জেরা

পিয়ারা যখন বোটে গিয়ে উঠল ততক্ষণে ভোর হয়ে এসেছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মেঘার নোঙর তুলে ইঞ্জিন চালু করে দিল হরেন। বলল, যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে সরে পড়া যায় ততই মঙ্গল। বাঘ মারার খবর ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কানে পৌঁছলেই সঙ্গে সঙ্গে ঝামেলা শুরু হয়ে যাবে। তারপর দাঙ্গা, গোলাগুলি, পাইকারি হারে গ্রেফতার–সবই হতে পারে। সেরকম অভিজ্ঞতা আগে হয়েছে হরেনের।

ভটভটির মুখ ঘুরতে শুরু করতেই জামাকাপড় পালটানোর জন্য নিজের কেবিনের দিকে চলল কানাই। আর পিয়া, খানিকটা যেন অভ্যাসের বশে, ওপরের ডেকের সামনে ওর নিজের জায়গার দিকে এগিয়ে গেল। কানাইয়ের মনে হল কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওর ‘নজরদারি’ ফের চালু হয়ে যাবে। কিন্তু কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে কানাই দেখল ডেকের ওপর কেমন যেন গা ছেড়ে দিয়ে বসে আছে পিয়া, মাথাটা হতাশ ভাবে রেলিঙের ওপর হেলানো। ভঙ্গিটা দেখে কানাই পরিষ্কার বুঝতে পারল এতক্ষণ এখানে বসে বসে কাঁদছিল পিয়া।

ওর পাশে গিয়ে বসল কানাই। বলল, “মিছিমিছি এভাবে কষ্ট পাওয়ার কোনও মানে হয় পিয়া। ওখানে আমাদের কিছুই করার ছিল না।”

“একবার চেষ্টা তো করতে পারতাম।”

“তাতে লাভ কিছুই হত না।”

“হয়তো হত না,” হাতের পেছন দিয়ে চোখ মুছল পিয়া। “যাক গে। তবে আপনার কাছে মনে হয় একটা ব্যাপারে আমার ক্ষমা চাওয়ার আছে কানাই।”

“ওখানে যা সব বলেছিলেন সে জন্য?” হাসল কানাই। “তাতে কিছু মনে করিনি আমি– আপনার রাগ করার যথেষ্ট সংগত কারণ ছিল।”

মাথা নাড়ল পিয়া, “না–শুধু সে জন্যে নয়।”

“তা হলে?”

“গতকাল আপনি আমাকে কী বলছিলেন মনে আছে?” জিজ্ঞেস করল পিয়া। “ঠিকই বলেছিলেন আপনি। আমিই আসলে ভুল বুঝেছিলাম।”

“আমি ঠিক বুঝতে পারছি না–কোন ব্যাপারে কথা বলছেন আপনি,” কানাই বলল। “ওই যে আপনি বলছিলেন না–সেই যে, কোনও রকমের কোনও মিলই নেই..”

“আপনার আর ফকিরের মধ্যে?”

“হ্যাঁ,” বলল পিয়া। “ঠিকই বলেছিলেন আপনি। আমিই আসলে বোকামি করছিলাম। মনে হয় এরকম কিছুর একটা দরকার ছিল আমার ভুলটা ভাঙার জন্য।”

জয়ের আনন্দে প্রথমেই যে কথাটা মুখে আসছিল একটু চেষ্টা করে সেটা গিলে ফেলল কানাই। গলার স্বর যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে জিজ্ঞেস করল, “এই গভীর উপলব্ধি আপনার কীভাবে হল সেটা জানা যেতে পারে কি?”

“এইমাত্র যা ঘটে গেল তার থেকেই হল,” বলল পিয়া। “ফকিরের এইরকম ব্যবহার আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না।”

“কিন্তু এ ছাড়া আর কী আশা করেছিলেন ওর কাছ থেকে আপনি, পিয়া?” কানাই জিজ্ঞেস করল। “আপনি কি ভেবেছিলেন ও আসলে মাটির থেকে উঠে আসা একজন পরিবেশবিদ? তাও নয়। ফকির একজন জেলে পেটের জন্য মাছ মারাই ওর কাজ।”

“সেটা বুঝতে পারি,” পিয়া বলল। “ওকে দোষ দিচ্ছি না আমি। আমি জানি ছোটবেলা থেকে এই ভাবেই ও বেড়ে উঠেছে। আসলে আমি ভেবেছিলাম ও হয়তো ঠিক অন্য সকলের মতো নয়, একটু আলাদা।”

