মাসখানেক কেটে গেছে ঝড়ের পর। একদিন দুপুরে নিজের ডেস্কে বসে কাজ করছে নীলিমা, এমন সময় হাসপাতাল থেকে একজন নার্স ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিল বাসন্তীর লঞ্চ থেকে ‘পিয়াদিদিকে’ নামতে দেখেছে ও, এই ট্রাস্টের অফিসের দিকেই এখন আসছে ‘পিয়াদিদি’।
বিস্ময় গোপন করতে পারল না নীলিমা। জিজ্ঞেস করল, “পিয়া? মানে সায়েন্টিস্ট পিয়া? তুই ঠিক দেখেছিস?”
“হ্যাঁ গো মাসিমা, পিয়াদিদিই। ভুল দেখিনি আমি।”
চেয়ারে গা এলিয়ে দিল নীলিমা, মনে মনে খবরটা হজম করার চেষ্টা করতে লাগল। প্রায় হপ্তাদুয়েক হয়ে গেল এখান থেকে চলে গেছে পিয়া। সত্যি বলতে কী ওকে বিদায় জানানোর সময় নীলিমা ভাবেইনি আবার কখনও দেখা হবে ওর সঙ্গে। ঝড়ের পর কয়েকদিন লুসিবাড়িতেই থেকে গিয়েছিল মেয়েটা। গেস্ট হাউসে ওর উপস্থিতিটা কেমন যেন অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছিল তখন যেন একটা ছায়া পড়েছিল ওর ওপর, ভূতের মতো থাকত সারাদিন নিজের মনে, মুখখানা সব সময় গোমড়া, কথাবার্তাও বিশেষ বলত না কারও সঙ্গে। একা নীলিমার পক্ষে ওকে সামলানো তখন হয়তো কঠিন হত, কিন্তু ভাগ্যক্রমে সেই সময়টায় ময়নার সঙ্গে অদ্ভুত একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল পিয়ার। বেশ কয়েকবার ওদের একসঙ্গে দেখেছে নীলিমা, গেস্ট হাউসের ভেতরে কিংবা আশেপাশে, চুপ করে পাশাপাশি বসে আছে দু’জন। এমনকী মাঝে মাঝে পিয়াকে ময়না বা ময়নাকে পিয়া ভেবে ভুলও করেছে নীলিমা। নিজের জামাকাপড় সব নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই তখন শাড়ি পরতে হচ্ছিল পিয়াকে উজ্জ্বল লাল, হলুদ, সবুজ রং-এর সব শাড়ি। ময়না যে কাপড়গুলো আর কোনওদিন পরবে না, সেগুলো দিয়ে দিয়েছিল পিয়াকে। বৈধব্যের রীতি মেনে নিজের চুলগুলো কেটে ফেলেছিল ময়না, পিয়ার চুলের মতো ছোট ছোট করে। তাতে আরও এক রকম লাগত দু’জনকে। মিল বলতে অবশ্য শুধু এইটুকুই। স্বভাবে আর মনের ভাব প্রকাশের ভঙ্গিতে কিন্তু দু’জনে একেবারেই দু’রকম। ময়নার শোক চোখে দেখে বোঝা যেত, সব সময় লাল হয়ে ফুলে থাকত ওর চোখদুটো; পিয়ার মুখ কিন্তু পাথরের মতো, ভাবলেশহীন, দেখে মনে হত যেন নিজের ভেতরে গুটিয়ে গেছে মেয়েটা।
“পিয়া আসলে একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে,” দিল্লি ফিরে যাওয়ার আগে নীলিমাকে একদিন বলেছিল কানাই। “সেটা অবশ্য স্বাভাবিক। কল্পনা করতে পারো, ঝড়ের শেষটায় ওই গাছের ওপর বসে থাকার সময় কী মনের অবস্থাটা হয়েছিল ওর? ফকিরের মরা শরীরটা যখন ঝড় থেকে আড়াল করে রেখেছে ওকে? সেই ভয়ংকর স্মৃতির কথা যদি বাদও দাও, তাহলেও ওর অপরাধবোধ আর দায়ভারের কথাটা একবার ভাব।”
“সেসব আমি বুঝতে পেরেছি রে কানাই,” নীলিমা জবাব দিয়েছিল। “সেইজন্যেই আরও আমার মনে হয় এখান থেকে ফিরে গিয়ে নিজের চেনা কোনও জায়গায় থাকলেই আঘাতটা কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে ওর পক্ষে। তুই কী বলিস, আমেরিকাতেই ফিরে গেলে ভাল হয় না ওর এখন? না হলে অন্তত নিজের আত্মীয়স্বজনদের কাছে কলকাতাতেও গিয়ে থাকতে পারে।”
