কথা
স্নানের পর জামাকাপড় পালটে ছইয়ের তলা দিয়ে গুঁড়ি মেরে নৌকোর সামনের দিকটায় গেল পিয়া। সেই চেক-চেক কাপড়ের টুকরোটা তখনও ঝুলছে হাতে। কিছুতেই মনে আসছে না কাপড়টার নাম। ফকিরকে একবার জিগ্যেস করল, কিন্তু ওর ইশারার প্রশ্ন ফকির বুঝতেই পারল না। একটু অবাক হয়ে হাঁ করে চেয়ে রইল ওর মুখের দিকে। অবশ্য বুঝবে যে, সে আশাও পিয়া বিশেষ করেনি; কারণ এতক্ষণের মধ্যে একবারও ফকির ওকে বাংলা শেখাবার কোনও চেষ্টাই করেনি। একটু আশ্চর্যই হয়েছে তাতে পিয়া। এইরকম ক্ষেত্রে সাধারণত ও দেখেছে লোকে আশেপাশের এটা-সেটার দিকে দেখিয়ে তাদের ভাষায় সেগুলির নাম বলে বলে দিতে থাকে, চেষ্টা করে যাতে ভিনদেশি মানুষটা কিছুটা অন্তত বুঝতে পারে তারা কী বলতে চাইছে। কিন্তু ফকির দেখা গেল ব্যতিক্রম। পিয়া যে ওই চেক কাটা কাপড়টার বাংলা নামটা জানতে চাইতে পারে সেটা তাই ওর মাথাতেই এল না।
কিন্তু পিয়াও হাল ছাড়ার পাত্রী নয়। নানারকম ইশারা অঙ্গভঙ্গি করেই যেতে লাগল যতক্ষণ না ফকির বুঝতে পারে ও কী বলতে চাইছে। বেশ খানিকক্ষণের চেষ্টার পর অবশেষে সফল হল পিয়া। “গামছা”, ফকির সংক্ষেপে বলল। আরে, তাই তো! গামছা, গামছা–শব্দটা তো পিয়া জানে! কিছুতেই মনে পড়ছিল না এতক্ষণ।
আচ্ছা, কেমন করে একেকটা শব্দ এভাবে হারিয়ে যায়? স্মৃতির মধ্যে লুকিয়ে থাকে–ভাঙা আলমারির এক কোনায় পড়ে থাকা পুরনো খেলনার মতো? তারপর কোনওদিন কেউ জঞ্জাল সাফ করতে গিয়ে হঠাৎ সেটা ফিরে পায়, বের করে আনে মাকড়শার জাল আর ধুলোর মধ্যে থেকে।
ছোটবেলার কথা মনে পড়ে পিয়ার। বাংলা ভাষা সে সময় যেন ক্রোধের বন্যার মতো আছড়ে আছড়ে পড়ত ওর দরজায়। ঝড়ের মতো, ঢেউয়ের মতো প্রবল সেই তোড়ের থেকে বাঁচার জন্য গুঁড়ি মেরে ও গিয়ে ঢুকত কাপড়ের আলমারির পেছনে, দু’কান চেপে ধরে দূরে ঠেলে রাখতে চাইত শব্দগুলোকে। কিন্তু আলমারির পলকা দরজা বাবা-মার গলার আওয়াজ আটকাতে পারত না। বাংলা ছিল পিয়ার মা আর বাবার ঝগড়া করার ভাষা। সে ঝগড়ার শব্দ দরজার তলা দিয়ে ফাঁকফোকর গলে পৌঁছে যেত পিয়ার কাছে, মুহূর্তে মুহূর্তে বাড়তে থাকত বন্যার জলের মতো, একেক সময় মনে হত শব্দের সেই জলোচ্ছ্বাস যেন ডুবিয়ে মারতে চাইছে ওকে। যেখানেই লুকোক, কী করে যেন সেই ঝগড়ার আওয়াজ ঠিক খুঁজে খুঁজে বের করত পিয়াকে। সে সময় বাবা আর মা তাদের সমস্ত জমা রাগ উগরে দিত বাংলা ভাষায়। সেই থেকেই ভাষাটার সঙ্গে কোথায় যেন একটা বিষণ্ণতার সুর লেগে