সহানুভূতির সঙ্গে পিয়ার হাটুতে আলতো করে হাত রাখল কানাই। “বাদ দিন এসব আলোচনা এখন। সামনে অনেক কাজ পড়ে আছে আপনার।”

মাথা তুলে তাকাল পিয়া। একটু চেষ্টার হাসি ফোঁটাল মুখে।

ঘণ্টাখানেকের পথ পেরিয়ে এসেছে মেঘা, এমন সময় ছাই-রঙা একটা মোটরবোট সশব্দে বেরিয়ে গেল পাশ দিয়ে। পিয়া তখন দূরবিন চোখে ভটভটির সামনে দাঁড়িয়ে, আর কানাই বসে আছে ছাউনির নীচে। দুজনেই তাড়াতাড়ি পাশের দিকটায় গিয়ে উঁকি মেরে দেখল তিরবেগে ভাটির দিকে চলে যাচ্ছে বোটটা, তাতে ভর্তি খাকি পোশাক পরা ফরেস্ট গার্ড। যে গ্রাম থেকে ওরা খানিক আগে এসেছে সেইদিকেই যাচ্ছে মনে হল।

এর মধ্যে হরেনও এসে দাঁড়িয়েছে ওদের পাশে। ও কিছু একটা বলল, তাতে হো হো করে হেসে উঠল কানাই। পিয়াকে ব্যাখ্যা করে বলল, “হরেন বলছে কারও যদি কখনও এরকম অবস্থা হয় যে একদিকে গেলে জলদস্যুর হাতে পড়বে আর অন্য দিকে গেলে ফরেস্ট গার্ডের হাতে, তা হলে জলদস্যুর দিকে যাওয়াটাই ভাল। কম বিপজ্জনক।”

কাষ্ঠ হেসে ঘাড় নাড়ল পিয়া। ফরেস্ট গার্ডদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ল ওর। জিজ্ঞেস করল, “ওরা কী করতে যাচ্ছে ওখানে?”

“ধরপাকড়, জরিমানা, মারধর–আরও কী কী করবে কে জানে,” কানাই বলল।

আরও ঘণ্টাখানেক কেটে গেল। একটা মোহনা পার হতে গিয়ে বেশ কয়েকটা ছাই-রঙা মোটরবোটের একটা দল চোখে পড়ল ওদের। আগের বোটটা যেদিকে গেছে মনে হল এগুলোও সেই একই দিকে যাচ্ছে।

“আরেব্বাস,” বলে উঠল পিয়া। “এরা তো মনে হচ্ছে সহজে ছাড়বে না।”

“সেরকমই দেখা যাচ্ছে,” বলল কানাই।

হঠাৎ একটা মোটরবোট মুখ ঘুরিয়ে দল ছেড়ে বেরিয়ে এল। স্পিড বাড়াতে বোঝা গেল সোজা মেঘার দিকেই আসছে ওটা।

হরেনও দেখতে পেয়েছে বোটটাকে। সারেঙের ঘরের ভেতর থেকে মুখ বের করে ব্যস্ত ভাবে কী যেন একটা বলল কানাইকে।

“পিয়া, আপনাকে এবার কেবিনে ঢুকে পড়তে হবে,” কানাই বলল। “হরেন বলছে যদি আপনাকে ওরা লঞ্চে দেখতে পায় তা হলে ঝামেলা হতে পারে। মানে, আপনি বিদেশি আর ঠিকমতো পারমিট-টারমিট নেই, এসব বলে ঝাট করতে পারে।”

“ওকে।” পিঠব্যাগটা তুলে নিয়ে কেবিনে গিয়ে ঢুকল পিয়া। দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল ভেতর থেকে। বাঙ্কে শুয়ে পড়ে ক্রমশ জোরালো হতে থাকা মোটরবোটের ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে লাগল। শব্দটা যখন থেমে গেল, ও বুঝতে পারল বোটটা মেঘার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তারপর শুনতে পেল লোকজনের কথাবার্তার আওয়াজ, বাংলায়। প্রথমটায় শান্ত ভদ্র সুরে কথা শুরু হল, তারপর সুর চড়তে আরম্ভ করল আস্তে আস্তে। অনেকের গলার মধ্যে থেকে কানাইয়ের গলাটা আলাদা করে শুনতে পেল পিয়া।

