» » বিচার-বিভাগ

বর্ণাকার

বিচার-বিভাগ

আধুনিক গণকল্যাণ রাষ্ট্রের একটি মহৎ লক্ষণ হচেছ প্রশাসন নিরপেক্ষ স্বাধীন বিচার-বিভাগ সংস্থাপন। বলা বাহুল্য, বর্তমান সভ্যতাভিমানী রাষ্ট্রসমূহে এ লক্ষণটি বিকশিত হয়েছে বহু বিলম্বে বহু আবর্তনের মাধ্যমে। কিন্তু খলিফা ওমরের প্রতিভার ফলশ্রুতিরূপে বিচার-বিভাগ প্রশাসনিক আওতা থেকে তার খেলাফতের প্রথমভাগেই মুক্ত হয়েছিল।

আবুবকরের সময় পর্যন্ত স্বয়ং খলিফা ও তার প্রশাসন কর্মচারীরাই কাজীর বা বিচারকের কর্তব্য পালন করেছেন। ওমর প্রথমেও এরূপ কর্তব্য পালন করেছেন যতদিন না তাঁর প্রশাসনিক ক্ষমতা অবিসংবাদী রূপে প্রতিষ্ঠিত ও জনগণের শ্রদ্ধাই হয়েছে। এ প্রত্যয় তাঁর সুদৃঢ় ছিল যে, যতক্ষণ না গণমনে কারও মর্যাদা শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত না হয় ততক্ষণ তার বিচারকর্ম আস্থাভাজন হয় না। এ প্রত্যয়ে নিষ্ঠা থাকায় ওমর আবু মুসা আশারীকে একদা লিখেছেন: এমন কোনও ব্যক্তিকে কাজী নিযুক্ত করা উচিত হবে না যিনি জনগণের শ্রদ্ধা আকর্ষণে অক্ষম। শুধু এই কারণেই ওমর আবদুল্লাহ বিন্ মাসুদকে বিচার-কার্য করতে নিষেধ করেছিলেন।

খেলাফতের প্রভাব সুপ্রতিষ্ঠিত হলেই ওমর বিচার বিভাগকে পৃথক করেন। তিনি কাজী নিযুক্ত করেন। কেবলমাত্র বিচারকর্ম করতে এবং এ বিষয়ে তিনি কুফার শাসনকর্তা আবু মুসা আশারীর নিকট যে ঐতিহাসিক ফরমান প্রেরণ করেন, সেটিতে বিচারকের অবশ্য পালনীয় মৌলিক নীতিসমূহ বিশদরূপে বিবৃত হয়েছে।

ফরমানটির আক্ষরিক অনুবাদ এই :

‘আল্লাহ্‌র প্রশংসা কীর্তিত হোক। এখন, ন্যায়-বিচার একটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। তোমার উপস্থিতিতে, তোমার এজলাসে এবং তোমার রায়ে সকল মানুষকে সমান ব্যবহার দেখাবে, যাতে দুর্বল ন্যায়-বিচারে আস্থা না হারায় এবং সবল অনুগ্রহের আশা না রাখে। প্রমাণের ভার বাদীর উপর এবং অস্বীকৃতি যেন শপথ নিয়ে করা হয়। আপোষ করা যেতে পারে, কিন্তু তার দরুণ ন্যায়কে অন্যায় ও অন্যায়কে ন্যায় করা চলবে না। পুনর্বিবেচনায় তোমার সিদ্ধান্তকে পরিবর্তন করতে কোন বাধা যেন না জন্মে (যদি পূর্বসিদ্ধান্ত ভ্রান্ত হয়)। কোনও প্রশ্নে সংশয় দেখা দিলে এবং কোরান কিংবা মহানবীর সুন্নায় তার বিষয়ে কিছু না পাওয়া গেলে প্রশ্নটি পুনরায় চিন্তা করো। নজীর সমূহ ও অনুরূপ পূর্ব-মামলাগুলিও বিবেচনা করবে এবং তার পর উপমা-নির্ভর সিদ্ধান্তে উপস্থিত হবে। যে সাক্ষী উপস্থিত করতে চায়, তাকে শর্তাধীন হতে হবে। যদি সে দাবী প্রমাণ করে তবে তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত কর। অন্যথায় তার মামলা ডিসমিস হবে। সব মুসলিমই বিশ্বাসযোগ্য, কিন্তু তারা নয়, যারা বেত্রদণ্ড লাভ করেছে, কিংবা মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে, কিংবা যাদের ওয়ারিসী সম্বন্ধে সংশয়কুল।’