রয়েছে। আলমারির কোনায় গুঁড়ি মেরে শুয়ে থাকতে থাকতে সে সময় পিয়া ওই শব্দগুলোকে মাথা থেকে ধুয়ে মুছে সাফ করে ফেলতে চাইত; এমন সব শব্দের কথা ভাবত যেগুলি হবে ইস্পাতের মতো ভারী, ডাক্তারের দস্তানার মতো পরিষ্কার, ঝকঝকে, জীবাণুমুক্ত। সেই সব শব্দের স্বপ্ন দেখত অভিধানে যাদের ঠিকানা মেলে, যাদের সঙ্গে কোনও অসুখের অনুষঙ্গ জড়িয়ে নেই।
পিয়ার সেই ছোটবেলার শোয়ার ঘরের একটা জানালা দিয়ে এক চিলতে সমুদ্র নজরে আসত। ওদের অ্যাপার্টমেন্টটা ছিল ছোট্ট দুটো বেডরুম, একটা লিভিংরুম আর একটা রান্নাঘর। সেই অ্যাপার্টমেন্টের একটা বেডরুমের জানালা দিয়ে এরকম সুন্দর দৃশ্য দেখতে পাওয়া রীতিমতো ভাগ্যের ব্যাপার ছিল।
সেই সবচেয়ে ভাল ঘরটাই ছিল পিয়ার নিজের ঘর। দু’বছরের পিয়াকে ঘিরেই তখন ওর মা-বাবার সাজানো সংসার। ওর কাছে তখন সেই বাড়িটা ছিল একটা মন্দিরের মতো, আর ওর নিজের ঘরটা তার গর্ভগৃহ। মা আর বাবা থাকত অন্য ঘরটাতে। সেটা এত ছোট যে খাটের পায়ের দিকটা বেয়ে ওদের বিছানায় উঠতে হত। সেই ছোট্ট বদ্ধ ঘরটাই ছিল ওদের দু’জনের সমস্ত রাগ-অভিমান প্রকাশের একমাত্র জায়গা। তার মধ্যেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাত ওরা, এটা-সেটা নিয়ে খিটিমিটি করত, আর মাঝে মধ্যে চিৎকার করে ঝগড়া করত।
বড় ঘরটাকে প্রায় বছর পাঁচেক নিজের দখলে রেখেছিল পিয়া। তারপর হঠাৎ একদিন মা এসে ওকে সেখান থেকে উৎখাত করল। বাবার সঙ্গে এক ঘরে আর থাকতে পারছিল না মা। দরজা বন্ধ করে তাই বাকি পরিবারের থেকে নিজেকে আলাদা রেখে শান্তিতে থাকতে চাইছিল। কিছুদিন পরেই ধরা পড়ল মায়ের ক্যান্সার হয়েছে। সার্ভাইকাল ক্যান্সার। কিন্তু মাঝের বেশ খানিকটা সময় মা ওকে বিছানায় বসতে দিত মনে আছে। একমাত্র পিয়াই তখন যেতে পারত মা-র কাছে, দেখা করতে পারত, ছুঁতে পারত মাকে। আর কাউকেই সে সময় সহ্য করতে পারত না মা। বাবাকে তো নয়ই। পিয়ার মনে আছে ও স্কুল থেকে বাড়ি ফিরলেই মা ওকে আদর করে ডেকে নিত : “আয় পিয়া, আয়, এখানে এসে বোস।” অদ্ভুত ব্যাপার, সেই শব্দগুলো কেমন শুনতে ছিল সেটা পিয়ার আর কিছুতেই মনে পড়ে না (ইংরেজিতে বলত কি মা, নাকি বাংলাতে?) কিন্তু শব্দগুলির মানে, মায়ের গলার আওয়াজ, কথা বলার সুরটা স্পষ্ট মনে আছে এখনও। ও আস্তে আস্তে ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখত মা গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে বিছানার ওপর, পুরনো একটা শাড়ি পরে। সারা সকালটা তখন বাথরুমে কাটাত মা, ধুয়ে ধুয়ে কাল্পনিক ময়লা সব সাফ করতে চেষ্টা করত। অতক্ষণ ভিজে থাকার জন্য তাই কেমন যেন ভাজ ভাজ হয়ে থাকত হাতের চামড়া।
