শহুরে এলাকা ছাড়িয়ে মিনিট বিশেক চলার পর ট্রেনটা একটা স্টেশনে এসে থামতেই কপালজোরে জানালার পাশের সিটটা পেয়ে গেল পিয়া। এতক্ষণ ও ঘুপচিমতো একটা কোনার দিকে ভিড়ে ঠাসা বেঞ্চির ওপর কোনওরকমে আলগাভাবে বসেছিল। সামনে পড়েছিল গন্ধমাদনের মতো বিশাল পিঠব্যাগগুলো। জানালার পাশে এসে এবার একটু হাঁফ ছাড়ার সুযোগ পেল। বাইরে তাকিয়ে দেখল স্টেশনটার নাম চম্পাহাটি। প্ল্যাটফর্মটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে কতগুলো নোংরা ঝুপড়ির কাছে, তারপর ডুব দিয়েছে একটা এঁদো ডোবার মধ্যে। ডোবার ঘোলাটে জলে থকথকে ময়লা ফেনা ভাসছে। কামরার ভেতরে এখনও তিলধারণের জায়গা নেই। তার মানে ক্যানিং পর্যন্ত এইরকমই চলবে। রেললাইন বরাবর ঝুপড়ি-বস্তিগুলোর দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে ও ভাবছিল, কে বলবে যে সুন্দরবনের প্রায় দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে ট্রেনটা?
প্ল্যাটফর্মে একটা লোক চা বিক্রি করছে। জানালা দিয়ে হাত বার করে ইশারায় ওকে ডাকল পিয়া। দাম মিটিয়ে জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে গরম ভাড়টা যেই ও হাতে নিয়েছে, সামনের সিটে বসা লোকটা কীসের যেন একটা পাতা ওলটাল, আর তার হাতের ধাক্কায় ভাড় থেকে চলকে পড়ল খানিকটা চা। চট করে হাত ঘুরিয়ে নিয়ে পিয়া চেষ্টা করল যাতে বেশিরভাগটাই জানালার বাইরে পড়ে, কিন্তু তা সত্ত্বেও কয়েকটা ফোঁটা গিয়ে পড়ল লোকটার হাতের কাগজে। “ওহ, আই অ্যাম সো সরি”–একেবারে মরমে মরে গেল পিয়া। কামরার সবগুলো লোকের মধ্যে বেছে বেছে এই লোকটার সঙ্গেই এরকম হল! ঢাকুরিয়া স্টেশনেই ওকে লক্ষ করেছিল পিয়া। লোকটার ঘাড় হেলিয়ে দাঁড়ানোর মধ্যে এমন একটা আত্মতুষ্ট ভাব ছিল যে সেটা নজর না করে পারেনি ও। স্টেশনের অন্যদের থেকে একেবারে আলাদা করে চোখে পড়ছিল লোকটাকে; অসংকোচে চারপাশের প্রত্যেকের দিকে তাকিয়ে দেখছিল–প্রতিটা লোককে খুঁটিয়ে নজর করে, যেন মনে মনে মেপেজুপে আলাদা আলাদা করে রেখে দিচ্ছিল যার যার নিজের জায়গায়। অন্যকে নিজের গুরুত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার একটা অনায়াস দক্ষতাও আছে লোকটার, লক্ষ করেছিল পিয়া, যখন পাশের ভদ্রলোককে জানালার কাছের সিটটা থেকে সরিয়ে দিল ও। ওকে দেখে নিজের কয়েকজন কলকাতার আত্মীয়র কথা মনে পড়ছিল পিয়ার। মনে হচ্ছিল তাদেরই মতো অনেকটা এই লোকটা, এরা মনে করে যেন পৃথিবীর যাবতীয় সুখসুবিধা এদেরই প্রাপ্য (শ্রেণিগত কারণ, না শিক্ষা?), আশা করে যেন ছোটখাটো সমস্যা-টমস্যাগুলো ওদের সুবিধার জন্য আপনা থেকেই সরে যাবে।
“এই নিন,” লোকটার দিকে একমুঠো টিস্যু পেপার এগিয়ে দিল ও। “আমি হেল্প করছি আপনাকে কাগজগুলো মুছতে।”
“দরকার নেই। একেবারে বারোটা বেজে গেছে।” বিরক্ত মুখ করে দুমড়ে মুচড়ে কাগজগুলো জানালার বাইরে ছুঁড়ে দিল লোকটা।
একটু থতমত খেয়ে গেল পিয়া। মিনমিন করে বলল, “খুব একটা ইম্পর্ট্যান্ট কিছু ছিল না তো?”