বিচারবিভাগের ন্যায়পরায়ণতা এবং বিচারে ন্যায় রক্ষা হয় তিনটি মৌলনীতিতে: আইনের নির্ভুলতা ও সর্বময়তা, যার দ্বারা বিচারকার্য করতে হয়; সাধু, নির্লোভ ও দক্ষ বিচারক নিয়োগে এবং কতকগুলি নিয়ম ও নীতির উপস্থিতি, যার দরুন বিচারকরা পক্ষপাতিত্ব দেখাতে না পারেন এবং উৎকোচ ও অন্যায় প্রভাবের শিকার না হন। তার সঙ্গে আরও একটি নিয়ম যোগ করা উচিত। বিচারকের সংখ্যা মামলা দায়েরের সংখ্যানুপাতিক হওয়া চাই, যাতে বিচারে অযথা বিলম্ব না হয়। ওমর এ-সব নিয়মের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করেছিলেন। নতুন আইন প্রবর্তনের প্রয়োজন ছিল না, কারণ ইসলামী আইনের মৌল উৎসই হচ্ছে কোরআন। কোরআনে পরিচ্ছন্ন নির্দেশ কিংবা বিশদ তথ্য পাওয়া না গেলে সুন্না, ইজমা ও ক্বিয়াস হবে তার সহায়ক ও পরিপূরক। বিচারকদিগকে ওমর বারে বারে আইনের মৌল উৎসসমূহের দিকে লক্ষ্য রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন : মামলার নিষ্পত্তি করতে হবে কোরআনের বিধিবিধান অনুযায়ী; যেখানে কোরআনের বিধান মিলবে না, কিংবা তা পরিচ্ছন্ন হয় না, সেক্ষেত্রে সুন্নার সাহায্য নেওয়া উচিত সুন্নাতেও যার বিধান মেলে না, তার নিষ্পত্তি করতে হবে মুসলিমের সর্ববাদিসম্মত মতভিত্তিতে। তাতেও অক্ষম হলে বিচারক নিজের জ্ঞান প্রয়োগ করবেন। ওমর কেবল ফরমান জারী করেই ক্ষান্ত হন নি, তিনি মাঝে মাঝে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সমাধান হিসেবে ফতোয়া বা মীমাংসা লিখে কাজীদের নিকট পাঠিয়ে দিতেন আদর্শ হিসেবে। তাঁর ফতোয়াসমূহ সংরক্ষিত হলে একটি আদর্শ ন্যায়সংহিতা পাওয়া যেতো; কিন্তু কালের করালগ্রাসে তাদের অনেকগুলিই হারিয়ে গেছে, কয়েকটি মাত্র পাওয়া যায় ‘আখবারুল-কুয়াত’ ‘কানযুল-উমমাল’ ও শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলবীর ‘ইযালাতুলখিফা’ নামক গ্ৰন্থসমূহে।