সেই সময়েই একদিন জানালা দিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পিয়া জানতে পারল মায়ের ছেলেবেলার অনেকটা সময় কেটেছে এইভাবে জলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। মায়ের বাবা ছিলেন আসামের এক চা বাগানের ম্যানেজার। সেই বাগানের ধার ঘেঁষে বয়ে যেত এক বিশাল নদ। তার নাম ব্ৰহ্মপুত্র। আমেরিকার খুপরি ফ্ল্যাটবাড়ির ঘরে শুয়ে সমুদ্র দেখতে দেখতে মা পিয়াকে তার ছোটবেলার সুখের সময়ের গল্প বলত। রোদটলা সেই চা বাগানে ওরা কেমন দৌড়োদৌড়ি করে খেলে বেড়াত, মাঝে মাঝে লম্বা নৌকোসফরে যেত ব্রহ্মপুত্রে, সেই সব কথা বলত।
পরে, পিয়া যখন গ্রাজুয়েট স্কুলে ভর্তি হল, সে সময়ে ওকে অনেকেই জিজ্ঞেস করত মিষ্টি জলের শুশুকের বিষয়ে ওর আগ্রহের পেছনে কোনও পারিবারিক কারণ আছে কি না। প্রসঙ্গটা উঠলেই গা জ্বলে যেত পিয়ার। ও কী পড়াশোনা করবে, কী গবেষণা করবে সেটা মা বাবা ঠিক করে দিয়েছে–সে ইঙ্গিতটার জন্যে রাগ হত ওর। তা ছাড়া ব্যাপারটা আদৌ সে রকম কিছু ছিল না। ছোটবেলা থেকে ইতিহাসের কথা, পরিবারের কথা, ভাষার কথা, নানা রকম দায়িত্বের কথা পিয়া অনেক শুনেছে, কিন্তু ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কথা মা-বাবা কখনও ভাবেইনি।
যেমন, কলকাতার কথা বহু শুনেছে পিয়া মা-বাবার কাছে, কিন্তু কেউ ওকে কখনও বলেনি যে আমেরিকার এই পিউগেট সাউন্ড সমুদ্রের খুনে তিমির সমগোত্রীয় ওর্কায়েলা ব্রেভিরোষ্ট্রিস সেখানেই প্রথম দেখা গিয়েছিল।
খানিক বাদেই রাতের খাওয়া-দাওয়ার তোড়জোড় শুরু করল ফকির। তক্তার নীচ থেকে দুটো বেশ বড়সড় জ্যান্ত কাঁকড়া বের করে নিয়ে এল। সেগুলোকে কালচিটে একটা পাত্র দিয়ে ঢেকে রেখে রান্নার অন্যসব সরঞ্জাম আনতে গেল। ছইয়ের ভেতর থেকে নিয়ে এল বড় একটা ছুরি, সঙ্গে আরও কিছু বাসনপত্র, আর একটা চোঙামতন মাটির জিনিস। সেটাকেও প্রথমে একটা বাসনই ভেবেছিল পিয়া। তার পরে দেখল জিনিসটার গায়ে একদিকে গোলমতো একটা গর্ত করা আছে। শেষে যখন তার মধ্যে টুকরো টুকরো জ্বালুনি কাঠ গুঁজে দিল ফকির, তখন পিয়া বুঝল ওটা আসলে একটা স্টোভ, মাটির তৈরি। স্টোভটাকে নৌকোর পেছনের দিকে তুলে নিয়ে গেল ফকির। ছইয়ের থেকে বেশ খানিকটা দূরে রেখে