খবরটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো পুরো শহরে।

ওরা গুলি করেছে।

ছাত্রদের উপরে গুলি চালিয়েছে ওরা।

কজন মারা গেছে?

হয়তো একজন। কিম্বা দুজন। কিম্বা অনেক। অনেক।

দোকান-পাটগুলো সব ঝড়ের বেগে বন্ধ হতে শুরু হলো।

দোকানিরা নেমে এলো রাস্তায়।

বাসের চাকা বন্ধ।

কল-কারখানা বন্ধ।

বিকট শব্দে হুইসেল বাজিয়ে ইঞ্জিন ছেড়ে নিচে নেমে এলো ট্রেনের ড্রাইভাররা।

আজ চাকা বন্ধ।

রিকশাটা একপাশে ঠেলে রেখে খবরটা যাচাই করার জন্যে সামনের একটা পান-দোকানের দিকে এগিয়ে গেলো সেলিম।

সে-ও আজ রিকশা চালাবে না।

ওরা নাকি ছাত্রদের উপর গুলি করেছে। কতজন মারা গেছে?

হিসাব নেই।

সবাই খোঁজ নিতে এগিয়ে গেলো বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে।

মেডিক্যালের দিকে।

এটা অন্যায়।

এই অন্যায় আমরা সহ্য করবো না।

মেডিক্যালের কাছাকাছি এসে জনতা এক বিশাল মিছিলে পরিণত হলো। ক্ষুব্ধ আক্রোশ ফেটে পড়ছে মানুষগুলো।

এ হত্যার বিচার চাই আমরা।

যারা আমাদের ভাইদের খুন করেছে তাদের বিচার চাই আমরা।

ধীরেধীরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো।

ঘন অন্ধকারে ঢেকে গেল পুরো শহরটা!

সেই অন্ধকারকে আশ্রয় করে দুটো এম্বুলেন্স নিয়ে মেডিক্যালের পেছনে মর্গের সামনে এসে দাঁড়ালো কয়েকজন পুলিশ অফিসার।

মৃতদেহগুলো রাতারাতি সরিয়ে ফেলতে হবে।

ভোর হবার আগেই আজিমপুরায় কবর দিয়ে দিতে হবে ওদের।

সারাশরীর ঘামছে।

পকেট থেকে রুমাল বের করে বারকয়েক মুখ মুছলেন আহমেদ হোসেন।

লাশগুলোর নাম ধাম ঠিকানা যদি কিছু থেকে থাকে লিখে নাও।

কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না স্যার।

জবাব দিলেন জনৈক সহকারী।

একজনের কাছে একটা পুঁটলি পাওয়া গেছে। তার মধ্যে দুটো শাড়ি, কিছু চুড়ি, আর একটা আলতার শিশি। এগুলো কী করবো স্যার?

রেখে দাও। কাল অফিসে জমা দিয়ে দিয়ে। লাশগুলো তাড়াতাড়ি তুলে নাও গাড়ির ভেতরে। এখানে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা ঠিক হবে না।

লাশগুলো একবার দেখবেন কি স্যার?

আরেক সহকারী প্রশ্ন করলেন।

না। প্রয়োজন নেই।

শান্তগলায় জবাব দিলেন আহমেদ হোসেন।

রুমালে আবার মুখ মুছলেন তিনি।

ছেলে তসলিমের মূখতার জন্য এতদিন প্রমোশন বন্ধ হয়েছিলো।

এবার সরকার হয়তো মুখ তুলে তাকাবেন তার দিকে।

মনে মনে ভাবলেন তিনি।

মৃতদেহগুলো গাড়ির মধ্যে ভোলা হচ্ছে।

সহসা একটা সিগারেট ধরাতে গিয়ে চমকে উঠলেন আহমেদ হোসেন।

সমস্ত শরীরটা মুহূর্তে যেন হিম হয় গেলো তার।

শরীরের সমস্ত শক্তি নিয়ে অতি ক্ষীণস্বরে তিনি ডাকলেন—

দাঁড়াও।

মুহূর্তে যেন একটা ভূমিকম্প হয়ে গেলো।

মাতালের মতো টলতে টলতে মৃতদেহের দিকে এগিয়ে এলেন তিনি।

টর্চ! টর্চটা দেখি!!