ঝাড়া একটা ঘণ্টা কেটে গেল এই করে। যুক্তি, পালটা যুক্তি চলতে লাগল, সঙ্গে সঙ্গে ওঠানামা করতে লাগল গলার স্বর। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গুমোট বাড়ছে কেবিনের ভেতর। ভাগ্যিস একটা  জলের বোতল ছিল পিয়ার কাছে।

আরও বেশ খানিকক্ষণ পরে আস্তে আস্তে থেমে গেল কথাবার্তার আওয়াজ। মোটরবোটটাও ফিরে চলে গেল তারপর। ধকধক শব্দ উঠল মেঘার ইঞ্জিনে, আর পিয়ার কেবিনের দরজায় কে এসে ঠকঠক আওয়াজ করল। দরজা খুলে কানাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল পিয়া।

“কী এত গোলমাল হচ্ছিল?”

মুখ বাঁকাল কানাই। “যা বোঝা গেল, ওরা শুনেছে কালকে যখন বাঘটাকে মারা হয়েছে তখন একজন বিদেশি ওই গ্রামে ছিল। তাই ওরা নাকি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেছে।”

“কেন?”

“বলছে যে বর্ডারের এত কাছে গার্ড ছাড়া ঘুরে বেড়ানো নাকি একজন ফরেনারের পক্ষে খুব বিপজ্জনক। কিন্তু আমার মনে হয় ওরা আসলে খবরটা বাইরে ছড়াতে দিতে চায় না।”

“বাঘ মারার খবরটা?”

“হ্যাঁ,” মাথা নাড়ল কানাই। “এতে করে ওদের সম্পর্কে লোকের ধারণা খারাপ হয়ে যাবে। কিন্তু একটা জিনিস যেটা বোঝা যাচ্ছে সেটা হল আপনি যে এই এলাকায় ঘোরাফেরা করছেন সেটা ওরা জানে, আর এটাও পরিষ্কার যে আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে ওরা। বারবার জিজ্ঞেস করছিল আমরা আপনাকে দেখেছি কিনা।”

“কী বললেন আপনারা?”

হাসল কানাই। “হরেন আর আমি তো পুরো অস্বীকার করে গেলাম। মোটামুটি মানিয়েও ফেলেছিলাম, কিন্তু তারপর ওরা ফকিরকে দেখতে পেয়ে গেল। একজন গার্ড ওকে চিনে ফেলল। বলল, ওর নৌকোতেই শেষ দেখা গিয়েছিল আপনাকে।”

“ও মাই গড!” পিয়া বলল। “ছুঁচোমুখো একটা গার্ড?”

“হ্যাঁ। সেরকমই দেখতে। অন্যদের ও কী বলল জানি না, কিন্তু ফকিরকে তো নিয়ে জেলে পুরে দিয়েছিল আর একটু হলে। কোনও রকমে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শেষে ওদের নিরস্ত করলাম।”

“কী করে করলেন?”

খুব শুকনো গলায় কানাই বলল, “কী করে আর করব? আমার দু-একজন বন্ধুবান্ধবের নাম বললাম, আর তারপর একটু গল্পগুজব করে ওরা চলে গেল।”

পিয়া আন্দাজ করল ব্যাপারটার গুরুত্ব খানিকটা হালকা করার জন্যই এই শ্লেষের সুর কানাইয়ের গলায়। ধীর, নাগরিক স্বভাবের মানুষটার প্রতি হঠাৎ একটা কৃতজ্ঞতাবোধে ভরে উঠল ওর মন। আজকে যদি কানাই এখানে না থাকত কী হত তা হলে? খুব সম্ভবত ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের মোটরবোটে গিয়ে ওঠাই কপালে ছিল ওর।

কানাইয়ের হাতের ওপর একটা হাত রাখল পিয়া। “থ্যাঙ্ক ইউ। আপনি যা করলেন তার তুলনা নেই। এক বর্ণও বাড়িয়ে বলছি না। ফকিরও নিশ্চয়ই খুবই কৃতজ্ঞ।”