তাতে আগুন দিল, তারপর হাওয়া দিয়ে দিয়ে গনগনে আঁচ তুলল। এবার খানিকটা চাল ভাল করে ধুয়ে জলটা একটা তোবড়ানো টিনের পাত্রের মধ্যে ঢালল। তারপর চালটাতে আবার খানিকটা জল দিয়ে আগুনে বসাল সেটাকে। খানিক পরে হাঁড়িতে যখন টগবগ শব্দ উঠল, তখন কঁকড়াগুলোকে নিয়ে বসল ফকির। টুকরো টুকরো করে কেটে, দাঁড়াগুলো ছুরি দিয়ে ভেঙে ভেঙে নিল। ভাত হয়ে যাওয়ার পর হাঁড়ি নামিয়ে আরেকটা কালচে রঙের অ্যালুমিনিয়ামের পাত্র বসাল সেখানে। তারপর একটা তোবড়ানো টিনের কৌটো থেকে পাঁচ-সাতটা ছোট ছোট কাগজের পুঁটলি বের করল। পুঁটলিগুলো খুলে খুলে পর পর গোল করে সাজিয়ে রাখল স্টোভটার সামনে। দাউ দাউ আগুনের আভায় পিয়া দেখল বিভিন্ন রঙের সব মশলা রাখা আছে মোড়কগুলির মধ্যে কোনওটা লাল, কোনওটা হলুদ, কোনওটা তামাটে। আগুনে বসানো পাত্রটার মধ্যে খানিকটা তেল ঢালল ফকির, তারপর মশলার মোড়কগুলির ওপরে ওর হাত যেন উড়ে বেড়াতে লাগল পাখির মতো। একের পর এক মশলা ছিটিয়ে দিতে থাকল ফুটন্ত তেলে হলুদ, লঙ্কা, ধনে, জিরে।
রান্নার গন্ধটা ঝাঁঝালো লাগছিল পিয়ার নাকে। অনেকদিন এরকম খাবার খায়নি ও। ফিল্ডে থাকলে তো এমনিতে প্যাকেট, ক্যান বা বোতলের জিনিস ছাড়া কিছু মুখেই দেয় না। বছর তিনেক আগে ফিলিপাইন্সের মালাম্পায়া সাউন্ডে কাজ করার সময় একবার অসাবধান হয়েছিল ও। ফল হয়েছিল মারাত্মক। প্রায় বেহুশ অবস্থায় হেলিকপ্টারে করে ওকে তুলে নিয়ে যেতে হয়েছিল ম্যানিলায়, চিকিৎসার জন্য। তারপর থেকে সার্ভেতে গেলেই সব সময় নিজের সঙ্গে খাদ্য-পানীয়ের একটা জোগান রাখে পিয়া। যথেষ্ট পরিমাণে মিনারেল ওয়াটার, আর হালকা কিছু খাবার। প্রধানত হাই-প্রোটিন নিউট্রিশন বার। কখনও কখনও গুঁড়ো দুধ বা ওভালটিন জাতীয় পাউডারও রাখে। দুধ খাওয়ার একান্ত দরকার পড়লে সেটা গুলে নেয়। তা না হলে দিনে গোটা দুয়েক প্রোটিন বারেই ওর চলে যায়। তার একটা বাড়তি সুবিধাও আছে। এতে করে অজানা-অচেনা জায়গায় জঘন্য সব বাথরুম ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় কম।
আগুনের সামনে বসে ফকিরের রান্না করা দেখতে দেখতে বেশ বুঝতে পারছিল পিয়া যে রান্না শেষ হলেই ওকে খেতে বলবে ফকির। কিন্তু এই খাবার তো পিয়া খাবে না। তবু, রান্নার ঝাঝালো গন্ধে গা গুলিয়ে উঠলেও, মশলার মোড়কের ওপর দিয়ে উড়ে বেড়ানো ফকিরের আঙুলগুলির দিক থেকে চোখ সরাতে পারছিল না পিয়া। মনে হচ্ছিল ও যেন আবার সেই ছোট্ট পিয়া হয়ে