⁝⁝⁝

মেঘা

সকালে একটা সাইকেল ভ্যান ভাড়া করে ফকিরের জোগাড় করা ভটভটিটা দেখতে গেল পিয়া আর কানাই। ইট-বসানো রাস্তা দিয়ে ঝাঁকুনি খেতে খেতে গ্রামের দিকে চলেছে। ভ্যান। পিয়া বলল, “ওই নৌকোর মালিককে আপনি চেনেন বলছিলেন না? কীরকম লোক ও?”

“আমি যখন ছোটবেলায় এখানে এসেছিলাম তখন ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল আমার,

কানাই বলল। “ওর নাম হরেন। হরেন নস্কর। খুব যে চিনি সেটা বলা ঠিক হবে না, তবে এটুকু বলতে পারি যে আমার মেসোর সঙ্গে ওর ভালই যোগাযোগ ছিল।”

“আর ফকিরের কে হয় ও?”

“ধর্মবাপ বলতে পারেন,” জবাব দিল কানাই। “ফকিরের মা মারা যাওয়ার পর হরেনের কাছেই থাকত ও।”

বাঁধের গোড়ার কাছে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল হরেন। ফকির দাঁড়িয়ে ছিল পাশে। এক নজর দেখেই হরেনকে চিনতে পারল কানাই–সেই গাঁট্টাগোট্টা চেহারা, চওড়া কঁধ। শরীরে খানিকটা চর্বি জমেছে এই ক’বছরে। ভুড়ি হয়েছে একটু। ফলে বুকের ছাতিটা আগের চেয়েও চওড়া মনে হচ্ছে। বয়েসের সঙ্গে গম্ভীর হয়েছে মুখের ভাঁজগুলি–চোখ দুটো দেখাই যায় না প্রায়। তবে সাথে সাথে একটা ভারিক্কি ভাবও এসেছে চেহারায়। হাবভাবে যূথপতির গাম্ভীর্য। দেখলেই বোঝা যায় এ মানুষটা আশেপাশের সব লোকেদের শ্রদ্ধার পাত্র। পোশাক-আশাকেও স্বাচ্ছল্যের আভাস ডোরাকাটা লুঙ্গিটা সযত্নে মাড় দিয়ে ইস্ত্রি করা, গায়ের জামা ধবধবে সাদা। হাতে ভারী মেটাল স্ট্র্যাপের ঘড়ি, জামার পকেট থেকে একটা সানগ্লাস উঁকি দিচ্ছে।

“আমাকে চিনতে পারছেন হরেনদা?” হাত জোড় করে নমস্কারের ভঙ্গি করল কানাই। “আমি সারের ভাগ্নে।”

“চিনব না কেন?” হরেন নিরুত্তাপ। “বাড়ি থেকে আপনাকে শাস্তি দিয়ে এখানে পাঠানো হয়েছিল সত্তর সালে। সেই আগুনমুখা ঝড়ের বছর। তবে আপনি তো বোধহয় ঝড়ের আগেই ফিরে গিয়েছিলেন।”

“ঠিক বলেছেন। তা আপনার ছেলেমেয়েরা কেমন আছে? তখন তো বোধহয় তিনটি ছিল, তাই না?”

“ওরা নিজেরাই এখন ছেলেপুলের বাপ-মা হয়ে গেছে,” হরেন বলল। “এই যে, এ হল আমার এক নাতি,” স্মার্ট নীল টি-শার্ট আর জিনস পরা একটা ছেলের দিকে ইশারা করল ও। “ওর নাম নগেন। এই সবে ইস্কুল শেষ করেছে। ও-ও যাবে আমাদের সঙ্গে নৌকোয়।”

“বেশ বেশ,” কানাই বলল। “এবার এনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ইনি হলেন শ্রীমতী পিয়ালি রায়, বৈজ্ঞানিক। ইনিই আপনার ভটভটিটা ভাড়া করছেন।”