“সেরকম অপূরণীয় ক্ষতি কিছু হয়নি। একটা লেখার জেরক্স কপি ছিল ওগুলো।”
এক মুহূর্তের জন্য পিয়ার মনে হল লোকটাকে বলে যে ওরই হাতের ধাক্কায় পড়েছিল চা-টা, কিন্তু ওর মুখ দিয়ে শুধু বেরোল, “আমি খুবই দুঃখিত। কিছু মনে করলেন না আশা করি।”
“মনে করেও কি লাভ আছে কিছু?” ব্যঙ্গের চেয়ে চ্যালেঞ্জের ভাবই যেন বেশি প্রশ্নটার মধ্যে। “আজকের দুনিয়ায় আমেরিকানদের সঙ্গে টক্কর দিয়ে কেউ কি সুবিধা করতে পারে?”
ঝগড়া করার ইচ্ছে ছিল না, তাই প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেল পিয়া। বদলে একটা তারিফের ভাব দেখিয়ে চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল, “কী করে বুঝলেন?”
“কী বুঝলাম?”
“যে আমি আমেরিকান? আপনার চোখ আছে বলতে হবে।”
একটু যেন শান্ত হয়ে লোকটা আরাম করে সিটে হেলান দিল। “বোঝার কিছু নেই, আমি জানতাম।”
“কী করে জানতেন? আমার উচ্চারণ শুনে?”
“হ্যাঁ,” মাথা নাড়ল লোকটা। “উচ্চারণ শুনে লোক চিনতে ভুল আমার কমই হয়। আসলে আমি ট্রান্সলেটর। দোভাষীর কাজও করি। এটাই আমার পেশা। উচ্চারণের সামান্য তফাতও সেই জন্যে আমি চট করে ধরে ফেলতে পারি।”
“সত্যি?” পিয়া হাসল। ওর ডিমাকৃতি শ্যামলা মুখে সাদা দাঁতগুলো ঝিকিয়ে উঠল। “কটা ভাষা জানেন আপনি?”
“ছ’টা। ডায়লেক্টগুলো বাদ দিয়ে।”
“ওয়াও!” সত্যি সত্যি তারিফের সুর এবার পিয়ার গলায়। “আমি তো শুধু ইংরেজিটাই জানি, আর সেটাও যে খুব একটা ভাল জানি তা নয়।”
একটু আশ্চর্য হল লোকটা। “আপনি বলছিলেন আপনি ক্যানিং যাচ্ছেন, তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু পথঘাট চেনেন না, বাংলা-হিন্দি না জানলে ওখানে গিয়ে তো মুশকিলে পড়বেন।”
“মনে হয় না। এসব অভ্যেস আছে আমার,” হেসে ফেলল পিয়া। “কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা হয়েই যায়। তা ছাড়া আমার যা কাজ তাতে কথাবার্তার বিশেষ কোনও দরকারও পড়ে না।”
“কী কাজ করেন আপনি, জানতে পারি?”
“আমি সিটোলজিস্ট। মানে–” ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে বোঝাতে যাচ্ছিল পিয়া, কিন্তু মাঝপথে ওকে থামিয়ে দিল লোকটা।
“সিটোলজিস্ট মানে আমি জানি। আপনাকে বুঝিয়ে দিতে হবে না। আপনি জলচর স্তন্যপায়ী প্রাণীদের নিয়ে কাজ করেন, তাই তো?”
“হ্যাঁ,” মাথা নাড়ল পিয়া। “আপনি তো অনেক কিছু জানেন দেখছি। জলচর স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ওপরই গবেষণা করি আমি–ডলফিন, তিমি, ডুগং এইসব। কাজের জন্য অনেকটা সময়ই আমাকে জলের ওপর কাটাতে হয়। কথা বলার মতো ধারে কাছে কেউ থাকেই না। অন্তত ইংরেজি বলার মতো কেউ তো নয়ই।”
“তা হলে কাজের সূত্রেই আপনি ক্যানিং যাচ্ছেন?”