“সে কথা আমি ওকে বলেছিলাম মাসি, কানাই বলেছিল। “এমনকী ওর আমেরিকা যাওয়ার টিকিটের ব্যবস্থাও করে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মনে হল ও যেন শুনতেই পেল
আমার কথাগুলো, সত্যি বলছি। আমার ধারণা ময়না আর টুটুলের কী হবে সেটাই সব সময় ভেবে যাচ্ছে ও। একটা অপরাধবোধও হয়তো কাজ করছে মনের মধ্যে। আসলে, নিজেকে সামলানোর জন্যে একটু সময় দিতে হবে ওকে, কিছুদিন একটু নিজের মতো থাকতে দিতে হবে।”
“তার মানে ওকে এখানে এইভাবে রেখেই তুই চলে যাবি? আমার ঘাড়ে ফেলে দিয়ে?” আশঙ্কার সুর নীলিমার গলায়।
“তোমার কোনও অসুবিধা ও করবে বলে মনে হয় না আমার”, জবাব দিয়েছিল কানাই। “ওকে নিয়ে কোনও ঝামেলাই হবে না তোমার, দেখো। ওর আসলে একটু সময় লাগবে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্যে। আমি এখানে থাকলে তার কোনও সুবিধা হবে বলে মনে হয় না, বরং উলটোটাই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।”
আর আপত্তি করেনি নীলিমা। কানাইকে আটকাতেও চেষ্টা করেনি আর। “জানি রে কানাই, তোরও তো কাজকর্ম সব পড়ে আছে…”
মাসিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরেছিল কানাই। বলেছিল, “কিছু চিন্তা কোরো না গো মাসি। দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আবার আসব কিছুদিন পরে।”
কানাইয়ের শেষ কথাটাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি নীলিমা। মাথা নেড়ে বলেছিল, “সে আসিস। তোর জন্যে তো এখানকার দরজা সব সময়ই খোলা…”
পরের দিনই দিল্লি ফিরে গিয়েছিল কানাই–ঝড়ের ঠিক এক সপ্তাহ পর। তার দিন কয়েক পরেই পিয়া একদিন এসে নীলিমাকে বলল ও-ও চলে যাবে।
“হ্যাঁ বাছা, যাবে তো নিশ্চয়ই। কী আর বলব।” মনের স্বস্তিটুকু যাতে ধরা না পড়ে যায়, তার জন্যে খানিকটা জোর করেই নিরুত্তাপ ভাব আনতে হল গলায়। গত কয়েকদিন ধরেই একটা কথা নীলিমার মনের মধ্যে খোঁচা দিচ্ছিল : পিয়া লুসিবাড়িতে আছে বলে সরকারি লোকেরা কোনও ঝামেলা করবে না তো? ভিসা-টিসা কি আছে ওর? ঠিকঠাক পারমিট নিয়ে এসেছে কি? জানে না নীলিমা। জিজ্ঞেসও করতে চায় না। “এই ক’দিন যা গেছে তোমার ওপর দিয়ে…” নীলিমার গলায় স্নেহের সুর। “ঝড়টা কাটিয়ে ওঠার জন্যে নিজেকে একটু সময় দাও এবার।”
“কিছুদিন পরেই আবার ফিরে আসব আমি,” পিয়া বলেছিল। অকৃত্রিম স্নেহে নীলিমা জবাব দিয়েছিল, “হ্যাঁ মা, নিশ্চয়ই আসবে।”
এই ধরনের কথাগুলি নীলিমার খুব চেনা। অনেক সহৃদয় বিদেশির মুখে হুবহু এই শব্দগুলোই এর আগে বহুবার শুনেছে ও। তাদের একজনও আর ফিরে আসেনি কখনও। যোগাযোগও করেনি। পিয়ার বেলাতেও তাই তার অন্যথা হবে বলে আশা করেনি নীলিমা। কিন্তু সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়ে গেল এখন। সত্যি সত্যিই কথা রেখেছে পিয়া।
ভাল করে গুছিয়ে বসার আগেই টক টক আওয়াজ শোনা গেল দরজায়। কী বলবে ভেবে উঠতে না পেরে শেষে নীলিমা বলল, “আরে পিয়া! তুমি ফিরে এসেছ!”
