রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।

অসংখ্য কণ্ঠের গগনবিদারি চিৎকারে দ্রুত গাড়ি থেকে নিচে নেমে এলেন পুলিশের বড় কর্তারা।

তাদের চোখের ভাষা পড়ে নিতে ছোটকর্তাদের একমুহূর্ত বিলম্ব হলো না।

মুহূর্তে তারা ফিরে তাকালেন কন্সটেবলগুলোর দিকে।

হুকুমের দাস সেপাইগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট লক্ষ করে এগিয়ে এলো রাস্তার মাঝখানে।

প্রথম দশজন ছাত্রের দল তখন তৈরি হচ্ছে একশো চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙার জন্যে।

একটি ছেলে তাদের নাম-ঠিকানা কাগজে লিখে নিচ্ছে।

প্রচণ্ড শব্দে লোহার গেটটা খুলে গেলো।

পুলিশের দল আরো দু-পা এগিয়ে এলো সামনে।

শপথের কঠিন দীপ্তিতে উজ্জ্বল দশজন ছাত্র।

দশটি মুখ।

মুষ্ঠিবদ্ধ হাতগুলো আকাশের দিকে তুলে পুলিশের মুখোমুখি রাস্তায় বেরিয়ে এলো।

রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।

সেপাইরা ছুটে এসে চক্রাকারে ঘিরে দাঁড়ালো ওদের।

সবার বুকের সামনে একটা করে রাইফেলের নল চিকচিক করছে।

আমলা।

মধুর রেস্তোরাঁ।

ইউনিয়ন অফিস।

পুকুরপাড়।

চারপাশ থেকে ধ্বনি উঠলো—

রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।

ততক্ষণে ছাত্রদের দ্বিতীয় দলটা বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়।

তৃতীয় দল এলো।

চতুর্থ দল এলো।

ধরে ধরে সবাইকে দুটো খালি ট্রাকের মধ্যে তুলে নিলো সেপাইরা। পু

লিশের বড়কর্তাদের চোখেমুখে উৎকণ্ঠা।

কত ধরবো?

কত নেবো জেলখানায়?

ঢেউয়ের পর ঢেউয়ের মতো বাইরে বেরিয়ে আসছে ছাত্ররা।

সহসা চোখ-মুখ জ্বালা করে উঠলো ওদের।

সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে।

দরদর করে পানি ঝরছে দুচোখ দিয়ে।

কে যেন চিৎকার দিয়ে উঠলো—

কাঁদুনে গ্যাস ছেড়েছে ওরা।

চোখে পানি দাও।

অনেকগুলো ছাত্র হুমড়ি খেয়ে পড়লো বিশ্ববিদ্যালয়ের পুকুরটার ভেতরে।

চোখ জ্বলছে।

পানি ঝরছে।

কেমন যেন ধোঁয়াটে হয়ে গেছে পুরো এলাকাটা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল টপকে ঝাকোকে ছাত্ররা এগিয়ে গেলো মেডিক্যাল ব্যারাকের দিকে।

কবি আনোয়ার হোসেনের জামাটা একটা লোহার শিকের মধ্যে আটকে ছিঁড়ে গেল।

পেছন ফিরে তাকালেন না তিনি।

চোখমুখ জ্বলছে তার।

জ্বলুক।

ছাত্ররা একশো চুয়াল্লিশ ধারা ভেঙে দিয়েছে।

আন্দোলন সবে শুরু হলো। কাঁদুনে গ্যাসের ধোঁয়া দিয়ে তাকে আটকানো যাবে না।

ভাইসব!

সহসা চিল্কার করে উঠলো তসলিম।

আপনারা বিশৃঙ্খলভাবে ছুটোছুটি করবেন না। আপনারা এদিকে আসুন। আমরা মেডিক্যাল ব্যারাকে আবার জমায়েত হবো।

পুলিশের গাড়িগুলো ততক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে সরে গিয়ে মেডিক্যাল ব্যারাকের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে।

বড়কর্তাদের কাছে হুকুম এসেছে, যেমন করে হোক এ আন্দোলনকে এখানে শেষ করতে হবে।

একটু পরে এসেম্বলি বসবে।

এমএলএরা সবাই আসবেন।

তাদের আসার আগে পথ পরিষ্কার করে দিতে হবে।

ছাত্রদের সরিয়ে দিতে হবে পুরো এলাকা থেকে।

বড়কর্তারা আরো সেপাহি চাইলেন।

আরো গাড়ি চাইলেন।

আরো গাড়ি এলো।

আরো সেপাহি এলো।

আরো অস্ত্র এলো।

সঙ্গে সঙ্গে আরো ছাত্র এলো।

আরো কঠিন শপথে হলো দীপ্ত ওদের মুখ।

মেডিক্যাল কলেজের সামনের রাস্তাটা প্রায় যুদ্ধক্ষেত্রের অবয়ব নিয়েছে।

বিলকিস বানুর গাড়িটা ঘিরে দাঁড়ালো একদল ছাত্র।

এদিকে কী হচ্ছে—ঘুরে দেখবার বাসনা নিয়ে দেখতে এসেছিলেন বিলকিস বানু।

কিন্তু ছাত্রদের হাতে এভাবে ধরা পড়ে যাবেন ভাবতেও পারেননি।

তার গাড়ির চাকা থেকে বাতাস ছেড়ে দেয়া হলো।

কাচগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলো ছাত্ররা।

আপনার সাহস তো কম নয়। লিপস্টিক মেখে গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়াচ্ছেন! জানেন না আজ হরতাল?

