হতাহত

স্রোত তখন ঘুরতে শুরু করেছে, এমন সময় অবশেষে জলের ওপর উঠে থাকা একটা তেকোনা পাখনা চোখে পড়ল পিয়ার। ডিঙি থেকে প্রায় কিলোমিটারখানেক সামনে, পাড়ের কাছ ঘেঁষে। যন্ত্রে ডলফিনটার অবস্থান মেপে দেখা গেল গর্জনতলা থেকে দক্ষিণ-পুবে প্রায় বিশ কিলোমিটার দূরে রয়েছে ওটা। দূরবিনটা ফের চোখে লাগিয়ে পিয়া আবিষ্কার করল ডলফিনটা একা নয়। আরও বেশ কয়েকটাকে আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যাচ্ছে। নির্দিষ্ট একটা জায়গার মধ্যেই পাক খেয়ে যাচ্ছে প্রাণীগুলো–গর্জনতলার দহটাতে যেমন করে, সেরকম।

এখনও মোটামুটি মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে জলের স্তর। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে পিয়া দেখল বিকেল তিনটে। বুকের ভেতর একটা ধুকপুকুনি টের পাচ্ছিল ও। প্রথম যেদিন ফকির ওকে গর্জনতলায় ডলফিনের দলটাকে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল সেদিনও ঠিক এরকমই অনুভূতি হয়েছিল পিয়ার। এই জায়গাটাতেও যদি ভাটার সময় শুশুকগুলো এসে জড়ো হয়, তার মানে এখানেও ওরকম আরেকটা দহ আছে। তা হলে এটা নিশ্চয়ই নতুন আরেকটা দল। এর থেকে ভাল খবর আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু ফকিরের দিক থেকে তো উৎসাহের কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কেমন একটা খটকা লাগল পিয়ার ওর মুখের দিকে তাকিয়ে। কীরকম যেন একটা সতর্ক দৃষ্টি ওর চোখে, যেন কোথাও কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। পিয়ার একটু অস্বস্তি লাগল।

ডলফিনগুলো যখন নৌকো থেকে আর কয়েকশো মিটার মাত্র দূরে, এমন সময় কাদার ওপরে স্থির হয়ে পড়ে থাকা ইস্পাত-ধূসর একটা আকৃতি চোখে পড়ল। মুহূর্তে চোখ বন্ধ করে ফেলল পিয়া। জিনিসটা কী সেটা ও জানে। মনে মনে তবুও আশা করছিল যে হয়তো ভুল হলেও হতে পারে। চোখ যখন খুলল, ওটা তখনও পড়ে আছে একই জায়গায়। এবং ও যে ভয় করেছিল বস্তুটা তাই একটা ইরাবড়ি ডলফিন। মরা।

কাছ থেকে ভাল করে দেখতে গিয়ে আরও একটা ধাক্কা লাগল পিয়ার। প্রাণীটার শরীর অন্যদের তুলনায় মাপে একটু ছোট। দেখা মাত্র পিয়ার মনে হল এটা নিশ্চয়ই ওর চেনা সেই বাচ্চা ডলফিনটা, গত কয়েকদিন ধরে যেটাকে জুড়ি বেঁধে ঘুরতে দেখেছিল মায়ের সঙ্গে। ছোট্ট শরীরটা মনে হল কয়েক ঘণ্টা আগেই এসে ঠেকেছে ডাঙায়, জল নেমে যাওয়ায় পড়ে রয়ে গেছে কাদার ওপর। প্রাণহীন দেহটাকে এখন প্রায় ছুঁইছুঁই করছে জোয়ারের জল, মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছে সেটা স্রোতের ধাক্কায়।

পিয়ার ষষ্ঠেন্দ্রিয় যেন ওকে বলে দিল ভাটার সময় ডলফিনদের যে দলটা গর্জনতলায় এসে জড়ো হয় এটা সেই একই দল। মরা শুশুকটা দেখে ওদের স্বাভাবিক চলনের পরিবর্তনের কারণটাও খানিকটা আন্দাজ করল ও চোখের সামনে মৃত সঙ্গীকে এভাবে ফেলে রেখে গর্জনতলার দহে ওরা ফিরে যেতে চাইছে না। পিয়ার মনে হল জোয়ারের জলে ডলফিনটা আবার ভেসে উঠবে, দলটা যেন সেই অপেক্ষাতেই আছে।