“হ্যাঁ। সুন্দরবনের এইসব জলচর প্রাণীদের স্টাডি করার ইচ্ছে আছে আমার। আশা করি কোনওরকমে পারমিট একটা জোগাড় হয়ে যাবে।”
এবার একটু থমকাল লোকটা। একটুই অবশ্য। “সুন্দরবনে এরকম প্রাণী আছে নাকি? আমি তো জানতামই না।”
“আছে। মানে একসময় ছিল তো বটেই। প্রচুরই ছিল।”
“তাই? সুন্দরবন মানেই তো আমাদের ধারণা শুধু বাঘ আর কুমির।”
“জানি। সুন্দরবনের অন্য সব জলচর প্রাণীর কথা লোকে প্রায় ভুলেই গেছে। কারণটা বলা মুশকিল। হতে পারে যে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে জীবগুলো। অথবা, এদের নিয়ে কখনও কোনও গবেষণা হয়নি, সে কারণে সাধারণ মানুষ এদের কথা জানে না, তাও হতে পারে। এমনকী ঠিকমতো সার্ভেও কখনও করা হয়নি।”
“কেন?”
“হয়তো পারমিশন পাওয়া যায় না বলে। গত বছর একটা টিম এসেছিল এখানে সার্ভের জন্য। বেশ কয়েকমাস ধরে ওরা প্রস্তুতি করেছিল, দরকারি কাগজপত্র ঠিকঠাক পাঠিয়েছিল, কিন্তু শেষে যেতেই পারল না নদী পর্যন্ত। একেবারে লাস্ট মোমেন্টে পারমিট বাতিল করা হল।”
“আপনার ক্ষেত্রেও তো একই ব্যাপার ঘটতে পারে?”
“একা থাকলে কঁকফোকর গলে বেরিয়ে যাওয়াটা অনেক সোজা।”
একটু থেমে মুচকি হাসল পিয়া–”তা ছাড়া কলকাতায় আমার এক কাকা আছেন বেশ উঁচু সরকারি পদে। উনি ক্যানিং-এ ফরেস্ট অফিসে একজনের সঙ্গে কথা বলে রেখেছেন। এখন দেখা যাক কী হয়।”
“আই সি!” পিয়ার এই অকপট অথচ চালাক-চতুর ভাবটা লোকটার ভাল লেগেছে মনে হল। “তা হলে ক্যালকাটায় আত্মীয়স্বজন আছে আপনার?”
“হ্যাঁ। আমার নিজের জন্মও ওখানেই। আমার বাবা-মা দেশ ছেড়েছেন যখন আমার এক বছর বয়স।” কথাটা বলেই লোকটার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল ও ভুরু তুলে বলল, “আপনিও দেখছি ক্যালকাটা বলেন। আমার বাবাও এখনও বলেন ক্যালকাটা।”
মাথা নেড়ে ভুলটা স্বীকার করল কানাই। “ঠিকই বলেছেন, একটু খেয়াল রাখতে হবে নামটা বলার সময়।” হেসে হাতটা বাড়িয়ে দিল ও–”পরিচয়টা সারা যাক। আমার নাম কানাই দত্ত।”
“আমি পিয়ালি রয়। সবাই পিয়া বলেই ডাকে।”
ওর এমন পরিষ্কার বাংলা নাম শুনে কানাই একটু আশ্চর্য হয়েছে বুঝতে পারল পিয়া। আরও বিশেষ করে এইজন্য যে পিয়া নিজে ভাষাটা জানে না। কানাই হয়তো ভেবেছিল পিয়ার বাবা-মা ইন্ডিয়ার অন্য কোনও অঞ্চলের লোক হবে।
“আপনার নামটা তো দেখছি বাঙালি, কিন্তু আপনি বাংলা জানেন না?”
“দোষটা ঠিক আমার নয়,” তাড়াতাড়ি বলল পিয়া। “আমি আমেরিকায় বড় হয়েছি। আর আমরা যখন দেশ ছেড়ে গেছি তখন আমি এত ছোট যে ভাষাটা শেখার সুযোগই পাইনি।”
“সেরকম হিসেব করলে তো আমারও ইংরেজি বলার কথা নয়। কারণ আমি বড় হয়েছি কলকাতায়।”
“আসলে ভাষার ব্যাপারে আমার মাথা বিশেষ কাজ করে না…” কথাটা শেষ করল না ও, যেন বাতাসে ভাসিয়ে দিল। তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ পালটে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, আপনি কেন ক্যানিং যাচ্ছেন, মিস্টার দত্ত?”
“কানাই–আমাকে কানাই বলে ডাকতে পারেন।”
“কান-আয়,” একটু হোঁচট খেয়ে উচ্চারণ করল পিয়া। ওকে শুধরে দেওয়ার জন্য কানাই বলল, “হাওয়াই-এর সঙ্গে মিলিয়ে বলতে পারেন।”
“কানাই?”
“দ্যাটস রাইট। এবার আপনার প্রশ্নের জবাব দিই–আমি আমার এক মাসির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।”
“উনি ক্যানিং-এ থাকেন?”
