অর্থ আর প্রাচুর্যের অফুরন্ত সমাবেশ।

অভাব বলতে কিছু নেই। মকবুল আহমদের জীবনে।

বাড়ি আছে।

গাড়ি আছে।

ব্যাঙ্কে টাকা আছে।

ছেলেমেয়েদের ইনসুরেন্স আছে কয়েকখানা।

ব্যবসা একটা নয়।

অনেক। অনেকগুলো।

পানের ব্যবসা।

তেলের ব্যবসা।

পাটের ব্যবসা।

পারমিটের ব্যবসা।

সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হয় তাঁকে।

কখনো নেতার বাড়িতে।

কখনো আমলাদের সভা-সমিতিতে।

তাঁর জীবনেও দুঃখ অনেক।

দুটো পাটকল বসাবার বাসনা ছিল। একটার কাজও এখনো শেষ হলো না। শ্রমের দুঃখ।

বড় ছেলেটাকে বাচ্চা বয়সেই বিলেতে পাঠিয়ে ভালো শিক্ষা দেয়ার ইচ্ছে ছিলো। স্ত্রী তার সন্তানকে কাছ ছাড়া করতে রাজি হলো না। জাগতিক দুঃখ।

তেলের কলের শ্রমিকগুলো শুধু বেতন বাড়াবার জন্যে সারাক্ষণ চিৎকার করে, আর হরতালের হুমকি দেয়। দুঃখ। উৎপাদনের দুঃখ। কিছু ছেলে ছোকরা এবং গুণ্ডা জাতীয় লোক পথে-ঘাটে মাঠে-ময়দানে মিছিল বের করে। সভা বসিয়ে সরকারের সমালোচনা করে। যাদের টাকা আছে তাদের সব টাকা গরিবদের বিলিয়ে দিতে বলে। দুঃখ। দেশের দুঃখ।

এই অনেক দুঃখের মধ্যেও একটা আনন্দ আছে তাঁর। যখন সারাদিনের ব্যস্ততার শেষে রাতে ক্লাবের এক কোণে চুপচাপ বসে বোতলের পর বোতল নিঃশেষ করেন তিনি। তখন অদ্ভুত এক আনন্দে ভরে ওঠে তাঁর চোখ মুখ।

স্ত্রী বিলকিস বানুর সঙ্গে তাঁর কদাচিৎ দেখা হয়। একই বাড়িতে থাকেন। এক বিছানায় শোয়। কিন্তু কাজের চাপে, টেলিফোনের অহরহ যন্ত্রণায় স্ত্রীর সঙ্গে বসে দু’দণ্ড আলাপ করার সময় পান না তিনি।

অথচ স্ত্রীকে তিনি ভীষণ ভালোবাসেন।

তাঁর সুখ-শান্তির প্রতি লক্ষ্য রাখেন।

এবং যখন যা প্রয়োজন মেটাতে বিলম্ব করেন না।

স্বামীর সঙ্গ পান না, সে জন্যে বিলকিস বানুর মনে কোন ক্ষোভ নেই।

কারণ, সঙ্গ দেওয়ার লোকের অভাব নেই তাঁর জীবনে।

 

সেলিমও স্বপ্ন দেখে।

একটা রিক্সা কেনার স্বপ্ন।

বারো বছর ধরে মালিকের রিক্সা ভাড়ায় চালিয়ে চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে।

সারাদিনের পরিশ্রম শেষে তিনটি টাকা রোজগার হলে দুটো টাকা মালিককে দিয়ে দিতে হয়। একটা টাকা থাকে ওর।

সেই টাকায় বউ আর বাচ্চাটাকে নিয়ে দিনের খাওয়া হয়।

মাসের বাড়ি ভাড়া।

বিড়ি কেনা।

আর সিনেমা দেখা।

পোষায় না তার।

দেশ কি সে জানে না।

সভা-সমিতি-মিছিলে লোকগুলো কেন এতো মাতামাতি করে তার অর্থ সে বুঝে না।

পুলিশেরা যখন ছাত্রদের ধরে ধরে পেটায় তখন সে অবাক চোখে চেয়ে চেয়ে দেখে। কোন মন্তব্য করে না। তার ভাবনা একটাই।

একটা রিক্সা কিনতে হবে।

আরো একটা ভাবনা আছে তার। মাঝে মাঝে ভাব।

ছেলেটা আর একটু বড় হলে তাকেও রিক্সা চালানো শেখাতে হবে।

 

খেয়াঘাট পেরিয়ে শহরে এলো গফুর।

বগলে একটা ছোট্ট কাপড়ের পুটলী।

পুটলীতে বাঁধা একটা বাড়তি লুঙ্গি, জামা, আর কিছু পিঠে।

শহরে নেমেই সে অবাক হয়ে দেখলো মানুষগুলো সব কেমন যেন উত্তেজনায় উত্তপ্ত।

এখানে সেখানে জটলা বেঁধে কি যেন আলাপ করছে তারা।

খবরের কাগজের হকাররা অস্থিরভাবে ছুটাছুটি করছে।

কাগজ কেনার ধুম পড়েছে চারদিকে।

সবাই কিনে কিনে পড়ছে ৷

উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে এদেশের।

না! না!!