ঠাট্টা করে মাথা নোয়াল কানাই। “আপনাদের কৃতজ্ঞতা আমি মাথায় করে নিলাম।” তারপর একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “তবে একটা কথা আমি বলব পিয়া, ফিরে যাওয়ার ব্যাপারটা কিন্তু একবার সিরিয়াসলি ভেবে দেখবেন। যদি ওরা আপনাকে খুঁজে পেয়ে যায় তা হলে কিন্তু ভীষণ ঝামেলায় পড়বেন। জেলেও যেতে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আর আমার বা অন্য কারও খুব একটা কিছু করার থাকবে না। বর্ডার এলাকার হিসাব কেতাব কিন্তু অন্য সব জায়গার থেকে আলাদা।”

দূর জলের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল পিয়া। ওর মনে পড়ল একশো বছর আগে যখন ব্লিথ কি রক্সবার্গের মতো প্রকৃতিবিদরা এই অঞ্চল চষে বেড়িয়েছেন তখন জলচর প্রাণীতে থিকথিক করত এখানকার নদীনালা। তারপরের এই এতগুলো বছরের কথা মনে পড়ল ওর কোনও না কোনও কারণে ওই সব প্রাণীদের প্রতি আর কেউ বিশেষ নজর দেয়নি; ফলে কীভাবে ওরা আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল সে খোঁজও রাখা হয়নি। এতদিন পরে ওর ওপরই প্রথম দায়িত্ব পড়েছে সরেজমিনে দেখে রিপোর্ট তৈরি করার। সে দায়িত্ব ও কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারবে না।

“এখন ফিরে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না কানাই,” পিয়া বলল। “আসলে, আমার কাজটা ঠিক কতটা ইম্পর্ট্যান্ট সেটা আপনাকে আমি বোঝাতে পারব না। আমি যদি আজকে ফিরে চলে যাই, আবার কবে একজন সিটোলজিস্ট এখানে আসতে পারবে কে বলতে পারে? যতদিন সম্ভব হয় আমাকে থাকতেই হবে এখানে।”

ভুরু কোঁচকাল কানাই। “আর যদি ওরা আপনাকে জেলে পুরে দেয় তা হলে কী হবে?”

কাঁধ ঝাঁকাল পিয়া। “জেলে আর কতদিন রাখবে? আবার যখন ছেড়ে দেবে, যা যা দেখেছি সেগুলো তো আমার মাথায় রয়েই যাবে, তাই না?”

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে এল। সূর্য গনগন করছে মাথার ওপর। কাজ থামিয়ে খানিকক্ষণের জন্য কানাইয়ের পাশে তেরপলের ছায়ায় এসে বসল পিয়া। চোখের দৃষ্টি একটু যেন ক্লিষ্ট। সেটা লক্ষ করে কানাই বলল, “আপনি কি এখনও ওই ফরেস্ট গার্ডদের কথা ভাবছেন নাকি?”

কথাটা শুনে মনে হল যেন একটু চমকে উঠল পিয়া। “না না, সেসব কিছু নয়।”

“তা হলে?”

মাথা পেছনে হেলিয়ে পিয়া  ওয়াটার বটল থেকে একটু  জল খেল। মুখটা মুছে নিয়ে বলল, “ওই গ্রামটার কথা ভাবছি। কালকে রাত্রের কথা। কিছুতেই আমি ঘটনাটা বের করতে পারছি না মাথা থেকে–ঘুরে ফিরে ছবিগুলো চোখের সামনে ভেসে আসছে–ওই লোকগুলোর ছবি, আগুনের ছবি.. যেন অন্য কোনও যুগের একটা ঘটনা–ইতিহাস লেখা শুরু হওয়ার আগেকার কোনও সময়ের। মনে হচ্ছে কখনওই মন থেকে আমি দূর করতে পারব না ওই…”

মনে মনে ঠিক শব্দটা হাতড়াতে লাগল পিয়া। শূন্যস্থান পূরণ করার জন্যে কানাই বলল: “ওই বিভীষিকা?”

“বিভীষিকা। হ্যাঁ। জীবনে কখনও ভুলতে পারব কি না জানি না।”

“সম্ভবত না।”

“কিন্তু ফকির বা হরেন বা গ্রামের অন্য সব লোকেরা ওদের কাছে তো এটা রোজকার জীবনের অংশ, তাই না?”

“আমার মনে হয় পিয়া, এইভাবেই জীবনটাকে নিতে শিখেছে ওরা। তা ছাড়া ওরা বাঁচতে পারবে না।”

“সেই চিন্তাটাই তাড়া করে বেড়াচ্ছে আমাকে,” বলল পিয়া। তার মানে ওরাও তো এই বিভীষিকারই অংশ হয়ে গেল, ঠিক না?”

