা ভূত-পেত্নী ভেন্টাইবার পারি।
হ্যাঁরে—হাঁই-হুম-হাঁই-হুম-হাঁই।
তোমার লেইগ্যা বইস্যা আছি, কও তোমার নাম।
কিবা জাত, কিবা গোত, কোন খানেতে ধাম?
হ্যাঁরে—হাঁই-হুম-হাঁই-হুম-হাঁই।
শাগরেদের ওপর চালান-দেওয়া ভূত বলে—
আমার নাম ল্যাজফটকা থাকি ডালে ডালে,
কাচ্চা-বাচ্চা পাই যদি ভরি দুই গালে।
সিয়ানা অইলে তার কান্ধে চইড়্যা বসি,
লহু মাংস শুষে খাই সারা দেহ চষি।
হাঁরে—হাঁই-হুম-হাঁই-হুম-হাঁই।
রুস্তম অন্ধকারের মধ্যে বাম হাত চালিয়ে পাশের সাদেকের পিঠে চাপ দেয়। উদ্দেশ্য, সাদেকের মনে এ ব্যাপারে আরো বেশী বিস্ময় জাগিয়ে তোলা। সাদেক কাঁপছে থরথর করে। তার রক্তও বুঝি হিম হয়ে যায়।
পাশের ঘরে কাসু থেকে থেকে প্রলাপ বকছে। ফকির আবার বলে—
শোনরে ভাই ল্যাজফটকা, রাখ বাজে কথা,
বাঁচতে চাইলে উড়াল দে যথা ইচ্ছা তথা।
হাঁরে—হাঁই-হুম-হাঁই-হুম-হাঁই।
এই বাড়ী ছাইড়া যদি না যাস চলে,
লোয়া পুইড়্যা লাল কইর্যা ছেঁকা দিমু গালে।
হাঁরে—হাঁই-হুম-হাঁই-হুম-হাঁই।
ভূত বলে—
তোর মতন ফকিরের রাখি কিরে ডর?
কত ফকির ভাইগ্যা গেল খাইয়া থাপ্পর।
হাঁরে—হাঁই-হুম-হাঁই-হুম-হাঁই।
বিছানার ওপর দুই হাতের থাপ্পড় মেরে ফকির বিকট চিৎকার করে–
তয়রে হারামজাদা বইস্যা থাক সোজা,
পাগলা দিদার মন্তর ঝাড়ব বুঝবি এহন মজা।
কই গেলিরে ল্যাৰা ভূত, কই গেলিরে ট্যাবা,
কই গেলি কাইল্যা ঠ্যাড়া, কই গেলিরে খ্যাবা,
সমদ্দুরের ফেনা আইন্যা–
ভূত এবার ভয়ে আর্তনাদ করে ওঠে। দুই হাতে ফকিরের পা জড়িয়ে ধরে বলে—না, না, না। আমি এহনি চইল্যা যাই। সব্বনাশ কইর্য না আমার। বাপ্পুস রে!
—হ, অহনি চইল্যা যা। দেরেং করলে বোতলের মইদ্যে আটকাইয়া ফ্যালাইমু, কইয়া। দিলাম হেই কতা।
—তুমি আমার মনিব। আমি তোমার নফর। যাওনের আগে একটা ভোগ দ্যাও।
–কিয়ের ভোগ?
—আড়াই গণ্ডা শবরীকেলা, মিহিন চাউলের ভাত
সেরেক পাঁচেক মাইপ্যা দিও কাইট্যা কেলার পাত।
ঝাল-ছাড়া নুন-ছাড়া পোড়া গজার মাছ,
রাইখ্যা দিও এইগুলা যেথায় তেঁতুল গাছ।
ফকির বলে—আইচ্ছা, আইচ্ছা, দিমু। তুই অহন পলা।
অন্ধকারের মধ্যে ঘরের চালাটা আবার কড়কড় করে ওঠে।
বাতি জ্বালাতেই দেখা যায়, ফকিরের শাগরেদ বিছানার ওপর বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। ফকির ও তার অন্যান্য শাগরেদ ছাড়া আর সবার মুখ ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে ওঠে।
ফকির এবার পানিতে হাত ভিজিয়ে শাগরেদের গায়ের ওপর ছিঁটিয়ে দেয়। শাগরেদ লাফ দিয়ে ওঠে।
ফকির আড়ামোড়া ভেঙে শাগরেদকে জিজ্ঞেস করে—কিরে, কই আছিলি এতক্ষুণ?
—ঘুমাইয়া পড়ছিলাম।
ফকির মাথা নাড়ে আর গোঁফের তলা দিয়ে হাসে।
করিম বক্শ বলে—ঘুমাইছিলা! আর তোমার উপরে এত তফরখানা গেল!
ফকির অভিভাবকের মত বলে—থাউক, থাউক, ওয়া নিয়া আর মাথা ঘামাইয়া কাম নাই। হোন করিম বক্শ, কামডা খুব সহজে অইয়া গেল। ওরে ওই হগল খাইতে দিলেই ও চইল্যা যাইব। কাইলই বাজার তন গজার মাছ, কেলা আর চিনিগুড়া চাউল আইন্যা আমার কাছে দিও। তেতুল গাছের গোড়ায় আমিই রাইখ্যা আসমু ঠিক রাইত দুপুরের সুময়। তোমাগ যেই ডর! তোমার উপরে এই কাম ছাইড্যা দিতে ভস্সা পাই না।
একটু থেমে আবার সে বলে—ভুত ছাইড়া গেলে কাসুরে গোসল করাইয়া পাক-সাফ করতে অইব।
—গোসল! এই জ্বরের মইদ্যে?
–-হ, হ। জ্বর কুথায় দ্যাখছ তুমি? এইডাও জান না, ওরা আগুনের তৈয়ারী? আমাগ মতন মাডির তৈয়ারী না। ঘেড়ির উপরে চাইপ্যা থাকলে শরীল গরম না অইয়া যায়? পরশু বিহানে মোরগের বাকের আগে কাসুরে রাস্তার তেমাথায় নিয়া গোসল করাইতে অইব। তুমি সাত পুকুরের পানির যোগাড় রাইখ্য। সাত ঘাডের না কিন্তুক। এক পুকুরেরও সাতখান ঘাড থাকতে পারে। সাত পুকুরের পানি অওয়ন চাই।