ইসলামের আলোকধারায়
ওমরের জীবনের প্রায় সাতাশ-আটাশ বছর কেটে গেছে। মধ্যযৌবন-কাল।
ঠিক এই সময়ে প্রায় ৬১০ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বজগৎ এক নতুন জীবনের আস্বাদ লাভ করে। এক নয়া জ্যোতির বিকিরণ হয় আরবের হিরার গুহায়। কালক্রমে জগজ্জ্যোতিরূপে সে আলো ছড়িয়ে পড়ে সবখানে, সবদেশে। ইসলাম তার পরিচয়।
কিন্তু এ আলোকশিখা, এ সিরাজুম্-মুনীরার বিকিরণ দাবানল গতিতে হয় নি। একটু একটু করে ধীর-মন্থর গতিতে তার দীপ্তি বিকশিত হয়েছিল।
আর এই আলোকবর্তিকা নির্ভয়ে এবং নীরব হয়ে নম্র হয়ে প্রাণ পর্যন্ত পণ করে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন, সেই নরকুলধন্য কামেল মানুষটি। তাঁর পবিত্র দেহের উপর দিয়ে নির্বিচারে ও নির্মমভাবে স্রোত বয়ে গেছে নির্যাতনের, নিপীড়নের। তার আপন গোত্রীয় এমনকি নিকট-আত্মীয়দের নিকট থেকে এসেছে কতো ভ্রূকুটি প্রদর্শন, কতো শাসন-বচন, কতো শাস্তিবচন। কিন্তু নিজের মাঝেই শক্তি ধরে নিঃশঙ্কচিত্তে উদার কণ্ঠে তিনি বিলিয়ে চলেছেন শান্তির ললিত বাণী, ইসলামের বাণী। নিখিল মানবের অভয়দাতা, ত্রাণকর্তা হযরত মুহম্মদের কণ্ঠে বার বার ধ্বনিত হচ্ছে তওহীদ-মন্ত্র ‘লা-শরীক আল্লাহ্—’।
একটির পর একটি প্রদীপ জ্বলতে থাকে এ বাণীর তড়িৎস্পর্শে। এক এক করে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় খোঁজে।
নবুয়ত-প্রাপ্তির পর প্রায় ছয় বছর কেটে যাচ্ছে। এ দীর্ঘকালে প্রায় পঁয়তাল্লিশ জন পুরুষ একুশ জন নারী ইসলাম কবুল করেছেন। কারও কারও মতে এ সংখ্যার সামান্য কম-বেশি হতে পারে।
কিন্তু এই স্বল্পসংখ্যক ইসলাম কবুলকারীদের উপরেও বিপক্ষ দলের নির্যাতন নিপীড়নের অন্ত ছিল না। জুলুম ও অত্যাচারের ঝড় বয়ে গেছে তাদের উপর। তাদের কেউ কেউ আবিসিনিয়ায় (হাবশ) আশ্রয় খুঁজেছে প্রাণের দায়ে রসুলে আকরমের অনুমতি নিয়ে।
ওমরের কানেও এসেছে এই তওহীদ-বাণী। কিন্তু গুমরাহীর অন্ধকারায় তাঁর সহৃদয় মন সঠিকভাবে আবদ্ধ। পাষাণে সারা জাগছে না। বারে বারে ধাক্কা দিয়ে প্রতিহত হচ্ছে। পাষাণ প্রাণকে আরও বিরুদ্ধমনা, কুলিশ-কঠোর করে তুলছে।
আপন ঘরে বাঁদী লবিনাহ মুসলিম হয়ে গেছে এ খবরে ওমর ক্ষিপ্তপ্রায় হয়ে গেছেন। বেদেরেগভাবে তাকে বেধড়ক প্রহার করে চলেছেন। শেষে নিজেই ক্লান্ত হয়ে শাসাচ্ছেন, ‘থাম্ থাম্! আমি একটু নিশ্বাস ফেলি তার পর আবার প্রহার শুরু করবো।’
কিন্তু তবুও যে তওহীদ-মন্ত্রে দীক্ষিত একজনকেও ফিরানো যায় না। এ অগ্নিশিখায় সন্দীপিত একটি হৃদয়ও বশ মানে না। টলে না, দমে না। শুধু ঘরে-ঘরে জ্বলে উঠছে দ্বীন-ইসলাম লাল মশাল। এ কোন শরাব, কোন আবেহায়াত পান করাচ্ছেন আবদুল্লাহ-নন্দন?
