ভ্রমণকাহিনি
গেস্ট হাউসে ফিরে কানাই দেখল টিফিন ক্যারিয়ারে করে দুপুরের খাবার রেখে গেছে। ময়না। সাদামাটা খাবার ভাত, মুসুরির ডাল, একটা চচ্চড়ি আলু, মাছের কাটা আর কী একটা শাক দিয়ে। শাকটা ঠিক চিনতে পারল না কানাই। আর ছিল কুচো মৌরলা মাছের পাতলা ঝোল। ঠান্ডা হয়ে গেলেও খাবারটা অমৃতের মতো লাগল কানাইয়ের। দিল্লিতে ওর যে রাঁধুনি আছে সে লক্ষৌর লোক। নানারকম মোগলাই খাবারই সে বেশি বানায়। ফলে বহুদিন এরকম সাধারণ বাঙালি খাবার কপালে জোটেনি কানাইয়ের। প্রতিটা খাবারের স্বাদ যেন ওর মাথার মধ্যে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে লাগল। শেষ পর্যন্ত এত খেয়ে ফেলল যে পেটটা আইঢাই করতে লাগল একেবারে।
খাওয়ার পর বাসনপত্র সরিয়ে রেখে ওপরে নির্মলের পড়ার ঘরে গেল কানাই। দরজাটা বন্ধ করে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল ডেস্কটার সামনে। তারপর নোটবইটা খুলল।
কানাই, সেই ১৯৭০-এ শেষ যারা কুসুমকে দেখেছিল লুসিবাড়িতে, তাদের মধ্যে তুমি ছিলে একজন। সে বছর বনবিবি জহুরানামা পালা চলার সময় হঠাৎই নিখোঁজ হয়ে যায় ও। যেন একটা ঝড় ওকে তুলে নিয়ে চলে গিয়েছিল কোথাও, এতটুকু চিহ্নও রেখে যায়নি। কেউ জানত না কোথায় গেল কুসুম। সেই শেষ। তারপরে আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি ওর। সত্যি বলতে কী, ওর কী যে হল তা নিয়ে আমরা কেউ মাথাও ঘামাইনি। খুবই দুঃখের বিষয় হলেও সত্যি, এই ভাটির দেশের অনেক ছেলেমেয়েই এভাবে হারিয়ে যায় শহরের ভিড়ে। এরকম ঘটনা এত ঘটে যে খেই রাখা মুশকিল।
তারপর বহু বছর কেটে গেল, আমারও অবসরের সময় চলে এল। অস্বীকার করলে.মিথ্যে বলা হবে, আমার বুকটা একটু দুরুদুরু করছিল বইকী। প্রায় তিরিশ বছর হেডমাস্টারি করেছি। এই স্কুল, এই ছাত্ররা, তাদের পড়ানো–এসবই জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছিল আমার। ক্লাসরুম আর রুটিনের নিয়মের বাইরে বেরিয়ে আমি বাঁচব কী নিয়ে? বহু বছর আগের সেই অসম্বন্ধ দিনগুলির কথা মনে পড়ে গেল আমার, যখন পৃথিবীটাকে এত নৈরাশ্যময় আর জটিল মনে হত যে সবসময় খালি শুয়ে থাকতেই ইচ্ছে করত। আবার যদি সেরকম হয়? সে সময় আমার মনের অবস্থাটা নিশ্চয়ই তুমি কল্পনা করতে পারছ।
ছকে-বাঁধা জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হল তার অর্থহীনতাটা বোঝা যায় বড় দেরিতে। কত বছর ধরে আমি নীলিমাকে বলেছি যে আমি ওপরে আমার স্টাডিতে বসে লেখার কাজ করছি। শুনে খুব খুশি হত নীলিমা। এই যে চারিদিকে ওর এত খ্যাতি, প্রতিপত্তি, আর আমার কিছুই নেই, সেটা ওর ভাল লাগত না। ওর বিশ্বাস ছিল আমি একজন লেখক, কবি। ও চাইত কবি হিসেবে, লেখক হিসেবে আমাকেও সবাই চিনুক, জানুক। কিন্তু সত্যি কথা হল লুসিবাড়িতে এতগুলো বছরে একটা শব্দও লিখিনি আমি। শুধু তাই নয়, আমার আরেকটা ভালবাসার জিনিস বই পড়া, সে অভ্যাসটাকেও বিসর্জন দিয়েছিলাম একেবারে। অবসরের সময় যত এগিয়ে আসতে লাগল, এই সবকিছুর জন্য ভীষণ অনুশোচনা হতে লাগল আমার। একদিন কলকাতায় গিয়ে আমার এক সময়কার প্রিয় দোকানগুলোতে বইপত্র ঘেঁটে অনেকটা সময় কাটালাম, দেখলাম বই কেনার সামর্থ্য আমার আর নেই। একটা মাত্র নতুন বই নিয়ে ফিরে এলাম লুসিবাড়িতে। বার্নিয়ের ভ্রমণকাহিনি। তুমিই কিনে দিয়েছিলে সেটা আমাকে।
