সন্ধে নামার সময় জিপিএস-এ ডিঙির অবস্থান মেপে পিয়া দেখল গর্জনতলা তখনও প্রায় বারো কিলোমিটার দূরে। বোঝাই যাচ্ছিল রাতের মধ্যে ওখানে গিয়ে আর পৌঁছনো যাবে না। কিন্তু পিয়ার মনে হল তাতে ভাবনার কিছু নেই। হরেন মনে হয় না খুব একটা দুশ্চিন্তা করবে। ও নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে যে ফিল্ডে কাজ করতে করতে অনেকটা দূরে চলে গেছে পিয়ারা, রাতের মধ্যে তাই ফেরা সম্ভব হচ্ছে না।
ফকিরও মনে হল একই কথা ভাবছে। কারণ, খানিক বাদেই দেখা গেল রাতের জন্যে নোঙর ফেলার মতো একটা জায়গা খুঁজছে ও। দিনের শেষ আলোটা মিলিয়ে যাওয়ার ঠিক আগে অবশেষে মোটামুটি উপযুক্ত একটা জায়গা পাওয়া গেল–সরু একটা সুতিখাল প্রায় সমকোণে এসে একটা বড় খালে পড়েছে, ঠিক তার বাঁকে। শেষবেলার ভরা জোয়ারে ছোট নালাটাকেও একটা প্রমাণ মাপের নদী বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু পিয়া জানে যে জল একবার নেমে গেলেই ছোট্ট শান্ত পুঁতিখাল তার নিজের চেহারায় ফিরে আসবে। চারদিকে ডাঙা যেটুকু দেখা যাচ্ছে সবই ঘন জঙ্গলে ঢাকা। সন্ধের আবছা আলোয় নিরেট একটা সবুজ দেয়ালের চেহারা নিয়েছে সে জঙ্গল।
নালাটা ঠিক যেখানে বড় খালে এসে পড়েছে জল সে জায়গাটায় একটু শান্ত। সেইখানটাতেই এসে নোঙর ফেলল ফকির। নোঙরটা নামানোর আগে হাত দিয়ে চারিদিকে একবার ইশারা করে জায়গার নামটা বলল পিয়াকে: গেরাফিতলা।
ডিঙিটা থেমে যাওয়ার পর পিয়া লক্ষ করল থালার মতো বড় একটা চাঁদ উঠেছে আকাশে। প্রায় নিটোল গোল, একটা ধার শুধু যেন আলতো করে কেউ চেঁছে নিয়েছে। হালকা তামাটে রঙের একটা আভা ছড়িয়ে আছে চাঁদের চারদিকে। পিয়ার মনে হল এই বাদাবনের স্থির, ভেজা ভেজা হাওয়ায় যেন আতসকাঁচের গুণ আছে। এত বড় আর এত স্পষ্ট চাঁদ এর আগে ও কখনও দেখেনি।
মুগ্ধ হয়ে দেখছিল পিয়া, এমন সময় ডিঙির ছইয়ের ভেতর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে ফকির এসে পাশে বসল। গাঢ় বেগুনি রং ধরেছে আকাশে, প্রতি মুহূর্তে তা গাঢ়তর হচ্ছে। একটা আঙুল তুলে সেই লালচে-বেগনি আকাশের গায়ে ধনুকের মতো একটা দাগ কাটল ফকির। কিন্তু সেদিকে তাকিয়ে কিছুই দেখা গেল না। মাথা নেড়ে পিয়া বোঝাল ওর চোখে বিশেষ কিছু পড়ছে না। তখন আর একবার ভাল করে তাকিয়ে দেখতে ইশারা করল ফকির। চাঁদের ওপর দিয়ে গোল করে ধনুকের মতো দাগ টানল আঙুলে। রুপোলি আলোয় ৩২৮
চোখ খানিকটা সয়ে আসতে হঠাৎ রঙিন আলোর আবছায়া একটা পট্টি নজরে এল পিয়ার। এক মুহূর্তের জন্যে যেন শূন্যে ভেসে রইল আলোটা, তারপরেই মিলিয়ে গেল আবার। ফকিরও আলোটা দেখতে পেয়েছে কি না বোঝার জন্যে ওর দিকে একবার তাকাল পিয়া, সেটা দেখে মাথা ঝাঁকাল ফকির। তারপর আঙুল দিয়ে আবার একটা ধনুকের মতো আঁক কাটল শুন্যে, এবার অনেক বড় মাপে–আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত। হঠাৎ পিয়ার মনে হল ও বোধহয় রামধনু জাতীয় কিছু একটা জিনিসের কথা বোঝানোর চেষ্টা করছে। সেটাই কি ওকে দেখাল ফকির এক্ষুনি–চাঁদের আলোয় রামধনু? সোৎসাহে মাথা ঝকাল ফকির, পিয়াও ঘাড় নাড়ল–ব্যাপারটা তো নিজের চোখে দেখেছে ও, মুহূর্তের জন্যে হলেও দেখেছে। জীবনে এরকম কিছুর কথা কখনও শোনেনি পিয়া, কিন্তু কীই বা এসে গেল তাতে?
