কুসুম লুসিবাড়িতে আসায় আদৌ খুশি হয়নি নীলিমা। সেইদিন সন্ধেবেলা আমাকে বলল, “জানো, কুসুম আজকে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। ওই মরিচঝাঁপির ঝামেলায় ট্রাস্টকে জড়াতে চাইছিল। ওরা চায় ওখানে কিছু চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে ট্রাস্ট ওদের সাহায্য করুক।”
“তুমি কী বললে?”
“আমি বলে দিয়েছি আমাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়,” খুব ঠান্ডা দৃঢ় গলায় বলল নীলিমা।
“কেন সাহায্য করতে পারবে না ওদের?” প্রতিবাদ করলাম আমি। “ওরাও তো। মানুষ–অন্য সব জায়গার লোকেদের মতো ওদেরও অসুখ-বিসুখ করে, ওষুধপত্রের দরকার হয়।”
“এটা সম্ভব নয় নির্মল,” বলল নীলিমা। “এই লোকগুলো দখলদার; ওই দ্বীপের জমি তো ওদের নয়, ওটা সরকারের সম্পত্তি। অমনি উড়ে এসে জুড়ে বসে পড়লেই হয়ে গেল? ওদের যদি ওখানে থাকতে দেওয়া হয়, লোকে তো ভাববে এই ভাটির দেশের যে-কোনও দ্বীপই এরকমভাবে ইচ্ছেমতো দখল করে নেওয়া যায়। জঙ্গলটার তা হলে কী হবে? পরিবেশের কথাটা কেউ একবার ভাববে না?”
জবাবে আমি বললাম, এই লুসিবাড়িও একসময় জঙ্গল ছিল–এই জমিও সরকারের সম্পত্তি ছিল এককালে। তা সত্ত্বেও স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিলটনকে তাঁর পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য এখানে বসতি গড়ার অধিকার দেওয়া হয়েছিল। এবং এত বছর ধরে নীলিমা বলে এসেছে উনি যা করেছেন সেটা খুবই প্রশংসাহ। তফাতটা তা হলে কী? এই উদ্বাস্তুদের স্বপ্নের মূল্য কি স্যার ড্যানিয়েলের স্বপ্নের মূল্যের চেয়ে কম? উনি ধনী সাহেব আর এরা ঘরছাড়া গরিব মানুষ বলে?
“কিন্তু নির্মল, স্যার ড্যানিয়েল যা করেছিলেন সে অনেককাল আগের কথা,” বলল নীলিমা। একবার ভাবো এখন যদি সবাই সেরকম করতে শুরু করে কী হাল হবে এই গোটা জায়গাটার। জঙ্গলের কোনও চিহ্নই থাকবে না আর।”
“দেখো নীলিমা, ওই উদ্বাস্তুরা আসার আগেও কিন্তু মরিচঝাঁপিতে জঙ্গল সেভাবে ছিল না। দ্বীপের খানিকটা অংশ তো সরকারই ব্যবহার করছিল চাষবাসের জন্য। এখন পরিবেশের নামে যা বলা হচ্ছে সব বাজে কথা। যে মানুষগুলোর আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, তাদের ওই দ্বীপটা থেকে তাড়ানোর জন্যই শুধু বলা হচ্ছে এসব।”
“তা হতে পারে, কিন্তু ট্রাস্টকে আমি এই ব্যাপারে কিছুতেই জড়াতে দিতে পারি না,” নীলিমা বলল। “আমাদের পক্ষে একটু বেশি ঝুঁকি হয়ে যাবে সেটা। হাসপাতালের রোজকার কাজ কীভাবে চলে তুমি তো জানো না, জানলে বুঝতে পারতে সরকারের সুনজরে থাকার জন্য কী করতে হয় আমাদের। নেতারা যদি একবার আমাদের পেছনে লাগে তা হলে তো হয়ে গেল। সেই ঝুঁকি আমি নিতে পারি না।”
এবার পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হল আমার কাছে। “তা হলে তুমি বলতে চাইছ যে বিষয়টার ন্যায়-অন্যায় নিয়ে তোমার কোনও বক্তব্য নেই। এই লোকগুলোকে তুমি সাহায্য করবে না, তার কারণ তুমি সরকারের সুনজরে থাকতে চাও।”
হাতদুটো মুঠো পাকিয়ে কোমরের কাছে রেখে দাঁড়াল নীলিমা। বলল, “তোমার কোনও বাস্তব ধারণা নেই নির্মল। তুমি এখনও তোমার ওই দুর্বোধ্য কবিতা আর বিপ্লবের ঝাপসা স্বপ্নের জগতেই বাস করছ। কিছু একটা সত্যি সত্যি গড়ে তোলা আর সেটার স্বপ্ন দেখা এক জিনিস নয়। কোনও জিনিস গড়ে তুলতে গেলে সবসময়েই বুঝেশুনে কিছু আপোশের রাস্তা বেছে নিতে হয়।”
নীলিমা যখন এই সুরে কথা বলে তখন সাধারণত আমি তর্কের মধ্যে আর যাই না। কিন্তু এবার ঠিক করলাম আমিও ছেড়ে কথা বলব না–”যে আপোশের রাস্তা তুমি নিয়েছ সেটা খুব বুঝেশুনে বেছে নেওয়া বলে মনে হয় না আমার।”
