অনুসরণ

খাঁড়ির মধ্যে মা ডলফিন আর তার ছানা যখন মাছ ধরতে ব্যস্ত, তখন পাশের খালে ডিঙিটাকে স্থির রাখতে দম বেরিয়ে যাচ্ছিল ফকিরের। স্রোত খুব বেশি এখানে, তার মধ্যেই কোনওরকমে একই জায়গায় চক্কর কেটে যাচ্ছিল ফকির, যাতে ডলফিনগুলো পিয়ার নজরের মধ্যে থাকে। যদিও হাওয়া নেই এক বিন্দু, তাও নদীতে এত ছোট ছোট ঢেউ আর ঘূর্ণি যে মনে হচ্ছে জল যেন ফুটছে।

ছ’খানা ডেটাশিট ভর্তি করার পর পিয়া ঠিক করল জল কতটা গভীর এখানে সেটা একবার মেপে দেখবে। নৌকোর সামনের দিকটাতেই বসেছিল ও, যেমন বসে সাধারণত, আর ফকির ছিল মাঝামাঝি জায়গায়, ঝপাঝপ দাঁড় ফেলছিল একবার ডাইনে, একবার বাঁয়ে। পিয়া ওর ডেস্থ সাউন্ডারটা জলে মাত্র ডুবিয়েছে, ঠিক সেই সময় হঠাৎই ফকিরের নজর গেল ওর দিকে। সঙ্গে সঙ্গে ফকিরের চোখ গোল গোল হয়ে গেল, এমন এক চিৎকার করল যে পিয়া যে অবস্থায় ছিল সে ভাবেই থমকে থেমে গেল, ওর কবজি পর্যন্ত তখনও জলে ডোবানো। দাঁড়-টাঁড় নৌকোর ওপর ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়ল ফকির পিয়ার দিকে, হুমড়ি খেয়ে সামনে পড়ে অন্ধের মতো টান মারল ওর কবজি ধরে। উলটে পড়ে গেল পিয়া, জল থেকে ছিটকে উঠে এল ওর হাত, আর ডেপ্‌থ সাউন্ডারটা উড়ে গিয়ে পড়ল নৌকোর মাঝখানে।

ঠিক তখনই আচমকা জল তোলপাড় করে বিশাল একটা হাঁ-করা মুখ তিরবেগে উঠে এল নদী থেকে, এক মুহূর্ত আগেও পিয়ার কবজিটা যেখানে ছিল ঠিক সেই জায়গাটায়। চোখের কোনা দিয়ে পিয়া দেখল ঝকঝকে একজোড়া ধারালো দাঁতের সারি পাক মেরে ছিটকে উঠল তখনও ঝুলে থাকা হাতটার দিকে: এত কাছ ঘেঁষে গেল যে শক্ত খসখসে নাকের ডগাটা ঘষে গেল ওর কনুইয়ে, আর নিশ্বাসের সঙ্গে আসা জলের ছিটেয় ভিজে গেল হাতের সামনেটা। এক সেকেন্ড পরেই জলের তলা থেকে আসা প্রচণ্ড এক ধাক্কায় টলমল করে উঠল ডিঙিটা। এত জোরালো সে ধাক্কা, যে নৌকোর খোলের মধ্যে জমে থাকা জল ছিটকে উঠে এল, মড়মড় করে আওয়াজ হল একটা, আর ডিঙিটা এমনভাবে কাত হয়ে গেল, মনে হল নির্ঘাত উলটে যাবে। পিয়ার পায়ের কাছে রাখা ক্লিপবোর্ডটা পিছলে গিয়ে পড়ল জলে, নৌকোর পাটাতনের কাঠগুলো উলটে চলে এল হুড়মুড় করে।

টুটুল বসেছিল ছইটার ভেতরে। একটা বলের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে ব্যালান্স ঠিক রাখতে গিয়ে ডিগবাজি খেতে খেতে চলে এল সামনের দিকে। ঝপাস করে একটা আওয়াজ করে ফের সোজা হল নৌকোটা। একটা জলের পর্দা ছিটকে উঠল নদী থেকে। এক মুহূর্ত পরেই আরেকবার প্রচণ্ড ধাক্কা এল নীচ থেকে। এবার ডিঙির পেছনের দিকটায়। ভয়ানক দুলুনির মধ্যেই কোনও রকমে হাঁটু গেড়ে উঠে বসে একটা বৈঠা তুলে নিল ফকির। মাথার ওপরে সেটাকে এমন ভাবে তুলে ধরল, যাতে বৈঠার ডগাটা একটা ফলার মতো কাজ করে, তারপর প্রচণ্ড জোরে সেটা চালিয়ে দিল জলের ভেতরে। ঠিক সেই মুহূর্তেই আরেকবার ধাক্কা দিতে যাচ্ছিল কুমিরটা। বৈঠাটা গিয়ে পড়ল একেবারে ওর মাথার ওপর। ঘা-টা এত জোরে গিয়ে লাগল যে তার চোটে ঝপাৎ করে বন্ধ হয়ে গেল কুমিরের হাঁ করা মুখটা। বৈঠাটাও টুকরো টুকরো হয়ে গেল সে আঘাতে, ফলাটা হাতলের থেকে ভেঙে চারকির মতো পাক খেতে খেতে ছিটকে গেল জলের ওপর দিয়ে। আর, বুজকুড়ি তুলতে তুলতে দৃষ্টির আড়ালে তলিয়ে গেল কুমিরটা। ডুব মারার পর এক মুহূর্তের জন্য জলের মধ্যে ভুতুড়ে একটা ছায়ার মতো ওটার আকৃতি নজরে এল পিয়ার। দেখল প্রায় এই ডিঙির সমান বড় ছিল সরীসৃপটা।

ইতোমধ্যে ফকির ঠিক হয়ে বসে একজোড়া বৈঠা তুলে নিয়েছে হাতে। ডলফিনগুলো যে খাঁড়িটার মধ্যে শিকার ধরছিল, স্রোতের টানে তার থেকে বেশ কয়েকশো মিটার সরে এসেছে নৌকোটা। এবার ফকির প্রাণপণে বৈঠা চালিয়ে এ খাঁড়ি সে খাঁড়ি দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আরও দূরে সরে যেতে লাগল জায়গাটা থেকে।

প্রায় মিনিট বিশেক ওইভাবে একটানা দাঁড় টেনে একটা সরু খালে এসে ঢুকল ওরা। এঁকেবেঁকে ঘন জঙ্গলে ভরা একটা দ্বীপের মধ্যে ঢুকে গেছে খালটা। তার মধ্যে দিয়ে নৌকোটাকে নিয়ে গিয়ে এমন একটা জায়গায় দাঁড় করাল ফকির যেখানে জোয়ারের টান আর বোঝা যায় না। নোঙর নামিয়ে চুপচুপে ভেজা গেঞ্জিটা গা থেকে টেনে খুলে ফেলল। তারপর গামছা নিয়ে বুক বেয়ে গড়িয়ে নামা ঘাম মুছতে লাগল।

দম ফিরে পেয়ে পিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “লুসিবাড়ি?”

সাগ্রহে রাজি হয়ে গেল পিয়া। বলল, “ইয়েস। লেটস হেড ফর লুসিবাড়ি। ইটস টাইম।”