পিয়ার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝোকাল হরেন। বলল, “চলুন তা হলে, ভটভটিটা দেখে নিন একবার।”

হরেনের পেছন পেছন বাঁধের ওপর উঠে এল পিয়া আর কানাই। সামনে নদীর বুকের ওপর ঢোকা লম্বাটে একটা বালির চড়া দেখা যাচ্ছে। এটাই লুসিবাড়ির জেটি। তার পাশে নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে হরেনের ভটভটি। তার গলুইয়ের সামনে বড় বড় সাদা অক্ষরে লেখা ‘এম ভি মেঘা।

এমনিতে নজরে ওঠার মতো কিছু নয় নৌকোটা। কেমন একটু অদ্ভুত ভাবে ভেসে আছে জলের ওপর। জায়গায় জায়গায় রং চটে গেছে, এখানে ওখানে বেড়ানো–পুরনো টিনের খেলনার মতো দেখতে খানিকটা। হরেনের কিন্তু ওর ভটভটি নিয়ে গর্বের শেষ নেই। বিশদভাবে তার গুণকাহিনি বর্ণনা করল ও। এ পর্যন্ত নাকি বহু সওয়ারি বয়েছে এই মেঘা। কখনও কেউ মন্দ বলতে পারেনি। কত পিকনিক পার্টিকে নিয়ে গেছে পাখিরালায়, কত বর আর বরযাত্রীকে নিয়ে দূর দূর দ্বীপে পৌঁছে দিয়েছে সেসব গল্প কানাইকে শোনাল হরেন। খুব একটা অবিশ্বাস্য মনে হল না গল্পগুলো। কারণ বাইরে থেকে দেখে জরাজীর্ণ মনে হলেও, জায়গা অনেক আছে নৌকোটায়। একটু গাদাগাদি হলেও, প্রয়োজন হলে যে এ ভটভটিতে অনেক লোক উঠতে পারে সে ব্যাপারে সন্দেহের বিশেষ কোনও কারণ দেখা গেল না। নৌকোর ভেতর দিকটা খানিকটা বড়সড় একটা গুহার মতো। সারি সারি বেঞ্চি পাতা। টানা লম্বা জানালায় হলুদ তেরপলের পর্দা ঝুলছে। গুহার এক প্রান্তে ইঞ্জিন ঘর, আরেক প্রান্তে রান্নার জায়গা। ওপরে একটা ছোট ডেক, সারেঙের ঘর, আর ছোট্ট ছোট্ট দুটো কেবিন। শেষ প্রান্তে টিন দিয়ে ঘেরা একটা বাথরুম। সেখানে মেঝেতে একটা গর্ত ছাড়া আর কিছুই নেই, তবে মোটের ওপর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।

“দেখতে আহামরি কিছু নয়,” স্বীকার করল কানাই। “তবে কাজ চলে যাবে মনে হয়। ওপরের কেবিনদুটোর একটায় আপনি থাকতে পারবেন, আর একটায় আমি। তা হলে ইঞ্জিনের আওয়াজটাও কানে লাগবে না, আর ধোঁয়াও খেতে হবে না।”

“আর ফকির কোথায় থাকবে?” পিয়া জিজ্ঞেস করল।

“ফকির নীচে থাকবে। হরেন আর ওর হেল্পার, মানে ওর নাতির সঙ্গে।”

“ব্যাস, মাত্র দু’জন? আর কোনও লোকজন লাগবে না?” প্রশ্ন করল পিয়া।

“নাঃ। বেশ ফাঁকায় ফাঁকায় যাওয়া যাবে,” বলল কানাই।

আরেকবার সন্দেহের দৃষ্টিতে মেঘার দিকে তাকাল পিয়া। “রিসার্চের পক্ষে আদর্শ নৌকো বলা যাবে না এটাকে, তবে মনে হয় মোটামুটি চালিয়ে নিতে পারব আমি। একটাই শুধু সমস্যা আছে।”

“কী সমস্যা?”