গেছে, পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে ডিঙি মেরে দেখছে স্টোভের পাশে রান্নার তাকের ওপর পর পর সাজানো সব স্টেনলৈস স্টিলের বাসন, যেন ও দেখছে ওর মায়ের আঙুল, মশলার রং আর আগুনের আভার মধ্যে ছুটে বেড়াচ্ছে এদিক থেকে ওদিক। ছেলেবেলার এই ছবিটা হারিয়েই গিয়েছিল পিয়ার মন থেকে। আর সে ছবি যে সুন্দরবনের নদীতে এই নৌকোর ওপর এভাবে ফিরে আসবে সে কথা ও কখনও স্বপ্নেও ভাবেনি।
এই ঝাঝালো গন্ধগুলোই এক সময় কত চেনা ছিল পিয়ার। এগুলিই ছিল ওর বাড়ির গন্ধ। সব সময় এই গন্ধই ও পেত মায়ের গায়ে; স্কুল থেকে ফেরার পথে, ফ্ল্যাটের লিফটে উঠতে উঠতে–সারাক্ষণ এ গন্ধগুলো নাকে লেগে থাকত পিয়ার। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেই দৌড়ে আসত গন্ধগুলো পোষা প্রাণীর মতো। ফ্ল্যাটের বদ্ধ গরম হাওয়ায় যেন পুষ্টি পেত ওরা। পিয়া কল্পনা করত রান্নাঘরটা যেন ওদের খাঁচা, ওখানেই ওরা খায়-দায়, ঘুমোয়। তাই খেলার মাঠে লোকের আলগোছ মন্তব্য বা বন্ধুদের খোঁচা-মারা রসিকতায় পিয়া যখন বুঝতে পারত যে অদৃশ্য পোষা প্রাণীর মতো গন্ধগুলি সব সময় ওর পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়ায়, তখন রীতিমতো চমকে যেত ও। এক সময় পিয়ার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। লড়াই শুরু করল ও–এই গন্ধগুলির বিরুদ্ধে, ওর মায়ের বিরুদ্ধে। দীর্ঘ, শান্ত, নাছোড়বান্দা লড়াই। রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করে সেখানেই ও ওদের আটকে রাখতে চেষ্টা করত।
কিন্তু এখানে এই নৌকোর ওপরে চারপাশের পরিবেশ যেন শান্ত করে রেখেছে ওই পোষা গন্ধের ভূতগুলোকে। ফকিরের আঙুলগুলোর চলনে প্রায় সম্মোহিত হয়ে গেছে। পিয়া। কেবল একেকটা হাওয়ার দমকে যখন লঙ্কার তীব্র ঝাঁঝ সরাসরি ওর নাকে এসে ঝাঁপটা মারছে, তখনই শুধু মুহূর্তের জন্য কেটে যাচ্ছে সে সম্মোহনের ঘোর। হঠাৎ করে তখন যেন জেগে উঠছে ভূতগুলো, তীক্ষ্ণ নখে চিরে দিচ্ছে ওর গলা আর চোখ–যেন ও কোনও শত্রুপক্ষের লোক, হঠাৎ সীমান্ত পেরিয়ে চলে এসেছে এখানে। আস্তে আস্তে নৌকোর সামনের দিকটায় সরে গেল পিয়া। একটু পরে ফকির যখন এগিয়ে এসে ভাতের থালা বাড়িয়ে দিল, তখন জলের বোতল আর প্রোটিন বারগুলোর দিকে দেখিয়ে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে হেসে মাথা নাড়ল ও। হাবেভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল, ফকির কিছু যেন মনে না করে।