চাঁদ আর বনের ছায়ার থেকে চোখ সরিয়ে স্রোতের আঁকিবুকির দিকে তাকাল পিয়া। মনে হল জলের গভীর থেকে একটা হাত এসে যেন নদীর বুকে চিঠি লিখে যাচ্ছে ওর জন্যে–ঢেউ আর ঘূর্ণির আঁকাবাঁকা অক্ষরে। একটা টুকরো কথা হঠাৎ ভেসে এল মনে, কানাই বলেছিল, ময়নার বিষয়ে না দেখা জলের স্রোত আর চোখে-পড়া হাওয়ার কারিকুরি নিয়ে কী যেন একটা কথা। আচ্ছা, ফকির কি বোঝে যে ও এমন একজন মানুষ, যার প্রেরণা থেকে এত কিছু যন্ত্রণা আর অসুবিধা সত্ত্বেও উঠে আসতে পারে এরকম অবিচল আনুগত্য? যে সম্পদ ফকিরের আছে তার এক ভগ্নাংশের সমান মূল্যেরও কি কিছু ওকে কোনওদিন দিতে পারবে পিয়া নিজে?
নিশ্চল বসে রইল ওরা পরস্পরের অস্তিত্বের তীব্রতায় অবশ হয়ে থাকা দুটো বন্য প্রাণীর মতো। যখন চোখাচোখি হল, পিয়ার মনে হল ও এতক্ষণ ধরে যা ভাবছিল এক নজর তাকিয়েই তা যেন বুঝতে পেরে গেছে ফকির। ওর একটা হাত নিয়ে ফকির নিজের দুহাতে ধরল একবার, তারপর মুখ ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে। পিয়ার দিকে আর না তাকিয়ে ডিঙির পেছনে চলে গিয়ে উনুন ধরাতে বসল।
রান্নাবান্না শেষ হওয়ার পর একটা থালায় করে খানিকটা খাবার পিয়ার জন্যে নিয়ে এল ফকির ভাত আর আলুর তরকারি। কিছুতেই ফেরাতে পারল না পিয়া। মনে হল খাবারের থালাটা যেন ওকে উৎসর্গ করছে ফকির, বিদায়ী প্রতাঁকের মতো। একসঙ্গে দেখা ওই জ্যোৎস্নার রামধনু যেন দু’জনের মধ্যেকার একটা আড়াল ভেঙে দিয়েছে, একটা কিছু যেন শেষ হয়ে গেছে, পড়ে রয়েছে শুধু তার বেদনার ছায়াটুকু। সে বেদনার রূপ বোঝা যায় না, কেননা কোনও নাম নেই তার। খানিক পরে, উনুন আর বাসনপত্র গুছিয়ে তুলে রাখা হয়ে গেলে ফকিরের একটা কথা মুড়ি দিয়ে ডিঙির সামনে নিজের জায়গাটায় এসে বসল পিয়া। ফকির গিয়ে ঢুকল ছইয়ের নীচে।
কানাইয়ের দেওয়া চিঠিটার কথা মনে পড়ল পিয়ার। সেটা বের করে নিল পিঠব্যাগ থেকে। মনটা একটু অন্যদিকে ঘোরাতে পারলে ভাল হয়, অন্য কিছু একটা চিন্তা করা দরকার এখন। চাঁদের আলোয় খামের ওপরের লেখাটা চোখ কুঁচকে পড়ার চেষ্টা করছে দেখে ফকির এসে একটা দেশলাই আর মোমবাতি দিয়ে গেল। সলতেটা জ্বালিয়ে দু’-এক ফোঁটা গলন্ত মোম ডিঙির আগার কাঠটার ওপর ফেলল পিয়া। তারপর বাতিটা চেপে বসিয়ে দিল তার ওপর। নিঝুম হয়ে আছে রাত্রি, বাতাস একেবারে স্থির, একটুও নড়ছে না মোমবাতির শিখা। আড়ালের কোনও দরকার নেই।
খাম ছিঁড়ে লেখাটা বের করে পড়তে শুরু করল পিয়া।
“ডিয়ার পিয়া,
“একজন পুরুষ যখন কোনও নারীকে কিছু দিতে চায়–যার দাম টাকায় মাপা যায় না, যে উপহারের মূল্য বুঝবে কেবল সেই নারী, সে ছাড়া আর কেউ নয়–তার মানেটা কী হতে পারে বলুন তো?
