বুড়ো রাত বাড়তে লাগলো ধীরে ধীরে।

কাল কি হবে কেউ জানে না।

রাস্তায় পুলিশ নেমেছে। পুলিশের গাড়ি ইতস্তত ছুটোছুটি করছে।

পথঘাটগুলো জনশূন্য।

একটা খালি রক পেয়ে তার উপরে গামছা বিছিয়ে শুয়ে পড়লো গফুর। দুটো শাড়ি

কিনেছে সে।

এক শিশি আলতা।

কিছু চুড়ি।

একটা নাকফুল।

সেগুলো বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে নানা কথা ভাবতে লাগলো সে। আমেনার কথা।

বিয়ের পর কেমন করে সংসার করবে সে কথা।

আর কোনদিন যদি ছেলেপুলে হয় তার কথা।

ইচ্ছে করলে সে আজ গ্রামে ফিরে যেতে পারতো। কিন্তু সে যায়নি কারণ সে হরতাল দেখবে।

হয়তো কোনদিন আর শহরে আসা নাও হতে পারে। তাই হরতাল সে দেখে যাবে।

দু’ একটা কেনাকাটাও বাকি রয়ে গেছে।

একটা লাল লুঙ্গি কিনবে সে ভেবেছিলো।

কয়েক দোকানে ঘোরাঘুরিও করেছিলো।

কিন্তু ওরা বড় চড়া দাম চায়।

তাই গফুর ভাবলো, যদি কম দামে পাওয়া যায়। আর দু’ একটা দোকানপাট খোলা থাকে তাহলে সে কিনবে সেটা।

লাল লুঙ্গি আমেনা ভীষণ পছন্দ করে।

শুয়ে শুয়ে গফুর দেখলো দুটো পুলিশের গাড়ী ছুটে চলে গেলো রাস্তা দিয়ে। গফুর চোখ বন্ধ করলো।

 

কবি আনোয়ার হোসেন উত্তেজিতভাবে ঘরের ভেতরে পায়চারি করলেন অনেকক্ষণ ধরে।

সালেহা ডাকলো—

কই, শোবে না?

না।

শান্ত গলায় জবাব দিলেন কবি—

জানো সালেহা, আজ বহুদিন পর আমার কি মনে হচ্ছে জানো? মনে হচ্ছে, আমার জীবনটা ব্যর্থ হয়ে গেলো। আমি কবি হতে চেয়েছিলাম। কবিতা লিখতাম। কবিতা ছিল আমার স্বপ্ন। আমার সাধনা। ভেবেছিলাম সারাটা জীবন আমি কবিতা লিখেই কাটিয়ে দেবো। কিন্তু আমি— সেই আমি— দেখ আজ লেজার লিখতে লিখতে ক্লান্ত।

সালেহা সহানুভূতির সঙ্গে তাকালেন তাঁর দিকে।

লেখো না কেন? মাঝে মাঝে লিখলেই তো পারো। তুমি তো কবিতা লিখেই আমাকে পাগল করেছিলে, মনে নেই?

কথাটা শুনে সহসা শব্দ করে হেসে উঠলেন কবি আনোয়ার হোসেন। মনে আছে সালেহা। মনে থাকবে না কেন? শুধু কি জানো! আমার সেই মনটা নেই, যে মন নিয়ে একদিন আমি কবিতা লিখতাম।। আমার সেই মনটা না, লেজারের চাপে দুমড়ে গেছে। মরে গেছে।

এসো এখন শুয়ে পড়ো।

সালেহা ডাকলো।

না!

আবার বললেন আনোয়ার হোসেন।

তাঁর সারা মুখে কি এক অস্থিরতা।

স্ত্রীর কাছে এসে বসলেন তিনি—

সালেহা, আমি ঠিক করেছি, আমি আর ও চাকরি করবো না। এসব সরকারি চাকরি মানুষকে ক্রীতদাস করে ফেলে। আমি ছেড়ে দেবো। যেখানে আমার সামান্য স্বাধীনতা নেই সেখানে কেন আমি কুলুর বলদের মতো ঘানি টেনে যাবো। আমি আবার কবিতা লিখবো সাহেলা। যে কবিতা পড়ে তোমার একদিন ভালো লেগেছিলো— তেমনি কবিতা লিখবো আমি।

সালেহার পুরো চেহারায় কে যেন আলকাতরা লেপে দিলো।

না, না! চাকরি ছাড়া ঠিক হবে না। তাহলে সংসার চলবে কি করে? কবিতা লিখে তো আর টাকা পাবে না তুমি।

টাকা! টাকাই কি জীবনের সব কিছু সালেহা? মানুষের মন বলে কি কিছুই নেই?

শোনো। ওসব চিন্তা এখন রাখো।

সালেহা স্বামীর হাত ধরলো।

এসো, এখন শুয়ে পড়া যাক। কাল আবার ভোরে ভোরে উঠতে হবে না!

