পতন
সন্ধে প্রায় ঘনিয়ে এসেছে, এমন সময় দূরে একটা নৌকো নজরে এল পিয়ার। শুরুতে একেবারে বিন্দুর মতো দেখা যাচ্ছিল নৌকোটাকে–দিগন্তের কাছে অনেকগুলি নদীর মোহনায় যেন স্থির একটা কালো দাগ। খানিক বাদে দাগটা একটু বড় হতে বোঝা গেল সেটা একটা ছইওয়ালা ছোট্ট মাছধরা ডিঙি। দুরবিন চোখে লাগিয়ে একজনই মাত্র জেলেকে দেখতে পাচ্ছিল পিয়া। নৌকোর ওপর সোজা দাঁড়িয়ে লোকটা একটা জাল ছুঁড়ে দিচ্ছে, একটু পরে আবার নিচু হয়ে টেনে টেনে তুলছে।
তিন ঘণ্টা হয়ে গেল লঞ্চের সামনের দিকটায় ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে পিয়া। দূরবিনটা একবারও নামায়নি চোখ থেকে, জলের দিকে চেয়ে অপেক্ষা করেছে যদি একটা শুশুক কোথাও দেখা যায়। তবে লাভ কিছু হয়নি এখনও পর্যন্ত। একবার মুহূর্তের জন্য একটু আশা জেগেছিল, কিন্তু শেষপর্যন্ত দেখা গেল জল থেকে যেটা লাফিয়ে উঠেছে সেটা আসলে একটা শংকর মাছ। শূন্যের মধ্যে লেজওয়ালা প্রাণীটাকে মনে হচ্ছিল যেন একটা উড়ন্ত ঘুড়ি। তার মিনিট দুয়েক পরেই হঠাৎ ভীষণ উত্তেজিত হয়ে ওপরে দৌড়ে এল মেজদা। ওর প্রপেলারের মতো হাত-পা নাড়া দেখে পিয়ার মনে হল নিশ্চয়ই শুশুক-টুশুক কিছু একটা দেখতে পেয়েছে। কিন্তু এবারেও ব্যর্থ আশা। পাড়ে শুয়ে রোদ পোয়ানো কয়েকটা কুমির দেখানোর জন্যে দৌড়ে এসেছে মেজদা। তবে ওর উৎসাহের কারণটা বোঝা গেল এর পর। ডান হাতের তর্জনী আর বুড়ো আঙুলে ইশারা করে ও জানাল এই গুরুদায়িত্ব সম্পাদনের জন্যে কিছু বকশিস লাগবে। খুব রাগ হল পিয়ার। বিরক্ত একটা ভঙ্গি করে ও বুঝিয়ে দিল বকশিস-টকশিস কিছু হবে না।
মেজদা দেখানোর অনেক আগেই কুমিরগুলো নজরে এসেছিল পিয়ার। দূরবিন দিয়ে বেশ কয়েক কিলোমিটার দূর থেকেই ওদের দেখতে পেয়েছিল ও। দানবের মতো বিশাল চারখানা সরীসৃপ, সবচেয়ে বড়টা লম্বায় প্রায় এই লঞ্চটার সমান। এগুলির একটার মুখোমুখি পড়লে কী যে হবে ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল পিয়ার।
কুমির আর শংকরমাছ ছাড়া এই তিন ঘণ্টায় আর কিছুই চোখে পড়ল না। কিছু যে দেখা যাবেই ঠিক সেরকম যে আশা করেছিল পিয়া তা নয়, তবে সারা দুপুরটা এইরকম নিষ্ফলা যাবে তাও ভাবেনি। এই অঞ্চলের নদীতে একসময় যে প্রচুর শুশুক ছিল সে বিষয়ে তো কোনও সন্দেহ নেই। ঊনবিংশ শতকের অনেক প্রাণিবিজ্ঞানীই এদের বিষয়ে লিখে গেছেন। গ্যাঞ্জেটিক ডলফিনের আবিষ্কর্তা’ উইলিয়াম রক্সবার্গের লেখায় রয়েছে, মিষ্টিজলের শুশুকরা “কলকাতার দক্ষিণ এবং দক্ষিণপূর্বের নদী-খাড়িগুলিতে থাকতে পছন্দ করে”। অথচ এই অঞ্চলটাতেই এতক্ষণ ঘোরাঘুরি করেও কিছুই চোখে পড়ল না। পিয়া ভেবেছিল পথে কোনও পোড়-খাওয়া জেলের সঙ্গে দেখা হলেও কিছু খোঁজখবর হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু সেরকম জেলে নৌকোও খুব বেশি নজরে পড়েনি আজ সারাদিনে। ভিড়ে ঠাসা খেয়া