ফকিরও বোঝা গেল দেখতে পেয়েছে মরা ডলফিনটাকে। পিয়া লক্ষ করল নৌকোর মুখ আস্তে আস্তে ঘুরে যাচ্ছে পাড়ের দিকে। ডাঙার কাছাকাছি আসতেই ভক করে একটা দুর্গন্ধের ঝলক পিয়ার গলার ভেতর এসে লাগল। দুপুরের চড়চড়ে রোদ এসে পড়েছে মরা প্রাণীটার গায়ে; ফলে এত জোরালো গন্ধ বেরোচ্ছে যে পাড়ে নামার আগে দু’ ফেরতা কাপড় মুখের চারিদিকে জড়িয়ে নিতে হল পিয়াকে।

কাছে গিয়ে পিয়া দেখল ডলফিনটার নাকের ঠিক পেছন থেকে বিশাল একটা ক্ষত। একটুকরো মাংস আর চর্বি কে যেন খুবলে বের করে নিয়েছে। ক্ষতটার আকার দেখে মনে হল প্রাণীটা কোনও দ্রুতগতির মোটরবোটের প্রপেলারে ধাক্কা খেয়েছিল। ব্যাপারটা লক্ষ করে একটু অবাকই হল পিয়া: এ অঞ্চলে সেরকম কোনও মোটরবোট চলাচল করতে তো ও এ যাবৎ দেখেনি। ফকিরই অবশেষে সমস্যাটার সমাধান করল। হাত দিয়ে কাদার ওপর একটা টুপির ছবি আঁকল ও। পিয়া বুঝতে পারল উর্দিপরা সরকারি লোকেরা যে ধরনের বোট ব্যবহার করে সেইরকম কোনও বোটের কথা বোঝাতে চাইছে ফকির–কোস্টগার্ডের বা আর্মির বোট। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টেরও হতে পারে। সকালের দিকে হয়তো এরকম কোনও মোটরবোট এদিক দিয়ে গেছে, আর অনভিজ্ঞ ছানাটা নিশ্চয়ই ঠিক সময় মতো পথ থেকে সরে যেতে পারেনি।

পিঠব্যাগ থেকে একটা ফিতে বের করে নরিস প্রোটোকল অনুযায়ী ভাল করে ডলফিনটার মাপ নিল পিয়া। তারপর ছোট একটা ছুরি নিয়ে চামড়া, চর্বি আর কয়েকটা প্রত্যঙ্গের কিছু স্যাম্পল কেটে নিল। রাংতায় মুড়ে নিয়ে জিপলক ব্যাগের মধ্যে যত্ন করে রাখল সেগুলোকে। এর মধ্যেই দলে দলে কাঁকড়া আর নানা পোকামাকড় ঘেঁকে ধরেছে ছোট্ট শরীরটাকে, ক্ষতস্থানটা থেকে কুরে কুরে খেতে শুরু করেছে মাংস আর চর্বি।

পিয়ার মনে পড়ল প্রথমবার মায়ের পাশে পাশে সাঁতার কাটা ছানাটাকে দেখে ও কেমন খুশি হয়ে উঠেছিল। সেই প্রাণীটার মরা শরীরের পাশে বেশিক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না ও। ফকিরকে ইশারা করল ওটার লেজের দিকটা তুলে ধরতে, নিজে মুঠো করে ধরল পাখনাদুটো। তারপর দুজনে মিলে নিষ্প্রাণ শরীরটাকে শূন্যে কয়েকবার দুলিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিল নদীর মধ্যে। পিয়া ভেবেছিল জলের ওপরে ওটা ভেসে উঠবে আবার, কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে দেহটা দ্রুত তলিয়ে গেল নদীর গভীরে।

বেশিক্ষণ আর জায়গাটাতে থাকতে চাইছিল না পিয়া। ডিঙির কাছে গিয়ে যন্ত্রপাতিগুলো ছুঁড়ে দিল ভেতরে, তারপর ফকিরের সঙ্গে হাত লাগিয়ে নৌকোটাকে ঠেলে দিল জলের ভেতর।

স্রোতের টানে আস্তে আস্তে ভেসে যাচ্ছিল ডিঙি। হঠাৎ ফকির তার ওপর দাঁড়িয়ে উঠল। তারপর উজান আর ভাটির দিকে, পুবে আর পশ্চিমে হাত দিয়ে ইশারা করে দেখাতে লাগল। আস্তে আস্তে সেই ইশারার অর্থ স্পষ্ট হল পিয়ার কাছে। মনে হল ফকির বলতে চাইছে যে এখানে ওরা যা দেখেছে এই অঞ্চলে সেরকম দৃশ্য প্রায়শই দেখা যায়। ফকির নিজেই তিনটে ডলফিনের মৃতদেহ দেখেছে বিভিন্ন জায়গায় জায়গাগুলোর একটা এখান থেকে খুবই কাছে, ভাটির দিকে। সেখানেও একটা মরা ডলফিন এরকম স্রোতের টানে পাড়ে গিয়ে ঠেকেছিল। সেটা মনে ছিল বলেই ফকির ওকে এইদিকে নিয়ে এসেছে।