“হ্যাঁ,” শুকনো গলায় জবাব দিল পিয়া। “আপনি কি ভেবেছিলেন আর আসব না?”
সত্যি কথা বলতে কী, মনে মনে সেইরকমই ভেবেছিল নীলিমা। তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে তাই বলল, “তারপর? এখান থেকে যাওয়ার পর কোথায় কোথায় ঘুরলে?” এর মধ্যে নতুন জামাকাপড় কিনে নিয়েছে মেয়েটা, লক্ষ করল নীলিমা। আগের মতোই সেই সাদা শার্ট আর সুতির প্যান্ট পরেছে।
“কলকাতায় গিয়েছিলাম,” বলল পিয়া। “ওখানে আমার মাসির কাছে ছিলাম কয়েকদিন। বেশিরভাগ সময়টাই ইন্টারনেট দেখে কাটিয়েছি। যা রেসপন্স পেয়েছি না–জানলে খুব খুশি হবেন আপনি।”
“রেসপন্স? কীসের?”
“ঝড়ের সময় কী কী হয়েছিল আর ফকির কীভাবে মারা গেল সেসব বিস্তারিতভাবে লিখে বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটা চিঠি পাঠিয়েছিলাম আমি। সেই চিঠিগুলোকে আবার আমার কয়েকজন বন্ধু আর সহকর্মী সারা পৃথিবীর বহু মানুষকে পাঠিয়েছে; পরিচিত লোকেদের কাছে সাহায্য চেয়েছি ময়না আর টুটুলের জন্যে। আমরা যতটা আশা করেছিলাম তার থেকে অনেক অনেক বেশি রেসপন্স এসেছে মাসিমা। অবশ্য টাকা যতটা হলে ভাল হত ততটা ওঠেনি, তবে খানিকটা উঠেছে। যা জোগাড় হয়েছে তাতে মাথার ওপরে একটা ছাদের ব্যবস্থা হয়ে যাবে ওদের, আর কলেজ পর্যন্ত টুটুলের পড়াশোনার খরচও হয়তো চলে যাবে।”
“আচ্ছা!” সোজা হয়ে উঠে বসল নীলিমা। “খুব খুশি হয়েছি আমি, খুব খুশি হয়েছি। ময়নাও নিশ্চয়ই খুশি হবে খুব।”
“তা ছাড়াও আরও আছে–”
“সত্যি? ভুরুদুটো ওপরে তুলে বলল নীলিমা। “আর কী কী করেছ তুমি শুনি?”
“একটা রিপোর্ট লিখেছি,” জবাব দিল পিয়া। “এখানে ডলফিনদের ওপর যতটুকু স্টাডি করতে পেরেছি তার ওপর। খুবই ভাসা ভাসা হয়েছে রিপোর্টটা, কারণ ডেটা যা জোগাড় করতে পেরেছিলাম সবই তো নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু ওইটুকু দেখেই খুব উৎসাহিত হয়েছেন অনেকে। বেশ কয়েকটা সংরক্ষণ সংস্থা এবং পরিবেশ নিয়ে যারা কাজকর্ম করে এরকম কয়েকটা অর্গানাইজেশন এই বিষয়ে গবেষণা করার জন্য খরচ অফার করেছে আমাকে। কিন্তু আপনার সঙ্গে আগে কথা না বলে ওদের কিছু জানাতে চাইনি আমি।”
“আমার সঙ্গে?” বিস্ময় ধরে রাখতে পারল না নীলিমা। “আমি এসবের কী জানি?”
“আপনি এখানকার মানুষদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন মাসিমা,” পিয়া বলল। “আর আমার দিক থেকে আমি এইটুকু বলতে পারি যে পরিবেশ সংরক্ষণের ভার মাথায় চাপিয়ে দিয়ে সাধারণ গরিব-গুর্বো মানুষকে নাজেহাল করার মতো কোনও কাজ আমি করতে চাই না। যদি কোনও প্রজেক্ট আমি এখানে করি, সেটা আমি করতে চাই বাদাবন ট্রাস্টের সাহায্য নিয়ে, যাতে যে সমস্ত জেলেরা এখানে মাছ-কাঁকড়া ধরে খায়, তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে এগোনো যায়। ট্রাস্টেরও তাতে উপকার হবে। ফান্ড যা আসবে তা আমরা ভাগ করে নেব।”
ফান্ডের কথা উঠতেই সচেতন হয়ে উঠল নীলিমার বাস্তববাদী মন। ঠোঁট কামড়ে বলল, “বেশ। নিশ্চয়ই ভাবা যেতে পারে ব্যাপারটা। কিন্তু পিয়া, এর মধ্যে প্র্যাকটিকাল সমস্যা যা যা হতে পারে সেগুলো কি ভাল করে ভেবে দেখেছ তুমি? যেমন ধরো, তুমি নিজে কোথায় থাকবে?”
