রাজ্যজয় ও রাষ্ট্রগঠন
ওমরের সাড়ে দশ বছর খেলাফৎ আমলে মোট বাইশ লক্ষ একান্ন হাজার ত্রিশ বর্গমাইল ভূ-খণ্ড ইসলামিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। তার বিস্তৃতি ছিল মক্কাকে কেন্দ্র করে এক হাজার ছত্রিশ মাইল উত্তরে, এক হাজার সাতাশি মাইল পূর্বে এবং চারশো তিরাশি মাইল দক্ষিণে, পশ্চিমে লোহিত সাগরের উপকূল পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। এই ভূখণ্ড সমগ্র ইন্দো-পাকিস্তান উপমহাদেশ ও ইরানের সমষ্টি এলাকার প্রায় সমতুল্য। পশ্চিমে মিসর থেকে শুরু করে সিরিয়া, খোজিস্তান, ইরাক-আরব, ইরাক-আযম, আর্মেনিয়া, আজরবাইজান, ফারস্, কিরমান, খোরাসান, মাকরান ও পূর্ব সীমান্তে বেলুচিস্তানের কিয়দংশ ছিল এই বিশাল ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। আরও উল্লেখযোগ্য যে, এই ভূখণ্ডে তখন পারস্যের কিার ও পূর্ব রোমক রাজ্যের সীজারের দুটি সাম্রাজ্য অবস্থিত ছিল। আর এই সাম্রাজ্য দুটিই ছিল সমকালীন বিদিত পৃথিবীর মধ্যে ধন-সম্পদে, সামরিক শক্তিমত্তায়, কৃষ্টিসভ্যতায় ও শিল্পকলায় শীর্ষস্থানীয়।
এই বিশাল ভূখণ্ডের এমন বিদ্যুৎগতিতে অধিকার সম্বন্ধে আলোচনাকালে পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকগণ বলে থাকেন, পূর্বরোমক সাম্রাজ্যের ও কিরা সাম্রাজ্যের হীনবল ও অন্তিমদশাই হলো আরব-বিজয়ের প্রথম কারণ। আর দ্বিতীয় কারণ হলো, ধর্মীয় বিরোধ-বিক্ষোভহেতু স্থানীয় বাসিন্দাদের বিজেতাগণকে সাদর আহ্বান। পারস্যের মাজদক ও নেস্টরীয় খ্রিস্টান সম্প্রদায় এবং পূর্বরোমক সাম্রাজ্যের বিশেষত মিসরের খ্রিস্টানরা নয়া ‘মনোলিথিক’চার্চের বিরোধী থাকায় এ সব ক্ষুব্ধ ধর্মসম্প্রদায় নিজ নিজ রাজশক্তির বিরুদ্ধভাবাপন্ন ছিল এবং তাঁরাই সক্রিয়ভাবে সাহায্য দান করে নবাগত বিজেতাদেরকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়েছিল। তার ফলেই আরব বিজয় অভিযান দ্রুত সাফল্যমণ্ডিত হয়েছিল।
কারণ দুটিতে কিছুটা সত্য থাকলেও, তাই সবটুকু নয়। আলোচ্য সাম্রাজ্য দুটি উন্নতির শীর্ষবিন্দুতে অধিষ্ঠিত না থাকলেও মোটেই এমন হীনবল ছিল না যে, মরুচর আরবজাতির ন্যায় অর্ধসভ্য ও অনুন্নত শক্তির হাতে ভেঙ্গে চুরমার হওয়ার মতো অন্তঃসারশূন্য ছিল। পারসিকরা ও বাইজান্টাইনরা নিঃসন্দেহে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী ছিল। তাদের সমরাস্ত্র সমূহও উন্নত ধরনের ছিল। তাছাড়া তাদের ছিল অসংখ্য লোকবল, অতুলনীয় অর্থবল, প্রচুর রসদ-সম্ভার এবং অসংখ্য সুরক্ষিত কিল্লা ও সমরঘাটি। তাঁদেরকে আক্রমণাত্মক পন্থা অবলম্বন করতে হয় নি, নিজের সুপরিচিত ও সুরক্ষিত পরিবেশে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা সুদৃঢ় করে আত্মরক্ষা করতে হয়েছিল। একথা স্মরণীয় যে, মুসলিমদের