“এই গামলাটায় চড়ে ডলফিনগুলোকে ফলো করব কী করে সেটাই ভাবছি। সরু খাঁড়ি-টাড়িতে তো এটা ঢুকতে পারবে না।”

পিয়ার প্রশ্নটা হরেনকে অনুবাদ করে শোনাল কানাই। হরেনের জবাবটা আবার ইংরেজিতে বলে দিল পিয়াকে : ফকিরের ডিঙিটাও যাবে ওদের সঙ্গে। দড়ি দিয়ে মেঘার সঙ্গে বাঁধা থাকবে ওটা। তারপর পিয়ার কাজের জায়গায় পৌঁছলে ভটভটিটা এক জায়গায় অপেক্ষা করবে, আর পিয়া ফকিরের সঙ্গে ডিঙিতে করে ডলফিনদের পেছন পেছন যেতে পারবে।

“সত্যি?” এই জবাবটাই শুনতে চাইছিল পিয়া। “এই একটা জায়গায় অন্তত ফকির আমার থেকে এগিয়ে।”

“কী মনে হয়? চলবে?” জিজ্ঞেস করল কানাই।

“চলবে না মানে? চমৎকার আইডিয়া,” পিয়া বলল। “ছোট ডিঙিতেই ডলফিনদের ফলো করা বেশি সুবিধার।”

কানাইয়ের মধ্যস্থতায় ভটভটির ভাড়া-টাড়াগুলো ঠিক করা হয়ে গেল চটপট। ভাড়ার খানিকটা অংশ দিতে চাইল কানাই, কিন্তু কিছুতেই রাজি হল না পিয়া। শেষে রফা হল রসদ যা লাগবে তার খরচটা দু’জনে ভাগ করে নেবে। হরেনকে কিছু টাকা তক্ষুনি দিয়ে দেওয়া হল, চাল, ডাল, তেল, চা, মিনারেল ওয়াটার, গোটাদুয়েক মুরগি আর বিশেষ করে পিয়ার জন্য প্রচুর পাউডার দুধ কেনার জন্য।

“ওঃ, এত এক্সাইটেড লাগছে আমার,” গেস্ট হাউসের পথে ফিরতে ফিরতে বলল পিয়া। “মনে হচ্ছে এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ি। গেস্ট হাউসে ফিরে আজ সকালেই জামাকাপড়গুলো কেচে ফেলব।”

“আমিও মাসিকে গিয়ে খবরটা দিই। দিনকয়েক যে থাকব না সেটা জানাই। মাসি আবার কী বলবে কে জানে,” কানাই বলল।

দরজা খোলাই ছিল। ঘরে ঢুকে কানাই দেখল টেবিলের সামনে বসে আছে নীলিমা, হাতে চায়ের কাপ। হাসিমুখে তাকাল কানাইয়ের দিকে। কিন্তু তারপরেই হাসি মিলিয়ে গিয়ে ভাজ পড়ল কপালে। “কী ব্যাপার রে কানাই? কিছু গণ্ডগোল হয়েছে?”

“না, গণ্ডগোল কিছু হয়নি,” একটু অস্বস্তির সুর কানাইয়ের গলায়। “তোমাকে একটা কথা বলতে এসেছিলাম মাসি। আমি কয়েক দিন থাকব না।”

“ফিরে যাচ্ছিস নাকি?” আশ্চর্য হয়ে বলল নীলিমা। “এইতো মাত্র এলি, এখনি চলে যাবি?”

“ফিরে যাচ্ছি না গো,” কানাই বলল। “তুমি রাগ কোরো না মাসি, আসলে পিয়া একটা ভটভটি ভাড়া করেছে ওর সার্ভের জন্য। তো, ওর একজন দোভাষীর দরকার।”

“ও, আই সি,” নীলিমা বলল ইংরেজিতে। “তার মানে তুই ওর সঙ্গে যাচ্ছিস?”