আমার স্কুল থেকে বিদায়ের দিন যত এগিয়ে আসতে লাগল, পরিষ্কার বোঝা গেল অন্য মাস্টারমশাইরা সাগ্রহে অপেক্ষা করে আছেন আমার যাওয়ার জন্য। আমার মনে হয় না তার মধ্যে বিদ্বেষের ভাব খুব একটা ছিল। আসলে অনাগত ভবিষ্যতের গর্ভে কী লুকোনো আছে সেটা দেখার জন্যই ওরকম উদগ্রীব হয়েছিলেন ওঁরা। কেউ যদি কোনও জায়গায় একটানা তিরিশ বছর কাজ করে, সেখানকার দেওয়ালের গায়ে শ্যাওলার মতো হয়ে যায় সে। নতুন দিনের আলোয় কেমন করে তা শুকিয়ে ঝরে যায় সেটা সকলেই দেখতে চায়।
আমার অবসরের খবর যত ছড়াতে থাকল, বহু নিমন্ত্রণ পেতে থাকলাম আমি আশেপাশের অন্য সব দ্বীপের স্কুলগুলো থেকে, সেসব জায়গায় একবার ঘুরে আসার জন্য। আগে হলে হয়তো রাজি হতাম না, কিন্তু এখন কবির সেই সতর্কবাণী মনে পড়ল আমার–”থেমে যাওয়ার অর্থ অস্তিত্বহীনতা”। কাজেই খুশি হয়েই সে সব নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে লাগলাম। একদিন এরকমই এক নিমন্ত্রণ এল কুমিরমারি দ্বীপ থেকে। আমার পরিচিত একজন সেখানে থাকতেন। লুসিবাড়ি থেকে কুমিরমারির দূরত্ব খুব একটা কম নয়, বেশ কয়েকবার ফেরি পার হয়ে যেতে হয়। স্থির করলাম যাব।
যেদিন সকালে আমার যাওয়ার কথা, ঘটনাচক্রে নীলিমা সেদিন বাড়ি ছিল না, ট্রাস্টের কাজে কোথাও গিয়েছিল। আমিও খালি বাড়িতে মনের আনন্দে অনেকক্ষণ ধরে আমার ঝোলা গোছালাম। একটা বই ঢোকালাম, তারপর মনে হল আরও একটা নিই–এত দূরের পাড়ি, অনেক পড়ার জিনিস লাগবে। এই করতে করতে সময়ের হিসাব ভুলে গেলাম আমি–ক’টার সময় নৌকো আছে, জেটি পর্যন্ত হেঁটে যেতে কতক্ষণ লাগবে–সব গোলমাল করে ফেললাম। তারপর কী হল সে আর বিশদ বলার কিছু নেই। এইটুকু বললেই চলবে যে প্রথম নৌকোটা ধরতে পারলাম না আমি। অর্থাৎ পরের কোনও ঘাটেও আর ফেরি ধরতে পারব না।
হতাশ হয়ে বাঁধের ওপর বসেছিলাম, হঠাৎ দেখি একটা চেনা চেহারা–নৌকো নিয়ে যাচ্ছে সামনে দিয়ে। হরেন নস্করকে বহু বছর দেখিনি, কিন্তু ওই তাগড়াই চেহারা আর সরু চোখ দেখে সঙ্গে সঙ্গেই চিনতে পারলাম ওকে। কিশোর বয়সি একটি ছেলে ছিল সঙ্গে, নিশ্চয়ই ওর বড় ছেলে।
তড়িঘড়ি বাঁধ বেয়ে নেমে গিয়ে ডাকলাম ওকে–”হরেন! হরেন! একটু দাঁড়াও!”
কাছাকাছি আসতে অবাক হয়ে হরেন বলল, “সার? আপনি এখানে? আমি তো ছেলেকে নিয়ে আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম। ও আপনার স্কুলে ভর্তি হতে চায়।”
ছেলেটার কাঁধে হাত রাখলাম আমি। “অবশ্যই ওর ভর্তির ব্যবস্থা করে দেব। কিন্তু আমারও যে একটা উপকার করে দিতে হবে হরেন।”
“নিশ্চয়ই সার। কী করতে হবে বলুন।”
“হরেন, আমাকে এখন একবার কুমিরমারি যেতেই হবে। তুমি নিয়ে যাবে?”