জনৈক সহকারী টর্চটা জ্বেলে মৃতদেহের উপর ধরলেন।

মৃত তসলিমের রক্তাক্ত মুখের দিকে চেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন আহমেদ হোসেন।

চেনেন নাকি স্যার?

একজন সহকারী প্রশ্ন করলেন তাকে।

আহমেদ হোসেন বোবাদৃষ্টিতে একবার তাকালেন শুধু তার দিকে।

কিছু বলতে গিয়ে মনে হলো জিহ্বাটা পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে।

কিছুতেই নাড়াতে পারছেন না তিনি।

ডুকরে কেঁদে উঠলেন মা।

এ কী সর্বনাশ হয়ে গেলো আমার! আমি এবার কী নিয়ে বাঁচবো!!

ছোট ভাইবোনগুলো মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে।

জানালার পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে সালমা।

বাইরের আকাশটার দিকে তাকালো সে।

বুকে তার এক অব্যক্ত যন্ত্রণা।

আর একটা দিনও কি বেঁচে থাকতে পারতো না তসলিম!

কেন সে এমন করে মরে গেলো?

মেডিক্যালের সবগুলো ওয়ার্ড ঘুরে ঘুরে দেখলো সালেহা।

নেই।

এখানে নেই।

থানায় গেলো।

জেলগেটে বন্দিদের খাতা খুলে নাম পড়লো সবার।

নেই।

এখানেও নেই।

শূন্যঘরে ফিরে এসে সারারাত অপেক্ষা করলো সালেহা। ভোরের কাক ডেকে উঠলো।

কেউ এলো না।

কান্নায় ভেঙে পড়লো সালেহা।

সে বুঝি আর এই পৃথিবীতেই নেই।

কলসি কাঁখে পুকুরঘাটে দাড়িয়ে রইলো আমেনা।

দিন গেলো।

রাত গেলো।

লোকটা যে বিয়ের বাজার করতে সেই-যে শহরে গেলো, কই আর তো এলো না।

নকশি কাঁথার কত ফুল।

কত পাখি! রঙিন সুতো দিয়ে আঁকলো আমেনা।

রাতে কোনো বাড়িতে পুঁথিপড়ার শব্দ শুনলে হঠাৎ চমকে ওঠে আমেনা।

চোখের পাতা পানিতে ভিজে যায়।

সূর্য উঠছে।

সূর্য ডুবছে।

সূর্য উঠছে।

সূর্য ডুবছে।

সুতোর মতো সরু পানির লহরি বালির উপর দিয়ে ঝিরঝির করে বয়ে যাচ্ছে।

ধলপহরের আগে রাস্তায় নেমে এলো একজোড়া খালি পা।

সুতোর মতো সরু পানি ঝরনা হয়ে বয়ে যাচ্ছে এখন।

কয়েকটি খালি পা কংক্রিটের পথ ধরে এগিয়ে আসছে সামনে।

ঝরনা এখন নদী হয়ে ছুটে চলেছে সাগরের দিকে।

সামনে বিশাল সমুদ্র।

এ সমুদ্রের মতো জনতা।

নগ্নপায়ে এগিয়ে চলেছে শহীদ মিনারের দিকে।

অসংখ্য কালো পতাকা।

পতপত করে উড়ছে।

উড়ছে আকাশে।

মানুষগুলো সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো অসংখ্য ঢেউ তুলে এগিয়ে আসছে সামনে।

ইউক্যালিপ্টাসের পাতা বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে নিচে। মাটিতে।

ঝরে।

প্রতি বছর ঝরে।

তবু ফুরোয় না।