নির্মলের স্মৃতি নীলিমার কাছে যে কতখানি, সেটা ভাল করেই জানে কানাই। নরম গলায় তাই বলল, “ভাবছিলাম নোটবইটাও নিয়ে যাব সঙ্গে। অবশ্য যদি তোমার আপত্তি না থাকে।”

“সাবধানে রাখবি তো?”

“নিশ্চয়ই।”

“কতটা পড়লি এ কয়দিনে?”

“অনেকটাই পড়া হয়ে গেছে,” জবাব দিল কানাই। “ফিরে আসার আগেই শেষ হয়ে যাবে মনে হয়।”

“বেশ। এই নিয়ে আর এখন কিছু জিজ্ঞেস করব না তোকে,”নীলিমা বলল। “কিন্তু একটা কথা বল কানাই, ঠিক কোথায় যাচ্ছিস তোরা?”

কানাই মাথা চুলকোতে লাগল। কোথায় যে যাওয়া হচ্ছে সেটা তো ও জানেই না। জিজ্ঞেস করার কথাটাও মাথায় আসেনি। কিন্তু কোনও ব্যাপারেই নিজের অজ্ঞানতা প্রকাশ করাটা স্বভাবে নেই ওর। তাই যে নদীর নাম মুখে এল বলে দিল মাসিকে। “মনে হয় তারোবাঁকি নদী পর্যন্ত যাব আমরা। একেবারে ফরেস্টের ভেতরে।”

“জঙ্গলে যাচ্ছিস?” একটু চিন্তিত চোখে কানাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল নীলিমা।

“তাই তো জানি,” কানাইয়ের গলায় অনিশ্চয়তা।

চেয়ার ছেড়ে উঠে ওর সামনে এসে দাঁড়াল নীলিমা। “কানাই, ভাল করে ভেবেচিন্তে যাচ্ছিস তো?”

“হ্যাঁ, ভাবব না কেন? ভেবেছি তো,” নিজেকে হঠাৎ একটা স্কুলে-পড়া ছেলের মতো মনে হল কানাইয়ের।

“আমার মনে হয় না তুই ভেবেচিন্তে যাচ্ছিস,” নীলিমা কোমরে হাত রাখল। “অবশ্য তোকে দোষ দেওয়াও যায় না। আমি জানি, বাইরের লোকেরা ধারণাই করতে পারে না কী ধরনের বিপদ হতে পারে এখানকার জঙ্গলে।”

“মানে তুমি বাঘের কথা বলছ?” কানাইয়ের ঠোঁটে মুচকি হাসির আভাস। “পিয়ার মতো একটা তাজা সুস্বাদু খাবার মুখের সামনে থাকলে বাঘে আমার দিকে ফিরেও তাকাবে না।”

“কানাই!” এক ধমক দিল নীলিমা। “এটা ঠাট্টার বিষয় নয়। আমি জানি, এই টুয়েন্টিফার্স্ট সেঞ্চুরিতে দাঁড়িয়ে নিজেকে বাঘের শিকার বলে কল্পনা করাটা তোর পক্ষে সহজ নয়, কিন্তু বাঘের অ্যাটাক এই সুন্দরবনে কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। প্রতি সপ্তাহে অন্তত এ রকম দু-তিনটে ঘটনা এখানে ঘটে।”

