ওমরের শাহাদাত
দেশে দেশে দিকে দিকে যখন জ্বলে উঠেছিল ‘দী-ই-ইসলামী লাল মশাল’ যখন ‘রণধারা বাহি’ ‘জয় গান গাহি’ ‘উন্মাদ কলরবে ভেদি’ ‘মরুপথ গিরিপর্বত’, মুসলিম বাহিনী পূর্বে সিন্ধুদেশ সীমান্ত থেকে মিসরের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত বিজয়-গৌরবে বিচরণ করে ফিরছিল, ঠিক সেই চরম গৌরব মুহূর্তে ইসলাম-জগতের উপর সহসা অশনিসম্পাত হয়ে গেল। উন্মাদ নিয়তির তর্জনীহেলনে ইসলামের অগ্রগতি নিমেষে রুদ্ধ ও স্তব্ধ হয়ে গেল।
তেইশ হিজরীর ছাব্বিশে জিলহজ্জ বুধবার দিন। (তেসরা নভেম্বর, ৬৪৪ খ্রি.)। ওমর মারাত্মকভাবে আহত হন। তারপর মাত্র তিনদিন জীবিত ছিলেন।
ওমরের আততায়ীর নাম ছিল ফিরোজ ওরফে আবু লুলু। জাতিতে সে পারসিক, ধর্মে অগ্নিপূজক। মাত্র দুবছর পূর্বে নিহাওন্দের যুদ্ধে বন্দী হয়ে সে মদিনায় আনীত হয় এবং মুগিরাহ্ বিন্-শব্হার গোলাম হিসাবে তাঁর আজ্ঞাধীন হয়।
সে-বছর হজ সমাপনান্তে ওমর মদীনায় প্রত্যাগত হন। কয়েক দিন পর তিনি বাজারের পথে যাচ্ছিলেন, এমন সময় আবু লুলু তাঁর পথরোধ করে ও নালিশ জানায়: আমীরুল মুমেনীন! আমায় মুগিরার হাত থেকে বাঁচান। তিনি অন্যায়ভাবে আমার উপর বেশি কর নির্ধারণ করেছেন। ওমর জিজ্ঞাসা করলেন, করের পরিমাণ কত? সে উত্তর দিল, দৈনিক দুই দিরহাম। ওমর পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, কী কাজ কর তুমি? সে বললে, ছুতারের কাজ করি, ছবি আঁকি, আবার কামারের কাজও করি। তখন ওমর বলেন, পেশার তুলনায় তোমার কর তো বেশি নয়! আমি তো শুনেছি, তুমি হাওয়ায় চলা কলও তৈরি করতে পার। সত্যি নাকি? আবু লুলু বললে, সত্যি বটে। তখন ওমর বললেন, তা হলে আমার জন্যে একটা কল তৈরি করে দাও। আবু লুলু চোখ মুখ লাল করে বললে, যদি বেঁচে থাকি, আপনার জন্যে এমন কল তৈরি করবো, তার আলোচনায় পশ্চিম থেকে পূর্বদেশ মুখর হয়ে উঠবে। তার পর সে হনহন করে চলে গেল। ওমর উপস্থিত লোকদের বললেন, লোকটা আমায় শাসিয়ে গেল।
অভ্যাসমতো ওমর সেদিন অতি প্রত্যুষে গৃহত্যাগ করে মসজিদে উপস্থিত হন ফজরের নামাজের জন্যে। নিয়মিতভাবে শ্রেণী ঠিক করা হলো এবং সকলে নামাজের জন্যে প্রস্তুত হলে ওমর ইমামতির জন্যে সবার অগ্রে দণ্ডায়মান হলেন। তখনও রঙিন ঊষার ভালে সূর্যের দীপ্তি জাগে নি। কিন্তু নামায শুরু করা মাত্রই আবু লুলু পিছন থেকে ক্ষিপ্রগতিতে ছয়বার ওমরের দেহে ছুরিকাঘাত করে, একটি আঘাত সাংঘাতিকভাবে নাভীর নিম্নদেশে লাগে। ওমর তৎক্ষণাৎ পড়ে গিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, ধরো, ধরো, এই কুকুরটা আমায় খুন করে ফেললে।