ওরা যখন মাঝনদীতে গিয়ে পৌঁছল ততক্ষণে শুশুকগুলো আস্তে আস্তে সরে যেতে শুরু করেছে জায়গাটা থেকে। শুধু একটা ছাড়া। দহটা ছেড়ে সেটা যেন নড়তেই চাইছে না। পিয়া আন্দাজ করল ডুবে যাওয়া মৃতদেহটা স্রোতের টানে গড়িয়ে যাচ্ছে নদীর তলায়, আর সেটারই চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে ডলফিনটা। এটাই কি ওই ছানাটার মা? কোনও উপায় নেই সে প্রশ্নের জবাব পাওয়ার।

হঠাৎই কীসের যেন সংকেত পেয়ে এক সঙ্গে সমস্ত ডলফিনগুলো উধাও হয়ে গেল। ওদের পেছন পেছন যাওয়ার ইচ্ছে ছিল পিয়ার, কিন্তু সেটা এখন আর সম্ভব নয়। বিকেল চারটে বেজে গেছে। আর হুড়মুড় করে নদীতে ঢুকে আসছে জোয়ারের জল। সকালে যে জলের স্রোত ওদের সহায় হয়েছিল, এখন তা প্রতিকূলে। দুজনে মিলে দাঁড় বাইলেও খুব একটা বেশি এগোনো যাবে না।

প্রায় তিনঘণ্টা ধরে নিষ্ফল ঘোরাঘুরির পর অবশেষে হরেন বলল, “যথেষ্ট খোঁজা হয়েছে, এবার ফিরতে হবে আমাদের।” ওর রুক্ষ গলায় যেন একটা জয়ের সুর।

খাঁড়ি আর সুতিখালগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ব্যথা হয়ে গেছে কানাইয়ের। সূর্য পশ্চিমের দিকে ঢলে পড়েছে, বিকেলের রোদটা সোজা চোখে এসে লাগছে। ফলে ভাল করে দেখাটা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু মনের ভেতর থেকে অস্বস্তিটা কিছুতেই যাচ্ছে না। ওদের পক্ষে আর কিছুই করার নেই সেটা ঠিক যেন বিশ্বাসই করে উঠতে পারছিল না কানাই। “এক্ষুনি ফিরে যেতে হবে?” ও জিজ্ঞেস করল হরেনকে।

মাথা নাড়ল হরেন। “অনেকটা তেল খরচ করে ফেলেছি আমরা। আরও বাড়তি ঘোরাঘুরি করলে কালকে লুসিবাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতেই পারব না। তা ছাড়া ওরা মনে হয় এতক্ষণে পৌঁছে গেছে গর্জনতলায়।”

“আর যদি না পৌঁছে থাকে?” তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করল কানাই। “ওদের ফেলে রেখে চলে যাব নাকি আমরা?”

চোখদুটো সরু করে ভুরু কুঁচকে কানাইয়ের দিকে তাকাল হরেন। বলল, “দেখুন, ফকির আমার ছেলের মতো। আর কিছু করা যদি আমার পক্ষে সম্ভব হত, সেটা আমি ঠিকই করতাম।”

হরেনের বকুনিটা যুক্তিযুক্ত, মেনে নিল কানাই। মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা তো ঠিকই।” ফকির আর পিয়াকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে হরেনের আগ্রহকে সন্দেহ করেছিল বলে মনে মনে একটু লজ্জাও লাগল ওর। বোটের মুখ ঘোরার পরে খানিকটা আপোশের সুরে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা হরেনদা, আপনার তো এসব ব্যাপারে অনেক অভিজ্ঞতা। সাইক্লোন যদি আসে তা হলে এসব জায়গায় কী অবস্থা হতে পারে একটু বলুন না আমাকে।”

গম্ভীরভাবে চারদিকে একবার চেয়ে দেখল হরেন। “একেবারে পালটে যাবে এ জায়গার চেহারা। কোনও মিলই পাবেন না। রাত আর দিনের যেমন তফাত, সেইরকম তফাত হয়ে যাবে।”

“আপনি তো একবার সাইক্লোনের মুখে পড়েছিলেন, তাই না।”