“কেন নিয়ে যাব না সার? এটুকু করতে পারব না আপনার জন্য? উঠে আসুন, উঠে আসুন।” ছেলের পিঠে একটা চাপড় মেরে ওকে বলল একাই বাড়ি ফিরে যেতে। তারপর একবারও পেছনে না তাকিয়ে আমরা রওয়ানা হলাম কুমিরমারির উদ্দেশ্যে।
চলতে শুরু করেই আমার মনে হল বহু বছর পরে হরেনের নৌকোর মতো এরকম নৌকোয় চড়লাম। গত কয়েক বছরে যখনই লুসিবাড়ির বাইরে যাওয়ার দরকার হয়েছে–খুব একটা বেশি হয়নি অবশ্য–সাধারণত লঞ্চ বা ভটভটিতেই যাতায়াত করেছি। এখন এই নৌকোয় বসে চারপাশের চেনা দৃশ্যগুলোই কেমন অন্যরকম মনে হতে লাগল–যেন নতুন দৃষ্টিতে দেখছি আমি। ছাতা দিয়ে রোদ আড়াল করে বসে একটা বই বের করলাম–সেই বার্নিয়ের ভ্রমণকাহিনি–আর যেন কোনও জাদুমন্ত্রে বইয়ের যে পাতাগুলো খুলল ঠিক সেই জায়গাটাতেই সাহেব ভাটির দেশে তার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন।
হরেন বলল, “কী পড়ছেন সার? গল্পের বই? আমাকেও একটা গল্প বলুন না ওটা থেকে। অনেক দূরের পথ তো, শুনতে শুনতে যাওয়া যাবে বেশ।”
“ঠিক আছে, আমি বললাম, “শোনো তা হলে।
“এই বইটা লিখেছিলেন একজন খ্রিস্টান পাদরি। ফরাসি দেশ থেকে ১৬৬৫ সালে এসেছিলেন ভারত ভ্রমণ করতে। তখনও চৈতন্য মহাপ্রভুর কথা আমাদের গ্রামগঞ্জের মানুষের বেশ মনে আছে। আর দিল্লির মসনদে তখন ছিলেন মুঘল বাদশা আওরঙ্গজেব। তো, আমাদের পাদরিসাহেব ছিলেন জেসুইট সম্প্রদায়ের মানুষ। নাম ছিল সোয়া বার্নিয়ে। সাহেবের সঙ্গে ছিল দু’জন পর্তুগিজ পথপ্রদর্শক আর বেশ কিছু চাকর-বাকর। সকলে মিলে তো এসেছেন এই বাদাবনে। কিন্তু প্রথম দিনেই সাহেবরা খিদের জ্বালায় অস্থির। সঙ্গে খাবার ছিল, কিন্তু ডাঙায় নেমে রান্না করার সাহস আর হয় না। এখানকার বাঘের হিংস্রতার বহু গল্প তারা শুনে এসেছেন, সবাই। তাই খুব সাবধান। অবশেষে নদীর মাঝে একটা সুবিধাজনক চড়া পাওয়া গেল। সেখানে নেমে রান্না করা হল–দুটো মুরগি আর একটা মাছ। খাওয়া-দাওয়ার পরে তো আবার রওয়ানা হল নৌকো। একেবারে অন্ধকার নামা পর্যন্ত তারা চললেন। সন্ধের মুখে মুখে নিরাপদ একটা খাঁড়িতে ঢুকে দু’দিকের তীরের থেকে বেশ খানিকটা দূরে এসে নোঙর ফেলা হল। সাহেবদের মনে হল জন্তুজানোয়ারের আক্রমণের সম্ভাবনা অনেক কম হবে এই মাঝখাঁড়িতে। তবুও, বাড়তি সাবধানতা হিসেবে ঠিক হল পালা করে রাত জেগে পাহারা দেওয়া হবে। পাদরি সাহেব লিখেছেন কী ভাগ্যিস তাকেও রাত জাগতে হয়েছিল সেখানে, সেইজন্যেই অপূর্ব এক দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হল তার–চাঁদের আলোয় রামধনু।”
“ও!” হরেন বলে উঠল, “আমি জানি কোন জায়গায় হয়েছিল এটা। নিশ্চয়ই গেরাফিতলার কাছটায় হবে।”
“রাবিশ,” আমি বললাম, “কী করে জানবে তুমি হরেন? তিনশো বছরেরও আগেকার ঘটনা, সেটা তুমি কী করে জানবে?”