চিৎকার করে উঠলেন কবি আনোয়ার।

আমি মানি না।

স্ত্রী অবাক হয়ে তাকালো তাঁর দিকে।

স্বামীকে এতো জোরে চিৎকার করতে কোনদিন দেখেনি সে।

কেন, কি হয়েছে?

ওরা বলছে বাংলাকে ওরা বাদ দিয়ে দেবে। উর্দু, শুধু উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করবে ওরা। জানো সালেহা, যে ভাষায় আমরা কথা বলি, যে ভাষায় আমি কবিতা লিখি, সে ভাষাকে বাদ দিতে চায় ওরা।

সে কিগো! আমরা তাহলে কোন্ ভাষায় কথা বলবো?

ভয়ার্ত দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকায় সালেহা।

না। না। আমি অন্যের ভাষায় কথা বলবো না! আমি নিজের ভাষায় কথা বলবো।

কবি আনোয়ার হোসেন চিৎকার করে উঠলেন।

বজ্র থেকে ধ্বনি নিয়ে গর্জন করে উঠলো তসলিম।

এই সিদ্ধান্ত আমি মানি না।

আমরা মানি না।

মানি না!

মানি না!!

মানি না!!!

আমতলায় ছাত্রদের সভাতে অনেকগুলো কণ্ঠ এক সুরে বলে উঠলো, আমরা মানি না।

বাচ্চারা কোন কিছুই সহজে মানতে চায় না ৷

তাদের মানিয়ে নিতে হয়।

আমলাদের সভায় মেপে মেপে কথাগুলো বললেন মকবুল আহমদ। প্রথমে আদর করে দুধ কলা খাইয়ে ওদের মানিয়ে নিতে হয়। তবু যদি না মানে চাবুকটাকে তুলে নিতে হবে হাতে। মানবে না কি? মানতে বাধ্য হবে তখন।

কতগুলো মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আকাশের দিকে তুলে শ্লোগান দিচ্ছে—

রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।

আজ পান খাওয়া ভুলে গেলেন কবি আনোয়ার হোসেন। সেদিকে তাকিয়ে চোখজোড়া আনন্দে জ্বল জ্বল করে উঠলো তাঁর।

ভুলে গেলেন— কখন পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়েছেন।

তিনি দেখছেন মিছিলের মুখগুলোকে।

রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।

পেছন থেকে কে যেন ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল তাঁকে। কি সাব। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কি দেখেন?

রিক্সা চালক সেলিম।

তার রিক্সাটা নিয়ে এগিয়ে যায় সামনে।

ছেলেগুলো চিৎকার করছে। করুক। ওতে তার কোন উৎসাহ নেই। পারবে না। তুমি দেখে নিও। ওরা জোর করে উর্দুকে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারবে না।

গদগদ কণ্ঠে স্ত্রীকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন কবি আনোয়ার হোসেন। ছেলেরা ক্ষেপেছে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে ওরা ছাড়বে না।

স্ত্রী পান খাচ্ছিলো।

একটুখানি চুন মুখে তুলে বললো— হ্যাঁ গা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলে তোমার বেতন কি বেড়ে যাবে? ক’টাকা বাড়বে বলতো।

কি যে হবে দেশের কিছু জানি না। বিদেশের চোর এসে ভরে গেছে পুরো দেশটা।

স্ত্রীর সঙ্গে বহুদিন পরে আজ কথা বলতে বসলেন মকবুল আহমদ। বাংলা বাংলা করে চিৎকার করছে ওরা। বাংলা কি মুসলমানের ভাষা নাকি? ওটাতো হিন্দুদের ভাষা। হিন্দুরা এদেশটাকে জাহান্নামে নেবে। কথাটা চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন বিলকিস বানু।

কোথায় উর্দু আর কোথায় বাংলা! উর্দু হচ্ছে খানদানী ভাষা।

আমাদের ফ্যামিলিতে বাবা মা সবাই উর্দুতে কথা বলেন।

 

উর্দু বাংলা আমি কিছু বুঝি না। আমার সোজা কথা। তোমার ছেলেকে সাবধান করে দাও। ও যদি আবার সে সভা-সমিতি আর আন্দোলন করে তাহলে এদ্দিন প্রমোশন বন্ধ হয়েছিল, এবার আমার চাকরিটাই যাবে।

তসলিমের পুলিশ বাবা। উত্তেজনায় থর থর করে কাঁপতে লাগলেন। মাও শিউরে উঠলেন।

অনাগত ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কথা ভাবতে গিয়ে চোখে পানি এসে গেলো তাঁর।

তুই কেমন নিষ্ঠুর ছেলেরে।

তসলিমকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন তিনি।

তোর মা বাবা ভাই বোনগুলোর কথা ভেবেও কি তুই ওসব ক্ষান্ত দিতে পারিস না? চাকরিটা চলে গেলে আমরা খাবো কি?

তসলিম নিশ্চুপ।

সালমা বললো—

খালুজান ক’দিন ধরে আপনার চিন্তায় চিন্তায় খাওয়া-দাওয়াও ছেড়ে দিয়েছেন। এসব কাজ না করলেই তো পারেন। কি হবে এসব করে?

সালমার দিকে অবাক হয়ে তাকালো তসলিম। এর মধ্যে সালমাকে অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে হয়েছিলো তার। কিন্তু কিছুই বললো না। শুধু বললো—

তুমি ওসব বুঝবে না।