আমি কিন্তু কাল অফিসে যাবো না।

কেন?

আমি হরতাল করবো। ওরা নিষেধ করেছে। বলেছে চাকরি যাবে, যাক সেটা পরোয়া করি না। আমার ভাষার চেয়ে কি চাকরি বড়?

কাল কি হবে কে জানে। হয়তো মারাত্মক কিছুও ঘটতে পারে। বসে বসে ভাবলো তসলিম। জীবনে এই প্রথম অনুভূতির জন্ম নিলো তার মনে।

একশো চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙতেই হবে। নইলে আন্দোলন এখানেই শেষ হয়ে যাবে।

বাংলা ভাষাকে চিরতরে নির্মূল করে দেবে ওরা।

আর একশো চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙতে গেলে হয়তো পুলিশ গুলিও চালাতে পারে।

হয়তো তসলিম মারা যাবে।

নিজের মৃত্যুর কথা ভাবতে গিয়ে সহসা শিউরে উঠলো সে। মনে হলো যেন নিজের মৃত্যুকে সে এ মুহূর্তে প্রত্যক্ষ করছে।

ভাত খাবেন না!

সালমার কণ্ঠস্বরে চমকে তাকালো তসলিম।

সালমা বললো—

তরকারি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে চলুন।

বলে চলে যাচ্ছিলো সালমা।

সহসা পেছন থেকে তাকে ডাকলো তসলিম—

সালমা, শোন! তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

সালমা ফিরে তাকালো।

নীরব দৃষ্টিতে প্রশ্ন করলো—

কি বলুন?

সে চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না তসলিম। চোখ নামিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে বললো—

কথাটা আমার তুমি কিভাবে নেবে জানি না, হয়তো তুমি রাগ করবে—। বলতে গিয়ে থেমে গেলো সে।

সালমা নীরব।

কয়েকটি নীরব মুহূর্ত।

সহসা তসলিম আবার বললো—

বহুবার ভেবেছি বলবো তোমাকে। বলা হয়নি। হয়তো কোনদিন বলতাম না। কিন্তু আজ কেন জানি না বলতে ভীষণ ইচ্ছে করছে আমার।

আবার নীরব হলো তসলিম।

সালমা মাটির দিকে চেয়ে চুপ করে আছে।

মনে হলো ওর মুখখানা কৃষ্ণচূড়ার রঙে ভরে গেছে।

সালমা বললো—

চলুন, এখন খেয়ে নিন। পরে এক সময় না হয় শুনবো ওসব।

না না সালমা, যদি কাল কোন অঘটন ঘটে। ধরো যদি আমি মারা যাই। তাহলে?

মেয়েটি শিউরে উঠলো।

চোখজোড়া মুহূর্তে ছল ছল করে উঠলো তার।

ছিঃ। এসব কি বলছেন! আপনি মরবেন কেন? আপনি অনেক অনেক দিন বাঁচবেন। আসুন, এখন খেয়ে নিন। চলুন।

কথাটা শুনবে না?

না, এখন নয়। পরে শুনবো।

উত্তরের অপেক্ষা না করেই সামনে থেকে সরে গেল সালমা।

 

তুমি কি কাল বাইরে বেরুবে, না ঘরে থাকবে?

বিছানায় শোবার আগে মুখে ক্রিম ঘষতে ঘষতে স্বামীকে প্রশ্ন করলেন বিলকিস বানু।

হ্যাঁ, বেরুবো বৈকি। বেরুবো না কেন?

না, বলছিলাম কি যদি হরতাল হয় তাহলে?

হরতাল মোটেও হবে না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।

বিজ্ঞের মতো জবাব দিলেন মকবুল আহমদ।

হরতালের সব রাস্তা আমরা বন্ধ করে দিয়েছি।

যে হরতাল করবে তার লাইসেন্স আমরা কেড়ে নেবো। কেউ যদি অফিসে না আসে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করবো। আমরা জানিয়ে দিয়েছি। পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছি সবাইকে। তারপরও কি কেউ হরতাল করবে বলে মনে হয় তোমার?

স্লিপিং স্যুটটা পরে নিয়ে বিছানায় এসে শুলেন মকবুল আহমদ। কিন্তু ছাত্ররা হয়তো এক আধটু গোলমাল করতে পারে। তাও আমরা ভেবে রেখেছি।

ক্রিম ঘষা শেষ হলে বিলকিস বানু বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে বিছানায় এসে বসলেন।

আমার কি মনে হচ্ছে জানো? কাল কোন একটা কিছু হয়তো হতেও পারে। তুমি যেদিকে খুশি যেও, কিন্তু ওই ছাত্রদের পাড়ায় গাড়ি নিয়ে যেও না।

তুমি মিছেমিছি ভাবছো। শুয়ে পড়ো এখন।

চোখ বন্ধ করে ঘুমোবার চেষ্টা করলেন মকবুল আহমদ।