আবু লুলু রাত্রির অন্ধকারে মসজিদের এককোণে লুকিয়েছিল। তার চাদর-ঢাকা হাতের মধ্যে দুদিকে তীক্ষ্ণ ফলাযুক্ত একটি ছুরি ছিল। ওমরকে প্রাণান্তক আঘাত করেই আবু লুলু প্রাণভয়ে দৌড় দেয়। উপস্থিত নামাযীরা প্রথমে হকচকিয়ে উঠে, তার পর আবু লুলুকে তাড়া করে। সে ছুরি উচিয়ে ডানে-বামে উন্মত্তের মতো চালাতে থাকে, ফলে বারজন আহত হয়। তাদের মধ্যে প্রায় ছয়জন প্রাণত্যাগ করে। শেষে একজন পিছন থেকে একখানা চাদর ছুঁড়ে দেয় আবু লুলুর মুখের উপর। আবু লুলু পড়ে যায়, কিন্তু কায়দামতো ধৃত হওয়ার পূর্বেই ছুরি দিয়ে আত্মহত্যা করে ফেলে।
ওমর মাটিতে পড়ে যেয়েই আবদুর রহমান-বিন্-আউফকে ইঙ্গিত করলেন, নামাযে ইমামতি করতে এবং তার পরই মূর্ছিত হয়ে পড়লেন। আমীরুল মুমেনীনের রক্তাক্ত দেহ মাটিতে পড়ে রইলো, আল্লাহ্র বান্দারা নামাযে খাড়া হলেন, আবদুর রহমান নামায শেষ করলেন দুটি সংক্ষিপ্ত সুরা আসর ও সুরা কওসর আবৃত্তি করে। তারপর সকলে ধরাধরি করে ওমরকে স্বগৃহে আনয়ন করে। সেখানে তাঁর চৈতন্যেদয় হলে সর্বপ্রথম জিজ্ঞাসা করেন তাঁর আততায়ী কে? উত্তর হলো, ফিরোয। ওমর হাত তুলে বললেন, আল্লাহ্ শুকর। কোন মুসলিম আমায় খুন করে নি। আমার কোন আরব খুন করে নি।
একজন আরব চিকিৎসক ডাকা হলো। তিনি ওমরকে কিছুটা খুর্মার রস খাওয়ান, কিন্তু সমস্তটাই নাভীর নিচের জখম দিয়ে বেরিয়ে গেল রক্তরঙীন হয়ে। পুত্র আবদুল্লাহ্ একজন আনসারী চিকিৎসক ডাকালেন, বানু মাবিয়া বংশেরও একজন চিকিৎসক উপস্থিত হলেন। তাঁদের নির্দেশ অনুযায়ী খলিফাকে কিছু দুগ্ধ পান করান হয়। কিন্তু তার সমস্তটুকুই উক্ত জখম দিয়ে বেরিয়ে গেল, একটুও বর্ণের পরিবর্তন হলো না। তখন চিকিৎসক খলিফাকে বললেন, আমীরুল মুমেনীন। আল্লাহ্র নাম স্মরণ করুন। তার পরিষ্কার অর্থ, খলিফার মৃত্যু অনিবার্য, ওমর হাসিমুখে বললেন, তবীব ভাই। তুমি সত্য কথাই বলেছ, আল্লাহ্ আমায় ডাক দিয়েছেন। উপস্থিত সকলেই এ দুরাশা পোষণ করেছিলেন, খলিফার জখম মারাত্মক নয়, আল্লাহর রহমতে নিরাময় হয়ে উঠবেন 1 এখন তাঁরা খলিফার মৃত্যু নিশ্চিত জেনে মাতম করে উঠলেন। তাঁদের মাথায় যেন বিষাদের ও শোকের পাহাড় ভেঙ্গে পড়লো। তা শুনে ওমর বললেন, আমার জন্যে অশ্রুপাত করো না। যে কাঁদবে, সে এখান থেকে সরে যাও। তোমরা কি রসূলুল্লাহ্ বাণী ভুলে গেছ, আত্মীয়ের অশ্রুবর্ষণে মৃতের উপর গযব আসে?
এদিকে মসজিদে ও চতুর্দিকে সারা মদীনাবাসী ভেঙ্গে পড়েছে। সকলের মুখে এককথা, কেন এই হামলা খলিফার উপর? কেন আবু লুলু এমন শয়তানী কাজ করলো? এর পিছনে আর কে আছে?