“সে কী! এত আকছার?” কানাই জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ। তার চেয়ে বেশি বই কম নয়। দাঁড়া, একটা জিনিস তোকে দেখাই,” কানাইয়ের কনুই ধরে ঘরের অন্যপ্রান্তে দেওয়ালের গায়ের সারি সারি বইয়ের তাকগুলোর কাছে নিয়ে গেল নীলিমা। “দেখ,” নীলিমা একটা ফাইলের বান্ডিলের দিকে ইশারা করল। “বছরের পর বছর ধরে লোকের মুখে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে আমি এই আনঅফিশিয়াল রেকর্ড রেখে যাচ্ছি। আমার হিসেব মতো প্রতি বছর একশোরও বেশি মানুষ এখানে বাঘের পেটে যায়। এটা কিন্তু শুধু সুন্দরবনের ইন্ডিয়ান অংশটার কথা বলছি আমি। বাংলাদেশের ভাগটাও যদি ধরিস তা হলে বোধহয় সংখ্যাটা দ্বিগুণেরও বেশি গিয়ে দাঁড়াবে। সব মিলিয়ে হিসেব করলে দেখা যাবে প্রতি একদিন অন্তর একটা করে মানুষ বাঘে নেয় এই সুন্দরবনে। অন্তত।”

চোখ কপালে উঠে গেল কানাইয়ের। “বাঘের হাতে যে মানুষ মরে এখানে সেটা জানতাম, কিন্তু সংখ্যাটা এত বেশি সেটা ধারণা ছিল না।”

“সেটাই সমস্যা,” নীলিমা বলল। “কেউই জানে না ঠিক কত লোক বাঘের কবলে পড়ে সুন্দরবনে। কোনও হিসেবই ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়। কিন্তু একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত–সরকারি খাতাপত্রে যা হিসেব দেখানো হয়, সংখ্যাটা তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি।”

কানাই মাথা চুলকাল। “এই বাড়াবাড়িটা নিশ্চয়ই রিসেন্ট ব্যাপার। লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার জন্যও তো হতে পারে? হয়তো বাঘের থাকার জায়গায় মানুষের হাত পড়ছে, বা ওরকম কিছু কারণে?”

“কী যে বলিস,” নীলিমা একটু বিরক্ত হল। “শত শত বছর ধরে এইভাবে মানুষ মরছে এখানে। লোকসংখ্যা যখন এখনকার তুলনায় খুবই সামান্য ছিল তখনও একই ঘটনা ঘটেছে। এইটা দেখ,” বুড়ো আঙুলের ওপর ভর দিয়ে ওপরের তাক থেকে একটা ফাইল টেনে নামাল নীলিমা। তারপর নিয়ে গেল নিজের টেবিলে। “দেখ। এখানে দেখ। দেখতে পাচ্ছিস সংখ্যাটা?”

খোলা পাতাটার দিকে তাকিয়ে কানাই দেখল নীলিমা যেখানে আঙুল রেখেছে ঠিক তার ওপরে লেখা রয়েছে একটা সংখ্যা : ৪,২১৮।

“সংখ্যাটা লক্ষ কর কানাই,” বলল নীলিমা। “এটা হল মাত্র ছ’বছরের হিসেব। ১৮৬০ থেকে ১৮৬৬-র মধ্যে এই এতগুলো তোক বাঘের পেটে গিয়েছিল এই নিম্নবঙ্গে। এটা জে. ফেরারের দেওয়া হিসেব। এই ফেরার ছিলেন একজন ইংরেজ প্রকৃতিবিদ। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার’ নামটা ওনারই দেওয়া। একবার কল্পনা কর কানাই–চার হাজারেরও বেশি মানুষ মরেছে মাত্র ছ’বছরে। গড়ে প্রতিদিন দু’জন করে। একশো বছরে সংখ্যাটা তা হলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে একবার ভেবে দেখ।”

“ষাট-সত্তর হাজার।”ভুরু কুঁচকে ফাইলের খোলা পাতাটার দিকে তাকিয়ে রইল কানাই।

“বিশ্বাস করা কঠিন।”

“কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এটা নির্জলা সত্যি,” নীলিমা বলল। “তোমার কী মনে হয় মাসি? কেন এরকম হয়?” জিজ্ঞেস করল কানাই। “কী হতে পারে কারণটা?”