“আমিও দেখেছি তো, “ হরেন প্রতিবাদ করল, “ঠিক যেমন আপনি বলছেন–একটা বড় নদী দিয়ে গিয়ে একটা খাঁড়ি, সেরকম। শুধু সে জায়গাটায় দেখা যায় ওই চাঁদের রামধনু। পূর্ণিমার রাতে কুয়াশা থাকলে রামধনু হয় ওখানটায়। সে যাকগে, আপনি গল্পটা বলুন সার।”
“বাদাবনে আসার তৃতীয় দিনে বার্নিয়ে আর তার দলবল আবিষ্কার করলেন যে তাঁরা পথ হারিয়ে ফেলেছেন। একবার এ নদী দিয়ে যান, একবার সে খাঁড়িতে ঢোকেন–আর যত এরকম ঘুরতে থাকেন, আরও গুলিয়ে যায় পথ। ভয়ে সবার প্রাণ শুকিয়ে গেছে, ভাবছেন বুঝি এই গোলোকধাঁধা থেকে বেরোনোই যাবে না কোনওদিন, এখানেই বোধ হয় ঘুরে মরতে হবে। এইরকম সময়, আবার এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। নৌকো থেকে দেখা গেল দূরে একটা বালির চরের ওপর কিছু লোক কী যেন করছে। নৌকোর মুখ ঘোরানো হল সেদিকে। সাহেবরা ভেবেছিলেন নিশ্চয়ই স্থানীয় জেলে-টেলে হবে, ওদের কাছ থেকে বেরোনোর পথ জেনে নেওয়া যাবে। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখা গেল লোকগুলি পর্তুগিজ। নুন তৈরি করছে ওই বালির চরে।”
“ওহ!” লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে বলল হরেন। “ও জায়গাটা তো আমি চিনি। কেঁদোখালি যাওয়ার পথে পড়ে। ওদিকে একটা জায়গা আছে যেখানে এখনও গ্রামের কিছু লোক নুন তৈরি করে। আমার ছোটকাকা একবার এক রাত্তির ছিল ওই চরে। সারারাত কাদের সব গলা শুনেছে। অদ্ভুত ভাষায় কী সব কথা বলছে। নিশ্চয়ই
ওই ভূতগুলোই হবে। সে যাকগে সার, আপনি বলুন গল্পটা।”
“চারদিনের দিন, তখনও এই ভাটির দেশ থেকে বেরোতে পারেননি পাদরিসাহেব আর তার দলবল। সন্ধে হয়ে এসেছে, তখন আবার একটা খাঁড়ির মাঝে গিয়ে নোঙর ফেলা হল। সে রাত এক অসাধারণ রাত। প্রথমে তো হাওয়া বন্ধ হয়ে গেল; সারা জঙ্গলে একটা গাছের পাতা নড়ছে না। তারপর, নৌকোর চারপাশের বাতাস আস্তে আস্তে গরম হয়ে উঠতে লাগল। ক্রমে এত গরম হয়ে গেল যে পাদরি আর তার দলবলের প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসার মতো অবস্থা হল। তারপর হঠাৎ মনে হল নৌকোর চারপাশের জঙ্গলে যেন আগুন লেগেছে; গাছে গাছে থিকথিক করছে অজস্র জোনাকি। এমনভাবে উড়ছিল জোনাকিগুলো, মনে হচ্ছিল যেন গাছের ডাল আর শেকড়গুলোর ওপর দিয়ে আগুন নেচে বেড়াচ্ছে। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল মাঝিরা। পাদরি লিখেছেন, “উহাদের মনে হইতেছিল ওইগুলি সব ভূতপ্রেত।”
“কিন্তু সার,” অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে হরেন জিজ্ঞেস করল, “মনে হচ্ছিল কেন লিখেছে সার? ওগুলো তো ভূতই। তা ছাড়া আবার কী?”
