ভোর হবার আগেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো গফুরের।

চেয়ে দেখলো পথঘাটগুলো তখনো জনশূন্য।

দুটো কুকুর রাস্তার মাঝখানে বসে ঝগড়া করছে।

গফুর উঠে বসলো।

পুটলীতে রাখা জিনিসপত্রগুলো পরখ করে দেখলো একবার।

পূবের আকাশে সবে ধলপহর দিয়েছে।

দু’পাশের উঁচু উঁচু দালানগুলোকে আকাশের পটভূমিতে ছায়ার মতো মনে হচ্ছে।

দু’ একটা কাক গলা ছেড়ে চিৎকার করছে।

মাঝে মাঝে রাস্তায় নেমে এসে খাবার খুঁজছে।

আবার উড়ে গিয়ে বসছে টেলিগ্রাফের তারের উপর।

দু’টো মেয়ে রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে ঝাড়ু দিচ্ছে।

আবর্জনা পরিষ্কার করছে।

রাস্তার পাশে একটা কল থেকে হাত মুখ ধূলো গফুর।

ততক্ষণে লোকজন পথ চলতে শুরু করেছে।

দু’ একটা রিক্সার টুং টুং আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

একটা দুটো করে দোকানপাট খুলছে।

টাউন সার্ভিসের বাসগুলো মানুষ ভর্তি করে ছুটছে ঊর্ধ্বশ্বাসে।

হরতাল!

কোথায় হরতাল?

গফুর অবাক হয়ে তাকালো চারপাশে।

সেলিম তার রিক্সাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো রাস্তায়।

যাবার সময় বৌকে বলে গেল—

কালুকে আজ রাস্তায় বেরুতে দিসনে। গোলমাল হতে পারে।

কালু ওর ছেলের নাম।

মকবুল আহমদও বেরুলেন বাইরে।

স্ত্রী বিলকিস বানুকে সঙ্গে নিয়ে।

ডাইভারকে নির্দেশ দিলেন। রেসকোর্স ঘুরে সেক্রেটারিয়েটের দিকে যাবার জন্যে।

পুরোনো শহরেও একবার যাবেন তিনি।

কারখানায় যাবেন।

অফিস পাড়াগুলো ঘুরবেন।

হরতাল ব্যর্থ হয়েছে কি হয়নি তাই তদারক করবেন তিনি।

বিলকিস বানু সহসা শব্দ করে হেসে উঠলেন।

ওই যে দেখ দেখ। একটা বাস আসছে, দুটো রিক্সা। একটা ঘোড়ার গাড়ি। ওটা একটা প্রাইভেট কার, না!

দু’জনের মুখে হাসি।

চারপাশে সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে যেন খুঁজছেন তারা।

রাস্তায় গাড়ি দেখলে কিম্বা দোকান খুলেছে নজরে এলে উল্লাসে ভরে উঠছে তাঁদের

চোখমুখ।

তোমাকে বলিনি আমি!

সগর্বে স্ত্রীর দিকে তাকালেন মকবুল আহমদ।

কেউ হরতাল করবে না। দেশের দুশমনদের সাথে কেউ যোগ দেবে না। স্বামীর একখানা হাত নিজের হাতের মধ্যে তুলে নিলেন বিলকিস বানু।

 

তুমি কি সত্যি সত্যি আজ অফিসে যাবে না?

বাইরে বেরুবার মুহূর্তে প্রশ্ন করলো সালেহা।

একটা কথার আর ক’বার উত্তর দেবো বল তো?

কবি আনোয়ার হোসেন রেগে গেলেন—

বলেছি তো যাবো না।

তাহলে এখন বেরুচ্ছো কোথায়।

পথ রোধ করে দাঁড়ালো সালেহা।

বাইরে হরতাল কেমন হলো দেখতে যাবো।

তারপর?

তারপর ইউনিভার্সিটিতে যাবো। ছাত্ররা কি করছে।

না। আমি তোমাকে বেরুতে দেব না।

সালেহা দৃঢ় কণ্ঠে বললো—

শেষে কোথায় গিয়ে কি করবে— পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে তখন আমার কি অবস্থা হবে শুনি?

দেখ, বাজে বকো না। পথ ছাড়। পুলিশে ধরবে। আমি তার তোয়াক্কা করি না। আর আমার যদি কিছু হয় তাহলে তুমি বাপের বাড়ি চলে যেও।

উত্তরের আর অপেক্ষা করলেন না আনোয়ার হোসেন। বাইরে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

 

ভোর রাতে পুলিশের পোষাক পরে কোমরে পিস্তল এঁটে বাইরে বেরিয়ে গেছেন বাবা। আজ তাঁর বড় ব্যস্ততার দিন।

তসলিমও ব্যস্ত।

তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার পথে সালমার সঙ্গে দেখা হলো তসলিমের।

আজ বাইরে না গেলেই কি নয়!

এই একটি কথা বলার জন্যই হয়তো সিঁড়ির গোড়ায় অপেক্ষা করছিলো মেয়েটি।

তসলিম থমকে দাঁড়ালো।

তুমি তো সবই জানো সালমা। জানো, আমি যাবো। তবু কেন বাধা দিচ্ছো।

দৃষ্টি নত করলো সালমা।

খালু বলছিলেন আজ গোলমাল হতে পারে।

বলতে গিয়ে গলার স্বরটা কেঁপে গেলো তার।

তসলিম সেটা লক্ষ্য করলো।

এ মুহূর্তে অনেক কথাই বলতে ইচ্ছে করছিলো তার।

কিছুই বলতে পারলো না। শুধু বললো—

চলি সালমা। আবার দেখা হবে।

বলে সালমার দিকে আর তাকালো না সে। নীরবে বেরিয়ে গেলো।