আবু লুলুর হামলার পিছনে কোন ষড়যন্ত্র ছিল কি-না এবং এ ষড়যন্ত্রের অংশীদার কে কে ছিল, সে রহস্য উৎঘাটিত হয় নি। আবু লুলু আত্মহত্যা করায় তার জবানীতে এ রহস্য উদ্ঘাটিত করার পথও চিরতরে রুদ্ধ হয়ে গেছে। তবু উপস্থিত মদীনাবাসী এ সম্বন্ধে যা আলোচনা করেছিল, যে যে কাহিনী ব্যক্ত করেছিল, তার কোন কোনটি ঐতিহাসিকরা ইচ্ছামত গ্রহণ করে বর্ণনা করে গেছেন। তার দরুন তাঁদেরও বর্ণনায় সামঞ্জস্য না থাকায় রহস্য উদ্ঘাটনে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। তবে তাঁদের সকলের বর্ণনা থেকে যে কথাটি নিঃসন্দেহে স্পষ্ট হয়েছে, তার উল্লেখ করা যেতে পারে।
যখন থেকে মুসলিমরা পারসিকদের, ইহুদী ও খ্রিস্টানদের উপর প্রভুত্ব স্থাপন করে, তাদের দেশের উপর একচ্ছত্র অধিকার বিস্তার করে এবং শাহানশাহ্ কিস্স্সা ইয়েদির্গকে লগুড়াহত কুকুরের মতো স্বদেশ থেকে বিতাড়িত করে, তখন থেকেই পারসিক ইহুদী ও খ্রিস্টানদের অন্তর-মন হিংসায় ও বিদ্বেষে ভরে যায় সারা আরবের প্রতি এবং বিশেষ করে খলিফা ওমরের প্রতি তারা আক্রোশে ফুলতে থাকে এবং আপসে তাঁর বিরুদ্ধে চুপে চুপে নিজেদের বিদ্বেষ-বিষ ছড়াতে থাকে। এ কথা স্মরণীয় যে, ওমরকে যখন বলা হয় যে, তাঁর আততায়ীর নাম আবু লুলু, তখন তিনি বলেছিলেন, তোমাদেরকে মানা করেছিলুম, কোনো বেদ্বীনকে আমার সামনে আসতে দিও না, তোমরা আমার বারণ শুনলে না। এ থেকেই পরিষ্কার যে, এ-সব অমুসলিমকে বিদ্বেষ ও হিংসার কথা তাঁরও আগোচর ছিল না। এ কথা নিঃসন্দেহ যে, সংখ্যাল্প হলেও মদীনায় এ-সব আযমী অমুসলিমদের একটি জামাত ছিল এবং তাদের এই বিদ্বেষ ও হিংসার কথাও অবিদিত ছিল না। হরমুযান এবং জুফিনাহকে তাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মিশতে দেখা যেতো। হরমুজানের পরিচয় পূর্বেই দেওয়া হয়েছে। জুফিনাহ্ ছিল হিরাবাসী একজন খ্রিস্টান এবং সা’দ-বিন-আবু ওক্কাসের একজন দুগ্ধভাই। এই্ আত্মীয়তাহেতু সা’দ তাঁকে মদীনায় আনয়ন করেন। জুফিনাহ্ মদীনায় মুসলিম বালকদেরকে লেখাপড়া শিখাতো।
আবদুর রহমান-বিন্-আউফ যখন ওমরকে জখম-করা ছুরিখানা দেখেন, তখন বলেছিলেন আমি এই ছুরি গতকাল হরমুযান ও জুফিনার নিকট দেখেছি। আমি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করি, এ ছুরি দিয়ে কি হবে? তারা উত্তর দেয়, গোশত কাটবে। আবদুর রহমান-বিন্-আবুবকরও বলেছিলেন : আমি গত রাতে ওমরের আততায়ী আবু লুলুর নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেম। তখন লক্ষ্য করলেম, সে হরমুযান ও জুফিনাহ সঙ্গে চুপি চুপি আলাপ করছে। আমি নিকটবর্তী হতেই আবু লুলু পালাবার চেষ্টা করে এবং তখন একটা ছুরি তার নিকট থেকে পড়ে যায়। তার মাঝখানে বাঁট এবং দুদিকে ফলা। বলা বাহুল্য, এমন দুজন সম্ভ্রান্ত ও মর্যাদাবান ব্যক্তির সাক্ষ্যের পর এই ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব সম্বন্ধে এবং হরমুযান ও জুফিনাহর তাতে অংশগ্রহণ করা সম্বন্ধে কারও এতটুকু সন্দেহ থাকে না, এবং এরূপে নিঃসন্দেহ হয়েই আবুল্লাহ্-বিন-ওমর হরমুযান ও জুফিনাহকে হত্যা করেন।