পারস্যাভিযানে যসর, বুরায়েব, কাদিসিয়া, জালুলা, মাদায়েন, জাজিরাহ্, খোরাসান, জান্দিসাবুর, নিহাওন্দ, কামুস, আজারবাইজান, ফারস, কিরমান, সিস্তান, মাকরান ও খোরাসানে; সিরিয়া অভিযানকালে আজনা-দায়েন, দামেশক, হাল, হিস্, ইয়ারমুক, এমেসা ও সিজারিয়ায় এবং মিসর বিজয়াভিযানে ফারমা, ব্যাবিলন আলেকজান্দ্রিয়া ও অন্যান্য স্থানে প্রতিপক্ষের প্রবল বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। বিশেষত কাদিসিয়া, নিহাওন্দ, ইয়ারমুক ও আলেকজান্দ্রিয়ায় সংগ্রামকালে মুসলিমরা ভাগ্যবিপর্যয়েরও সম্মুখীন হয়ে পর্বতপ্রমাণ বাধাবিপত্তি সহ্য করে বিজয়মাল্য লাভ করেছিল। প্রতিটি শহর ও দুর্গ তাদেরকে প্রবল বাধা দিয়েছে, প্রতিটি দেশে ইঞ্চি ইঞ্চি করে অগ্রসর হতে হয়েছে। রোমক বীর জুলিয়াস সীজারের মতো ‘ভেনি ভিদি ভিসি’ অর্থাৎ ‘এলাম, দেখলাম ও জয় করলাম’ সৌভাগ্য তাদের কোনও ক্ষেত্রেই হয় নি। দুটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যশালী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে, একই সঙ্গে আক্রমণাত্মক সংগ্রাম পরিচালনাকালে মুসলিম সেনাবাহিনীর সংখ্যা কোনও সময় একলক্ষেরও উর্ধ্বে ওঠে নি। অথচ ইয়ারমুকের যুদ্ধে বিপক্ষ দলের সৈন্যসংখ্যা ছিল দুই লক্ষের উপর।
পারস্যের প্রবল প্রতাপ কিসরা পারভেজ আঁ-হযরতের সময় জীবিত ছিলেন এবং কাদিসিয়ার যুদ্ধ হয় চৌদ্দ হিজরীতে অর্থাৎ পারভেজের মৃত্যুর তিন বছরের মধ্যেই। এতো অল্প সময়ে এতো শক্তিশালী সাম্রাজ্য হীনবল হওয়ার কথা নয়, তার অর্থ বল, সৈন্যবল পূর্বের মতোই অক্ষুন্ন ছিল। আর স্থানীয় মাজদক বা খ্রিস্টান সম্প্রদায় কোন সময়ে আরবদের সাহায্য করেছে, এমন তথ্যও ইতিহাসে মেলে না। বরং স্বদেশ রক্ষার্থে তারা রাজশক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে, এরূপ সাক্ষ্যই পাওয়া যায়।
অপরদিকে সীজার হিরাক্লিয়াসও ছিলেন প্রবল প্রতাপান্বিত সম্রাট। ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি খ্রিস্টান-জগতের নয়া ত্রাতা ও পূর্বরোমক সাম্রাজ্যের ক্রুশটি উদ্ধার করেন ও বিরাট শান-শওকতের সঙ্গে জেরুজালেমে তার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তখন তার অখণ্ড প্রতাপ। মুতার যুদ্ধে (৮ হিজরী=৬৩০ খ্রি.) তাঁর অজেয় বাহিনী মুসলিমদের পরাজিত করেছে এবং আরবদের অন্তর্ভেদ করে মদীনা আক্রমণের জন্য হুমকি দেওয়ায় আরবজাতি দুরুদুরু বক্ষে প্রতীক্ষা করেছে। অথচ মাত্র ছয় বছর পরে ইয়ারমুকের যুদ্ধে (১৫ হি.=৬৩৬ খ্রি.) সীজারের বিশ্বত্রাসী বিরাট বাহিনী বিধ্বস্ত হয়ে গেছে সেই আরবজাতির হস্তে এবং হিরাক্লিয়াস্ শশকের মতো বাইজান্টাইনের পথে পলায়ন করেছেন সিরিয়াকে চিরবিদায় জ্ঞাপন করে। এ কি শুধু ভাগ্যের লীলাবৈচিত্র্য, না আরও কোনও বাস্তব কারণঘটিত?