মাথা নাড়ল পিয়া। বলল, “সেটাও ভেবেছি। আইডিয়াটা আপনার পছন্দ হয় কিনা দেখুন।”
“বলো।”
“আমি ভাবছিলাম, আপনার যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে এ বাড়ির দোতলাটা, মানে গেস্ট হাউসটা, আমি ভাড়া নিয়ে নিতে পারি। ওখানে থেকেই দিব্যি চালিয়ে নিতে পারব। ছোট একটা অফিস করব, আর একটা ডেটাব্যাঙ্ক। অফিস একটা দরকার হবেই, কারণ খুঁটিনাটি প্রত্যেকটা খরচ-খরচার সব হিসেব দেখাতে হবে।”
প্রশ্রয়ের হাসি হাসল নীলিমা। যে কাজ হাতে নিতে যাচ্ছে তার ঝামেলা যে কত সে ব্যাপারে কোনও ধারণাই নেই মেয়েটার। ফাইলপত্র ঘাঁটাঘাঁটির কাজ তো খুব কম দিন করছে না নীলিমা। নরম গলায় আস্তে আস্তে তাই পিয়াকে বলল, “শোনো মেয়ে, এত বড় মাপের একটা কাজ করতে গেলে একা হাতে তো তুমি পুরোটা সামলাতে পারবে না। তোমাকে নোক রাখতে হবে।”
“জানি মাসিমা, জবাব দিল পিয়া। “সেটাও আমি ভেবে রেখেছি। আমার মনে হয় ওই হিসেব কেতাবের ব্যাপারগুলো ময়নাই সামলে দিতে পারবে। তার জন্যে ওকে পুরো সময় কাজ করতেও হবে না; হাসপাতালের কাজ সেরে হাতে যেটুকু সময় থাকবে তাতেই হয়ে যাবে। এতে কিছু বাড়তি রোজগারও হবে ওর। আমার মনে হয় না ময়নার খুব একটা অসুবিধা হবে। আর আমার তো খুবই সুবিধা হবে। ও খানিকটা বাংলাও শিখিয়ে দিতে পারবে আমাকে; তার বদলে ওকে আমি ইংরেজি শেখাব।”
নিজের ডান হাতের চেটোটা বাঁ হাতের মধ্যে নিয়ে মোচড়াতে লাগল নীলিমা। ভুরু কুঁচকে ভাবতে লাগল পিয়া এখানে থেকে কাজ করতে গেলে কোন কোন দিক থেকে সমস্যা আসতে পারে। অবশেষে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, একটা কথা বলো, তোমার ভিসা আর পারমিট-টারমিট সব কিছু আছে? তুমি কিন্তু বিদেশি, সেটা ভুলে যেয়ো না। লম্বা সময়ের জন্যে তোমার এখানে থাকাটা বে-আইনি হবে কিনা আমি জানি না।”
এই সমস্যাটাও সমাধানের ব্যবস্থা করে ফেলেছে পিয়া। বলল, “আমি আমার কাকার সঙ্গে কথা বলেছি এই নিয়ে। কাকা বলেছেন কী একটা কার্ড আমি নাকি পেতে পারি যাতে যতদিন ইচ্ছা থাকা যেতে পারে এখানে। আমার বাবা-মা ইন্ডিয়ান ছিলেন বলেই নাকি এই সুবিধাটা পেতে পারি আমি। আর পারমিটের ব্যাপারে কাকা বললেন বাদাবন ট্রাস্ট যদি আমার রিসার্চের কাজ স্পনসর করতে রাজি হয় তাহলে বাকিটুকু উনি সামলে দিতে পারবেন। পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করে দিল্লির এরকম কিছু অর্গানাইজেশনের লোকজনদের কাকা চেনেন, তাদের বললে তারাই সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সব ব্যবস্থা করে দিতে পারবে।”
“বাপরে বাপ! তুমি তো দেখছি একেবারে সব আটঘাট বেঁধেই এসেছ,” হোহো করে হেসে উঠল নীলিমা। “তোমার প্রোজেক্টের একটা নামও নিশ্চয়ই ঠিক করে ফেলেছ, তাই না?” ঠাট্টা করে বলা কথাটা শুনে একটু গম্ভীর হয়ে গেল পিয়া। নীলিমা বুঝতে পারল এই মেয়ের কাছে এটা কোনও রসিকতার বিষয় নয়। “সত্যি সত্যিই নাম ঠিক করা হয়ে গেছে? এর মধ্যেই?”