“না। উনি থাকেন লুসিবাড়ি বলে একটা ছোট্ট দ্বীপে। ক্যানিং থেকে বহুদূর।”
“ঠিক কোন জায়গায়?” পিঠব্যাগের চেন খুলে একটা ম্যাপ বের করল পিয়া। “জায়গাটা কোথায় এই ম্যাপে একটু দেখিয়ে দিন আমাকে।”
ম্যাপটা খুলে ধরে আঙুল দিয়ে একটা লম্বা আঁকাবাকা কাল্পনিক রেখা টানল কানাই। “ট্রেনে করে এলে ক্যানিং হল সুন্দরবনে ঢোকার দরজা। আর লুসিবাড়ি হল এই যে, এইখানে–একেবারে শেষপ্রান্তে। এর পরে আর কোনও দ্বীপে মানুষ থাকে না। অ্যানপুর, জেমসপুর, এমিলিবাড়ি ছাড়িয়ে আরও বেশ কিছুটা নদীপথে গেলে আপনি লুসিবাড়ি পৌঁছবেন।”
ম্যাপ দেখতে দেখতে ভুরু কোঁচকাল পিয়া, “অদ্ভুত সব নাম।”
“সুন্দরবনের কত জায়গার নাম যে ইংরেজি থেকে এসেছে জানলে আশ্চর্য হয়ে যাবেন। লুসিবাড়ি মানে হল লুসির বাড়ি।”
“লুসির বাড়ি?” অবাক হয়ে তাকাল পিয়া। “মানে লুসি নামের কোনও মেয়ের বাড়ি?”
“একজ্যাক্টলি,” কানাইয়ের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। “আপনি একবার এসে দেখে যেতে পারেন জায়গাটা। লুসিবাড়ি নামটা কী করে হল আপনাকে শোনাব।”
“নিমন্ত্রণ করছেন?” মুচকি হেসে পিয়া জিজ্ঞেস করল।
“অবশ্যই। চলে আসুন। আপনি এলে আমারও বনবাসের ভার একটু কমে।”
পিয়া হাসল। শুরুতে মনে হচ্ছিল কানাই একেবারেই আত্মকেন্দ্রিক একটা লোক, কিন্তু এখন মনে হল আরেকটু উদারভাবে দেখা যেতে পারে মানুষটাকে। কোথাও যেন একটা বৈপরীত্য রয়েছে ওর চরিত্রের মধ্যে। আর তার জন্যেই ওর আত্মকেন্দ্রিক ভাবটাও খানিকটা ইন্টারেস্টিং হয়ে উঠেছে। অন্তত পিয়া প্রথমে যা ভেবেছিল তার তুলনায় তো বটেই।
“কিন্তু আপনাকে পাব কোথায়? কোথায় গিয়ে খুঁজব?”
“আপনি সোজা লুসিবাড়ি হসপিটাল চলে যাবেন। সেখানে গিয়ে মাসিমার খোঁজ করলেই লোকে আপনাকে আমার মাসির কাছে নিয়ে যাবে। আর মাসির সঙ্গে দেখা করলেই আমার খোঁজ পেয়ে যাবেন।”
“মাসিমা?” পিয়া জিজ্ঞেস করল। “মাসিমা তো আমারও একজন আছেন। মাসিমা মানে মায়ের বোন তো, তাই না? শুধু মাসিমা বললেই হবে? আরও অনেকেরই নিশ্চয়ই মাসিমা থাকতে পারেন ওখানে?”
“আপনি যদি হসপিটালে গিয়ে মাসিমার কথা বলেন, যে কেউ বুঝবে আপনি কার সঙ্গে দেখা করতে চান। ওই হসপিটালটা আমার মাসিই শুরু করেছিলেন, আর যে সংস্থা ওটা চালায়–বাদাবন ট্রাস্ট–উনি তার সর্বেসর্বা। ওঁর নাম নীলিমা বোস, কিন্তু সবাই ‘মাসিমা বলেই ডাকে ওখানে। আমার মেসো আর মাসি ছিলেন একেবারে যাকে বলে রাজযোটক–ওখানকার সকলের সার’ আর ‘মাসিমা।”
“সার? তার মানে?”
কানাই হেসে ফেলল। “ওটা হল sir বলার বাংলা ধরন। আসলে উনি ছিলেন ওখানকার স্কুলের হেডমাস্টার। তাই সব ছাত্ররা ওনাকে sir-ই বলত। লোকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল ওনার একটা আসল নাম আছে–নির্মল বোস।”
“আপনি ওনার বিষয়ে পাস্ট টেন্স-এ কথা বলছেন যে?”