খাত্তাব-নন্দন শুধু ভাবেন, আর ভাবেন! কী উপায়ে এ বিপ্লব-তরঙ্গের গতিরোধ করা যায়।
সহসা তাঁর মাথায় মতলব এলো, সব অনর্থের মূল ইসলাম-প্রবর্তককে নিঃশেষ করলেই এ বিপদ দূর হয়। অগ্নিশিখার উৎসমূল নির্বাপিত করলেই সব চিন্তাভাবনার অবসান হয়।
যেই চিন্তা, সেই কাজ। ওমর খোলা তরবারি হাতে নিয়ে সোজা চললেন আঁ-হযরতের সন্ধানে।
পথেই দেখা হলো নূয়াইম-ইবনে-আবদুল্লাহর সঙ্গে। নূয়াইম ওমরেরই বংশজ এবং গোপনে তিনি ইসলাম কবুল করেছিলেন। আরও করেছিলেন ওমরের চাচাতো ভাই সাইদ, যিনি খাত্তাবের এক কন্যাকে শাদী করেছিলেন এবং স্ত্রীকেও ইসলামের সহধর্মিণী করেছিলেন। ওমর অবশ্য এসব কিছুই জানতেন না।
নুয়াইম ওমরের হাতে নাঙ্গা তলোয়ার, চোখে-মুখে তীব্র উত্তেজনা ও ঘন ঘন তপ্ত নিশ্বাস দেখে কিছুটা বিস্মিত হলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি ব্যাপার?’ ওমর সোজাসুজি বললেন, ‘মুহাম্মদকে খুন করতে চলেছি।’
নুয়াইম বললেন, ‘বনি-হাশিম ও বনি আবদে-মুনাফদের ভয় কর না? তারা তোমায় জ্যান্ত রাখবে কি?’
ওমর ক্রোধে চিৎকার করে উঠলেন, ‘মুহাম্মদের উপর এতো দরদ কেন? বুঝি ইসলাম কবুল করেছ? তবে এসো, তোমাকে দিয়েই শুরু করা যাক।’ নুয়াইম শ্লেষের হাসি হেসে বললেন, ‘নিজের ঘরের খবর রাখো কি? তোমার বোন ও ভগিনীপতিটি যে আগেই ইসলাম কবুল করেছে।’
একথা শুনে ওমর ক্রোধে দিশাহারা হয়ে ভগিনী ফাতেমার বাড়ীতে ছুটলেন। ফাতেমা ও সাঈদ তখন রুদ্ধদ্বার ঘরে খোবাবের নিকট কোরআনুল করিম তেলাওয়াত করছিলেন। ওমরের কর্কশ হাঁক শুনেই খোবাব লুকিয়ে গেলেন।
ওমর তীক্ষ্ণকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী পড়া হচ্ছিল?’
ফাতেমা বললেন, ‘ও কিছু না।’
ওমর বললেন, ‘আমার নিকট কিছুই লুকাতে চেষ্টা করো না, আমি সব জেনে ফেলেছি। তোমরা দু’জনেই নাকি ধর্মত্যাগ করেছ?’ একথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সাঈদকে ধরে প্রহারের পর প্রহার করতে লাগলেন। স্বামীকে রক্ষা করতে ফাতেমা ছুটে এলেন, কিন্তু তিনি প্রহারে প্রহারে জর্জরিত হয়ে গেলেন। তাঁর কোমলাঙ্গ ফেটে রক্তধারা ছুটলো।
কুপিতা সিংহিনীর মতো ফাতেমা তখন গর্জে উঠলেন, ‘ওমর, তোমার যা খুশী করতে পার। সত্যই আমরা ইসলাম কবুল করেছি এবং কিছুতেই আমরা আমাদের ‘দ্বীন’ ত্যাগ করতে পারবো না।’
সেই মুহূর্তে ওমরের মনে জন্ম নিল বিচিত্র এক সমবেদনা। তা কেবল কোমলাঙ্গী নারীদেহে রক্তধারা দর্শনসঞ্জাত নয়, একই নাড়ীর টানেও আপ্লুত নয়; চিরায়ত মানবতার বেদনার্ত চিত্তের এ স্বাভাবিক উপলব্ধি। ওমর শান্ত স্তব্ধ হয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর লজ্জাজড়িত কণ্ঠে ওমর ভগিনীকে অনুরোধ করলেন, ‘আচ্ছা, শোনাও তো—কী পড়ছিলে তোমরা!’