“ফাইনাল কিছু করিনি, তবে মোটামুটি একটা ভাবছিলাম,” পিয়া বলল। “ফকিরের নামে নাম দেওয়া যেতে পারে। ওর দেওয়া ডেটাগুলোর তো একটা বড় ভূমিকা থাকবে এই প্রোজেক্টে।”
“ফকিরের দেওয়া ডেটা?” চোখ প্রায় কপালে উঠে গেল নীলিমার। “ কিন্তু তুমি যে বললে ডেটাগুলো সব ঝড়ে হারিয়ে গেছে?”
হঠাৎ চকচক করে উঠল পিয়ার চোখ। বলল, “সবটা হারায়নি মাসিমা। এই জিনিসটা রয়ে গেছে আমার সঙ্গে।” পকেট থেকে জিপিএস মনিটরটা বের করে নীলিমাকে দেখাল পিয়া। “এই দেখুন, গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমে থাকা স্যাটেলাইটগুলোর সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ থাকে এই যন্ত্রের। ঝড়ের দিন এটা আমার পকেটে ছিল। ফলে যন্ত্রপাতির মধ্যে এটাই একমাত্র বেঁচে গেছে।” পিয়া একটা বোতাম টিপতেই জ্বলে উঠল স্ক্রিনের আলো। তারপর যন্ত্রের মেমরিতে পৌঁছনোর জন্য অন্য আর একটা বোম টিপল কয়েকবার। “যে যে পথ দিয়ে ফকির আমাকে নিয়ে গিয়েছিল সেগুলো সব স্টোর করা আছে এতে। দেখুন।” পর্দার ওপর ফুটে ওঠা একটা আঁকাবাঁকা রেখার দিকে ইশারা করল পিয়া। “ঝড়ের আগের দিন এই পথটা দিয়ে গিয়েছিলাম আমরা। সরু সরু সুঁতিখাল, খাঁড়ি–যেখানে যেখানে ডলফিন ওর চোখে পড়েছে তার প্রত্যেকটা জায়গায় সেদিন ডিঙি নিয়ে গিয়েছিল ফকির। বহু বছর ধরে সঞ্চয় করা জ্ঞানের ভাণ্ডার লুকিয়ে আছে এই একখানা ম্যাপের মধ্যে। এটার ওপর ভিত্তি করেই দাঁড় করাতে হবে আমার প্রোজেক্টকে। আর সেই জন্যেই আমার মনে হয় ফকিরের নামেই হওয়া উচিত এই প্রোজেক্টের নাম।”
“আরিব্বাস!” বলে উঠল নীলিমা। সামনের জানালার ফাঁক দিয়ে নজরে আসা এক চিলতে আকাশের দিকে চোখ চলে গেল ওর। “তার মানে তুমি বলছ এই সব কিছু ওইখানে ধরা রয়ে গেছে?”
“ঠিক তাই।”
চুপ করে গেল নীলিমা। মনে মনে ভাবতে লাগল ফকিরের কথা, ওর ডিঙিটার কথা, যে রহস্যময় পথে একদিন যাত্রা করেছিল ফকির কেমন দূর আকাশের তারার ভাষাতে লেখা হয়ে রয়ে গেছে সেই পথের ঠিকানা, সেই কথা। পিয়ার ডান হাতখানা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে আলতো করে চাপ দিল ও। বলল, “ঠিক বলেছ। ফকিরের একটা স্মৃতিচিহ্ন থাকুক। এই পৃথিবীতেও থাকুক, ওই আকাশেও থাকুক। কিন্তু কাজে হাত দেওয়ার আগে পুরো ব্যাপারটা একবার ভাল করে ভেবে নেওয়ার জন্য একটু সময় দিতে হবে আমাকে।” লম্বা একটা শ্বাস ফেলে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল নীলিমা। “তবে তারও আগে সবচেয়ে জরুরি কাজটা কী জান? গরম গরম এক কাপ চা খাওয়া। কী বলো?”