“আমাদের চিরকালের চেনা সেই একঘেয়ে পুরনো প্রশ্ন এ নয়। সত্যি বলছি, এক্কেবারে বোকা বনে গিয়েছি আমি–এই রকম আবেগ জীবনে কখনও অনুভব করিনি এর আগে। আমার মতো একজন লোক, যে সারা জীবন একেবারে খাঁটি বর্তমানটুকুকে নিয়ে কারবার করে এসেছে আর, স্বীকার করা ভাল, যে নিজের দিকে ছাড়া অন্য কোনওদিকে বিশেষ চেয়ে দেখেনি তার পক্ষে এ একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা, পুরোপুরি অচেনা একটা ক্ষেত্র। যে আবেগ থেকে অজানা এই অনুভূতির উৎসার, তা একেবারে ভিত পর্যন্ত নাড়িয়ে দিয়েছে আমাকে। তাই বলে এর আগে কি প্রেমে পড়িনি কখনও? জগৎ এবং জীবন সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতার গভীরতা আর বিস্তার নিয়ে সব সময় গর্ব করে এসেছি আমি: বুক ফুলিয়ে বলেছি, ছয়-ছয়টা ভাষায় প্রেম করেছি আমি। সেসব আজকে মনে হচ্ছে, যেন কত যুগ আগেকার কথা: গর্জনতলায় গিয়ে চোখ খুলে গেছে আমার। বুঝতে পেরেছি কত কম আমি চিনি এই জগৎটাকে। নিজেকেও।
“সুতরাং বলাই বাহুল্য, নিজে কষ্ট স্বীকার করেও অন্য আরেকটা মানুষকে খুশি করতে চাওয়ার যে কী অর্থ সে ধারণা আগে আমার কখনও ছিল না।
“কাল আমি উপলব্ধি করলাম যে আপনাকে এমন কিছু দেওয়ার ক্ষমতা আমার রয়েছে, যা আমি ছাড়া আর কেউ দিতে পারবে না। মনে আছে, আপনি কালকে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ফকির কী গান গাইছে, আর আমি বলেছিলাম ওই জিনিস অনুবাদ করা আমার কর্ম নয়: খুবই কঠিন কাজ ওটা? ভুল বলিনি কিন্তু। কারণ ও যেটা গাইছিল সে গানের প্রতিটা কথার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস, সে শুধু ফকিরের নিজের জীবনের ইতিহাস নয়, এই গোটা জায়গাটার ইতিহাস, এই ভাটির দেশের ইতিহাস। আপনাকে একদিন বলেছিলাম না, কিছু মানুষ থাকে যারা কবিতার দুনিয়াতে বাস করে? আমার মেসো ছিল সেইরকম একজন লোক। নিজে তো স্বপ্ন দেখতই, আর নিজের মতো মানুষদেরও ঠিক ঠিক চিনে নিতে পারত। যে নোটবইটা আমি পড়েছিলাম তাতে এক জায়গায় একটা ঘটনার কথা লিখেছে মেসো, যেখানে পাঁচ বছর বয়সের ফকির এই ভাটির দেশের একটা গাথা থেকে মুখস্থ বলে যাচ্ছে একটার পর একটা শ্লোক। বাদাবনের রক্ষয়িত্রী বনবিবির কাহিনি নিয়ে তৈরি সেই গাথা। সে কাহিনির ঠিক কোন অংশটা ফকির আবৃত্তি করছিল সেটাও লিখে গেছে মেসো যেখানে একটা মূল চরিত্র, দুখে বলে একটি গরিব ছেলেকে বাঘের দেবতা দক্ষিণ রায়ের মুখে ফেলে দিয়ে চলে গেছে ধনা নামের এক নৌকোর মালিক, সেই জায়গাটা।