আমাদের দৃষ্টিতে মুসলিম-বিজয়ের প্রকৃত কারণ ছিল ইসলামের শিক্ষার মহিমা, যার দরুন গোটা আরবজাতি উৎসাহে, সঙ্কল্পে, একগ্রতায়, বীর্যে ও নির্ভীকতায় নয়াভাবে সন্দীপিত হয়েছিল এবং ওমরের ব্যক্তিত্বের বলে এ গুণাবলী সুতীক্ষ্ণ ও সুদৃঢ় হয়েছিল। তার সঙ্গে হয়েছিল একটা নয়া জাতির আত্মচেতনা, প্রাণবন্ত লৌহ-কঠিন মনোবল অত্যুচ্চ সাধুতা ও অপক্ষপাত ন্যায়পরায়ণতা। যখনই একটা নতুন অঞ্চল বিজিত হয়েছে, তার অধিবাসীরা বিজেতা মুসলিমদের অত্যুচ্চ চরিত্রবলে এবং ন্যায়দৃষ্টি ও সহানুভূতিতে মুগ্ধ হয়ে গেছে, আর তাদের অন্তর মন থেকে বিজেতাদের প্রতি বিরূপ মনোভাব নিঃশেষে মুছে গেছে। স্মরণীয় যে ইয়ারমুকের যুদ্ধের প্রাক্কালে মুসলিমরা যখন কয়েকটি অধিকৃত শহর পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়, তখন তারা সমস্ত আদায়কৃত জিয়া ফেরত দিয়েছে এবং খ্রিস্টান অধিবাসীরা মুসলিমদের পুনরাগমনের জন্যে প্রার্থনা জানিয়েছে ও ইহুদীরা তওরাত হাতে নিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছে, সীজারকে তারা প্রাণ থাকতে আর গ্রহণ করবে না।
দ্বিতীয় কারণ ছিল, সিরিয়া ও ইরাক প্রবাসী আরব গোত্রসমূহের মধ্যে জাতীয় ও গোত্রীয় চেতনায় ফল; এজন্যে তারা খ্রিস্টান হয়েও স্বজাতি আরব-বিজেতাদেরকে অন্তর দিয়ে গ্রহণ করেছে এবং প্রায় ক্ষেত্রে ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিমদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। দামেশকের ঘাস্সানী গোত্রীয় আরবরা সিরিয়া বিজয়কালে এবং ইরাকের লামিদ্ গোত্রীয় আরবরা প্রথম সুযোগেই স্বজাতির সঙ্গে মিশে গেছে এবং সীজার ও কিার বিরুদ্ধে সাহায্য করেছে। সিরিয়া অভিযানকালে আরও লক্ষ্য করা গেছে যে, রোমসম্রাটের বিরুদ্ধে প্রজামণ্ডলী বিরূপ ছিল প্রধানত তিনটি কারণে : অসহনীয় করভার, ভূমিদাসত্বের প্রবর্তন এবং ইহুদীদের রোম-চার্চের বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি ধর্মীয় জুলুম। মিসরকে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের শস্যভাণ্ডার হিসেবে বিবেচনা করা হতো এবং কৃষিজাত শস্যের অধিকাংশই শোষণ করে কনস্টান্টিনোপলে চালান করে দেওয়া হতো। এজন্যে প্রজাকুল সীজারের শোষণ নীতির ফলে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল এবং অন্তর-মনে তাঁর শাসনের ইতি কামনা করতো।
ওমরের বিজয়সমূহের সঙ্গে আলেকজান্দার, চেঙ্গিস খান, নেবুকাত-নাজার, অমীর তাইমুর, নাদির শাহ্ প্রভৃতি বিশ্ববিজয়ী বীরের বিজয়-কাহিনীর সঙ্গে অনেকে তুলনামূলক আলোচনা করে থাকেন। অবশ্য এ রকম তুলনা কোনক্ষেত্রেই শোভনীয় ও সঙ্গত নয়। তবে তুলনার কথা প্রসঙ্গে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, তাঁদের সকলের বিজিত সাম্রাজ্য কোন্ দিন ধূল্যবলুণ্ঠিত হয়ে গেছে, কিন্তু তের শো বছরের পরেও ওমরের অধিকৃত এলাকাসমূহ এখনও মুসলিম শাসনাধীন আছে। আর ওমরের বিজয়সমূহের কোনও ক্ষেত্রে রক্তাক্ত হিংসার পথ অবলম্বিত হয় নি, কোথাও সামগ্রিকভাবে ধ্বংসাত্মক কার্য বা হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয় নি। যুদ্ধের পর প্রজাগণের জান-মাল নিরাপদ হয়েছে, এমন কি যুদ্ধের সময় নারী বা শিশু হত্যা, নিরীহ নগরবাসীর হত্যা বা উৎপীড়ন, এমন কি বৃক্ষ ফসলের ক্ষেত ধ্বংস করা হয় নি। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই সন্ধির শর্তসমূহ সততার সঙ্গে প্রতিপালিত হয়েছে। এজন্যে ওমরের নামোচ্চারণও এ-সব বিশ্বত্রাস বীরগণের সঙ্গে শোভনীয় নয়। আরও লক্ষণীয় যে, আলেকজান্দার, চেঙ্গিস, তাইমুর প্রভৃতি স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন, নরহত্যাযজ্ঞে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন; কিন্তু ওমর কখনও মদীনার বাইরে পদার্পণ করেন নি। অন্যান্য বীর অসংখ্য সশস্ত্র দেহরক্ষীবেষ্টিত হয়ে জনগণ মনে ত্রাস সঞ্চার করে ফিরেছেন। কিন্তু ওমর একজনও দেহরক্ষী বা দ্বাররক্ষী নিযুক্ত করেন নি। এমন কি দু’বার সিরিয়া যাত্রাকালে একটি মাত্র বাহন অনুচর ব্যতীত অন্য কোন সঙ্গী গ্রহণ করার প্রয়োজন অনুভব করেন নি। সাধারণের মধ্যে সমানভাবে মেলামেশা করেই নয়, একাত্ম হয়ে তাদের সঙ্গে মিশে যেয়ে এরূপ বিশাল ভূ-খণ্ডের শাসনদণ্ড পরিচালনার দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত বিশ্ব-ইতিহাসে বিরল।
অথচ ওমর ছিলেন কার্যত বিজয়সমূহের স্বয়ং সিপাহসালার। সামরিক বিভাগের সংগঠন, পরিকল্পনা, শৃঙ্খলাবিধান, নিয়ন্ত্রণ, সমস্তই তাঁর তর্জনী শাসিত ছিল। এমন কি, সৈন্য সংগ্রহ, ছাউনী নির্মাণ, সৈন্যদের কুচকাওয়াজ, সমরঘাঁটি নির্মাণ, অস্ত্রপরীক্ষা ও অনুমোদন, অবরোধ বা আক্রমণের গতি নিয়ন্ত্রণ, সব কিছুই ওমর মদীনার মসজিদের ধূলিশয্যায় বসে কৃতিত্বের সঙ্গে পালন করেন গেছেন। কাদিসিয়ার যুদ্ধকালে তিনি মদীনায় বসে যুদ্ধক্ষেত্রের ম্যাপ ঠিক করেছেন, সৈন্যবিন্যাসের ব্যবস্থা করেছেন, কে কোন দিকের বা কোন বাহুর সৈন্যাধ্যক্ষ হবেন, ও কে কিভাবে সৈন্য চালনা করবেন, তারও নির্দেশ প্রদান করেছেন নিখুঁতভাবে। নিহাওন্দ ও হিমসের যুদ্ধকালে মুসলিমবাহিনী কঠিন সঙ্কট-মুহূর্তের সম্মুখীন হলে ওমরই রণচাতুর্যের নির্দেশ দিয়ে শত্রুপক্ষকে বিধ্বস্ত করার উপায় বিধান করেছেন। সম্মুখসমরে উপস্থিত না হয়েও এ-রকম রণনীতি পারঙ্গমতার উদাহরণ ইতিহাসে সুলভ নয়।
ওমর একহাতে রাজ্যজয় করেছেন, প্রশাসনিক ব্যবস্থা অবলম্বন করেছেন দক্ষতার সঙ্গে এবং শান্তি শৃঙ্খলা স্থাপনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনাও করেছেন সুচারুরূপে। এজন্যে যতগুলি দফতরের প্রয়োজন, সে সবেরও প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং সে সবের সুষ্ঠু কার্যনির্বাহের প্রণালীও উদ্ভাবন করেছেন প্রবীণ শাসকের যোগ্যতা নিয়ে। বলা বাহুল্য, মুসলিম রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন রসূলে করীমের দ্বারা হলেও প্রশাসনিক দফতরসমূহের সৃষ্টি ওমরের আমলেই হয়েছিল।