“নিশ্চয় খাব মাসিমা। থ্যাঙ্ক ইউ।”
রান্নাঘরে গিয়ে ফিল্টার থেকে কেটলিতে জল ভরল নীলিমা। তারপর কেরোসিন স্টোভটা যখন পাম্প করছে, সেই সময় দরজা দিয়ে মাথা বাড়াল পিয়া।
“আচ্ছা মাসিমা, কানাইয়ের কী খবর?” ও জিজ্ঞেস করল। “এর মধ্যে আর যোগাযোগ করেছে?”
একটা দেশলাই কাঠি জ্বেলে স্টোভটা ধরাল নীলিমা। লোহার জালিটা বসাল তার ওপর। বলল, “হ্যাঁ করেছে। এই তো কালকেই একটা চিঠি পেয়েছি ওর কাছ থেকে।”
“কেমন আছে?” জিজ্ঞেস করল পিয়া। কেটলিটা স্টোভের ওপর বসাতে বসাতে একগাল হাসল নীলিমা। “কী বলব রে মা, ওরও তো তোমারই মতো অবস্থা। ভয়ানক ব্যস্ত সব সময়।”
“তাই নাকি? কী করছে ও এখন?”
“বলছি দাঁড়াও,” টিপটটার দিকে হাত বাড়াতে বাড়াতে বলল নীলিমা। “কোত্থেকে শুরু করি বলো তো? সবচেয়ে ভাল কাজ যেটা করেছে কানাই, সেটা হল নিজের কোম্পানিটাকে একেবারে ঢেলে সাজিয়েছে। ফলে এখন দরকার মতো একটু ছুটি নিতে পারে মাঝে মাঝে। কিছুদিন কলকাতাতেও এসে থাকার ইচ্ছে আছে ওর।”
“সত্যি?” পিয়ার চোখে বিস্ময়। “কী করবে ও কলকাতায়?”
“সেটা ঠিক বলতে পরব না,” অনেক দিন ধরে জমিয়ে রাখা দার্জিলিং চায়ের পাতা চামচে করে টিপটের মধ্যে ঢালল নীলিমা। “তবে আমাকে ও একদিন বলেছিল যে নির্মলের নোটবইয়ের কাহিনিটা ও গুছিয়ে লিখতে চায়: কী করে নোটবইটা ওর হাতে এল, কী ছিল ওর মধ্যে, কী করে আবার ওটা হারিয়ে গেল–এই সব। কিন্তু এই কাজটা ঠিক কীভাবে ও করতে চায় সেটা বরং তুমিই জিজ্ঞেস করে নিয়ে ওকে। দু-এক দিনের মধ্যেই ও আসবে এখানে।”
“দু-এক দিনের মধ্যে?”
মাথা নাড়ল নীলিমা। টক টক করে আওয়াজ উঠছে কেটলির ঢাকনায়; স্টোভ থেকে কেটলিটাকে নামিয়ে নিল ও। ফুটন্ত জলটা টিপটে ঢেলে দিয়ে বলল, “কানাই যখন আসবে তখন যদি কয়েকদিন ও ওপরের গেস্ট হাউসটাতে থাকে, তাতে তোমার কোনও আপত্তি নেই তো?”
হাসল পিয়া। “না। কোনওই আপত্তি নেই। সত্যি কথা বলতে কী, ও বাড়িতে থাকলে আমার ভালই লাগবে।”
পিয়ার শব্দ ব্যবহারে এত আশ্চর্য হয়ে গেল নীলিমা যে ঠং করে চায়ের চামচটা পড়ে গেল হাত থেকে। অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি ঠিক শুনলাম তো? ‘বাড়িতে’ বললে কি তুমি?”
নিজের অজান্তেই কথাটা বেরিয়ে এসেছিল পিয়ার মুখ দিয়ে। এখন খেয়াল হতে কপালে ভাঁজ পড়ল ওর।
অবশেষে বলল, “জানেন মাসিমা, এই ওর্কায়েলা ডলফিনগুলো যেখানে থাকে সেটাই আমার বাড়ি। তাহলে এই জায়গাটাই বা হবে না কেন?” চোখদুটো বড় বড় হয়ে উঠল নীলিমার। তারপর হো হো করে হাসিতে ফেটে পড়ে বলল, “দেখো পিয়া, এইখানে তোমার আর আমার মধ্যে একটা তফাত আছে। আমি ‘বাড়ি’ বলতে কী বুঝি জানো? যেখানে শান্তিতে এক কাপ চা বানিয়ে খেতে পারি সেটাই আমার বাড়ি।”