কাজী নির্বাচনে ওমর কতোখানি সাবধানতা ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেন, তার প্রমাণ এই যে, তাঁর নিয়োজিত কাজীরা সারা আরবের শ্রদ্ধেয় ও মর্যাদাসিক্ত ব্যক্তি ছিলেন। রাজধানী মদিনায় নিযুক্ত কাজী যিয়াদ-বিন্-সাবিত ছিলেন ওহী-প্রাপ্ত কোরআনের বাণীসমূহের বিশ্বনবী-নিযুক্ত লিপিকার, সিরীয় ও হিব্রুভাষায় সুপণ্ডিত এবং দায়বিষয়ক আইনে সারা আরবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বসরার কাজী কাব-বিন্-সুর-আল-আবদী ছিলেন মহাজ্ঞানী ও গভীর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, তাঁর বহু রায় লিপিবদ্ধ করেছেন ইমাম-বিন-শিরিন। প্যালেস্টাইনের কাজী ইবাদা-বিন-সামাত বিশ্বনবীর জীবিতাবস্থায় প্রসিদ্ধ হাফিয-ই-কোরআন-পঞ্চকের অন্যতম ছিলেন এবং খোদ নবী-করিম (স.) তাঁকে আসহাবে সাফ্ফার শিক্ষক নিযুক্ত করেছিলেন। ওমর ইবাদাকে এতোখানি সম্মানের চোখে দেখতেন যে, আমির মুয়াবিয়ার সঙ্গে তাঁর মনান্তর হলে ওমর তাঁকে মু’আবিয়ার কর্তৃত্ব থেকে নিষ্কৃতি দেন। কুফার কাজী আবদুল্লাহ-বিন্-মসউদের পাণ্ডিত্য ও বিচার জ্ঞান ছিল সন্দেহাতীত। হানাফী আইনের জনক হিসেবে তিনি কীর্তিত। তাঁর স্থলাভিষিক্ত কাযী শুরায়হ্ সাহাবা না হয়েও সারা আরবে প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার জন্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন এবং মহাজ্ঞানী আলী তাঁকে আদ্-উল-আরব অর্থাৎ সারা আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যায়াবীশ আখ্যা দিয়েছেন। এ-সব ছাড়া আরও বহু কীর্তিমান কাজীর নামোল্লেখ পাওয়া যায় সমকালীন সাহিত্যে, যাঁরা ওমরের খেলাফত আমলে কাজীর আসন অলঙ্কৃত করেছিলেন।

ওমর কাজী নিয়োগ করতেন স্বয়ং পরীক্ষা করে এবং ব্যক্তিগতভাবে তাঁর চরিত্র ও কাজের সঙ্গে পরিচিত হয়ে। কাজীরা প্রাদেশিক শাসকদের কর্তৃত্বাধীনে থাকতেন এবং শাসকদের কাজী নিয়োগের এখতিয়ারও ছিল। কিন্তু এ বিষয়ে বিশেষ সাবধানতার হেতু ওমর কাজী নিয়োগের কাজটি নিজের হাতেই রাখতেন। এ বিষয়ে কারও সুপারিশ চলতো না। কাজী শুরায় নিয়োগ হয়েছিল এভাবে: ওমর একটি অশ্ব ক্রয় করেন এবং তার উপযোগিতা পরীক্ষা করতে জনৈক ব্যক্তিকে আদেশ দেন। সে লোকটি দৌড় দেওয়ার সময় ঘোড়াটিকে খোঁড়া করে ফেলে। তখন ওমর মালিককে ঘোড়াটি ফেরত দিতে চান, কিন্তু মালিক নিতে অস্বীকার করে। ওমর এ বিষয়ে মীমাংসার জন্যে শুরায়কে অনুরোধ করেন। শুরায়হ্ বলেন, যদি মালিকের অনুমতিক্রমে দৌড় দেওয়া হয়ে থাকে তা হলে সে ফেরত নিতে বাধ্য, অন্যথায় বাধ্য নয়। ওমর এ মীমাংসায় প্রীত হন এবং শুরায়হ্ কুফার কাজী নিযুক্ত হন। কাজীরা যাতে উৎকোচ কিংবা অন্যায় পুরস্কার নিতে প্রলুব্ধ না হন, তাঁর জন্যে তাঁদের অভাব মোচনার্থে উচ্চ বেতন দেওয়া হতো। সাধারণত কাজীদের বেতন ছিল মাসিক পাঁচশত দিরহাম। আরও নিয়ম ছিল যে স্বচ্ছল সদ্বংশজাত সাধু ব্যক্তি ব্যতীত কেউ কাজীর আসন অলঙ্কৃত করতে পারবেন না। কাজীরা ব্যক্তিগত ব্যবসা কিংবা স্থানীয় নাগরিকদের সঙ্গে ক্রয়-বিক্রয় বা বিনিময় করতে পারতেন না।