“হ্যাঁ, ধীর, সংক্ষিপ্ত জবাব হরেনের। “যে বছর আপনি এসেছিলেন, সেই বছরে, ১৯৭০।”

বর্ষা কেটে যাওয়ার বেশ কিছুদিন পরে ঘটেছিল ঘটনাটা। বলাইকাকার নৌকোয় সাগরে গিয়েছিল হরেন। সবসুদ্ধ মোটে তিনজন ছিল নৌকোটাতে: হরেন, বলাইকাকা, আর একজন কে যেন–তাকে আগে দেখেনি হরেন। সাগরের ভেতরে খুব বেশিদূরে ওরা যায়নি, রায়মঙ্গল নদীর মুখটা থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার এগিয়েছিল। সেখান থেকে ডাঙা পরিষ্কার চোখে পড়ছিল। সে সময়ে তো আর এরকম আগাম সতর্কবার্তা-টার্তা ছিল না, তাই ঝড় এসে একেবারে ঘাড়ের ওপর পড়ার আগে কিছুই আন্দাজ করতে পারেনি ওরা। চারদিকে ঝকঝকে রোদ্দুর, একটু জোরালো বাতাস দিচ্ছিল শুধু। আধঘণ্টার মধ্যে হঠাৎ দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে হুড়মুড় করে এসে পড়ল ঝড়টা। দেখতে-না-দেখতে চারপাশ একেবারে অন্ধকার হয়ে এল। দিশা ঠিক করাই দায়। সঙ্গে কম্পাস-টম্পাস কিছু নেই; কোন পথে যেতে হবে বোঝার জন্য চোখই একমাত্র ভরসা। এমনিতে ডাঙার থেকে খুব বেশি দূরে সাধারণত ওরা যেত না। তবে যন্ত্রপাতি কিছু সঙ্গে থাকলেও লাভ বিশেষ কিছু হত না। সে ঝড়ে ইচ্ছেমতো দিক ঠিক করে নৌকো চালানোর সুযোগই ছিল না কোনও। বাতাসের বেগ এত প্রচণ্ড যে কোনও বাধাই তার সামনে বাধা নয়। ওরা হাওয়ার মুখে কুটোর মতো ভেসে চলল, উত্তর-পুবে। শক্ত করে ডিঙির কাঠ আঁকড়ে ঝুলে থাকা ছাড়া ঘণ্টা কয়েক কিছুই করার কোনও ক্ষমতা ছিল না ওদের। তারপর হঠাৎই দেখা গেল নৌকোটা তিরবেগে এগিয়ে চলেছে জলে ভেসে যাওয়া একটা গ্রামের দিকে। কয়েকটা গাছের মাথা আর কিছু ঘরবাড়ির চাল চোখে পড়ল–বেশিরভাগই ছোট ছোট কুঁড়েঘর। ঝড়ের এমনই দাপট যে জলের ধারের গ্রামগুলো সব একেবারে ডুবে গিয়েছিল। জল এতটা উঠেছিল যে একটা গাছের গায়ে সটান গিয়ে ধাক্কা খাওয়ার আগে ওরা বুঝতেই পারেনি যে ডিঙিটা ডাঙাজমির ওপর গিয়ে পৌঁছেছে অবশেষে। ধাক্কাটা খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল ডিঙি, কিন্তু হরেন আর ওর কাকা গাছটাকে আঁকড়ে ধরে প্রাণে বেঁচে গেল কোনওরকমে। দলের তিন নম্বর লোকটাও একটা ডাল হাতে ধরতে পেরেছিল, কিন্তু ওর ওজনে মট করে ভেঙে গেল সেটা। আর কখনও দেখা যায়নি লোকটাকে।

হরেনের তখন বছর কুড়ি মাত্র বয়েস, শরীরে মোষের মতো জোর। ফুঁসতে থাকা জলের ভেতর থেকে কাকাকে টেনে তুলে নিয়ে গাছের উঁচু একটা ডালে গিয়ে উঠল। দুজনে মিলে তারপর গামছা আর লুঙ্গি খুলে নিয়ে নিজেদের কষে বেঁধে নিল গাছটার সঙ্গে। শোঁ শোঁ করে বয়ে যাচ্ছে ঝড়, আর হরেন ওর কাকার দু হাত শক্ত করে ধরে বসে আছে গাছের ওপর। মাঝে মাঝে এত জোরে হাওয়া দিচ্ছিল যে অতবড় গাছটা একটা বঁটার মতো দুলছিল এদিক ওদিক। কোনওরকমে সেটাকে আঁকড়ে ধরে বসে রইল হরেন আর বলাই।

