সদরঘাটে যেখানে অনেকগুলো খেয়ানৌকা ভিড় করে থাকে তার কাছাকাছি একটা ইট টেনে নিয়ে বসে পড়লো গফুর।
ক্ষিদে পেয়েছে। খাবে।
পুটলীটা ধীরে ধীরে খুললো সে।
শহরের লোকজনদের সে বলতে শুনেছে— কাল নাকি হরতাল।
শহরের সমস্ত দোকানপাট বন্ধ থাকবে।
গাড়ি ঘোড়া চলবে না।
হরতাল কি গফুর বোঝে না।
পিঠা খেতে খেতে সে নানাভাবে হরতালের একটা অবয়ব চিন্তা করতে লাগলো। কিন্তু হরতালের কোন সঠিক চেহারা নির্ণয় করা তার পক্ষে সম্ভব হলো না।
সে ভাবলো, এটা হয়তো শহরেরই বিশেষ একটা রীতি কিম্বা নীতি। মাঝে মাঝে শহরের মানুষরা এরকম হরতাল পালন করে থাকে।
উঠে গিয়ে দু’হাতে বুড়িগঙ্গার পানি তুলে নিয়ে পান করলো গফুর। গামছায় মুখ হাত মুছলো। তারপর ট্যাক থেকে রুমালটা বের করে টাকাগুলো গুণে গুণে বার কয়েক দেখলো সে।
কাল দোকানপাট বন্ধ থাকবে।
কেনাকাটা আজকে শেষ করতে হবে।
মুহূর্তে আমেনার মুখ মনে পড়লো তার।
কি করছে আমেনা এখন?
হয়তো পুকুর ঘাটে পানি নিতে এসেছে।
কিম্বা ঢেঁকিতে পাড় দিচ্ছে।
অথবা কচু বনে ঘুরে ঘুরে কচু শাক তুলছে।
সাতদিন পরে বিয়ে।
ভাবতে বড় ভালো লাগলো গফুরের।
সহসা বিকট একটা আওয়াজ শুনে চমকে তাকাল গফুর।
দেখলো কয়েকটি ছেলে মুখে চোঙা লাগিয়ে চিৎকার করে বলছে— কাল হরতাল।
আমাদের মুখের ভাষাকে ওরা জোর করে কেড়ে নিতে চায়।
আমাদের প্রাণের ভাষাকে ওরা আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চায়। কিন্তু আমরা মাথা নোয়াবো না।
আমরা আমাদের ভাষাকে কেড়ে নিতে দেবো না।
আমরা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।
আর সে দাবিতে কাল হরতাল।
সবাই হরতাল পালন করুন।
গফুর অবাক হয়ে শুনলো।
সে ভাবলো কাউকে জিজ্ঞেস করবে ব্যাপারটা কি? কিন্তু সাহস পেলো না। অদূরে একটা লোক তাসের খেলা দেখাচ্ছিল।
নানা রকম খেলা।
আজগুবি খেলা।
গফুর ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে খেলা দেখতে লাগলো।
কিসের হরতাল?
আমি হরতাল মানি না।
রিক্সার ব্রেকটা খারাপ হয়ে গেছে। সেটা ঠিক করতে করতে আপন মনে গজ গজ করে উঠলো সেলিম।
রিক্সা না চালালে আমি রোজগার করবো কোত্থেকে ?
আমি খাব কি?
আমার বউ খাবে কি?
আমার ছেলে খাবে কি?
ওসব হরতালের মধ্যে আমি নেই।
ব্রেকটা ঠিক করে সবে রিক্সাটা নিয়ে সামনে এগুতে যাবে সে এমন সময় পেছন থেকে কে যেন ডাকলো—
ভাড়া যাবে?
সেলিম দেখলো একটা ছেলে।
বোধ হয় ছাত্র।
হাতে বই।
বগলে একগাদা কাগজ।
কোথায় যাবেন স্যার?
ইউনিভার্সিটি।
ওঠেন।
তসলিম রিক্সায় ওঠে বসতেই সেলিম প্রশ্ন করলো—
আপনারা কালকে হরতাল করছেন কেন? রিক্সা না চালালে আমরা রুজি-রোজগার করবো কেমন করে? হাওয়া খেয়ে বেঁচে থাকবো নাকি।
মুহূর্ত কয়েক সময় নিলো তসলিম। তারপর ধীরে ধীরে বললো— আমরা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। আর ওরা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চায়। উর্দু যদি রাষ্ট্রভাষা হয় তাহলে বাংলা ভাষা এ দেশ থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে। তোমাকে আমাকে আমাদের সবাইকে উর্দুতে কথা বলতে হবে।
উর্দু আমি কিছু কিছু জানি।
সেলিম বিজ্ঞের মতো বললো—
কিন্তু আমার বউ উর্দু একেবারে বোঝে না। ও মুন্সিগঞ্জের মেয়ে কিনা তাই। তবে ছেলেকে আমি উর্দু বাংলা দুটোই শেখাচ্ছি।
তসলিম বললো—
উর্দুর সঙ্গে আমাদের কোন বিরোধ নেই। আমরা উর্দু বাংলা দুটোকেই সমানভাবে চাই।
কিন্তু হরতাল করছেন কেন?