নৌকো আর স্টিমার দেখা গেছে বেশ কয়েকটা, তবে জেলে নৌকো এতই কম চোখে পড়েছে যে একেক সময় মনে হয়েছে হয়তো এই অঞ্চলে মাছ ধরা নিষেধ। এই জেলে ডিঙিটা তো, দেখা গেল বেশ অনেকক্ষণ পর। ওরা মনে হয় নৌকোটার কয়েকশো মিটার মাত্র দূর দিয়ে যাবে। লঞ্চটা একটু ঘুরিয়ে ওটার কাছাকাছি নিয়ে যেতে বলবে কিনা ভাবছিল পিয়া।
বেল্ট থেকে রেঞ্জফাইন্ডারটা খুলে হাতে নিল ও। খানিকটা দূরবিনের মতো দেখতে যন্ত্রটার একদিকে দুটো আইপিস, আর অন্যদিকে একটা সাইক্লোপিয়ান লেন্স। ডিঙিটার দিকে ফোকাস করে একটা বোতাম টিপল, কয়েক মুহূর্ত পরেই বিপ করে একটা আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে নৌকো আর লঞ্চের মধ্যের দূরত্বটা ভেসে উঠল যন্ত্রের পর্দায়–১.১ কিলোমিটার।
ডিঙির ওপর মাছ ধরতে ব্যস্ত লোকটাকে এতদূর থেকে খুব একটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু ও যে পাকা জেলে সেটা দিব্যি বোঝা যাচ্ছিল। থুতনি আর গালে সাদা ছোপ ছোপ দুরবিন দিয়ে দেখে মনে হল খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি। মাথায় পাগড়ি মতো কিছু একটা জড়ানো, কিন্তু সারা গা খালি; শুধু কোমরে একটুকরো কাপড় মালকেঁচার মতো করে বাঁধা। শরীরটা কঙ্কালসার ক্ষয়টে মতো, নোনা হাওয়া আর রোদ্দুরে যেন দেহের সব চর্বি-মাংস খেয়ে গেছে–সারাজীবন জলে জলে কাটালে যেমন হয়। অন্য অনেক নদীতে এরকম জেলেদের দেখেছে পিয়া, এদের কাছ থেকেই বেশিরভাগ সময় ভাল খোঁজখবর পাওয়া যায়। ও ঠিক করল একটু ঘুরে গিয়ে লোকটাকে একবার ওর ফ্ল্যাশকার্ডগুলো দেখিয়ে নেবে। যদি কিছু লাভ হয়।
এর আগেও দু’বার পিয়া মেজদাকে এদিকে-সেদিকে লঞ্চ ঘোরাতে বলেছিল, কিন্তু ওই কুমিরের ব্যাপারটার পর থেকে কীরকম একটু তিরিক্ষি হয়ে আছে লোকটা। আর বিশেষ পাত্তা-টাত্তা দিচ্ছে না ওকে। কিন্তু এবারে পিয়া ঠিক করেছে যে-কোনও ভাবেই হোক লঞ্চটাকে নিয়ে যাবে ওই নৌকোর কাছে।
কাঁচ-লাগানো সারেংএর ঘরটার মধ্যে পাশাপাশি বসেছিল মেজদা আর গার্ড–মেজদার হাতে স্টিয়ারিং। লঞ্চের সামনের দিকটা থেকে সরে এসে ওদের দিকে এগোল পিয়া। ওকে দেখেই চট করে চোখটা নামিয়ে নিল মেজদা। ওর চোর চোর ভাবটা দেখে পরিষ্কার বোঝা গেল ওকে নিয়েই ওরা আলোচনা করছিল এতক্ষণ।
একটা ফ্ল্যাশকার্ড বার করে সারেং-এর ঘরের সামনে এসে মেজদার ঠিক মুখোমুখি দাঁড়াল পিয়া। কাঁচের ওপর একটা হাত রেখে বলল, “স্টপ!” ওর আঙুল বরাবর তাকাতেই দূরের ডিঙি নৌকোটার দিকে নজর পড়ল মেজদার; ডিঙিটাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এখন। “ওই দিকে চলুন–ওই নৌকোটার দিকে। এই ছবিটা ও চিনতে পারে কিনা দেখব,” হাতের কার্ডটা তুলে দেখাল পিয়া।