চেয়ারে বসে পড়ল নীলিমা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “জানি না রে কানাই। এত রকম সব থিয়োরি আছে এই নিয়ে, কোনটা যে বিশ্বাস করব বুঝে উঠতে পারি না।”

“তবে একটা বিষয়ে সব তাত্ত্বিকরাই এক মত, এই ভাটির দেশের বাঘের স্বভাবচরিত্র অন্য সব জায়গার বাঘেদের থেকে একেবারে আলাদা,” বলল নীলিমা। অন্যান্য জায়গার বাঘেরা মানুষকে আক্রমণ করে একমাত্র খুব বিপাকে পড়লে–পঙ্গু হয়ে গেলে বা কোনও কারণে অন্য কোনও শিকার ধরতে অক্ষম হয়ে গেলে। কিন্তু ভাটির দেশের বাঘের জন্য সে তত্ত্ব আদৌ খাটে না। স্বাস্থ্যবান বা কমবয়সি বাঘেদেরও এখানে মানুষখেকো হতে দেখা যায়। কারও কারও মতে এর কারণ হল এখানকার অদ্ভুত পরিবেশতন্ত্র–একমাত্র এই জঙ্গলেই বাঘেদের চারণভূমির অর্ধেকের বেশি অংশ প্রতিদিন ডুবে যায় জোয়ারের জলে। জল তাদের ঘ্রাণচিহ্ন ধুয়ে দেয়, ফলে যে প্রবৃত্তিগত ক্ষমতায় বাঘেরা নিজেদের এলাকা চিনে নিতে পারে তা ঘুলিয়ে যায়। সেইজন্যেই এত হিংস্র হয়ে ওঠে এখানকার বাঘেরা। সুন্দরবনের বাঘের হিংস্রতার কারণ সম্পর্কে যে কয়েকটা তত্ত্বের কথা শোনা যায় তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় নীলিমার। কিন্তু এই তত্ত্ব মেনে নিলেও সে ব্যাপারে করার তো কিছু নেই।

বছর কয়েক পর পরই কেউ না কেউ একটা না একটা নতুন তত্ত্ব এনে হাজির করে। আর মাঝে মাঝে তার সাথে থাকে অদ্ভুত সব সমাধানের উপায়। ১৯৮০-র দশকে একবার এক জার্মান প্রকৃতিবিদ বললেন নরমাংসের প্রতি এখানকার বাঘেদের এই আসক্তির সঙ্গে সুন্দরবনে মিষ্টি জলের অভাবের সম্পর্ক আছে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের খুব মনে ধরেছিল সেই থিয়োরি। বাঘেদের জন্য চটপট কয়েকটা মিষ্টি জলের পুকুর খোঁড়া হয়ে গেল জঙ্গলের ভেতরে।

“ভাব একবার কাণ্ডটা!” নীলিমা বলল। “বাঘের জল খাওয়ার জন্য পুকুর! আর সেটা করা হচ্ছে এমন এক জায়গায় যেখানে মানুষের তেষ্টার কথাটা কেউ ভাবেও না!”

সে যাই হোক, এই পুকুর-টুকুর খোঁড়া সবই শেষ পর্যন্ত বৃথা গেল। বিন্দুমাত্র কোনও লাভ হল না। বাঘের আক্রমণ যেমন চলছিল চলতেই থাকল।

“তার কিছুদিন পর এল আরেকটা নতুন থিয়োরি। ইলেকট্রিক শক,” নীলিমার চোখের কোণে চিকচিক করছে হাসি।

“এক বিশেষজ্ঞের মনে হল পাভলভ তার কুকুরদের যেভাবে একটা নিয়মে অভ্যস্ত করেছিলেন, সেই একই পদ্ধতিতে সুন্দরবনের বাঘেরও অভ্যাস পালটে দেওয়া যেতে পারে। মাটি দিয়ে অনেকগুলো প্রমাণ সাইজের মানুষের মূর্তি বানানো হল। তারপর সেগুলোর গায়ে তার জড়িয়ে সেই তার জুড়ে দেওয়া হল গাড়ির ব্যাটারির সঙ্গে। এই বৈদ্যুতিক মানুষ-পুতুলগুলোকে এবার বসানো হল জঙ্গলের মধ্যে বিভিন্ন দ্বীপে। প্রথম প্রথম কিছুদিন মনে হল ওষুধ ধরেছে। লোকের মনে ফুর্তি আর ধরে না। কিন্তু কয়েকদিন পরেই আবার শুরু হল হানা। মূর্তিগুলো যেমন কে তেমন পড়ে রইল, আর আগের মতোই ফের মরতে লাগল মানুষ।