আইনের চোখে ধনী-নির্ধন, উচ্চ-নীচ, রাজা-প্রজা ভেদাভেদ নেই-এ নীতিটি ওমর আক্ষরিকভাবে পালন করতেন। তিনি বহুবার আদালতে বাদী প্রতিবাদীরূপে উপস্থিত হয়ে এ নীতিটি উপস্থিত করেছেন। একবার উবাই নামক জনৈক ব্যক্তি ওমরের নামে যিয়াদ-বিন্-সাবিতের আদালতে একটি নালিশ রুযু করে। সাধারণ বিচারপ্রার্থীর মতো ওমর আদালতে উপস্থিত হলে যিয়াদ তাঁকে সম্মান দেখাতে চান। ওমর বিরক্ত হয়ে যিয়াদকে ভর্ৎসনা করেন, “এটি তোমার প্রথম বে-ইনসাফ” এবং বাদী উবাইয়ের পাশে আসন গ্রহণ করেন। ওমর দাবী অস্বীকার করেন। উবাইয়ের সাক্ষী না থাকায় প্রচলিত আইনানুযায়ী সে দাবী করে, “ওমর শপথ নিয়ে দাবীটি অস্বীকার করুন।” খোদ আমীরুল মুমেনীনকে শপথ নিতে সঙ্কোচ বোধ করে যিয়াদ উবাইকে দাবীটি তুলে নিতে অনুরোধ করেন। ওমর রাগান্বিত হয়ে বলেন, “যদি ওমর ও অন্য সাধারণ ব্যক্তি তোমার চোখে তুল্যমূল্য না হয়, তা হলে কাজীর আসনে বসা তোমার শোভা পায় না।”

প্রত্যেক জেলায় অন্তত একজন কাজী নিযুক্ত থাকতেন। মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে অতিরিক্ত কাজী নিযুক্ত হতেন। অমুসলিমরা নিজেদের মধ্যেই বিবাদ মীমাংসা করে ফেলতে পারতো এবং কাজীর নিকট প্রায় ক্ষেত্রে হাজির হতো না। কিন্তু ওমরের এদিকে লক্ষ্য ছিল যে, বিচার ত্বরান্বিত হয়, ব্যয়সাধ্য না হয় ও প্রত্যেকের নিকট সহজলভ্য হয়। বাদীকে কোন ফি দিতে হতো না, মৌখিক নালিশ রুযু করা চলতো। নিজেই সাক্ষী হাজির করে পক্ষগণ নিজ নিজ দাবী প্রমাণ করতো। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ সাক্ষী কাজী নিজেই তলব করতেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একদা ওমরের নিকট জাবরকান নালিশ করেন, হাতীয়া একটি শ্লেষাত্মক কবিতা লিখে তাঁর সম্মানহানি করেছেন। কবিতাটির টেকনিক অভিনব থাকায় ওমর হাসান-বিন্-সাবিত নামক তৎকালীন মশহুর কবিকে আহ্বান করেন কবিতার প্রকৃত মর্ম ব্যক্ত করতে এবং তাঁর প্রদত্ত সাক্ষ্যানুসারে ওমর মামলাটির বিচার করেন। উত্তরাধিকার প্রশ্নে শারীরবিজ্ঞানীর বিশেষ সাক্ষ্য গ্রহণ করা হতো।