সঙ্গে সঙ্গে দড়াম করে খুলে গেল সারেং-এর ঘরের দরজাটা, আর খাকি প্যান্টটা টেনে তুলতে তুলতে বাইরে বেরিয়ে এল ফরেস্ট গার্ড। ডেকের সামনের দিকে লঞ্চের একেবারে কিনারায় গিয়ে দাঁড়াল লোকটা, এক হাতে রোদ্দুর আড়াল করে ঝুঁকে পড়ে ডিঙিটার দিকে তাকিয়ে রইল। দেখতে দেখতে ভুরু কুঁচকে উঠল গার্ডের, বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল সারেংকে। দু’জনে কী বলাবলি করল খানিকক্ষণ, তারপরে মাথা নেড়ে তাড়াতাড়ি স্টিয়ারিং ঘোরাল মেজদা। আস্তে আস্তে লঞ্চের মুখ ঘুরতে লাগল ডিঙিটার দিকে।
“গুড,” খুশি হল পিয়া। কিন্তু গার্ডটা কোনও পাত্তাই দিল না ওকে। তার সমস্ত মনোযোগ এখন ওই নৌকোটার দিকে। লোকটার হাবভাবের একাগ্রতা দেখে একটু আশ্চর্য হল পিয়া। কেমন একটা হিংস্র ভাব ওর চোখেমুখে। দেখে একটুও মনে হল না যে স্রেফ পিয়ার কথা রাখার জন্যই নৌকোটার দিকে যাচ্ছে ওরা।
ডিঙির জেলেটা তখন আরেকবার জাল ফেলার জন্য তৈরি হচ্ছে। নৌকো একই জায়গায় স্থির, একটু একটু করে আকারে বড় হয়ে উঠছে। এখনও এক কিলোমিটারের বেশি দূরে রয়েছে ডিঙিটা।
লঞ্চের মুখ ঘোরার পর একবারও ওটার দিক থেকে দূরবিন সরায়নি পিয়া। জেলেটা এতক্ষণ খেয়াল করেনি ওদের, কিন্তু লঞ্চের দিক বদলানোর সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল টের পেল ও, সতর্ক হয়ে বন্ধ করল জাল ফেলা। ঘুরে তাকাল ওদের দিকে, চোখেমুখে ভয়ের ছাপ। দূরবিন দিয়ে ওর চোখদুটো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল পিয়া। পাশের দিকে মুখ ফেরাল লোকটা, ঠোঁটদুটো নড়ে উঠল, মনে হল কাউকে কিছু বলছে। পাশে ফোকাস করে পিয়া দেখল ও একা নয়, আরও একজন আছে ডিঙিটাতে। একটা বাচ্চা ছেলে, হয়তো নাতি বা ভাইপো-ভাগনে কেউ হবে। ডিঙির আগায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে বাচ্চাটা। পিয়ার মনে হল ও-ই লঞ্চটা দেখতে পেয়ে লোকটাকে বলেছে। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে এখনও লঞ্চটারই দিকে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে ছেলেটা।
দুজনেই ওরা খুব ভয় পেয়েছে মনে হল। লোকটা তাড়াতাড়ি ভেতর থেকে একজোড়া বৈঠা বের করে ঊর্ধ্বশ্বাসে নৌকো বাইতে শুরু করল, আর ছেলেটা দৌড়ে ডিঙির পেছন দিকে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল ছইয়ের আড়ালে। মিটার পঞ্চাশেক দূরের সরু একটা খাঁড়ির মুখের দিকে এখন সোজা এগোচ্ছে নৌকোটা। ভরা জোয়ারের সময় খাঁড়ির দু’ ধারের ঘন জঙ্গল অর্ধেক ডুবে আছে জলে, আর একবার যদি সে বনের মধ্যে সেঁধিয়ে যেতে পারে, কোনও লঞ্চের সাধ্য হবে না ওই খুদে ডিঙিকে খুঁজে বের করে। জল এখন বেশ গভীর, নৌকোটা খুব সহজেই জঙ্গলের আড়ালে আড়ালে পালাতে পারবে।