ওমরের রাষ্ট্র-সংগঠনিক ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় শাসন-নীতিসমূহের আলোচনার প্রারম্ভে এ কথা সুস্পষ্ট হওয়া দরকার যে, ইসলামী রাষ্ট্র ছিল পূর্ণ গণতান্ত্রিক, স্বেচ্ছাতান্ত্রিক বা একতান্ত্রিক নয়। আরব-চরিত্রের বৈশিষ্ট্য গণাভিসারী হওয়া, একনায়কত্ব তারা বরদাস্ত করতে পারতো না। এজন্যে ওমরের সম্মুখে রোমক ও পারসিক রাজতান্ত্রিক শাসনের দৃষ্টান্ত থাকলেও তিনি সহজেই গণতান্ত্রিক শাসনের অনুসারী হন। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যে কয়টি মৌল প্রতিষ্ঠান-গণানুমোদিত নিয়মতান্ত্রিক সরকার, গণপরিষদ ও স্বাধীন বিচার বিভাগ-সে-সবের বাস্তব রূপায়ণও হয়েছিল ওমরের হাতে।
প্রথমেই উল্লেখ করা যায় ‘মজলিস-ই-শুরা’ বা মন্ত্রণাসভার। যখনই শাসনসংক্রান্ত কোনও প্রশ্ন দেখা দিত, তখনই ‘মজলিস-ই-শুরা’র অধিবেশনে ডাকা হতো, এবং খলিফা প্রশ্নটি উপস্থিত করে সকলের স্বাধীন মতামত আহ্বান করতেন। রীতিমতো তর্কবিতর্কের পর সংখ্যাধিক্যের মতানুযায়ী প্রশ্নটির মীমাংসা গৃহীত হতো। এই মজলিসে মুহাজেরীন ও আনসারী প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকতেন। মজলিসের সদস্যসংখ্যা এবং তাঁদের সকলের নাম না পাওয়া গেলে, লক্ষ্য করা গেছে, ওসমান, আলী, আবদুর রহমান-বিন্-আউফ, মুয়ায-বিন্-জবল, উবায়-বিন্-কাব এবং যায়েদ-বিন্-সাবিত সভ্য হিসেবে বরাবর উপস্থিত থেকেছেন এবং আলোচনায় অংশগ্রহণ করে স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করেছেন। মজলিসের অধিবেশনে এভাবে ডাকা হতো: একজন নির্দিষ্ট খতিব থাকতেন, তিনি মদীনাবাসীদেরকে নামাযে আহ্বান করতেন। সকলে উপস্থিত হলে ওমর প্রথমে মসজিদে নববীতে দুরাকাত নামায পড়তেন। তার পর মিম্বারে দাঁড়িয়ে বিষয়টি সকলের সম্মুখে উপস্থিত করতেন। সাধারণ দৈনন্দিন সমস্যাগুলির সমাধান এভাবে করা হতো। কিন্তু কোনও গুরুতর সমস্যা উপস্থিত হলে মুহাজেরীন ও আনসারীদের সাধারণ অধিবেশন ডাকা হতো। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ইরাক ও সিরিয়া বিজয়ের পর কয়েকজন সাহাবা দাবী করেন যে, অধিকৃত অঞ্চলের জমি সৈন্যদেরকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে বন্টন করে দেওয়া হোক। এ প্রশ্নের মীমাংসা হেতু আনসারী, মুহাজেরীন এবং আউস ও খাজরাজ গোত্রের পাঁচ জন করে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির মজলিস বসে। কয়েকদিন ধরে আলোচনা চলে। তখন ওমর যে বক্তৃতা দেন, তা থেকে খলিফার ক্ষমতা ও অধিকার সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ পরিচয় মেলে: আমি আপনাদেরকে আহ্বান করেছি, রাষ্ট্র সম্বন্ধে আমার গুরুভার দায়িত্বের অংশগ্রহণ করতে। কারণ, আমি আপনাদেরই একজন মাত্র এবং আমি চাই নে, আপনারা আমার ইচ্ছার, অনুবর্তী