“আরেকবার, এক ফরেস্ট অফিসারের মাথায় এরকমই আরেকটা অদ্ভুত আইডিয়া এল। জঙ্গলে যারা যাবে, তারা যদি মাথার পেছনদিকে একটা মুখোশ পরে নেয় তা হলে কেমন হয়? যুক্তিটা হল–বাঘে তো মানুষকে সাধারণত পেছনদিক থেকে আক্রমণ করে, তাই ওই একজোড়া রং করা চোখকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলে নিশ্চয়ই সেখান থেকে পালিয়ে যাবে। এই থিয়োরিটাও সকলের খুব পছন্দ হল। প্রচুর মুখোশ তৈরি করে বিলি করা হল সর্বত্র। সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হল অসাধারণ এক এক্সপেরিমেন্ট শুরু হয়েছে সুন্দরবনে। আইডিয়াটার চিত্রগুণ লোকের বেশ মনে ধরল। একের পর এক টেলিভিশন ক্যামেরা এল, এমনকী কয়েকজন পরিচালক ফিল্মও বানিয়ে ফেললেন গোটাকতক।

“কিন্তু বাঘেদের দিক থেকে আদৌ কোনও সহযোগিতা পাওয়া গেল না। বোঝাই গেল, মুখ আর মুখোশের তফাত ধরতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হচ্ছে না তাদের।”

“মানে তুমি বলতে চাইছ যে এই সবকিছু বুঝে শুনে হিসেব করে শিকার ধরার ক্ষমতা আছে এখানকার বাঘের?” জিজ্ঞেস করল কানাই।

“জানি না রে কানাই। আমি তো পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এখানে আছি, কিন্তু একবারও বাঘ দেখিনি। দেখতে চাইও না। এখানকার লোকে যেটা বলে সেটা আমি খুব মানিঃ জঙ্গলে বাঘ দেখে সে গল্প বলার জন্য জ্যান্ত ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। সেইজন্যেই তোকে বলছি কানাই, খেয়াল হল আর জঙ্গলে চলে গেলাম, সেরকম করা মোটেই উচিত নয়। যাওয়ার আগে ভাল করে একবার ভেবে দেখিস, সত্যিই তোর যাওয়ার কোনও প্রয়োজন আছে কি না।”

“কিন্তু আমার তো জঙ্গলে যাওয়ার কোনও প্ল্যান নেই,” কানাই বলল। “আমি তো থাকব ভটভটিতে। সেখানে আর বিপদ কেন হবে?”

“ভটভটিতে থাকলে কোনও বিপদ হতে পারে না ভেবেছিস?”

“হ্যাঁ। আমরা তো জলের ওপরে থাকব। পাড় থেকে অনেক দূরে। সেখানে আর কী হবে?

“তা হলে একটা ঘটনার কথা বলি তোকে। ন’বছর আগে এই লুসিবাড়ি থেকেই একবার একটা বাচ্চা মেয়েকে বাঘে নিয়েছিল। পরে দেখা গেল সে বাঘটা পুরো বিদ্যা নদীর মোহনা সাঁতরে এসেছিল এখানে। তারপর শিকার ধরে আবার ফিরে গিয়েছিল মোহনা পেরিয়ে। দূরত্বটা কত জানিস?”