ব্যাপারটা বেশ একটু অদ্ভুত লাগল পিয়ার। ইরাবড়ি বা মেকং-এ ও অনেক সময় দেখেছে যে জেলেদের সাথে কথা বলতে গেলে তারা অচেনা লোক বা সরকারি লোকেদের দেখে ভয় পেয়েছে, কিন্তু কোনও জেলেই কখনও ডিঙি নিয়ে পালানোর চেষ্টা করেনি।
ডানদিকে মুখ ফিরিয়ে পিয়া দেখল লঞ্চের সামনের দিকে দাঁড়িয়ে আছে ফরেস্ট গার্ড–কাঁধে রাইফেল। পিয়া যখন একদৃষ্টে নৌকোটার দিকে দেখছিল সেই সময়ে ভেতরে গিয়ে বন্দুকটা নিয়ে এসেছে ও। এতক্ষণে বোঝা গেল কেন পালাচ্ছে ডিঙিটা। পিয়া গার্ডের দিকে ফিরল। আঙুল দিয়ে বন্দুকটাতে খোঁচা মেরে বলল, “এটা কেন এনেছেন? কী করবেন রাইফেল দিয়ে? যান, রেখে আসুন ওটা।” ঝটকা মেরে পিয়ার হাতটা সরিয়ে দিয়ে লোকটা মেজদাকে চেঁচিয়ে কী একটা বলল। সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিনের ধকধকানি বেড়ে গেল, আর তিরবেগে লঞ্চটা এগিয়ে চলল নৌকোর দিকে।
পিয়া বুঝতে পারল ওর নিজেরই শুরু করা ঘটনাক্রম এখন আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। কী যে হচ্ছে, সেটাই ভাল করে মাথায় ঢুকছিল না। এক হতে পারে এটা নিষিদ্ধ এলাকা আর ওই জেলে বেআইনিভাবে মাছ ধরছিল, তাই ফরেস্ট গার্ড ওকে তাড়া করেছে। তাই যদি হয় তা হলে যে-কোনও ভাবেই হোক এই ইঁদুর-বেড়াল খেলাটা এক্ষুনি বন্ধ করতে হবে। কারণ একবার যদি খবর রটে যায় যে ও স্থানীয় লোকেদের পেছনে লেগেছে, সার্ভের কাজের একেবারে বারোটা বেজে যাবে।
সারেং-এর ঘরের দিকে ফিরে ও মেজদাকে বলল, “লঞ্চ থামান, আর যেতে হবে না। থামুন বলছি।” কথাটা শেষ করে কেবিনটার দিকে এগোতে গিয়েই শুনল ফরেস্ট গার্ড চিৎকার করে নৌকোর জেলেটাকে ধমকাচ্ছে। ওদিকে চেয়ে দেখল রাইফেলটা কাঁধের কাছে তুলে ধরে ডিঙির দিকে তাক করছে লোকটা, মনে হল যে-কোনও সময়ে গুলি চালিয়ে দেবে।
মাথায় রক্ত উঠে গেল পিয়ার। “ভেবেছেনটা কী আপনারা? যা ইচ্ছে তাই করবেন নাকি?” দৌড়ে গিয়ে একহাত দিয়ে গার্ডের কনুই ধরে আরেক হাতে বন্দুকের নলটা অন্যদিকে ঠেলে দিতে চেষ্টা করল ও। কিন্তু লোকটা অনেক বেশি ক্ষিপ্র। কিছু বোঝার আগেই ওকে কনুই দিয়ে প্রচণ্ড একটা গুতো মারল কাঁধের হাড়টার কাছে। ছিটকে পড়ল পিয়া ডেকের ওপর, হাত থেকে ডিসপ্লে কার্ডটা উড়ে গিয়ে পড়ল খানিকটা দূরে।
ডিঙির লোকটা ওদিকে দাঁড় টানা থামিয়ে দিয়েছে। মেজদাও লঞ্চের ইঞ্জিন বন্ধ করল। হঠাৎ করে যেন চারপাশটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। ধীরে ধীরে নৌকোর পাশে গিয়ে স্থির হল লঞ্চটা। চেঁচিয়ে কিছু একটা বলে গার্ড ডিঙিটার ওপর একটা দড়ি ছুঁড়ে দিল। দড়িটা ধরে নিয়ে নৌকোর সঙ্গে বেঁধে দিল জেলেটা। পিয়া দেখতে পেল ছইয়ের আড়ালের আবছা অন্ধকার থেকে জুলজুল করে তাকিয়ে রয়েছে বাচ্চাটা।