ফাতেমা লুক্কায়িত কোরআনের আয়াতসমূহ ওমরের সামনে তুলে ধরলেন। ওমর পাঠ করলেন :
‘আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে, সমস্ত আল্লাহর মহিমা গান করে, তিনি সর্বশক্তিমান, তিনি সর্বজ্ঞ।’
পাষাণ হিমগিরি গলে যাচ্ছে। ঘন তমসাবৃত অন্ধ হৃদয়ে আলোর খেলা শুরু হয়েছে। ওমর আবার পড়লেন, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের উপর ঈমান আনো।
বাণীর এ কী অনাস্বাদিত সুর-মূর্ছনা! এ যে কানের ভিতর দিয়ে সোজা কর্ণমূলে বেজে উঠে সারা প্রাণ আকুল করে তোলে। কান্না ও হর্ষের দোল-দোলায় মানুষ অভিভূত হয়ে উঠে। সংশয়-দ্বিধা-ভয় সব কেটে যাচ্ছে। ধ্রুব-জ্যোতিতে মনের সব অন্ধকার কেটে যেয়ে আলোয় আলোময় হচ্ছে। বিশ্বাসীর ঋজু ভঙ্গিতে অন্তর মন উজ্জীবিত হয়ে আসছে।
বিচিত্র অনুভূতিতে আচ্ছন্ন ওমর হৃদয়-কন্দরে যেন চিরবাঞ্ছিতের ডাক শুনতে পেলেন। তিনি সহসা ঘোষণা করলেন : লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ্। আমায় তাঁর নিকট নিয়ে চলো।
তখন রসূলে-আকরম ছিলেন সাহাবা আরকামের বাড়ীতে। সাফা পর্বতের সানুদেশে। ওমর নিজেই সেখানে উপস্থিত হলেন ও দরওয়াজায় সজোরে ধাক্কা দিলেন। তাঁর হাতে নাঙ্গা তলোয়ার দেখে সাহাবাদের অনেকের মুখে আতঙ্ক ফুটে উঠলো। আমীর হামযা বললেন : আসতে দাও ওমরকে। যদি বন্ধুভাবে এসে থাকে, অতি উত্তম কথা। অন্য মতলব থাকে তো আমি নিজেই তার শির লুটিয়ে দেব।
শান্ত সমাহিতচিত্ত ওমর ধীর পদক্ষেপে ভিতরে প্রবেশ করলে রসূলে-আকরম নিজেই তাঁর দিকে অগ্রসর হলেন। একটা মানুষকে বিশ্বাসে উজ্জীবিত করতে হলে যেমন বিশ্বাসীর ঋজুভঙ্গি আনতে হয় শরীরে, তাই এনে আঁ-হযরত ওমরের বস্ত্রাঞ্চলে ঝটকা মেরে বললেন : ওমর! কী ইচ্ছা নিয়ে এখানে এসেছো? এই দৃঢ়গম্ভীর বাণী শুনেই ওমরের চিত্ত কেঁপে উঠলো। তিনি নম্রসুরে ধীরে ধীরে বললেন, আমি ইসলাম কবুল করতে এসেছি। এ জওয়াব শুনেই আঁ-হযরতের কণ্ঠে উদাত্তসুরে ধ্বনিত হলো : আল্লাহু আকবর! সঙ্গে সঙ্গে সাহাবাদের কণ্ঠেও ধ্বনিত হলো: আল্লাহু আকবর! যে ভাব গম্ভীর ধ্বনি দূর-দিগন্তে মক্কার পর্বত-শ্রেণীতেও কেঁপে কেঁপে বয়ে গেল।
ওমরের ইসলাম গ্রহণ সম্বন্ধে এটিই অতি প্রসিদ্ধ ও বিশ্বস্ত কাহিনীরূপে স্বীকৃত হয়। কিন্তু ওমরের নিজস্ব বয়ান মতে আর একটি কাহিনীও আছে। এখানে সেটিও উল্লেখযোগ্য।
ওমর নিজেই বলেন : আমি ইসলাম থেকে বহু দূরে ছিলাম। জাহেলিয়াতের অন্ধকারায় এমনভাবে আবদ্ধ ছিলাম যে, আমি তখন শরাব পান করতাম এবং খুবই উল্লাসের সঙ্গে পান করতাম। আমার মহফিলে তখন কোরায়েশকুলের সব নওজওয়ানই ভীড় জমাতো। এক রাতে আমি নিজস্ব মহফিলে উপস্থিত হয়ে দেখলেম, অন্য কেউ তখন হয় নি। তখন চিন্তা করলেম, মক্কায় অমুক পানশালায় গেলে মদ মিলতে পারে। কিন্তু সেখানে যেয়েও বঞ্চিত হলেম। তখন চিন্তা করলেম, আচ্ছা! এ সময় কাবায় সাত কিংবা সত্তর বার প্রদক্ষিণ (তওয়াফ) করলে বেশ হয়। এ উদ্দেশ্যে