“না।”

“ছয় ছয় বারো কিলোমিটার, যাতায়াত মিলিয়ে। আর সুন্দরবনের বাঘের পক্ষে সেটা কোনও দূরত্বই নয়। একটানা তেরো কিলোমিটার পর্যন্ত সাঁতরে গিয়ে শিকার ধরেছে বাঘ সেরকম ঘটনাও ঘটেছে এখানে। তাই কখনওই ভাবিস না যে জলের ওপর আছিস বলে বিপদের কোনও সম্ভাবনা নেই। নৌকো আর ভটভটিতে বাঘের হানার কথা আকছারই শোনা যায় এখানে। এমনকী মাঝনদীতেও। প্রত্যেক বছর বেশ কয়েকটা ঘটনা ঘটে এরকম।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ,” মাথা নাড়ল নীলিমা। “আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয় তা হলে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের যে-কোনও লঞ্চ দেখলেই বুঝতে পারবি কতখানি ঝুঁকি নিয়ে চলাফেরা করতে হয় এখানে। একেকটা লঞ্চ একেবারে ভাসমান দুর্গের মতো। আমার কবজির মতো ইয়া মোটা মোটা লোহার গরাদ দেওয়া জানালায়। ফরেস্ট গার্ডদের সঙ্গে বন্দুক থাকা সত্ত্বেও এই রকম দুর্ভেদ্য করে বানানো হয় লঞ্চগুলিকে। তোর ওই ভটভটির জানালায় কি কোনও গরাদ-টরাদের বালাই আছে?”

মাথা চুলকাল কানাই। “মনে পড়ছে না ঠিক।”

“কিছু বলার নেই,” বলল নীলিমা। ব্যাপারটা লক্ষ করারই কোনও প্রয়োজন মনে করিসনি তুই। কোন বিপদের মধ্যে পা বাড়াচ্ছিস সেটা তুই বুঝতে পারছিস বলে মনে হচ্ছে না। জন্তু জানোয়ারের কথা যদি ছেড়েও দিই–এইসব ভটভটি আর নৌকোগুলোই তো সবচেয়ে বিপজ্জনক। প্রতি মাসে কোথাও না কোথাও একটা-দুটো নৌকোডুবি লেগেই আছে।”

“তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পার মাসি। কোনওরকম কোনও ঝুঁকি নেব না আমি,” কানাই বলল।

“কিন্তু একটা কথা তুই বুঝতে পারছিস না কানাই। আমার মনে হচ্ছে তুই নিজেই সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। অন্য সবাই কোনও না কোনও প্রয়োজনে যাচ্ছে, কিন্তু তুই তো যাচ্ছিস স্রেফ একটা খেয়ালের বশে। জঙ্গলে যাওয়ার কোনও দরকার তো তোর নেই।”

“তা নয়, একটা কারণ আছে–” কিছু না ভেবেই কথাটা বলতে শুরু করেছিল কানাই। সচেতন হতে হঠাৎ থেমে গেল মাঝপথে।

“কানাই? তুই কিছু লুকোচ্ছিস আমার কাছ থেকে?”

“না না, সেরকম কিছু নয়,” কী বলবে ঠিক ভেবে উঠতে না পেরে মাথা নিচু করল কানাই।

তীক্ষ্ণ চোখে বোনপোর দিকে তাকাল নীলিমা। “ওই মেয়েটা, তাই না? পিয়া?” কোনও জবাব দিল না কানাই। মুখ ঘুরিয়ে তাকাল অন্য দিকে। হঠাৎ গলার সুরে প্রচণ্ড শ্লেষ ঝরিয়ে নীলিমা বলল, “তোরা সব এক রকম, তোরা পুরুষরা। তোদের মতো হিংস্র প্রাণীরা যদি মানুষ বলে পার পেয়ে যায় তা হলে বাঘেদের আর কী দোষ?” এত তেতো সুর মাসির গলায় আগে কখনও শোনেনি কানাই।

কানাইয়ের কনুইটা ধরে আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগোল নীলিমা। “সাবধান, কানাই খুব সাবধান, বলে রাখলাম।”