গার্ডের ধমক খেয়ে বিড়বিড় করে কী যেন একটা বলল নৌকোর লোকটা। জবাবটা মনোমতো হয়েছে মনে হল, কারণ মেজদার দিকে ফিরে একটা আত্মতৃপ্তির হাসি হাসল গার্ড। তারপর খানিক গুজগুজ করে কী সব বলাবলি করল দু’জনে, শেষে পিয়ার সামনে এসে ফরেস্ট গার্ড খানিকটা অভিযোগের সুরে বলল, “পোচার”।
“কী?” একেবারে হাঁ হয়ে গেল পিয়া। বলে কী লোকটা? এ তো রাতকে দিন করে দিতে পারে! মাথা নেড়ে ও বলল, “হতেই পারে না। ও স্রেফ মাছ ধরছিল।”
“পোচার”, গার্ড তার বক্তব্যে অনড়। রাইফেল দিয়ে জেলেটার দিকে দেখিয়ে আবার বলল, “পোচার”।
কী ঘটেছে এতক্ষণে বুঝতে পারছিল পিয়া। এই লোকটা নিশ্চয়ই নিষিদ্ধ এলাকায় মাছ ধরছিল; এমন একটা জায়গাও তাই বেছে নিয়েছিল দরকার হলে যেখান থেকে খুব সহজেই পালানো যেতে পারে। পিয়াদের লঞ্চটাকে ও মনে হয় ভেবেছিল সাধারণ টুরিস্ট লঞ্চ, তার মধ্যে যে একজন সশস্ত্র ফরেস্ট গার্ড থাকতে পারে সেটা বুঝতে পারেনি। এখন বাঁচতে হলে ওকে হয় ফাইন দিতে হবে, নয়তো ঘুষ দিতে হবে।
ক্লান্ত চেহারার লোকটা দাঁড়ে ভর দিয়ে খাড়া দাঁড়িয়েছিল নৌকোর ওপর। কাছ থেকে ওকে দেখে চমকে গেল পিয়া। দুরবিন দিয়ে দেখে যেরকম মনে হয়েছিল লোকটা আদৌ সেরকম সাদা দাড়িওয়ালা বুড়ো নয়। বয়সে ওর কাছাকাছিই হবে, খুব বেশি হলে সাতাশ-আটাশ। শরীরের কাঠামোটাও মোটেই ক্ষয়টে ধরনের নয়, শুধু একটু বেশি রোগা। লম্বা লম্বা হাত-পাগুলোতে এতটুকু চর্বি বা বাড়তি মাংসের চিহ্ন নেই, হাড়ের ওপর দড়ির মতো পাকিয়ে পাকিয়ে আছে পেশিগুলো। দূর থেকে যেগুলোকে দেখে পিয়া পাকা দাড়ি ভেবেছিল, সেই সাদা সাদা কুচিগুলো আসলে শুকনো নুনের গুঁড়ো–সারাদিন নোনা জলের ওপর কাটানোর ফল। লোকটার মুখটা সরু তিনকোনা মতো, আর এত ভীষণ রোগা যে তার ওপর চোখগুলোকে বিশাল বড় বড় মনে হচ্ছে। হতদরিদ্র চেহারাটা আরও ফুটে বেরোচ্ছে কোমরে জড়ানো আধময়লা ত্যানাটার জন্য। তবু ওর এই আপাত প্রতিরোধহীন হাড়-বেরোনো চেহারার মধ্যেও কোথাও একটা বিদ্রোহের ভাব রয়েছে মনে হল পিয়ার। একটু সতর্ক চোখে গার্ডের দিকে তাকিয়ে দেখছে লোকটা, যেন কত টাকা খোয়াতে হবে সেটা আঁচ করার চেষ্টা করছে। অন্তত এক সপ্তাহের রোজগার তো হবেই, মনে মনে ভাবল পিয়া; এক মাসেরও হতে পারে।
লঞ্চের ডেকের ওপর থেকে ডিসপ্লে কার্ডটা তুলে নিল ফরেস্ট গার্ড–মনে হল যেন পিয়ার এখানে কী কর্তব্য সেটা খেয়াল করিয়ে দিতে চায় ওকে। শিকার জালে পড়ে গেছে, তাই ওর ভাবভঙ্গিতে আর ব্যস্ততার চিহ্নমাত্র নেই। ধীরেসুস্থে কার্ডটা পিয়ার হাতে দিয়ে নৌকোর দিকে ইশারা করল জেলেটাকে একবার দেখিয়ে নেওয়ার জন্য।