মৃত্যু সম্বন্ধে নিঃসন্দেহের হয়ে ওমর প্রথমেই পুত্র আবদুল্লাহকে আদেশ দেন, আয়েশা সিদ্দীকার নিকট যেয়ে তাঁর অনুমতি প্রার্থনা করতে যে তিনি যেন আঁ-হযরতের একপাশে ওমরকে সমাহিত করার সম্মতি দেন। বলা বাহুল্য, ইতিপূর্বে আবুবকর সিদ্দীককে রসূলে-করীমের একপাশে সমাহিত করা হয়েছিল। আবদুল্লাহ আয়েশার নিকট উপস্থিত হয়ে প্রার্থনা জানালে আয়েশা ক্রন্দন করতে করতে বললেন: আমার ইচ্ছে ছিল এই স্থানটি আমার জন্যে নির্দিষ্ট থাকবে। কিন্তু আজ নিশ্চয়ই ওমরকে আমার উপরে স্থান দেব। তাঁর ইচ্ছা পূরণ হবেই। আবদুল্লাহ গৃহে ফিরলে ওমর অধীর আগ্রহে জিজ্ঞাসা করলেন, কী খবর বৎস? পুত্র উত্তর দিলেন, আপনার যাতে সন্তুষ্টি। ওমর স্মিত কণ্ঠে বললেন, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কামনা ছিল এইটিই। কিন্তু আমার নির্দেশ রইল, আমার লাশ নিয়ে আয়েশার গৃহে যেয়ে পুনরায় তাঁর অনুমতি নিও। তখন আমি খলিফা থাকব না এবং তখন তিনি সম্মতি দিলে আমায় সমাহিত করো।
ওমরের পরে কে-এটাই ছিল সে-সময়ের সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন। ইসলামের সবচেয়ে কঠিন সমস্যা ছিল, কে ওমরের পরে খলিফা হবেন। সকল সাহাবাই ওমরকে বারবার আরজ করলেন শেষ-নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে তিনি যেন উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান। এমন সঙ্কটময় মুহূর্তে তিনি যেন এ-সমস্যার সমাধান করে যান।
ওমর এ-প্রশ্নটি পূর্বে বহুবার চিন্তা করেছেন। বহুবার তাঁকে দেখা গেছে একাকী গভীর চিন্তায় মগ্ন আছেন শুধুমাত্র এই সমস্যাটি নিয়ে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলতেন, খেলাফতের সমস্যাই তাঁকে বেশি চিন্তিত করেছে। কিন্তু বারবার চিন্তা করেও তিনি উত্তরাধিকারী নির্বাচনে স্থির-নিশ্চয় হতে পারেন নি। এজন্যে মাঝে মাঝে গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করে বলতেন, কী আফসোস! আমি কাউকে এই গুরুভার বোঝা বইবার উপযুক্ত দেখছিনে। সাহাবাদের মধ্যে ছয়জন ছিলেন, যাঁরা তাঁর উত্তরাধিকারী হওয়ার যোগ্যতা রাখতেন। তাঁদের নাম সা’দ বিন্-ওক্কাস্, আবদুর রহমান বিন্ আউফ্, আলী বিন আবু তালিব, ওসমান-বিন আফ্ফান, জুবায়ের বিন্-আওয়াম ও তোলায়হা বিন্ আবদুল্লাহ্। কিন্তু ওমরের চোখে তাঁদের একটা না একটা স্বভাবগত দোষ ছিল এবং এ কথা তিনি বহুবার প্রকাশ্য ব্যক্ত করেছেন। তাঁদের মধ্যে আলীকেই তিনি সবচেয়ে উপযুক্ত বিবেচনা করতেন, কিন্তু কয়েকটি কারণে তাঁকেও তিনি মনোনীত করতে পারেন নি।
এখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত হয়ে জনগণের প্রবল অনুরোধে ওমর এই ওসিয়ত করে যান: এই ছয়জনের চেয়ে আর কাউকে খলিফা হওয়ার উপযুক্ত মনে করি নে। তাঁদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি ভোটের অধিকারী হবেন, তিনিই আমার পর খলিফা হবেন। যদি সা’দ নির্বাচিত হন, তা হলে তিনিই খলিফা হবেন, তাঁর দ্বারা কোনও ক্ষতির আশঙ্কা নেই। তেমনি অন্য কেউ নির্বাচিত হলে মুসলিমরা বিনা দ্বিধায় তাঁকে গ্রহণ করবেন।
নিষ্ঠুর আততায়ীর হাতে ছয়টি প্রাণঘাতী আঘাতের যন্ত্রণা সহ্য করে মৃত্যুর সঙ্গে সংগ্রামকালেও ওমর ইসলাম, মুসলিম জাতি ও আরবের অগ্রগতি, সংগতি এবং নিরাপত্তার বিষয় চিন্তা করেছেন, এ থেকেই তাঁর এ তিনটির প্রতি নিষ্ঠা ও প্রেমের প্রকৃষ্ট পরিচয় মেলে। তিনি সমাগত জনগণকে উদ্দেশ্য করে শেষ উপদেশ দিয়েছিলেন: আমার পর যিনিই খলিফা নির্বাচিত হোন, তাঁকে এই পাঁচ শ্রেণীর ব্যক্তির অধিকার ও দাবী-দাওয়া রক্ষার্থে বিশেষ সাবধান করছি: মুহাজেরীন, আনসারী, বেদুঈন, পরদেশে প্রবাসী আরবগণ ও জিম্মী অর্থাৎ ইসলামের আশ্রয়প্রার্থী খ্রিস্টান ইহুদী ও অগ্নি পূজকগণ। প্রত্যেক শ্রেণীর সুবিধা, অসুবিধা ও জন্মগত অধিকার সম্বন্ধে অবহিত করে জিম্মীদের সম্বন্ধে তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন, সমকালীন খলিফার প্রতি আমার শেষ নির্দেশ রইলো, তিনি যেন আল্লাহ ও রসূলের প্রতি তাঁর কর্তব্য যথাসাধ্য পালন করেন। তিনি যেন জিম্মীদের সঙ্গে প্রতিশ্রুত শর্তসমূহ মর্যাদার সঙ্গে রক্ষা করেন, তাদের শত্রুদের কবল থেকে রক্ষা করেন, এবং তাদেরকে সহ্যাতীত কোন হুকুমে বাধ্য না করেন।
সাধারণের প্রতি কর্তব্য পালন করে ওমর ব্যক্তিগত শেষ কর্তব্যের দিকে লক্ষ্য দেন। তিনি পুত্র আবদুল্লাহকে জিজ্ঞাসা করলেন বায়তুল মাল থেকে আমার ঋণের পরিমাণ কত? আবদুল্লাহ জওয়াব দিলেন: ছিয়াশি হাজার দিরহাম, উল্লেখযোগ্য যে, ওমর এই অর্থ বিভিন্ন সময়ে গ্রহণ করে সৎকার্যে দান করেছিলেন, পারিবারিক বা ব্যক্তিগত খরচের জন্যে নয়। ওমর তৎক্ষণাৎ নির্দেশ দেন: এই দেনা আমার নিজস্ব সম্পত্তি বিক্রয় করে শোধ করে দিও। তাতে সঙ্কুলান না হলে আদি গোত্রের লোকদের বলো, বাকী দেনা শোধ করে দিতে এবং তারাও অসমর্থ হলে কোরায়েশীদেরকে বলো, ঋণভার গ্রহণ করতে। অন্যের উপর এ বোঝা ফেলে দিও না। পরবর্তীকালে এই সমস্ত দেনা আমীর মু’আবীয়ার নিকট থেকে ক্রীত ওমরের বাসগৃহ বিক্রয় করে শোধ করা হয়। উল্লেখযোগ্য যে: বাবু-স্সালাম বা শান্তি দ্বার ও বাবু-র্ রহমাত বা করুণার দ্বার নামক দুটি পবিত্র দরওয়াজার মধ্যবর্তী স্থানে এই বাসগৃহ অবস্থিত ছিল এবং তার বিক্রয়মূল্যে দেনা শোধ করায় তার নামকরণ হয় দারুল-কাজা।