আমি কিছু জানি না। কিছু জানতাম না। বিশ্বাস করুন।

ভয়ে আর আতঙ্কে গলাটা শুকিয়ে গেলো বিলকিস বানুর।

ঝড়ে ভেজা কাকের মতো থরথর করে কাপছেন তিনি।

মেয়েমানুষ, আপনাকে মাপ করে দিলাম। গাড়ি এখানে থাকবে। পায়ে হেঁটে যেখানে যাবার চলে যান।

মুহূর্তে গাড়ির কথা ভুলে গেলেন বিলকিস বানু।

গাড়ির চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি।

বেঁচে থাকলে অকে অনেক গাড়ি হবে তার।

একটা পুলিশও ছিলো না ওখানে?

রাগে চোখমুখ লাল হয়ে গেলো মকবুল আহমদের।

দুচোখে পানি ঝরছে বিলকিস বানুর।

আমার চুল টেনে দিয়েছে ছাত্ররা।

আমার মুখে থুথু দিয়েছে ছাত্ররা।

আমার গাড়িটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।

রাগে কাঁপতে কাঁপতে রিসিভার তুলে নিলেন মকবুল আহমদ।

পুলিশের বড়কর্তাকে ফোনে পেয়ে রীতিমতো গালাগাল দিলেন তিনি।

গুণ্ডা বদমায়েশরা রাস্তাঘাটে মেয়েছেলেদের ধরে-ধরে অপমান করছে। দেখতে পাচ্ছেন না? কী করছেন আপনারা?

কাঁদুনে গ্যাস আর লাঠিতে যদি কাজ না হয়, হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে? গুলি করে ওদের খুলি উড়িয়ে দিতে পারছেন না?

মেডিক্যাল ব্যারাকের উপর তখন অজস্র কাঁদুনে-গ্যাসের বর্ষণ চলছ।

স্রোত বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দ্বিগুণ গতি নিয়েছে।

এসেম্বলির দিকে একটা মাইক্রোফোন লাগিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে তসলিম।

তার দিকে চেয়ে-চেয়ে বিড়বিড় করে বললেন কবি আনোয়ার হোসেন—

আন্দোলন সবে শুরু হয়েছে। কার শক্তি আছে একে স্তব্ধ করে দেয়?

মেডিক্যালের রাস্তায় অংসখ্য ইটের টুকরো ছড়ানো।

পুলিশ আর ছাত্রদের মধ্যে এখন ইটের যুদ্ধ চলছে।

পুঁটলিটা বগলে নিয়ে অবাক চোখে সেদিকে চেয়ে রইলো গফুর।

কী হচ্ছে এসব?

ভাবার চেষ্টা করলো।

কিন্তু নিজের ক্ষুদ্রবুদ্ধি দিয়ে কারণ নির্ণয় করতে পারলো না।

সূর্যটা ঈষৎ ঢলে পড়েছে পশ্চিম।

আকাশে তখনো একটুকরো মেঘ নেই।

পলাশের ডালে সোনালি রোদ লালরঙ মেখে নুয়ে পড়েছে পথের দু-পাশে। কয়েকটা কাক তারস্বরে চিৎকার জুড়েছে মেডিক্যালের কার্নিশে বসে।

এতক্ষণ বাতাস ছিলো।

মুহূর্ত-কয়েক আগে তাও বন্ধু হয়ে গেছে।

সহসা শব্দ হলো।

গুলির শব্দ।

আবার!

আবার!!

মুহূর্তে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল সবাই।

ছাত্র।

জনতা।

মানুষ।

এক ঝলক দমকা বাতাস হঠাৎ কোত্থেকে যেন ছুটে এসে ধাক্কা খেলো ব্যারাকের এক-কোণে দাঁড়ানো আমগাছটিতে।

অনেকগুলো মুকুল ঝরে পড়লো মাটিতে।

কাকগুলো চিঙ্কার থামিয়ে পরস্পরের মুখের দিকে তাকালো।

তারপর একটা কাক ভয়ার্ত ডানা মেলে আকাশে উড়লো।

আকাশে তখনো গনগনে রোদ।

শহরের সমস্ত আকাশ জুড়ে উড়তে লাগলো কাকটা।

কোথাও কোনো শব্দ নেই।

শুধু একটি ভয়ার্ত কাক আশব্দে উড়তে থাকলো আকাশে।

ঈশানকোণ থেকে ভেসে এলো একটুকরো কালো মেঘ।

সহসা সেই মেঘের আড়ালে মুখ লুকালো সূর্য।