“আমি জানি না, হরেন। পাদরি যা লিখেছেন সেটাই আমি বলছি।”
“ঠিক আছে সার, ঠিক আছে। বলুন, আপনি বলুন।”
“পরের রাতটা আরও সাংঘাতিক সম্পূর্ণরূপে ভয়াবহ এবং বিধ্বংসী’, লিখেছেন সাহেব। কথা নেই বার্তা নেই, হঠাৎ প্রচণ্ড এক ঝড় উঠল। ওদের নৌকোটাকে ঠেলে নিয়ে ঢোকাল এক খাঁড়ির মধ্যে। কোনওরকমে সেটাকে পাড়ের কাছে নিয়ে গিয়ে যত দড়িদড়া ছিল সব দিয়ে কষে বাঁধা হল একটা গাছের সঙ্গে। কিন্তু ভয়ানক সে ঝড়ের দাপট; হাওয়ার মুখে দড়ি বেশিক্ষণ টিকল না। খানিক পরেই টুকরো টুকরো হয়ে গেল সব বাঁধন, মনে হল ঝড়ের তোড়ে এক্ষুনি নৌকো খাঁড়ির নিরাপদ আশ্রয় থেকে ভেসে যাবে মোহনায়, উথাল পাথাল ঢেউয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে একেবারে। আর সমস্তক্ষণ অঝোরে বৃষ্টি, মনে হইতেছিল যেন কেউ বৃহৎ বারিভাণ্ড লইয়া নৌকার উপর জল নিক্ষেপ করিতেছে, আর মস্তকের সম্মুখে অনবরত এমন উজ্জ্বল বিদ্যুৎচমক আর কর্ণবিদারক বজ্রপাত হইতে লাগিল যে সে রাত্রে আমাদিগের প্রাণ বাঁচানোর আশা আর রহিল না।”
“এইরকম সময়ে ‘এক আকস্মিক এবং স্বতস্ফূর্ত চেষ্টায়’ পাদরিসাহেব আর তার দুই পর্তুগিজ পথপ্রদর্শক জঙ্গলের গাছের পাচালো শেকড়গুলি দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। তাদের হাতগুলোও যেন জীবন্ত শেকড়ের মতো হয়ে লেগে রইল গাছের সঙ্গে। প্রায় দুই ঘটিকা কাল, যতক্ষণ সে ঝঞ্ঝা তীব্র গতিতে বহিয়া চলিল’, ততক্ষণ ওঁরা সেইভাবে রইলেন।”
“এই রে!” বলে উঠল হরেন। “নিশ্চয়ই সে গণ্ডীটা পেরিয়ে গিয়েছিল।”
“কোন গণ্ডী হরেন?”
“বললেন না সার, যে ওরা হারিয়ে গেছিল?”
“হ্যাঁ, বললাম তো।”
“আর দেখতে হবে না! তা হলে তাই হয়েছিল। নিশ্চয়ই ভুল করে গণ্ডীটা পেরিয়ে গিয়েছিল, আর একেবারে দক্ষিণরায়ের এলাকায় কোনও দ্বীপে গিয়ে পড়েছিল। ওরকম কোথাও কিছু নেই হঠাৎ ঝড় শুরু হয়ে গেল–ওরকম হলেই বুঝতে হবে ও দক্ষিণরায় আর তার দানোগুলোর কারসাজি।”
আর ধৈর্য রাখতে পারলাম না আমি। বললাম, “হরেন, ঝড়ঝঞ্ঝা হল প্রাকৃতিক ব্যাপার, কারও ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর সেটা নির্ভর করে না।”
এত রূঢ়ভাবে কথাটা বলেছিলাম আমি যে হরেন আর প্রতিবাদ করল না, কিন্তু একমতওঁ হল না আমার সঙ্গে। “ঠিক আছে সার,” ও বলল, “আমার বিশ্বাস আমার কাছে, আপনার বিশ্বাস আপনার কাছে। তারপর গল্পটা কী হল বলুন।”
আমার মনে হল একমাত্র কবিই ওর মতো এইরকম মানুষদের চিনতে পেরেছিলেন–‘পেশি আর সারল্যে ভরপুর।’
অনেকক্ষণ একটানা লেখা হয়ে গেল কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে বোধহয়। আমার ডটপেনের কালিও ফুরিয়ে এসেছে। এত বছর না লিখলে এরকমই হয় প্রতিটা মুহূর্ত যেন স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ হয়ে ফিরে আসে, ছোট ছোট ঘটনাকে মনে হয় যেন বিশ্বদর্শন।
আমাকে এখানে ফকিরের কাছে রেখে কুসুম আর হরেন বেরিয়েছে। ওরা দেখতে গেছে যে গুজবটা সত্যি কিনা মরিচঝাঁপিতে হামলা হতে পারে সেই গুজব; যদি সেটা সত্যি হয় তা হলে কখন হতে পারে সে হামলা?
আপশোস হচ্ছে। এতগুলো বছর কত সময় ছিল আমার হাতে, কিন্তু একটা শব্দও লিখিনি আমি। আর এখন আমার নিজেকে আরব্যোপন্যাসের সেই শাহজাদির মতো মনে হচ্ছে–ভ্রান্তস্থিতি, ভ্রান্তলিঙ্গ–ছুটন্ত কলম হাতে কোনওরকমে রাতটা পার করে দেওয়ার চেষ্টা করছি…