আমি কাবায় উপস্থিত হয়ে দেখি, রসূলুল্লাহ্ তখন নামায পড়ছেন। লক্ষ্য তাঁর শাম অঞ্চলের দিকে এবং তাঁর ও শামের মধ্যস্থলে কাবা অবস্থিত। তাঁকে দেখেই চিন্তা করলেম, তাঁর বাণী শোনবার এটাই সবচেয়ে উত্তম সুযোগ। অতএব শোনাই যাক। কিন্তু এ আশঙ্কা হলো, খুব কাছাকাছি গেলে যদি তিনি ভয় পান। এরূপ ভেবে আমি ‘হজরে আসওয়াদের নিকট দিয়ে গিলাফে-কাবায় ঢুকে পড়লেম ও নিঃশব্দে তাঁর নিকটবর্তী হলেম। তিনি নামাযে কোরআন পাক তেলাওয়াত করছিলেন। আমিও চলতে চলতে একেবারে তাঁর সামনে পড়ে গেলাম। তখন তাঁর ও আমার মধ্যখানে গিলাফে-কাবা ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। কোরআনের মধুর বাণী আমার মর্ম স্পর্শ করতে লাগলো, ইসলাম আমার হৃদয়-দুয়ার খুলে দিয়ে নিঃশব্দে নীরবে প্রবেশ করতে লাগলো। আমি শান্তভাবে দাঁড়িয়ে রইলেম। রসূলুল্লাহ্ নামায শেষ করে গৃহাভিমুখে চলতে লাগলেন। আমিও তাঁর পিছনে পিছনে চলতে লাগলেম। তিনি স্বগৃহের নিকটবর্তী হয়ে আমার পদশব্দে চকিত হয়ে আমার দিকে ফিরলেন ও আমায় চিনলেন। হয়তো তাঁর সন্দেহ হলো, আমি কোনও কুমতলবে তাঁর অনুসরণ করছি। তখন সাহস সঞ্চয় করে বেশ উচ্চস্বরেই তিনি বললেন, খাত্তাব-নন্দন এ সময় কেন তুমি এসেছো? আমি বিনীতভাবে বললেম, আল্লাহ্র রসূলে ও তাঁর ওহীর উপর ঈমান আনবার জন্য। তিনি আল্লাহ্র প্রশংসায় মুখর হয়ে আমায় বললেন : আল্লাহ তোমায় সত্যপথের অনুসারী করেছেন। একথা বলে তিনি আমার বুকে হাত রাখলেন এবং আমার মুক্তি ও সত্যপন্থী হওয়ার জন্যে প্রার্থনা জানালেন। এভাবে আমি তাঁর দ্বীনের ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়ে গেলেম।
কাহিনী দুটির সত্যাসত্য তর্কিত হলেও এ-বিষয় তর্কাতীতভাবে প্রমাণিত যে, ওমরের ইসলামে দীক্ষা ইতিহাসের এক ক্রান্তিকালীন ঘটনা। পূর্বে ইসলামের প্রচার হচ্ছিল ধীরমন্থর গতিতে। যাঁরা মুসলিম হয়েছেন, তাঁরা নিজেদের দীক্ষা রেখেছেন গোপন করে এবং গোপনে ইসলামের সেবা করেছেন। প্রকাশ্যে ইসলাম অনুষ্ঠান পালন সহজ ছিল না, দিবালোকে জনসমক্ষে কাবাগৃহে নামায আদায় করা ছিল অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু ওমরের দীক্ষার পর সব কিছুই পরিবর্তিত হয়ে গেল। তিনি প্রকাশ্যে সকলের মুখের উপর ইসলামের দীক্ষা গ্রহণ প্রচার করতেন এবং অকুতোভয়ে বিপক্ষদলের সব রকম বিরোধ ও হিংসামূলক কাজের প্রতিদ্বন্দ্বিতা অগ্রাহ্য করে প্রকাশ্য মুসলিমদেরকে নিয়ে বিপক্ষদলের তীব্র বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে প্রকাশ্যে কাবাগৃহে নামায আদায় করেন। ইবনে হিশাম আবদুল্লাহ ইবনে-মাসুদের একটি উক্তির বরাত দিয়ে বলেছেন।
ওমর ইসলাম গ্রহণ করার পর কোরায়েশদের সঙ্গে বহু সংঘাতের সম্মুখীন হন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনিই জয়ী হন এবং শেষ পর্যন্ত কাবায় প্রবেশ করে নামায আদায় করেন। আমরাও তাঁর শরীক হয়েছিলাম।