হরতালের মাধ্যমে আমরা আমাদের বিক্ষোভ জানাতে চাই। আমাদের প্রতিবাদ জানাতে চাই।
কিছু না বুঝলেও বার কয়েক ঘাড় দোলালো সেলিম।
সরকারের চাকরি করি বলে কি আমরা আমাদের মতামতটাও বন্ধক দিয়ে দিয়েছি নাকি? আমরা কি ওদের ক্রীতদাস যে ওদের কথামতো আমাদের চলতে হবে।
চেয়ারে বসে ছটফট করতে লাগলেন কবি আনোয়ার হোসেন।
বড় কর্তার হুকুম এসেছে। কাল সবাইকে সময় মতো অফিসে হাজির হতে হবে। হরতাল করা চলবে না। যে হাজির হবে না তাকে সাসপেন্ড করা হবে।
কেন? আমাদের ভাষাটাকে তোমরা জোর করে কেড়ে নিয়ে যাবে? আর আমরা চুপ করে বসে থাকবো? কুকুর বেড়ালেরও নিজস্ব একটা ভাষা আছে। দেখি ওদের মুখ বন্ধ কর দাও তো! তোমাদের ছেড়ে দেবে? কামড়ে আঁচড়ে গায়ের রক্ত বের করে দেবে না? ওসব হুকুম আমি মানি না। যদি চাকুরি যায়, যাবে। মুটেগিরি করবো। দরকার হলে রাস্তায় খবরের কাগজ বিক্রি করবো। কিন্তু আমাকে তোমরা ক্রীতদাস বানিয়ে নিবে সেটা চলবে না।
রাগে গজ গজ করতে লাগলেন কবি আনোয়ার হোসেন।
ব্যাস কাল হরতাল। আমি অফিসে যাবো না, যা হয় হোক।
হিসেবের খাতাটা বন্ধ করে টেবিলের এক কোণে রেখে দিলেন তিনি।
ওসব হরতালের হুমকিতে মাথা নোয়ালে দেশ চলবে না। হরতাল বন্ধ করতে হবে। সভা-সমিতি ভেঙ্গে দিতে হবে। রাস্তায় মিছিল করা বে-আইনী ঘোষণা করতে হবে। তবে ঠাণ্ডা হবে ওরা।
আমলাদের সামনে লম্বা ভাষণ দিলেন মকবুল আহমদ।
মন্ত্রীরা ছুটোছুটি করছে।
এক মুহূর্তের বিশ্রাম নেই।
নেতারা তর্কবিতর্কে মেতে উঠেছেন।
আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলছেন।
যে করেই হোক হরতাল বন্ধ করতে হবে।
রাস্তায় মিছিল বের করা বে-আইনী করতে হবে।
পাড়ার মাতব্বরদের ডাকা হয়েছে।
তাদের সঙ্গে পরামর্শ চলছে।
যত লোক লাগে আমরা দেবো।
যত টাকা লাগে আমরা যোগাবো।
পুলিশের প্রয়োজন হলে পুলিশ দেবো।
সব কিছু পাবেন আপনারা।
হরতাল বন্ধ করতে হবে।
মিছিল বন্ধ করতে হবে।
মাতব্বররা ঘাড় নোয়ালেন।
নামাজের সেজদা দেয়ার মতো।
কতগুলো উদ্ধত মুখ।
ঋজু।
কঠিন।
একসঙ্গে চিৎকার করে উঠলো।
না।
আমরা মানি না।
সরকার একশ’ চুয়াল্লিশ ধারা জারী করে আমাদের মুখ বন্ধ করে দেবে। প্রতিবাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে আমাদের। সে অন্যায় আমরা মাথা পেতে নেবো না।
আইন দিয়ে ওরা আমাদের শৃঙ্খলিত করতে চায়। সে শৃঙ্খল আমরা ভেঙ্গে চুরমার করে দেবো।
আমরা গরু ছাগল ভেড়া নই যে, প্রয়োজন বোধে খোঁয়াড়ের মধ্যে বন্ধ করে রাখবে।
তর্কবিতর্ক চললো অনেকক্ষণ ধরে।
আলোচনার ঝড় উঠলো।
কেউ বললো—
আইন, আইন অমান্য করা ঠিক হবে না।
কেউ বললো—
এ আইন শোষণের আইন। এ আইন আমরা মানি না।