হবেন। একুশ হিজরীতে নিহাওন্দ যুদ্ধের প্রাক্কালে সঙ্কট সম্বন্ধে বিবেচনার জন্যে বৃহৎ মজলিস ডাকা হয়। ওসমান, আলী, তালহা, জুবায়ের, আবদুর রহমান ও অনেকে বক্তৃতা করেন এবং সকলে মত প্রকাশ করেন, খলিফার স্বয়ং যুদ্ধস্থলে যাওয়া উচিত। কিন্তু সংখ্যাধিক্যের মতানুযায়ী স্থির হয়, খলিফার যুদ্ধে যাওয়া উচিত নয়। এই রকম সৈন্যদের বেতন ও ভাতা, দপ্তরের সৃষ্টি বিদেশীদের সঙ্গে অবাধ বাণিজ্য আমদানির মাসুল নির্ণয় প্রভৃতি রাষ্ট্রীয় প্রশ্নের মীমাংসা হতো মজলিস-ই-শুরায়। ওমর একবার পরিষ্কার বলেছিলেন, লা খিলাফাতুন ইল্লা আন মাশুরাতুন্-মন্ত্রণা ব্যতীত খেলাফত নেই।
মজলিসে-ই-শুরা বা মন্ত্রণাসভা ডাকা হতো রাষ্ট্রীয় কঠিন সমস্যা সমাধানের বিশেষ ক্ষেত্রে। দৈনন্দিন শাসনকার্য নির্বাহ ও অন্যান্য ছোট ছোট বিষয়ের মীমাংসার জন্যে দ্বিতীয় একটি মন্ত্রণাসভা ছিল। এই সভার অধিবেশনে বরাবর মসজিদে-নববীতে বসতো এবং মুহাজেরীন অংশগ্রহণ করতেন। প্রদেশ ও জিলাসমূহ থেকে যে দৈনন্দিন প্রশাসনিক রিপোর্ট আসতো, এ সভায় তা পেশ করা হতো, আলোচিত হতো ও যথানির্দেশ জ্ঞাপন করা হতো। অগ্নিপূজকদের উপর জিয়া প্রবর্তনের মীমাংসা এই সভায় স্থির হয়। ওমর সমাগত সভ্যদের সঙ্গে মসজিদে নামাযের পাটিতে বসেই সেসবের মীমাংসা করে ফেলতেন।
উপরে মজলিস-ই-শুরা সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে, আসলে তা ছিল পরামর্শসভা; আধুনিক পরিষদ (লেজিসলেচার) বলতে যা বোঝায়, তেমন কোনও পরিষদ খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলে ছিল না। কিন্তু যখনই কোনও রাষ্ট্রীয়নীতি সংক্রান্ত কোনও গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার উদ্ভব হতো, তখনই খলিফা সমাজের নেতৃবৃন্দকে আহ্বান করে তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করতেন। এ কথাও বিশদ হওয়া দরকার যে, যাঁদের সঙ্গে এভাবে পরামর্শ করা হতো, তাঁরা সাধারণ কর্তৃক কিংবা গোত্রীয় হিসেবে এতদুদ্দেশ্যে যথাবিধি নির্বাচিত হতেন না। খলিফার একমাত্র করণীয় ছিল, শ্রেষ্ঠ সাহাবাগণও বিভিন্ন গোষ্ঠী-সরদারগণকে আহ্বান করা এবং এই ছিল তাঁর মজলিস-ই-শুরা। কিন্তু তৎকালীন সমাজ-ব্যবস্থা যতটুকু প্রতিনিধিত্বশীল হওয়া সম্ভব ছিল, মজলিসে ই-শুরা ছিল ততটুকু প্রতিনিধিত্বশীল। উপস্থাপিত বিষয়টির আলোচনার পর ওমর সকলের মতামত চাইতেন, সে পরামর্শের মূল্য বিবেচনা করতেন এবং যা তিনি ঠিক মনে করতেন, সে অনুসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন— কখনও সংখ্যাগুরুর মত মেনে নিয়ে, কখনও সংখ্যালঘুর মত গ্রহণ করে এবং কখনও উভয়ের মত অগ্রাহ্য করে। রাষ্ট্রের দৈনন্দিন সমস্যাগুলোর সমাধান এভাবেই হতো; কিন্তু ওমরের চক্ষে মজলিসের গুরুত্ব কতোখানি ছিল, তার পরিচয় মেলে ওমরেরই উপরে উল্লেখিত উক্তি থেকে। এখানে আরও উল্লেখযোগ্য যে, সমসাময়িক ইতিহাসে মজলিসের বহু অধিবেশনের যে-সব বিস্তৃত বিবরণী লিপিবদ্ধ দেখা যায়, সে সব থেকে স্বতঃই প্রমাণিত হয় যে, মজলিস-ই-শুরার অধিবেশন খলিফার খেয়াল খুশীর উপর নির্ভরশীল ছিল না।
