কচু পাতার উপরে টল টল করে ভাসছে কয়েক ফোঁটা শিশির।
ভোরের কুয়াশার নিবিড়তার মধ্যে বসে একটা মাছরাঙা পাখি। ঝিমুচ্ছে শীতের ঠাণ্ডায়। একটা ন্যাংটা ছেলে, বগলে একটি স্লেট আর মাথায় একটা গোল টুপি গায়ে চাদর।
পায়ে চলা ভেজা পথ ধরে স্কুলে যাচ্ছে।
অনেকগুলো পাখি গাছের ডালে বসে নিজেদের ভাষায় অবিরাম কথা বলে চলেছে।
কতগুলো মেয়ে।
ত্রিশ কি চল্লিশ কি পঞ্চাশ হবে। কলসি কলসি
একটানা কথা বলছে। কেউ কারো কথা শুনছে না। শুধু বলে যাচ্ছে।
কতগুলো মুখ।
মিছিলের মুখ ৷
রোদে পোড়া।
ঘামে ভেজা।
শপথের কঠিন উজ্জ্বল দীপ্তিতে ভাস্বর।
এগিয়ে আসছে সামনে।
জ্বলন্ত সূর্যের প্রখর দীপ্তিকে উপেক্ষা করে।
সহসা কতগুলো মুখ।
শাসনের-শোষণের-ক্ষমতার-বর্বরতার মুখ।
এগিয়ে এলো মুখোমুখি।
বন্দুকের আর রাইফেলের নলগুলো রোদে চিক্চিক্ করে উঠলো।
সহসা আগুন ঠিকরে বেরুলো।
প্রচণ্ড শব্দ হলো চারদিকে।
গুলির শব্দ।
কচু পাতার উপর থেকে শিশির ফোঁটাগুলো গড়িয়ে পড়লো মাটিতে।
মাছরাঙা পাখিটা ছুটে পালিয়ে গেলো ডাল থেকে।
ন্যাংটা ছেলেটার হাত থেকে পড়ে গিয়ে স্লেটটা ভেঙ্গে গেলো।
পাখিরা নীরব হলো।
মেয়েগুলো সব স্তব্ধ নির্বাক দৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে তাকালো।
একরাশ কৃষ্ণচূড়া ঝরে পড়লো গাছের ডাল থেকে।
সূর্যের প্রখর দীপ্তির নিচে একটা নয়— দুটো নয়, অসংখ্য কালো পতাকা এখন।
উদ্ধত সাপের ফণার মতো উড়ছে।
একুশে ফেব্রুয়ারি।
সন ঊনিশশ’ বায়ান্ন।
খুব ছোট ছোট স্বপ্ন দেখতো।
চাষার ছেলে গফুর।
একটি ছোট্ট ক্ষেত।
একটি ছোট্ট কুঁড়ে।
আর একটা ছোট্ট বউ।
ক্ষেতের মানুষ সে।
লেখাপড়া করেনি।
সারাদিন ক্ষেতের কাজ করতো।
গলা ছেড়ে গান গাইতো।
আর গভীর রাতে পুরো গ্রামটা যখন ঘুমে ঢলে পড়তো তখন ছোট্ট মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে পুঁথি পড়তো সে, বসে বসে।
আমেনাকে দেখেছিলো একদিন পুকুর ঘাটে।
ঘোমটার আড়ালে ছোট্ট একটি মুখ।
কাঁচা হলুদের মতো রঙ।
ভালো লেগেছিলো।
বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে মেয়ের বাবা রাজি হয়ে গেলো।
ফর্দ হলো।
গফুরের মনে খুশি যেন আর ধরে না।
ক্ষেতভরা পাকা ধানের শিষগুলোকে আদরে আলিঙ্গন করলো সে।
রসভরা কলসিটাকে খেজুরের গাছ থেকে নামিয়ে এনে এক নিঃশ্বাসে পুরো কলসিটাকে শূন্য কর দিলো সে।
জোয়ালে বাঁধা জীর্ণ-শীর্ণ গরু দুটোকে দড়ির বাঁধন থেকে ছেড়ে দিয়ে চিৎকার করে বললো— যা আজ তোদের ছুটি।
গফুর শহরে যাবে।
বিয়ের ফর্দ নিয়ে।
সব কিছু নিজের হাতে কিনবে সে।
শাড়ি, চুড়ি, আলতা, হাঁসুলি।
অনেক কষ্টে সঞ্চয় করা কতগুলো তেল চিট্চিটে টাকার কাগজ রুমালে বেঁধে নিলো সে। বুড়িগঙ্গার উপর দিয়ে খেয়া পেরিয়ে শহরে আসবে গফুর। বিয়ের বাজার করতে।
বাবা আহমেদ হোসেন।
পুলিশের লোক।