ওমরের আর একটি কৃতিত্ব হচ্ছে ‘ইতা’ অর্থাৎ আইন উপদেষ্টার পদ প্রবর্তন। বিচারকর্মের অন্যতম মৌলনীতি হচ্ছে, প্রত্যেকেই আইন জানে, এ অনুমান গ্রহণীয় কেউ অপরাধমূলক কাজ করে এ রকম সাফাই নিতে পারে না, সে আইন জানে না। পৃথিবীর সকল সভ্য দেশে এ নিয়ম নিঃসন্দেহে সুপ্রতিষ্ঠিত যে, আইন জ্ঞাত নয়, এ সাফাই অচল। কিন্তু নীতি প্রতিষ্ঠিত হলেও এ পর্যন্ত কোনও সভ্যদেশে এমন কোনও অবস্থা অবলম্বিত হয় নি, যার দ্বারা জনসাধারণকে প্রচলিত আইনসমূহ সম্যক জ্ঞাত করা যায়। সাধারণ ব্যক্তি ব্যয়সাধ্য উকিলের পরামর্শ গ্রহণে বাধ্য হয়। ওমর আইন উপদেষ্টার পদ সৃষ্টি করে বিনা ব্যয়ে জনগণকে আইনের সাহায্য লাভের পথসুগম করে দেন। প্রত্যেক শহরে জনবহুল কেন্দ্রস্থলে একজন ফকীহ্ নিযুক্ত থাকতেন, তাঁর কর্তব্য ছিল বিনা পারিশ্রমিকে জনসাধারণকে আইনের সঠিক পরামর্শ দান করা। ফতোয়া দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। আলী, ওসমান, মুয়ায বিন্-জবল, আবদুর রহমান-বিন্‌-আউফ, উবাই-বিন্-ক্কব, যায়েদ-বিন্ সাবিত, আবু হোরায়রাহ্, আবু দর্দা প্রমুখের উপর এ-ভার ন্যস্ত ছিল। শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্ ‘ইযালাতুলখিফা’য় বলেছেন : প্রথম যুগে ফতোয়া দেওয়ার অধিকার খলিফার অনুমতি সাপেক্ষ ছিল এবং তাঁর হুকুম ব্যতীত কেউ আইনের ব্যাখ্যা করতে বা ফতোয়া দেবার অধিকারী ছিল না। পরবর্তীকালে অবশ্য অনেকে খলিফার অনুমতি ব্যতীত ফতোয়া দিতেন। মুফতীদের কর্তব্য ছিল, ফতোয়া প্রকাশ্যে প্রচার করবেন। সেকালে সংবাদপত্র বা আধুনিক রেডিও-টেলিভিশনের ন্যায় প্রচারযন্ত্র ছিল না। এজন্যে মুফ্‌তীকে ফতোয়া প্রচার করতে হতো জনসমাবেশে। প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সিরিয়ার সফরকালে ওমর জাবিয়ার জনসমাবেশে যখন বক্তৃতা করেন, তখন বলেছিলেন: কোরআন শরীফ লিখতে হলে উবাই-বিন্-ক্কাবের নিকট যাও, কর্তব্য কর্ম জানতে হলে যিয়াদের নিকট যাও, আর আইন জানতে হলে মুয়াযের নিকট যাও।

যতদূর তথ্য মেলে, তা থেকে জানা যায় না যে, ওমর স্বতন্ত্র ফৌজদারী আদালত স্থাপন করেছিলেন। চুরি ও ব্যভিচারের অপরাধে কাজীই বিচার করতেন, বাকী সাধারণ অপরাধের বিচার পুলিশ-বিভাগের হাতেই ছিল। পুলিশ-বিভাগকে আহ’দাস’ বলা হতো এবং পুলিশ প্রধানের উপাধি ছিল সাহিবুল-আদাস। আবুহোরায়রাহ্ বাহ্রায়েনের সাবিহ-ই-আহ্দাস ছিলেন। ওজনের বাটখারা পরীক্ষা করা, পথিপার্শ্বের অন্যায়াধিকার করে বাস উত্তোলন বন্ধ করা, ভারবাহী জন্তুকে কষ্ট দেওয়া বন্ধ করা, প্রকাশ্যে নিষিদ্ধ পানীয় বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ করা প্রভৃতি কাজও আদিস্-বিভাগের আওতায় ছিল। ওমর যখন আবদুল্লাহ্-বিন-ওবাকে বাজার পরিদর্শকের কাজে নিয়োগ করেন, তখন জেলরক্ষার ভারও তাঁর উপর ন্যস্ত হয়। ওমরের পূর্বে আরবে কোনও জেলখানা ছিল না। ওমর সাফওয়ান বিন্-ওমাইয়ার বাসগৃহটি চার হাজার দিরহামে ক্রয় করে প্রথম জেল স্থাপন করেন। ক্রমে ক্রমে প্রত্যেক জেলায় জেলখানা স্থাপিত হয়। প্রথম দিকে ফৌজদারী আসামীদেরকে জেলে পাঠানো হতো, পর ডিক্রি খাতকদেরকেও কাজী সুরায় জেলে পাঠাতেন। জেলখানা স্থাপিত হয়ে দণ্ডাজ্ঞায় কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়। শাস্তির কঠোরতা হ্রাস পায়। যেমন মদ্যপানের শাস্তি ছিল বেত্রদণ্ড; কিন্তু মশহুর কবি ও কাদিসিয়ার যুদ্ধখ্যাত বীর আবু মাজান সাফি বারবার পানদোষের জন্য দণ্ডিত হতে থাকায় শেষে তাঁকে জেলে পাঠানো হয়। দ্বীপান্তর দণ্ডও ওমরের সময়ে প্রবর্তিত হয়। আবু মাইজানকে একবার একটি ক্ষুদ্র দ্বীপে চালান করা হয়েছিল।