হাতের নোটবইটা ঝপ করে বন্ধ করে দিল কানাই। “ফকির কিংবা হরেনের মতো মানুষদের প্রতি অবিচার না করে যদি পুরো ব্যাপারটা দেখতে চান পিয়া, হলে কিন্তু আমি বলব বিষয়টা ঠিক এতটা সহজ নয়। মানে, আমি বলতে চাইছি সেভাবে দেখতে গেলে আমরাও কি এক হিসেবে ওই বিভীষিকার অংশ নই? আপনি বা আমি বা আমাদের মতো লোকেরা?”

নিজের ছোট ছোট কোকড়া চুলে আঙুল বোলাল পিয়া। “ঠিক বুঝলাম না।”

“ওই বাঘটা দু-দুটো মানুষ মেরেছে, পিয়া, কানাই বলল। “আর সেটা শুধু একটা মাত্র গ্রামে। এই সুন্দরবনে প্রতি সপ্তাহে লোক মারা পড়ে বাঘের হাতে। সেই বিভীষিকাটার কথা একবার ভেবে দেখেছেন কি? পৃথিবীর অন্য কোথাও যদি এই হারে মানুষ মরত তা হলে সেটাকে তো গণহত্যা বলা হত। কিন্তু এখানে এই নিয়ে সেরকম কোনও কথাই ওঠে না। এইসব মৃত্যুগুলোর কথা কোথাও লেখা হয় না, খবরের কাগজওয়ালারাও এই নিয়ে কখনও হইচই ফেলে না। কারণটা কী? না, এই মানুষগুলো এতটাই গরিব যে এরা মরল কি বাঁচল তাতে কারওর কিছু এসে যায় না। এই কথাগুলো আমরা সবাই জানি, কিন্তু জেনেশুনেও চোখ বন্ধ করে থাকি। একটা জানোয়ারের কষ্ট হলে আমাদের গায়ে লাগে, কিন্তু মানুষের কষ্টে কিছু এসে যায় না সেটা বিভীষিকা নয়?”

“কিন্তু একটা কথা আমাকে বলুন কানাই, সারা পৃথিবীতে প্রতিদিনই তো ডজন ডজন মানুষ মরছে রাস্তাঘাটে, গাড়িতে, অ্যাক্সিডেন্টে। এটা তার চেয়ে বেশি ভয়াবহ কেন বলছেন?” পালটা প্রশ্ন করল পিয়া।

“কারণ এর পেছনে আমাদেরও হাত রয়েছে পিয়া, সেইজন্যে।”

অস্বীকারের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল পিয়া। এখানে আমার হাত কীভাবে রয়েছে বুঝতে পারলাম না।”

“কারণ আপনার মতো লোকেরাই এখানে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য বার বার চাপ দিয়েছেন,” কানাই বলল। “আর তার জন্য মানুষকে কী দাম দিতে হবে তার তোয়াক্কাও করেননি। আর আমিও দায়ী তার কারণ আমার মতো মানুষেরা মানে আমার শ্রেণীর ভারতীয়রা–সেই দামের হিসেবটাকে কখনও প্রকাশ হতে দেয়নি, যাতে পশ্চিমি দেশগুলোর সুনজরে থাকতে পারে সেইজন্য। যে মানুষগুলো মরছে তাদের পাত্তা না দেওয়াটা খুব একটা কঠিন না, কারণ তারা গরিবস্য গরিব। একবার নিজেকেই জিজ্ঞেস করি দেখুন, পৃথিবীর আর কোনও জায়গায় কেউ এটা চলতে দেবে? মার্কিন দেশের কথা যদি ভাবেন, সেখানে বন্দি বাঘের সংখ্যা ভারতবর্ষে মোট যত বাঘ আছে তার থেকে বেশি। তারা যদি একবার মানুষ মারতে শুরু করে তা হলে কী হবে একবার বলুন দেখি?”

“কিন্তু কানাই, বন্দি অবস্থায় কোনও প্রজাতির সংরক্ষণ আর তাকে তার নিজের জায়গায় রেখে সংরক্ষণের মধ্যে একটা বড় তফাত আছে,” পিয়া বলল।

“তফাতটা ঠিক কী শুনি?”