ওমর আহত হন বুধবার প্রত্যুষে। শনিবার তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দশ বছর ছয় মাস চারদিন ওমর ইসলাম জগতের খলিফা ছিলেন। তিনি যখন খলিফা মনোনীত হন আবুবকরের দ্বারা তখন লোকেরা তাঁর মেজাজের রুক্ষতা ও কঠোরতা স্মরণ করে শিউরে উঠেছিল। আজ সাড়ে দশ বছরে তিনি জনগণের সবচেয়ে বড় বন্ধু, সবচেয়ে হিতকারী ও ন্যায়নিষ্ঠ শাসক হিসেবে তাদের মনে মণিকোঠায় শ্রদ্ধার ও প্রীতির স্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সেজন্যে আপামর সাধারণ তাঁর মৃত্যুতে নিজেদেরকে এতিম ও ভাগ্যাহত বিবেচনা করে শোকে অধীর হয়ে গেল। আলী তাঁর মৃত্যুতে অধীর হয়ে বলেছিলেন: আবু হাস! আল্লাহ আপনাকে নিজের করুণাধারায় সিক্ত করে দিলেন। কিন্তু আমার নিকটে রসূলুল্লাহ (স.) ব্যতীত আপনার ন্যায় কেউ প্রিয়জন ছিলেন না। আপনার আমলনামার সঙ্গে আমি আল্লাহর নিকট হাজির হবো।
জানাযার জন্যে ওমরের লাশ মসজিদে নীত হলে রসূলুল্লাহ্র মরদেহ মুবারক ও মিম্বারের মাঝেখানে রাখা হয়। ওসমান ও আলী জানাযা পড়াবার জন্যে ইচ্ছুক হলে আবদুর রহমান-বিন্-আউফ বললেন, তিনি হুকুম দিয়ে গেছেন শোহায়েবকে নামায পড়াতে। শোহায়েব নামায পড়ালেন এবং আবদুল্লাহ্-বিন্-ওমর, ওসমান, আলী, আবদুর রহমান-বিন্-আউফ্, সা’দ ও জুবায়ের তাঁর নশ্বর দেহ কবরের শেষ শয্যায় রক্ষা করলেন।
ধূলির দেহ ধূলিশয্যায় ধন্য হলো। পবিত্র নিষ্কলুষ আত্মা ফিরে গেল সেই অনন্ত অসীম প্রেমময়ের উদ্দেশ্যে, যেখান থেকে ধূলির ধরণীতে তার আবির্ভাব হয়েছিল। আটাশ বছর পূর্বে একদিন যার সম্মুখে হাতের শমশের ফেলে দিয়ে সব গর্ব, সব অহঙ্কার চোখের পানিতে ডুবিয়ে, যে রসূলে করীমের আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন, ষোল বছর ধরে ছায়ার মতো যাঁর চরণচিহ্ন দশ বছর সগৌরবে বহন করেছিলেন, আজ মৃত্যুর পর তাঁর পার্শ্বদেশে অনন্তশয্যা লাভ করে ওমরের দেহাবশেষও ধন্য হয়ে গেল। ইসলামের এক গৌরব-জ্যোতি অন্তর্হিত হয়ে গেল। অর্ধ পৃথিবীর অধীশ্বর হয়েও দুস্থ ধূলির সম্রাট আজ মৃত্যুর কবাট খুলে কোন্ সার্বজন্য আবেহায়াতের সন্ধানে চলে গেলেন; রেখে গেলেন সাম্য-মৈত্রী-তিতিক্ষার মহামন্ত্র। কোটি কোটি নরনারী শোক বিহ্বল হয়ে এতিমের মতো অসহায় কণ্ঠে আহাজারী করতে লাগলো:
ওমর! ফারুক! আখেরী নবীর ওগো দক্ষিণ বাহু!
আহ্বান নয়, রূপ ধরে এস, গ্রাসে অন্ধতা-রাহু।