অতি সচ্চরিত্র
তবু প্রমোশন হলো না তাঁর।
কারণ, তসলিম রাজনীতি করে।
ছাত্রদের সভায় বক্তৃতা দেয়।
সরকারের সমালোচনা করে।
ছেলেকে অনেক বুঝিয়েছেন বাবা।
মেরেছেনও।
যাঁর ধমকে দাগী চোর, ডাকাত, খুনী আসামীরা ভয়ে থর থর করে কাঁপতো— তাঁর অনেক শাসন, তর্জন-গর্জনেও তসলিমের মন টললো না। মিছিলের মানুষ সে।
মিছিলেই রয়ে গেলো।
মা কাঁদলেন।
বোঝালেন, দিনের পর দিন।
আত্মীয়স্বজন সবাই অনুরোধ করলো।
বললো বুড়ো বাপটার দিকে চেয়ে এসব এবার ক্ষান্ত দাও। দেখছো না ভাইবোনগুলো সব বড় হচ্ছে। সংসারের প্রয়োজন দিন দিন বাড়ছে। অথচ প্রমোশনটা বন্ধ হয়ে আছে।
কিন্তু নিষ্ঠুর হৃদয় তসলিম বাবার প্রমোশন, মায়ের কান্না, আত্মীয়দের অনুরোধ, সংসারের প্রয়োজন সব কিছুকে উপেক্ষা করে মিছিলের মানুষ মিছিলেই রয়ে গেলো।
কিন্তু এই নিষ্ঠুর হৃদয়ে কোমল ক্ষত ছিলো।
সালমাকে ভালবাসতো সে।
সালমা ওর খালাতো বোন।
একই বাড়িতে থাকতো।
উঠতো বসতো চলতো।
তবু মনে হতো সালমা যেন অনেক—অনেক দূরের মানুষ।
তসলিমের হৃদয়ের সেই কোমল ক্ষতটির কোন খোঁজ রাখতো না সে। কিংবা রাখতে চাইতো না।
বহুবার চেষ্টা করেছে তসলিম।
বলতে বোঝাতে। কিন্তু সালমার আশ্চর্য ঠাণ্ডা চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে কিছুই বলতে পারেনি সে।
এককালে ভালো কবিতা লিখতেন তিনি।
এখন সরকারের লেজারে টাকার অঙ্ক থরে থরে লিখে রাখা তাঁর কাজ।
কবি আনোয়ার হোসেন।
এখন কেরানি আনোয়ার হোসেন।
তবু কবি মনটা মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে যায়। যখন তিনি দিনের শেষে রাতে ঘরে ফিরে এসে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করেন।
ঝগড়া করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন।
যখন এ দেহ মন জীবন আর পৃথিবীটাকে নোংরা একটি ছেঁড়া কাঁথার মতো মনে হয়, তখন একান্তে বসে কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে তাঁর। আনোয়ার হোসেনের জীবনে অনেক অনেক দুঃখ।
ঘরে শান্তি নেই। স্ত্রীর দুঃখ।
বাসায় প্রয়োজনীয় আসবাব-পত্র নেই। থাকার দুঃখ।
সংসার চালানোর মতো অর্থ কিংবা রোজগার নেই। বাঁচার দুঃখ।
কবিতা লিখতে বসে দেখেন ভাব নেই। আবেগের দুঃখ।
শুধু একটি আনন্দ আছে তাঁর জীবনে।
যখন তিনি অফিস থেকে বেরিয়ে সামনের পানের দোকান থেকে কয়েকটা পান কিনে নিয়ে মুখে পুরে চিবুতে থাকেন। আর পথ চলতে চলতে কবিতা লেখার দিনগুলোর কথা ভাবতে থাকেন। তখন আনন্দে ভরে ওঠে তাঁর সারা দেহ।
কবি আনোয়ার হোসেন, ঘর আর অফিস, অফিস আর ঘর ছাড়া অন্য কোথাও যান না।
যেতে ভালো লাগে না, তাই।
কোনদিন পথে কোন বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে হয়তো একটা কি দুটো কুশল সংবাদ জিজ্ঞেস করেন। তারপর এড়িয়ে যান।
ভালো লাগে না।
কিছুই ভালো লাগে না তাঁর।