লোকটা ওকে ওর কাজ চালিয়ে যেতে বলছে, যেন কিছুই ঘটেনি! ব্যাপারটা বিশ্বাসই করতে পারছিল না পিয়া। মাথা নেড়ে হাত সরিয়ে নিল ও। কিন্তু নিরস্ত না হয়ে আবার কার্ডটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিল গার্ড। ওর হাতের সঙ্গে সঙ্গে এবার বন্দুকটাও মনে হল এগিয়ে এল, যেন গুঁতিয়ে ওকে পাঠাবে জেলেটার দিকে। “ঠিক আছে তা হলে,” কাঁধ আঁকাল পিয়া। কোমর থেকে যন্ত্রপাতির বেল্টটা খুলে নিল ও, তারপর দূরবিন-টুরবিন সুদ্ধ ওটাকে ঠেসে ঢোকাল পিঠব্যাগটার মধ্যে। ডিসপ্লে কার্ডটা তুলে নিয়ে লঞ্চের মুখের দিকে এগিয়ে গেল। পিয়ার ঠিক নীচে এখন নৌকোটা, লঞ্চের একেবারে গায়ের কাছে দড়ি দিয়ে বাঁধা। জেলেটার মুখটা ঠিক ওর হাঁটুর সামনে।
হঠাৎ মুখের সামনে পিয়াকে দেখে যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠল লোকটা। এতক্ষণ আসলে ওর সমস্ত মনোযোগটাই ছিল গার্ডের দিকে, লঞ্চে যে কোনও মহিলা থাকতে পারে সেটা ভাবতেই পারেনি। এখন পিয়াকে দেখতে পেয়ে হঠাৎই ও আত্মসচেতন হয়ে উঠল। মাথায় যে কাপড়ের টুকরোটা জড়ানো ছিল এক টান মেরে নামিয়ে আনল সেটাকে। গোটানো কাপড়টা খুলে গিয়ে পর্দার মতো গায়ের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। কোমরের কাছে একটা গিট মেরে বেঁধে দেওয়ার পর পিয়া বুঝতে পারল এতক্ষণ যে পাকানো কাপড়টাকে ও পাগড়ি বলে ভাবছিল সেটা আসলে লুঙ্গি। লোকটার বিবেচনা আছে দেখা যাচ্ছে। আর ওর উপস্থিতিকে স্বীকৃতি দেওয়ার ভাবটাতেও মনে মনে খানিকটা স্বস্তি পেল পিয়া। মনে হল লঞ্চে ওঠার পর থেকে এতক্ষণে এই প্রথম ও একজন স্বাভাবিক মানুষের কাছাকাছি এল। তবে এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতেও কিন্তু ওর মাথার মধ্যে একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে–কখন জেলেটাকে দেখাবে ফ্ল্যাশকার্ডটা।
এক হাঁটু ভাঁজ করে পায়ের ওপর ভর দিয়ে নিচু হয়ে জেলেটার মুখোমুখি বসল পিয়া। দু’জনের মাথা এক উচ্চতায় আসার পর কার্ডটা ওর সামনে ধরল। একটু হাসারও চেষ্টা করল ওকে আশ্বস্ত করার জন্য, কিন্তু কিছুতেই ওর চোখের দিকে তাকাল না লোকটা। তবে ছবিগুলোর দিকে নজর পড়তেই হাত তুলে ও নদীর উজানের দিকে একটা জায়গা দেখিয়ে দিল। এত দ্রুত আর দ্বিধাহীন প্রতিক্রিয়া দেখে পিয়ার একবার মনে হল লোকটা বোধহয় বুঝতে পারেনি ও কী জানতে চাইছে। ব্যাপারটা বোঝার জন্য সরাসরি চোখে চোখে তাকাতেই মাথা নাড়ল ও, যেন বলতে চায়, হ্যাঁ, ঠিক ওই জায়গাতেই এরকম শুশুক দেখেছি আমি। কিন্তু কোন ধরনের শুশুক ও দেখেছে সেটা ঠিক বোঝা গেল না। আবার কার্ডটা এগিয়ে দিল পিয়া, মনে মনে ভাবল নিশ্চয়ই গ্যাঞ্জেটিক ডলফিনের ছবিটার দিকে দেখাবে ও। কারণ এই প্রজাতির শুশুকই বেশি দেখা যায়। কিন্তু আশ্চর্য, লোকটা ইশারা করল অন্য ছবিটার দিকে। মানে ও ইরাবড্ডি ডলফিন দেখেছে এই নদীতে? ওর্কায়েলা ব্রেভিরোসি? এবার মুখ খুলল লোকটা। বাংলায় কী একটা বলে দু’হাতের ছ’টা আঙুল তুলে দেখাল।
“ছ’টা?” পিয়া উত্তেজনা চেপে রাখতে পারছিল না। “তুমি ঠিক দেখেছ?”