কিন্তু ফকির যেন জানতই যে ওই খাবার ও খাবে না। একটু অবাক হল পিয়া। ও ভেবেছিল প্রতিবাদ করবে ফকির, আশ্চর্য হবে, কতটা আহত হয়েছে সেটা বোঝানোর চেষ্টা করবে, কিন্তু সেসব কিছুই করল না ও। একবার মাথা নাড়ল শুধু, আর খানিকক্ষণ চেয়ে রইল পিয়ার দিকে, যেন যাচাই করার দৃষ্টিতে। মনে হল নিজের মনে একটা লিস্টিতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে ও, বোঝার চেষ্টা করছে কী কী কারণে ওর আনা খাবার ফিরিয়ে দিতে পারে পিয়া। পিয়ার আশঙ্কা হল ফকির হয়তো ভাবছে জাত-পাত বা ওই রকম কোনও রহস্যময় কারণে ও খাচ্ছে না ওই খাবার। তাই নিজের পেটে হাত রেখে খানিকটা শরীর খারাপের অভিনয় করে দেখাল ও কাজ হল তাতে। হেসে ফেলল ফকির। তারপর থালাটা দিয়ে দিল ছেলের হাতে। সেটা হাতে নিয়ে লোভীর মতো সাপটে সুপটে ভাত ক’টা খেয়ে নিল টুটুল।
খাওয়া-দাওয়া হলে বাসনপত্র আর স্টোভটা নিয়ে ফের তক্তার নীচে রেখে দিল ফকির। কয়েকটা মাদুর আর চাদর বের করে আনল সেখান থেকে। এর মধ্যেই ঝিমোতে শুরু করেছিল টুটুল। ছইয়ের নীচে একটা মাদুর পেতে নিয়ে মাথা অবধি চাদর মুড়ি দিয়ে খানিকক্ষণের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল ও। তার পাশেই আরেকটা মাদুর পেতে দিয়ে সেটার দিকে ইশারা করল ফকির। রাতের জন্য ওখানেই ও পিয়ার শোয়ার ব্যবস্থা করছে। কিন্তু পিয়ার নিজেরই একটা মাদুর রয়েছে সঙ্গে। নীল রঙের পাতলা ফোম একটা, পিঠব্যাগের ফ্রেমের সঙ্গে বাঁধা। ইলাস্টিকের দড়িটা খুলে নৌকোর ওপর সেটা পেতে নিল পিয়া। মাথার দিকটা রাখল নৌকোর মুখের সরু জায়গাটার কাছাকাছি।
পিয়াকে ওইখানে রাতের জন্য শোয়ার বন্দোবস্ত করতে দেখে অস্থির হয়ে উঠল ফকির। বারবার মাথা নেড়ে দূরের জঙ্গলের দিকে ইশারা করতে লাগল হাত দিয়ে। ফকিরের ইঙ্গিতটা মনে হল ইচ্ছাকৃতভাবে খানিকটা অস্পষ্ট। পিয়া অনুমান করল কোনও জংলি জানোয়ারের ভয় পাচ্ছে ও। কোনও হিংস্র জন্তুর ভয়। এতক্ষণে একটু একটু বুঝতে পারছিল ও কেন এরকম একটা অদ্ভুত জায়গায় এনে নৌকোটাকে রেখেছে ফকির। মাঝরাতে যাতে বাঘ এসে হানা দিতে না পারে সেই জন্য মনে হয়। স্থলচর মাংসাশী প্রাণীদের নিয়ে পিয়া কখনও বিশেষ চর্চা করেনি বটে, কিন্তু যত খিদেই পাক শিকারের জন্য পাড় থেকে এতটা দূরে কোনও জন্তু সাঁতরে আসতে পারে বলে মনে হল না ওর। আর চলেই যদি আসে, তা হলে ছইয়ের নীচেই শোও কি বাইরেই শোও, খুব একটা তফাত কি হবে? এ নৌকোর যা ছিরি, একটা বাঘ উঠে এলে তার ভারে সবসুদ্ধই উলটে যাবে মনে হয়।