‘ফকিরের ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল মেসো। কারণ, ও তো এখন যেরকম, তখনও তেমনই লিখতে পড়তে কিছু জানত না। সঙ্গে সঙ্গে মেসো এটাও বুঝতে পেরেছিল যে, যে শব্দগুলো গড়গড় করে বলে যাচ্ছে ওই বাচ্চা ছেলেটা, ওর কাছে সেগুলো শুধু একটা উপকথার অংশ মাত্র নয়, ওই কাহিনিই ওর চোখে জীবন্ত করে তুলেছে এই ভাটির দেশটাকে। সেই গানটাই কালকে ফকিরের গলায় শুনেছিলেন আপনিঃ ওর মজ্জার মধ্যে মিশে আছে ওই গান, আর, সম্ভবত এখনও ওর সত্তাটাকে তৈরি করে যাচ্ছে তিল তিল করে। আর এই উপহারই আপনাকে দিয়ে যাব আমি আজকে এই কাহিনি, যা আসলে একটা গান, এই কথাগুলো, যেগুলো ফকিরের সত্তার একটা অংশ। এই গল্প আপনাকে শোনাতে গিয়ে যদি ভুল কোথাও করি, তার জন্যে বিন্দুমাত্র আফশোস নেই আমার, কারণ আমার সেই ভুলগুলোই আপনাকে ভুলতে দেবে না আমার কথা, উঁচুদরের অনুবাদকদের মতো আড়ালে সরে যেতে দেবে না আমাকে। আর তা যদি হয়, তা হলে অন্তত এই একবারের মতো নিজেকে ভুলতে না-দেওয়া ভুল করতে পেরে ভাল লাগবে আমার।
“আবদুর রহিম প্রণীত ভাটির দেশের মহাকাব্য: বোন বিবির কেরামতি অর্থাৎ বোন বিবি জহুরানামা।
বোন-বিবি দুখেকে উদ্ধার করিবার বয়ান
দাড়ি মাঝিগণে ধোনা কহে ফজরেতে ॥ কেঁদোখালি যাব ডিঙা ছাড় সেতাবিতে * হুকুম পাইয়া দাড়ি মাঝি যত ছিল ॥ কেঁদোখালি তরফেতে রওয়ানা হইল * সাত ডিঙা বাহিয়া চলিল লোক জনে ॥ দেখিয়া দক্ষিণা দেও বলে মনে মনে * ধোনা মৌলে আসিতেছে সহদ লইতে ॥ বনে আমি যাই হাট মধু বসাইতে * কেঁদোখালি বিচে দেও আসিয়া পৌঁছিল ॥ যত মৌমাছি তরে হুকুম করিল * লক্ষ লক্ষ মৌমাছি হুকুমে দেওয়ের ॥ বসাইল হাট মধু ভিতরে বনের * থরেথরে খোনদাকে কোটরে ডালে পাতে ॥ বেশুমার মধু চাক লাগিল গড়িতে * খোসালিত হয়ে ধোনা তরণী লইয়া ॥ কয় রোজে কেঁদোখালি পৌঁছিল আসিয়া * মাঝিদিগে বলে কিস্তি বান্ধহ এইখানে ॥ চল মধু দেখিবারে যাই সবে বনে * ইহা বলে নৌকা বেন্ধে বাদা বনে যায় ॥ দেখিল মধুর চাক যেথায় সেথায় * ধোনা মৌলে দেখে ফিরে আইল খুসি হইয়া ॥ নায়ে এসে খেয়ে পিয়ে রহিল শুইয়া * দু প্রহর রাতে ধোনা স্বপন দেখিল ॥ আসিয়া দক্ষিণা দেও কহিতে লাগিল * চাক ভাঙ্গিবারে যবে যাইবে বনেতে । মেরা নাম লিবে ভাঙ্গিবার প্রথমেতে * তাহা বাদে দিবে হাত মধুর ভাণ্ডারে ॥ মৌমাছি উড়িয়া ভাগিয়া যাইবে দূরে * আর এক বাত আছে কহি তুঝে এবে ॥ একজনে সাথে লিয়া বনেতে যাইবে * নাহি দিব মোম মধু তোমাকে ভাঙ্গিতে ॥ তামাসা দেখিবে ঘুরেফিরে জঙ্গলেতে * আমার লস্কর দিয়া মধু ভাঙ্গাইব ॥ বেসেরবে তোমার ডিঙাতে পৌঁছাইব * কিন্তু সেই কথা মেরা ইয়াদ রাখিবে ॥ যাইবার সময় দুখেকে দিয়া যাবে * ওজর তাহার না করিবে খবরদার ॥ জান লিয়া টানাটানি হইবে তোমার * এ কথা বলিয়া দেও গায়েব হইল ॥ ফজরেতে ধোনা তবে জাগিয়া উঠিল * সবাকারে হুকুম করিল ফজরেতে ॥ দুখেকে বসায়ে চল সবে জঙ্গলেতে * যায় মধু ভাঙ্গিবার হুকুমে ধোনার ॥ দুখে বলে চাচাজি গো কি কহিব আর * কান্দিয়া কান্দিয়া ফের কহিতে লাগিল ৷ তোমার মোকছেদ চাচা হাছেল হইল * দেওয়ের সহিত তেরা হয়েছে কারার ॥ আমারে দিয়া যে ঘরে যাবে আপনার * এ কথা শুনিয়া ধোনা হাসিয়া উঠিল ৷ যত সব বাজে কথা তোরে কে শুনাল * এতেক বলিয়া ধোনা চলিল বেবাক ৷ যাইয়া মধুর চাক দেখিয়া অবাক * যত লোক গিয়াছিল ধোনায়ের সাথ ॥ লইয়া দেওয়ের নাম চাকে দিল হাত * মাক্ষি সব তাড়া পেয়ে ভাগিল উড়িয়া ॥ রাক্ষস দক্ষিণা দেও জানিতে পারিয়া * ভূত প্রেত দেওয়ান লইয়া সঙ্গেতে ॥ আসিয়া পৌঁছিল ধোনা ছিল যে বনেতে * দেও বলে দেখ ধোনা তামাসা আমার ॥ পৌঁছইয়া দিব মধু নায়েতে তোমার * এই কথা বলিয়া দেও দান সবাকায় ॥ মোম মধু ভাংগিতে হুকুম দিল ঠায় * দক্ষিণা দেওয়ের বাতে দান ছিল যত ॥ ভূত প্রেত ডাকিনী ধাইল শত শত * ভাংগিয়া তামাম মধু মহজার বিচেতে ॥ সাত ডিঙা বোঝাই করিল সহদেতে * ধোনাকে দক্ষিণা দেও কহে এ প্রকার ॥ দেখ আর জাগা নাই কিস্তিতে তোমার * ধাওয়াধাই ধোনা এসে নায়েতে পৌঁছিল ৷ বাকি নাহি আছে জাগা বোঝাই হইল * তখন আবার দেও কহে এ রূপেতে ৷ দেহ সাত ডিঙা মধু ফেলিয়া পানিতে * মোম দিব সাত ডিঙা বোঝাই করিয়া ॥ তাহাতে কিম্মত বেশি পাইবে বেচিয়া * মোম হৈতে খুব কম মধুর কিম্মত ॥ গাঙেতে ফেলিয়া দিল সহদ তারত * যে গাঙে ধোনাই মধু ফেলিল তামাম ॥ সেই হইতে সে গাঙের মধুখালি নাম * যে পানির মাঝে মধু ধোনাই ফেলিল ॥ চারিদিকে নোনা বিচখানে মিঠা হইল * আজ তক সেই গাঙে আছে মিঠা পানি। ৷ তাহা বাদে সাত ডিঙা মোম দেওমনি * ধোনার নায়েতে দিল বোঝাই করিয়া ॥ তা বাদে কহিল দেও শোন দেল দিয়া * তোমাকে দিলাম মোম বহুত কিম্মতি ॥ বেচিয়া পাইবে ধন করিবে রাজত্যি * যে কারণে দিনু মোম শোনো তার বেনা ৷ দুখেকে দিতে খবরদার ভুলিবে না * যদি হেলা ছাজি কর সাজা পাবে তার ॥ গাঙেতে তামাম নাও ডুবাব তোমার * বিদায় হইল এই ধোনাকে বলিয়া ॥ পাকাইতে ছিল দুখে নায়েতে বসিয়া * ভিজা কাট নাহি জ্বলে পাকাতে না পারে ॥ রন্ধন না হৈল তাই কান্দে জারে জারে * রশুই না হইলে গোশ্ব হইবে ধোনায় ॥ ভাবিয়া তাহার দিশা কিছু নাহি পায় * বন বিবির নাম শেষে ইয়াদ করিল ॥ ভুরকুণ্ডায় ছিল বিবি মালুম পাইল * পলক মারিতে দের না হইল আর ॥ দুখের নিকটে এসে কহে এ প্রকার * কেন ডাকিয়াছ কহে আসিয়া নিকটে ॥ দুখে কহে মা জননী পড়িনু সঙ্কটে * ধোনা চাচা বলে গেছে রশুই করিতে ॥ শুখা কাষ্ঠ অভাবে না পারি পাকাইতে *বন বিবি বলে বাছা না ভাবিও তুমি ॥ খোদার শুকুমে পাকাইয়া দিব আমি * বন বিবি তাহাকে যে ভরসা দিল । সকল হাড়ির পরে হাত ফেরাইল * কামালের ধনী বিবি বরকতের হাত ৷ বুজরগীতে পাকাইল ছালুন ও ভাত * বেগর আগুনে খানা হল তৈয়ার ॥ বিবি কহে সকলেতে খাও এইবার * আরজ করিয়া দুখে কহিল তখন ॥ শুন মা জননী আমার বিপদের বর্ণন * কাল বুঝি ধোনা চাচা যাবে ডিঙা লিয়া ॥ দক্ষিণা দেওয়ের তরে যাবে মোরে দিয়া * জগত জননী মাতা আসিয়া তরাবে ৷ বন বিবি বলে বাছা মনে না ভাবিবে * খাইতে তোমারে নাহি রায়ের ক্ষমতা ॥ আশা মেরে শা জঙলি উড়াইবে মাথা * বন বিবি ইহা বলে বিদায় হইল ৷ মহল থাকিয়া ধোনা আসিয়া পৌঁছিল * দুখেকে কহিল কোন ডিঙার উপর ॥ পাকাইয়া রাখিয়াছ কহ সে খবর * দুখে বলে চাচাজিগো এই ডিঙা পরে ॥ রান্ধিয়া রেখেছি আমি তোমাদের তরে * ধোনা যদি শোনে এয়ছা গিয়া সেই নায় ॥ সকলে একস্তরে বসে খানা খায় * সেরূপ অমৃত খানা কভু না খাইল ॥ সকলেতে কানাকানি করিতে লাগিল * সকলে মিলিয়া কহে ধোনার খাতের ॥ কভু এই খানা নহে দুখের হাতের * সকলেতে ঠারাঠারি কহিতে লাগিল ৷ দুখের উপরে সদয় বন বিবি হইল * ধোনা কহে হেগে বেটা পানি নাহি লয় ॥ দুখের উপর বন বিবি হইবে সদয় * এইরূপে বলা কওয়া করিতে লাগিল ৷ দিন গুজারিয়া রাত আসিয়া পৌঁছিল * যার যে ডিঙাতে গিয়া করিলা আরাম ॥ সারা রাত হৈল দুখের আরাম হারাম * ভাবিতে লাগিল এয়ছা কান্দিয়া কান্দিয়া ॥ ধোনা চাচা যাবে দেশে কাল ডিঙা লিয়া * দক্ষিণা দেওয়ের তরে আমারে দে যাবে ॥ বাঘ হয়ে আমাকে সে ধরিয়া খাইবে * মা বলিতে আমা বই কেহ আর নাই ৷ আমার ভাগ্যেতে আল্লা লিখি এয়ছাই ৷ এই কথা ভেবে দুখে দেলে আপনার ॥ আল্লাকে ইয়াদ করে কান্দে জারেজার * এক জারা চক্ষে তার নিন্দ না আইল ॥ কান্দিয়া কান্দিয়া সেই রাত পোহাইল * খানা পিনা খেয়ে সবে শুইয়া রহিল ৷ যেই রাত পোহাইয়া ফজর হইল * দাড়ি মাঝি সবাকারে কহিল ধোনাই ॥ খোলহ নায়ের কাছি আর দেরি নাই * ছয় ডিঙা খুলে দিল হুকুমে ধোনার ॥ নাহি খোলে এক ডিঙা ভেদ ছিল তার * কহে ধোনা দের করিতেছ কি কারণ ॥ মাঝি বলে কিসে হবে নায়েতে রন্ধন * নায়ের পরেতে কাঠ নাহি একখানা ॥ নায়ে এত লোক কিসে পাকাইবে খানা * মাঝির মুখেতে ধোনা শুনে এ বয়ান ॥ বলে বাবা দুখে থোড়া কাষ্ঠ কেটে আন * দুখে কহে মাফ কর চাচাজি আমায় ॥ দোছরাকে ভেজে দেহ না যাব চড়ায় * এত লোক আছে কর তাদের হুকুম ॥ আমার উপরে কর খামকা জুলুম * ধোনা মৌলে বলে বেটা নায়ে বসে খাবে । আদান ফরমাস করিলাম নাহি যাবে * ছঙিন জবাব দিলে মুখের উপরে ॥ চড়াতে না যাব আমি কাষ্ঠ আনিবারে * কাটিয়া জবান দেব কুকুরে আমার ॥ দুখে বলে চাচাজিগো হেকমত তোমার * চেতনে আথিনু দেও কহিল তোমায় ॥ কেঁদোখালি চরে তুমি দে যাবে আমায় * বাঘ হৈয়া দেও এসে পরে খাবে মোরে ॥ মাল লিয়া বড়লোক হবে গিয়া ঘরে * দুখের মায়েরে কবে দেশেতে যাইয়া ॥ ছেলেকে খাইল বাঘে দিবে শোনাইয়া । কি বলে আনিয়া মোরে ছিলে ঘর হইতে ৷ মা আমাকে সুপে দিয়া ছিল তেরা হাতে * তাহার সরত শুধু আদায় করিয়া ॥ কেঁদোখালির চরে মোরে বাঘে খাওয়াইয়া * শুনিয়া আমার মাতা কান্দিয়া কান্দিয়া ॥ আর কেহ নাহি শোকে যাইবে মরিয়া * ধোনা বলে পাজি বেটা ওস্তাদ ঠেটার ॥ একটা ফরমাস যদি শুনিলে আমার * ভালাই চাহ তো জলদি কাঠ আন গিয়া ॥ নাও হইতে কান ধরে দিব নামাইয়া * এই কাজের তরে মোরে নায়ে এনেছিলে ॥ দুখের জান গেল আর তুমি ধনী হইলে * আর কেন ফজিহত কর বার বার ॥ আমারে খাইলে বাঘে পরওয়া কি তোমার * দুখে বলে চাচাজিগো ছালাম চরণে ॥ বল কাঠ ভাঙিবারে যাব কোন বনে * এশারা করিয়া ধোনা বন দেখাইল ॥ দুঃখ মনে দুখে নাও হইতে নামিল ॥ গেল দুখে কেঁদোখালি চর পার হইয়া ॥ ধোনা ডিংগা খুলে গেল দুখেকে রাখিয়া * কহিতে লাগিল ধোনা মুখে আপনার ॥ দুখেকে দিলাম তোরে রাক্ষস এইবার * মেরা দোষ ঘাট মাফ কর দেওমণি ॥ রাখ মার যাহা ইচ্ছা আমি নাহি জানি ॥ কাঠ লিয়া আসে দুখে জংগল হইতে ॥ আসিয়া পৌঁছিল কেঁদোখালির চরেতে * দেখিল যে ধোনা মৌলে গেছে নাও লিয়া ॥ চরেতে বসিয়া কান্দে কাতর হইয়া * খাড়ি হতে দৈত্য তবে দেখিতে পাইল ॥ দুখেকে দিয়াছে ধোনা মালুম করিল * খাইতে রাক্ষস তবে এরাদা করিয়া ॥ আপনাকে বাঘের ছুরত বানাইয়া * মানুষের গোস্ত খাব বহুদিন বাদে ॥ দুখেকে খাইতে যায় মনের আনন্দে * চরে থেকে দুখে হেথা পাইল দেখিতে ॥ বাঘ হইয়া আসে দেও আমাকে খাইতে * প্রকাণ্ড শরীর আর দুম ঊর্ধ্বে তুলে ॥ হাওয়া ভরে আসে সেই বাঘ গাল মেলে * দেখিয়া দুখের গেল পরাণ উড়িয়া ৷ বলে বন বিবি মাগো লেহ উদ্ধারিয়া * এত বলে তরাসে গিরিয়া গেল ভূমে ॥ তামাম অজুদ তরতর হইল ঘামে * বলে মাগো বন বিবি কোথা আছে ছেড়ে ॥ এ সময় আইস মাগো দুখে মারা পড়ে * তরাবে বাঘের হাতে দিয়াছ কারার ॥ না তরাবে কলঙ্ক মা হইবে তোমার * এতেক বলিয়া তবে জ্ঞান হারাইল ॥ ভুরকুণ্ডে থাকিয়া বিবি জানিতে পারিল * সাজংলিকে কহে ভাই জলদি আইস সাথে ॥ বুঝি মারা গেল বাছা রাক্ষসের হাতে * চল জলদি গিয়া করি উহারে উদ্ধার ॥ আস্পর্ধা হয়েছে বড় রাক্ষস বেটার * খেয়ে যদি ফেলে তবে হবে মহা দায় ॥ পলকেতে ভাই বহিন পৌঁছিল সেথায় * দেখে দুখে পড়ে আছে হুস হারাইয়া ॥ দুখেকে লইল বিবি কোলে উঠাইয়া * ধুলা মুছ্যা কোলে নিল জগতের মাতা ॥ বাছা বাছা বলে ডাকে নাহি কহে কথা * বেহুস বেলাল ছিল না পায় শুনিতে ॥ জংগলিকে বলে ভাই দেখ কি চক্ষেতে * সা জংগলি কথা শুনে আসিয়া ত্বরায় ॥ এছম আজম পড়ে ফুক দিল গায় * পানি মুখে দিতে তবে হুস যে হৈল ॥ দেও দুরে বাঘ রূপে খাড়া হয়ে ছিল * সা জংগলিকে দেবি কহে গোশ্ব ভরে ॥ কিছু শিক্ষা দাও এই রাক্ষস বেটারে * ছের উড়াইয়া দেহ থাপ্পড় মারিয়া ॥ শুনিয়া সা জংগলি দৌড়ে আশা হাতে লিয়া * সা জংগলি হুকুম পেয়ে জানের গোশ্বায় ॥ খুব জোরে চড়া মারে বাঘের মাথায় * নামাকুল চড় খেয়ে ফাফড় হইল ৷৷ জান লিয়া দক্ষিণা দেও দক্ষিণে চলিল ॥”
চিঠি পড়া শেষ হতে ডিঙির মাঝখানটায় গিয়ে বসল পিয়া। খানিক বাদে ফকিরও এসে বসল পাশে। পিয়ার অবশ্য কেমন যেন মনেই হচ্ছিল যে ও আসবে। ডিঙির ধারের কাঠের ওপর ভর দিয়ে বসেছিল ফকির। ওর কবজির ওপর একটা হাত রেখে পিয়া বলল, “সিং। বনবিবি–দুখে–দক্ষিণ রায়। সিং।” খানিক দ্বিধার পর শেষে রাজি হল ফকির। মাথাটা একটু পেছনে হেলিয়ে সুর করে গাইতে শুরু করল আস্তে আস্তে। হঠাৎ পিয়ার চারিদিকে যেন নদীর মতো বয়ে যেতে লাগল সে গানের সুর আর কথা। তার কোনও অংশ এতটুকু দুর্বোধ্য নয়; প্রতিটা শব্দ পরিষ্কার বুঝতে পারছিল পিয়া। যদিও যে গলাটা কানে শুনতে পাচ্ছে সেটা ফকিরের গলা, আর গানের মানেটা যে বুঝতে পারছে সেটা কানাইয়ের কল্যাণে, এবং অন্তরের গভীরে পিয়া জানে যে ওর মনের ভেতরে এই দু’জনকে নিয়ে টানা-পোড়েন কখনও শেষ হবে না।
কানাইয়ের চিঠির শেষ পাতাটা ওলটাল পিয়া। পেছনে ছোট্ট কয়েক লাইন লেখা। “এই লেখার মূল্য কী তা যদি সত্যিই কখনও জানতে চান, রিলকের এই কথাগুলো মনে করবেন:
‘শোনো: আমরা যে প্রেম করি, ফুলেদের মতো নয়, নয় এক বৎসরের
জন্য শুধু প্রেমরত আমাদের বাহুতে উচ্ছিত হয় প্রাণরস
অনন্ত স্মরণাতীত কাল থেকে। হায়, কন্যা,
এ-ই তবে! অভ্যন্তরে আমরা বেসেছি ভাল–কোনো অনাগতা
অনন্যাকে নয়,
কিন্তু সব কিজাত অগণ্য উচ্ছ্বাস: শুধু নয় একটি শিশুকে,
কিন্তু পিতৃপুরুষেও, যাঁরা ভগ্ন পর্বতের মতো আমাদেরই
গভীরে আছেন পড়ে; আর লুপ্ত মাতাদের শুষ্ক নদীগর্ভ–
তাও; আর সেই শব্দহীন ভূদৃশ্যের সমগ্র বিস্তার, যার
নিয়তি কখনও মেঘে আচ্ছন্ন, আর কখনও নির্মল;–
কন্যা, এরা তোমার অগ্রিম।’