হঠাৎ একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজে ওর কথা থেমে গেল। তাকিয়ে দেখল ওদের কথাবার্তার সুযোগ নিয়ে কখন নৌকোটায় নেমে গেছে ফরেস্ট গার্ড। ছইয়ের ভেতর রাখা পোঁটলা-পুঁটলিগুলো হাতের রাইফেলটা নিয়ে নেড়ে-চেড়ে দেখছে। বাচ্চাটা এক কোনায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে, হাত দুটো বুকের কাছে মুঠো করে ধরা। আচমকা যেন ছোঁ মেরে ওকে টেনে তুলল গার্ড। জোর করে আলগা করল মুঠি। দেখা গেল সামান্য কয়েকটা টাকা ওর হাতে, সেগুলোকেই লুকোনোর চেষ্টা করছিল এতক্ষণ। গার্ড ওর কাছ থেকে টাকাগুলো ছিনিয়ে নিয়ে নিজের পকেটে পুরল, তারপর ধীরেসুস্থে লঞ্চে গিয়ে উঠল।
ওপর থেকে দেখতে দেখতে হঠাৎ নিজের কোমরের বেল্টে বাঁধা টাকার ব্যাগটার কথা মনে পড়ল পিয়ার। চুপি চুপি সেটার চেন খুলে একগোছা টাকা বের করে আনল ও। টাকাগুলোকে পাকিয়ে শক্ত করে মুঠোর মধ্যে ধরে অপেক্ষা করতে লাগল লঞ্চটা চালু হওয়ার জন্য। গার্ড পেছন ফিরতেই ঝুঁকে পড়ে হাতটা বাড়িয়ে দিল ও জেলেটার দিকে। প্রায় ফিসফিস করে বলল, “এই যে, এদিকে তাকাও একবার”। কিন্তু ইঞ্জিনের ভটভট শব্দে ওর গলা চাপা পড়ে গেল। চলতে শুরু করেছে লঞ্চ, নৌকো আর লঞ্চের মাঝে জল দেখা যাচ্ছে নীচে, কিন্তু পিয়ার মনে হল আর খানিকটা উঁচুতে দাঁড়াতে পারলেই টাকাটা ছুঁড়ে দিতে পারবে ও। একটা প্লাস্টিকের চেয়ার ছিল কাছে, সেটাকে লঞ্চের ধারে টেনে নিয়ে এল। ওটার ওপর কোনওরকমে ব্যালান্স করে দাঁড়িয়ে ছুঁড়ে দিল টাকাটা নৌকোর দিকে। “এদিকে তাকাও, এদিকে,” বলেই একটা জোরালো হিসহিসে আওয়াজ করল মুখ দিয়ে। এবার শুনতে পেল জেলেটা, চমকে প্রায় লাফিয়ে উঠল। কিন্তু শব্দটা কানে যেতে গার্ডও তিরবেগে দৌড়ে এল ডেকের অন্য প্রান্ত থেকে। লোকটার একটা পা এসে লাগল চেয়ারটায়, আর ভারসাম্য রাখতে না পেরে শূন্যে ছিটকে গেল পিয়া। টের পেল ও পড়ে যাচ্ছে, ঘোলাটে বাদামি জল দ্রুত এগিয়ে আসছে ওর মুখের দিকে।