“তফাতটা হল,” ধীরে ধীরে প্রতিটা শব্দের ওপর জোর দিয়ে পিয়া বলল, “প্রাণীগুলো যে এইভাবে বাঁচবে শুরু থেকে এটাই নির্দিষ্ট ছিল। আর সেটা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল প্রকৃতি–আপনি বা আমি নই। একবার ভাবুন তো, আমরা ছাড়া আর কোনও প্রজাতি জগতে রইল কি মরল তাতে কিছু যায় আসে না–এরকম একটা ভাবনার থেকে যে কাল্পনিক রেখাটা আমাদের ঠেকিয়ে রেখেছে, সেটা যদি একবার পেরিয়ে যাই তা হলে কী হবে? কতটুকু অবশিষ্ট থাকবে তা হলে? এই ব্রহ্মাণ্ডে আমরা তো যথেষ্টই একা, কানাই। আর সেখানেই কি সবকিছু থেমে থাকবে মনে করেছেন? একবার যদি আমরা স্থির করি যে অন্য সব জীবজন্তুকে মেরে সাফ করে দেওয়ার অধিকার আমাদের আছে, তারপরে তো শেষে মানুষ মারা শুরু হবে। যে মানুষগুলোর কথা আপনি বলছেন–গরিব অবহেলিত তারাই শিকার হবে তখন।”

“কথাগুলো বলেছেন ভালই পিয়া, কিন্তু আপনাকে তো আর প্রাণ দিয়ে তার দাম দিতে হচ্ছে না।”

“যদি দরকার হয় সে দাম আমি দিতে পারব না মনে করছেন?” চ্যালেঞ্জ করল পিয়া।

“মানে আপনি বলছেন আপনি মরতেও রাজি আছেন?” কানাই টিটকিরির সুরে প্রশ্ন করল। “কী যে বলেন পিয়া।”

খুব শান্ত গলায় পিয়া বলল, “আমি একবর্ণও মিথ্যে দাবি করছি না কানাই। যদি জানতাম আমার প্রাণের মূল্যে এই নদীগুলো আবার ইরাবড়ি ডলফিনদের জন্যে নিরাপদ হয়ে উঠবে, তা হলে আমার জবাব হল, হ্যাঁ। সেরকম ক্ষেত্রে মরতেও রাজি আছি আমি। কিন্তু সমস্যাটা হল আমি বা আপনি বা এরকম হাজারটা লোক মরলেও কোনওই সমাধান হবে না এ সমস্যার।”

“এসব কথা বলা তো খুবই সোজা–”

“সোজা?” শুকনো বিরক্তির সুর পিয়ার গলায়। “একটা কথা বলুন তো কানাই, যে কাজগুলো আমি করি তার কোনওটাই কি আপনার খুব সোজা মনে হয়? আমার দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন তো আমার ঘরবাড়ি নেই, টাকাপয়সা নেই, জীবনে উন্নতি করার কোনও আশা নেই। আমার বন্ধুবান্ধবরা আমার থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে, কপাল যদি ভাল থাকে খুব বেশি হলে বছরে একবার তাদের সঙ্গে দেখা হয় আমার। আর সেটাও তো কিছুই না। তার চেয়েও বড় কথা হল, আমি ভাল করেই জানি যে কাজটা আমি করছি শেষ পর্যন্ত তার সবটাই মোটামুটি ব্যর্থ হবে।”

মুখ তুলে তাকাল পিয়া। কানাই দেখল ওর চোখে টলটল করছে জল।

“সোজা কাজ এটা আদৌ নয় কানাই। কথাটা আপনাকে ফিরিয়ে নিতে হবে।”

একটা কড়া জবাব ঠোঁটের ডগায় চলে এসেছিল, কোনওরকমে সেটা গিলে ফেলল কানাই। তার বদলে পিয়ার একটা হাত নিজের দু’হাতের মধ্যে ধরে বলল, “সরি পিয়া। এভাবে বলা উচিত হয়নি আমার। কথাটা ফিরিয়ে নিলাম।”

হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল পিয়া। বলল, “যাই, কাজ করি গিয়ে।”

নিজের জায়গার দিকে এগিয়ে গেল পিয়া। পেছন থেকে ডেকে কানাই বলল, “আপনি কিন্তু খুব সাহসী মেয়ে, সেটা জানেন কি?”

অস্বস্তিতে কাঁধ ঝাঁকাল পিয়া। “আমি আমার নিজের কাজটা করছি শুধু।”