আরও রেগে গেল নীলিমা। বলল, “নির্মল, একটা কথা আমি তোমাকে মনে করিয়ে দিতে চাই। তোমার জন্যেই কিন্তু আমরা প্রথম লুসিবাড়িতে এসেছিলাম, কারণ রাজনীতি করতে গিয়ে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিলে তুমি, আর তারপর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে। আমার তো এখানে কিছুই ছিল না বাড়ির লোকজন না, বন্ধুবান্ধব না, চাকরিও না। কিন্তু আস্তে আস্তে আমি কিছু তো একটা গড়ে তুলেছি সত্যিকারের কিছু একটা, যেটা লোকের কাজে লাগছে, সামান্য হলেও যেটা মানুষের কিছু উপকারে আসছে। আর এতগুলো বছর ধরে তুমি শুধু বসে বসে আমার কাজের বিচার করে গেছ। কিন্তু এখন তো আমার কাজের ফল চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছ–এই হাসপাতালটা। আর এটাকে বাঁচানোর জন্য আমি কী করব যদি জিজ্ঞেস করো, তা হলে বলে রাখছি শোনো, মা তার বাচ্চাদের বাঁচানোর জন্য যেমন লড়াই করে, সেইভাবে শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব আমি। এই হাসপাতালটার ভালমন্দ, এর ভবিষ্যৎ–এটাই তো আমার সব। তার কোনও ক্ষতি আমি হতে দেব না। এতদিন ধরে তোমার কাছে আমি খুব একটা কিছু চাইনি, কিন্তু এবার চাইছি–আমার একটাই অনুরোধ, মরিচঝাঁপির ব্যাপারটার মধ্যে তুমি জড়িয়ো না। আমি জানি সরকার ওদের থাকতে দেবে না ওখানে, আর এটাও জানি যারা যারা এর মধ্যে থাকবে তাদের কাউকে ওরা রেয়াত করবে না। তুমি যদি ওই উদ্বাস্তুদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ো, তা হলে আমার সারা জীবনের কাজ দিয়ে আমাকে তার মূল্য দিতে হতে পারে। এইটা মাথায় রেখো। এইটুকুই শুধু তোমার কাছে চাইছি আমি।”
আর কিছু বলার রইল না আমার। আমার চেয়ে বেশি তো আর কেউ জানে না কী ত্যাগ স্বীকার করেছে আমার জন্য ও। বুঝতে পারলাম, মরিচঝাঁপিতে গিয়ে সেখানকার বাচ্চাদের পড়ানোর স্বপ্ন শুধু আমার এ বুড়ো বয়সের ভীমরতি, অনিবার্য অবসরকে ঠেকিয়ে রাখার একটা ব্যর্থ চেষ্টা। বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে চেষ্টা করলাম আমি।
নতুন বছর এসে পড়ল–১৯৭৯–আর কিছুদিন পরেই হাসপাতালের জন্য চাঁদা তোলার কাজে আবার বেরিয়ে পড়ল নীলিমা। কলকাতার এক ধনী মাড়োয়ারি পরিবার একটা জেনারেটর দিতে রাজি হয়েছে; ওর এক মাসতুতো ভাই রাজ্য সরকারের মন্ত্রী হয়েছে, তার সঙ্গেও একবার দেখা করতে চায় নীলিমা। এমনকী মোরারজি দেশাই সরকারের এক বড় অফিসারের সঙ্গে দেখা করতে একবার দিল্লিও যেতে হতে পারে। এত কিছু কাজ ওকে সামলাতে হবে।
নীলিমা যেদিন গেল, জেটি পর্যন্ত ওকে এগিয়ে দিতে গেলাম আমি। ঠিক নৌকোয় ওঠার মুখে ও বলল,”নির্মল, মরিচঝাঁপি নিয়ে যা বলেছি মনে রেখো। ভুলে যেয়ো না কিন্তু।”
নৌকো ছেড়ে দিল, আর আমিও ফিরে এলাম আমার পড়ার ঘরে। মাস্টারির কাজ মিটে গেছে, সময় কাটানোই এখন সমস্যা। বহু বছর পর আবার আমার খাতাটা খুললাম, ভাবলাম দেখি যদি কিছু লিখতে পারি। অনেকদিন ধরেই ভেবেছি একটা বই লিখব এই ভাটির দেশ নিয়ে–এত বছরে যা দেখেছি এখানে, যা কিছু জেনেছি জায়গাটার সম্পর্কে, সব থাকবে তাতে।
কয়েকদিন নিয়ম করে টেবিলটায় এসে বসলাম। বসে বসে দূরে রায়মঙ্গলের মোহনার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে কত কথাই যে মনে এল। মনে পড়ল, যখন প্রথম এই লুসিবাড়িতে এলাম আমি, সূর্যাস্তের সময় পাখির ঝাঁকে অন্ধকার হয়ে যেত আকাশ। বহু বছর আর তত পাখি একসঙ্গে দেখি না। প্রথম যখন লক্ষ করলাম পাখির সংখ্যা কমে এসেছে, ভাবলাম হয়তো সাময়িক ব্যাপার, আবার পরে ফিরে আসবে ঝাঁকে ঝাকে। কিন্তু এল না। মনে পড়ল, একটা সময় ছিল যখন ভাটার সময় নদীর পাড়গুলো লাল হয়ে থাকত–চারদিকে থিকথিক করত লক্ষ লক্ষ কঁকড়া। সেই রং আস্তে আস্তে ফিকে হতে শুরু করল, এখন তো দেখাই যায় না আর। মনে মনে ভাবি গেল কোথায় সেই লক্ষ লক্ষ কঁকড়া? সেই পাখির ঝক?