মন্ত্রণাসভা ছাড়াও নাগরিকদের অধিকার ছিল প্রশাসনিক বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করার। প্রাদেশিক শাসক ও জিলা-শাসকরাও নাগরিকদের অভিমত অনুযায়ী নিযুক্ত হতেন। কোন কোন ক্ষেত্রে এ-সব নিয়োগ নাগরিকদের নির্বাচন মতে হতো। কুফা, বসরা এবং সিরিয়ার রাজস্বসচিব নিয়োগকালে ওমর স্থানীয় নাগরিকদের নির্দেশ দেন, তারা যেন নিজেরাই আপন আপন কর্মচারী নির্বাচন করে তাঁর নিকটে অনুমোদনের জন্যে পাঠিয়ে দেয়। সা’দ বিন্ আবু ওক্কাসের মতো বিশিষ্ট সাহাবা ও পারস্য বিজয়ী বীর কুফার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন, কিন্তু প্রজারা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। ওমর নাগরিকদের বক্তৃতার সময় তাদের স্বত্বাধিকার সম্বন্ধে সচেতন করতেন এবং সরকারী কর্মচারীদেরকে নিয়োগের সময় উপদেশলিপি দিয়ে প্রজাদের স্বত্ব ও অধিকার সম্বন্ধে সতর্ক করে দিতেন। সময়ে সময়ে, বিশেষত প্রত্যেক হজের সময় প্রাদেশিক শাসকদের সম্মেলন আহ্বান করে নাগরিকদের অধিকার সম্বন্ধে সতর্ক করতেন এবং সেগুলি যথাযথ পালন করার নির্দেশ দিতেন।
এরূপ বিশাল ভূ-খণ্ডের রাষ্ট্রনায়ক ওমর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সংগঠনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, ব্যক্তিগত জীবনে নিজেকে জনগণের সঙ্গে একই সমতলে স্থাপন করে। খলিফা হিসেবে তাঁর কোনও বিশেষ ভাতা বা ব্যয়-বরাদ্দ ছিল না, বিশেষ অধিকার বা ক্ষমতা ছিল না। আইনের চোখে তাঁর ও একজন সাধারণের মধ্যে কোন ভেদাভেদ ছিল না। তাঁর ক্ষমতা ও কার্যকলাপ সাধারণ নাগরিকদের সমালোচনার উর্ধ্বে ছিল না। বহুবার তিনি নিজে খলিফা হিসেবে তাঁর মর্যাদা ও ক্ষমতার সীমা বিশেষভাবে ব্যক্ত করেছেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে একটি উক্তি উল্লেখযোগ্য: তোমাদের বায়তুলমালে আমার অধিকার এতিমের সম্পত্তির একজন অছির চেয়ে অধিক নয়। আমি স্বচ্ছল হলে এক কপর্দকও গ্রহণ করতে পারি নে। আমি দরিদ্র হলে সকলের সমান হারে ভাতা নিতে পারি। আমার উপর তোমাদের সকলের হক্ আছে, তোমাদের তা দাবী করা উচিত। তার একটি হলো, আমি অন্যায় ভাবে কর আদায় করতে কিংবা মালে-গনিমাতের অংশগ্রহণ করতে পারি নে। দ্বিতীয়টি হলো, কর বা মালে গনিমাত আমি স্বেচ্ছামতো ব্যয় করতে পারি নে। তৃতীয়টি হলো, আমার কর্তব্য, তোমাদের নিরাপত্তার বিধান করা।
একবার জনসমক্ষে বক্তৃতাকালে একজন চিৎকার করে ওঠে: ওমর! আল্লাহকে ভয় করো। তাকে স্তব্ধ করার চেষ্টা করা হলে ওমর বলেন : ওকে বলতে দাও। ওরা আমায় সাবধান না করলে ওদের মূল্য কোথায়? ওদের কথা না শুনলে আমি ভুল পথে চলবো। এভাবেই শাসক ও শাসিতের ব্যবধান দূর হয়েছিল। জনগণচিত্ত হয়েছিল ভয়শূন্য, শির উচ্চ ও স্বাধীন বাপ্ৰিয়।