সব কিছু মিলিয়ে ব্যাপারটা এমন অদ্ভুত অবাস্তব ঠেকল, যে হেসে ফেলল পিয়া। ফকিরকেও মজার ভাগ দেওয়ার জন্য ও হাতের আঙুলগুলো বাঁকিয়ে বাঘের মতো হিংস্র মুখভঙ্গি করে এগিয়ে গেল ওর দিকে। কিন্তু ফকির দু হাত দিয়ে ওর কবজি চেপে ধরল; আর প্রচণ্ড মাথা নাড়াতে লাগল। মনে হল কোনওভাবে ওই প্রসঙ্গটা তুলতেই ও বারণ করছে। তখনকার মতো ব্যাপারটাকে আর না ঘাঁটানোই স্থির করল পিয়া। হাত দিয়ে নিজের মাদুরটাকে টানটান করে নিয়ে শুয়ে পড়ল তার ওপর। মনে হল এটাই ফকিরকে বোঝানোর সবচেয়ে সহজ উপায় যে, কোনও জলচর শ্বাপদের ভয়ে ওই ছইয়ের নীচে গাদাগাদি করে রাত কাটানো ওর পক্ষে সম্ভব নয়। ও আর প্রতিবাদ করল না দেখে স্বস্তি পেল পিয়া। ছইয়ের ভেতর থেকে একটা শাড়ি নিয়ে সেটাকে ভাজ করে বালিশ বানিয়ে এনে দিল ফকির। সঙ্গে একটা তেলচিটে ময়লা চাদর।
তারপর নৌকোর মাঝের দিকে গিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে বসে একটা বিড়ি ধরাল ফকির। একটু পরেই আধো তন্দ্রায় পিয়ার কানে একটা গানের সুর ভেসে এল। ফকির গুনগুন করছে। কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে পড়ল পিয়া। বলল, “সিং”। একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ওর দিকে খানিক চেয়ে রইল ফকির। এবার পিয়া দু হাত ওপরের দিকে তুলে ইশারা করে বলল, “লাউডার। সিং লাউডার”।
বুঝল ফকির। মাথাটা পেছনে হেলিয়ে গাইল দু’ কলি। সুরটা শুনে অবাক হয়ে গেল পিয়া। এক্কেবারে অন্যরকম। এর আগে যেসব ভারতীয় গান ও শুনেছে–ওর বাবার প্রিয় হিন্দি ফিল্মের গান, আর মায়ের গলায় দুয়েকটা বাংলা গান–সেগুলোর সঙ্গে এই সুরটার কোনও মিলই নেই। ফকিরের গলা যে খুব ভাল তা বলা চলে না, একটু কর্কশই; খাদে বা চড়ায় সুর ধরে রাখতে পারছিল না ঠিক, কিন্তু সুরটার মধ্যে কেমন যেন একটা বিষণ্ণতার ছোঁয়া লেগে রয়েছে। পিয়াকে ভেতরে ভেতরে নাড়া দিয়ে গেল সেটা।
এতক্ষণ পিয়ার মনে হচ্ছিল ফকিরের ওই পেশল চেহারার মধ্যে একটা সরল নিষ্পাপ ভাব রয়েছে, যেটা মনকে টানে। কিন্তু এখন এই গান শোনার পর পিয়ার মনে হল ও নিজেই কি একটু বেশি সরল তা হলে? ওর জানতে ইচ্ছে করছিল গানটা কী নিয়ে, গানের কথাগুলোর কী মানে; কিন্তু এই সুরের বেদনা আজ এখানে মনের কোন তার কীভাবে ছুঁয়ে গেল, এক নদী শব্দ খরচ করেও যে তা ঠিকমতো বোঝানো যাবে না সেটাও বেশ বুঝতে পারছিল পিয়া।