বয়স মানুষকে মৃত্যুর চিহ্নগুলি চিনে নিতে শেখায়। হঠাৎ একদিনে সেগুলো দেখা যায় না; অনেক বছর ধরে ধীরে ধীরে বোঝা যেতে থাকে তাদের উপস্থিতি। এখন আমার মনে হল সর্বত্র সেই চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি আমি–আমার মধ্যে শুধু নয়, এই গোটা জায়গাটায়, যেখানে তিরিশটা বছর আমি কাটিয়ে দিয়েছি। পাখিরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে, মাছের সংখ্যা কমে আসছে, দিনে দিনে সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছে জমি। কতটুকু লাগবে এই গোটা ভাটির দেশটা জলের তলায় চলে যেতে? বেশি নয়–সমুদ্রের জলের স্তরের সামান্য একটুখানি হেরফেরই যথেষ্ট।
এই সম্ভাবনাটা নিয়ে যত ভাবতে লাগলাম, আমার মনে হতে লাগল খুব একটা সাংঘাতিক ক্ষতি কিছু হবে না সেরকম ঘটনা ঘটলে। এত যন্ত্রণার সাক্ষী এই দ্বীপগুলো–এত কষ্ট, এত দারিদ্র্য, এত বিপর্যয়, এত স্বপ্নভঙ্গ–এগুলো যদি আজকে হারিয়েও যায়, হয়তো মানবজাতির পক্ষে অকল্যাণকর হবে না সেটা।
তারপর মরিচঝাঁপির কথা মনে পড়ল আমার–যে জায়গাকে আমার মনে হচ্ছে কেবল চোখের জলে ভেজা, সেই একই দেশ তো কারও কারও কাছে সোনার সমান। কুসুমের গল্প মনে পড়ে গেল আমার–মনে পড়ল সেই দূর বিহারে ওর নির্বাসনের দিনগুলি, কেমন তখন ওরা এই ভাটির দেশে ফেরার স্বপ্ন দেখত, এই কাদামাটি এই জোয়ার-ভাটা কেমন ওদের মনকে টানত সেই কাহিনি মনে পড়ল। আরও বাকি যারা এসেছে মরিচঝাঁপিতে, কত কষ্ট সহ্য করেছে ওরা এখানে আসার জন্য, সেই কথাও মনে এল আমার। কীভাবে এই জায়গার প্রতি সুবিচার করতে পারি আমি? এমন কী লিখতে পারি এই দেশ সম্পর্কে আমি যা ওদের মনের টান আর ওদের স্বপ্নের সমান শক্তি ধরবে? কীরকম চেহারা হবে সে লাইনগুলোর? ঠিক করে উঠতে পারলাম না। আমি–নদীর মতো বহমান হবে কি সে লেখার গতি, না ছন্দোময় হবে জোয়ার-ভাটার মতো?
বইখাতা সব সরিয়ে রাখলাম আমি, ছাদে গিয়ে জলের দিকে তাকালাম। সেই মুহূর্তে আমার চোখে প্রায় অসহ্য লাগল ওই দৃশ্য। মনে হল দুই দিক থেকে দুই প্রচণ্ড টানে বুকটা ভেঙে যাচ্ছে আমার একদিকে আমার স্ত্রী, আরেকদিকে আমার বাগদেবী সেই নারী, যেরকম কেউ আগে আমার জীবনে কখনও আসেনি; একদিকে ধীর শান্ত দৈনন্দিন পরিবর্তনের জগৎ, আরেকদিকে বিপ্লবের মাতাল করা উত্তেজনা–একদিকে গদ্য, আরেকদিকে পদ্য।
ফিরে ফিরে মনে হতে লাগল, এই দ্বিধার কথা কল্পনা করে কি মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছি। আমি? এইসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার অধিকার কি আমি কখনও অর্জন করেছি?
সেই মুহূর্তে সেই জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম আমি, যেখানে কবির কথায় আমরা নিজেদের বলি–
‘হয়তো বা বাকি থাকে কোনো
ঢালুতে দাঁড়ানো বৃক্ষ, দ্রষ্টব্য দিনের পরে দিন,
কিংবা কাল যেখানে হেঁটেছিলাম, সেই পথ,
আর কোনো জট বাঁধা অভ্যাসের অদম্য সাধুতা–
বিদায়ে যা পরাত্মখ, আমাদের ভক্ত সহবাসী।’