ঝড়ের দাপট একটু কমলে দেখা গেল জলের তোড়ে এটা-ওটা নানা জিনিস এসে গাছের ডালপালার মধ্যে আটকে রয়েছে। আশেপাশের ঘরবাড়ি থেকে ভেসে আসা কিছু বাসন-কোসনও রয়েছে তার মধ্যে। সেখান থেকে একটা আস্ত মাটির হাঁড়ি খুঁজে বের করে নিয়ে তাতে খানিকটা বৃষ্টির জল ধরে রাখল হরেন। ভাগ্যিস বুদ্ধিটা মাথায় এসেছিল, তা না হলে পরের দিন তেষ্টার চোটেই গাছ থেকে নেমে পড়তে হত ওদের।

রাত কেটে অবশেষে সকাল হল। আকাশে আর মেঘের এতটুকু চিহ্ন নেই, চারিদিকে ঝকঝক করছে রোদ্দুর। পায়ের নীচে কিন্তু তোড়ে বয়ে চলেছে জলের স্রোত: ওদের গাছটার অর্ধেকের বেশি তখনও ডুবে আছে বানের জলে। আশেপাশে তাকিয়ে হরেন আর বলাই দেখল ওরা একা নয়, আরও বহু লোক ওদের মতো এভাবে গাছে উঠে প্রাণ বাঁচিয়েছে নিজেদের। ছেলেবুড়ো সুদ্ধ একেকটা গোটা পরিবার উঠে বসে আছে গাছের ডালে। এ গাছ থেকে ও গাছে চেঁচিয়ে কুশল জিজ্ঞাসার পর ওরা জানতে পারল ঝড়টা যখন উঠেছিল তখন ওরা যেখানে ছিল তার থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার মতো পুবে চলে এসেছে। বর্ডার-টর্ডার পেরিয়ে পৌঁছে গেছে গলাচিপার কাছে, একেবারে আগুনমুখা নদীর মুখে।

“সে জায়গাটা এখন বাংলাদেশে পড়ছে,” বলল হরেন। “বোধহয় খুলনা জেলা।”

দু’দুটো দিন সেই গাছের ওপর কাটিয়ে দিল ওরা। খাওয়া নেই, দাওয়া নেই, হাঁড়িতে ধরে রাখা সেই বৃষ্টির জলটুকু শুধু সম্বল। জল নামতে অবশেষে গাছ থেকে নেমে কাছাকাছি কোনও শহরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করল হরেন আর বলাই। তবে বেশিদূর যেতে পারল না, খানিকটা এগোতেই মনে হল ওরা যেন একটা যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে এসে পড়েছে। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে আছে মানুষের লাশ; মরা মাছ আর গোরু-ছাগলে একেবারে ঢেকে গেছে চারিদিক। পরে জানা গেল প্রায় লাখ তিনেক লোকের প্রাণ গিয়েছিল সেই ঝড়ে।

“এ তো একেবারে হিরোশিমার মতো,” প্রায় ফিসফিস করে বলল কানাই।

ভাগ্যক্রমে একদল জেলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল হরেন আর বলাইয়ের। তাদের ডিঙিটা মোটামুটি আস্তই ছিল। সেই ডিঙিতে করে এই খাল সেই খাল হয়ে কোনওরকমে বর্ডার পেরিয়ে অবশেষে ইন্ডিয়াতে এসে পৌঁছল ওরা।

এই হল হরেনের সাইক্লোন দেখার অভিজ্ঞতা। একটা জীবনে সে অভিজ্ঞতা ভোলা যায় না। আর কখনও এরকম ঝড়ের মুখে পড়তে চায় না হরেন।

গল্পটা যখন শেষ হল ততক্ষণে প্রায় গর্জনতলার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ওরা।

লালচে আলোর একটা গালিচা যেন পাতা রয়েছে জলে ভেজা দ্বীপটার সামনে। দহটাকে ঢেকে দিয়ে সে গালিচা চলে গেছে দুর মোহনার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত। সূর্য অস্ত যাচ্ছে সেখানে এখন। তেরছা হয়ে আলো যেভাবে এসে পড়েছে তাতে একটা কোনও নৌকো নদীতে থাকলেও জলের ওপর লম্বা ছায়া পড়বে তার, ছোট্ট একটা ডিঙি হলেও পরিষ্কার তা চোখে পড়বে। কিন্তু আশেপাশে একটা নৌকোরও কোনও চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। পিয়া আর ফকির এখনও ফেরেনি।