“হ্যাঁ। উনি বহুদিন হল মারা গেছেন।” মুখটা একটু বিকৃত করল কানাই; যেন মনে মনে স্বীকার করতে চায় না ব্যাপারটাকে।
“তবে এই মুহূর্তে কী মনে হচ্ছে আমার জানেন তো? মনে হচ্ছে মেসো যেন বেঁচেই আছেন এখনও।”
“কী রকম?”
“কারণ উনি প্রায় কবর খুঁড়ে উঠে এসে ডেকে পাঠিয়েছেন আমাকে,” হাসল কানাই।
“আসলে মারা যাওয়ার সময় মেসো কিছু কাগজপত্র আমার জন্য রেখে গিয়েছিলেন। এত বছর সেগুলোর কোনও হদিশ ছিল না, কিন্তু রিসেন্টলি পাওয়া গেছে। সেইজন্যই আমি লুসিবাড়ি যাচ্ছি। মাসির খুব ইচ্ছে আমি একবার গিয়ে কাগজগুলো দেখি।”
ওর কথার মধ্যে ক্ষীণ একটা বিরক্তির আভাস পেল পিয়া। “মনে হচ্ছে আপনার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না আসার?”
“ধরেছেন ঠিক। আদৌ ইচ্ছে ছিল না,” বলল কানাই। “হাতে এমনিতেই প্রচুর কাজ, আর এই সময়টাতে কাজের চাপ খুবই বেশি থাকে। এখন এক সপ্তাহ ছুটি নেওয়া–”
“ও। এই প্রথম আপনি যাচ্ছেন ওখানে?”
“না, প্রথম নয়। অনেক বছর আগে আরেকবার আমাকে ওখানে পাঠানো হয়েছিল।”
“পাঠানো হয়েছিল? কেন?”
“সে গল্প বলতে গেলে একটা ইংরেজি শব্দের কথা টানতে হয়, বুঝলেন?” হাসল কানাই। “রাস্টিকেট’ শব্দটা জানেন তো?”
“না। কখনও শুনেছি বলে মনে পড়ছে না।”
“এটা আসলে ছিল একটা শাস্তির ব্যবস্থা, দুষ্ট্র স্কুলছাত্রদের জন্য, কানাই বলল। “আগেকার দিনে এরকম দুরন্ত ছেলেদের সব গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হত গেঁয়ো, মানে রাস্টিক, লোকেদের কাছে। যখন ছোট ছিলাম, আমার ধারণা ছিল অনেক কিছুই আমি আমার মাস্টারমশাইদের থেকে বেশি জানি। একবার আমি একজন টিচারকে সবার সামনে অপদস্থ করেছিলাম। সে ভদ্রলোক কিছুতেই ‘লায়ন’ শব্দটা ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারতেন না। বলতে গিয়ে জিভ জড়িয়ে ফেলতেন, ফলে অদ্ভুত শোনাত শব্দটা, খানিকটা ‘গ্রয়েন’-এর সঙ্গে ছন্দে মিলত। আমার বয়স তখন দশ। তো, তারপর অনেক ঝামেলা-টামেলা হল, স্কুল থেকে আমার বাবা-মাকে জানানো হল যে আমাকে রাস্টিকেট করা হবে। সেই সময়ে আমাকে মাসি-মেসোর কাছে লুসিবাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল,” ঘটনাটা মনে করে হাসি পেল কানাইয়ের। “সে কতকাল আগের কথা, ১৯৭০।”
ট্রেনের গতি কমতে শুরু করেছিল; কানাইয়ের কথার মাঝখানেই হুইসল বাজল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে স্টেশনের হলুদ সাইনবোর্ডটা দেখতে পেল ও–”ক্যানিং।”
“এসে গেছি,” ট্রেনের আলাপ এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাওয়ায় হঠাৎ যেন মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল কানাইয়ের। এক টুকরো কাগজ ছিঁড়ে নিয়ে খসখস করে কয়েকটা শব্দ লিখে ও পিয়ার হাতে দিল–”এটা রাখুন, আমাকে খুঁজে বার করতে কাজে লাগবে।”
ট্রেন থামতেই কামরার সব লোক হুড়মুড় করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। পিয়াও দাঁড়িয়ে উঠে পিঠব্যাগগুলো কাঁধে ঝোলাল। “আবার হয়তো দেখা হয়ে যাবে।”
“আশা করি।” হাত নাড়ল কানাই। “মানুষখেকো বাঘ আছে কিন্তু, সাবধানে থাকবেন।”
“আপনিও ভাল থাকবেন। চলি।”