রাতের খাবার দেখে পিয়ার মনে হল ওর খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাস সম্পর্কে ময়নাকে কেউ কিছু বলেছে। সাধারণ ভাত আর মাছের ঝোল ছাড়াও এ বেলা ময়না নিয়ে এসেছে খানিকটা আলুসেদ্ধ আর দুটো কলা। ভাল লাগল পিয়ার। হাত জোড় করে ময়নাকে ধন্যবাদ জানাল ও।
ময়না চলে যাওয়ার পর পিয়া কানাইকে জিজ্ঞেস করল ও কি এ ব্যাপারে ময়নাকে কিছু বলেছে? মাথা নাড়ল কানাই : “না তো।”
“তা হলে নিশ্চয়ই ফকির।” সাগ্রহে আরও এক হাতা আলুসেদ্ধ তুলে নিল পিয়া। “এখন শুধু একটু ওভালটিন থাকলেই সোনায় সোহাগা হত।”
“ওভালটিন?” আশ্চর্য হয়ে প্লেট থেকে চোখ তুলে তাকাল কানাই। “আপনি ওভালটিন ভালবাসেন?” মাথা নেড়ে পিয়া হ্যাঁ বলাতে হাসতে শুরু করল ও। “মার্কিন দেশেও আজকাল লোকে ওভালটিন খাচ্ছে নাকি?”
“এই অভ্যাসটা আসলে দেশ থেকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল আমার বাবা মা,” জবাব দিল পিয়া। “স্টক ফুরোলে ওখানকার ইন্ডিয়ান দোকান থেকে কিনে নিত। আর আমি পছন্দ করি কারণ জিনিসটা সঙ্গে রাখাও সহজ, আর জলে জলে ঘোরার সময় বানিয়ে খেয়ে নিতেও কোনও ঝামেলা নেই।”
“তার মানে আপনার ওই ডলফিনদের পিছু পিছু ঘুরে বেড়াবার সময় আপনি ওভালটিন খেয়েই কাটান?”
“কখনও কখনও।”
প্লেট ভরে ভাত ডাল আর হেঁচকি তুলে নিতে নিতে দুঃখের সঙ্গে মাথা নাড়াল কানাই। “এই প্রাণীগুলোর জন্যে অনেক কষ্ট করেন আপনি, না?”
“আমি ঠিক সেভাবে দেখি না ব্যাপারটাকে।”
“আপনার এই জন্তুগুলো কি খুব ইন্টারেস্টিং?” জিজ্ঞেস করল কানাই। “মানে, ওদের নিয়ে চর্চা করার জন্যে আগ্রহ হতে পারে লোকের?”
“আমি তো যথেষ্টই ইন্টারেস্ট পাই,” পিয়া বলল। “আর অন্তত একটা কারণ আমি বলতে পারি যাতে আপনার মনেও একটু আগ্রহ জাগতে পারে।”
“বলুন, শুনছি,” জবাব দিল কানাই। “সাগ্রহে অপেক্ষা করিতেছি প্ররোচিত হইবার জন্য। বলুন, কী সেই কারণ?”
“একেবারে প্রথম দিকে যে জায়গাগুলোতে এই জাতীয় শুশুকের নমুনা পাওয়া গিয়েছিল, সেগুলির মধ্যে একটা হল কলকাতা,” পিয়া বলল। “একটু ইন্টারেস্ট পাচ্ছেন কি এবার?”
“কলকাতা?” কানাইয়ের চোখে অবিশ্বাস। “মানে আপনি বলতে চান কলকাতায় এক সময় ডলফিন দেখা যেত?”
“যেত। শুধু ডলফিন কেন, তিমি মাছও দেখা যেত এক সময়,” পিয়া বলল। “তিমি মাছ?” হেসে ফেলল কানাই। “রসিকতা করছেন?”
“রসিকতা নয়, সত্যি সত্যিই একটা সময় এইসব জলচর প্রাণীদের প্রচুর সংখ্যায় দেখতে পাওয়া যেত কলকাতায়।”
“বিশ্বাস হচ্ছে না,” স্পষ্ট জবাব কানাইয়ের। “মানে, এরকম কিছু হলে সেটা আমি নিশ্চয়ই জানতে পারতাম।”
“কিন্তু ঘটনাটা সত্যি,” বলল পিয়া। “আপনাকে বলেই ফেলি, এই যে গত সপ্তাহে আমি কলকাতা হয়ে এলাম, সেটা ছিল বলতে পারেন আমার প্রাণীবৈজ্ঞানিক তীর্থযাত্রা।”
হাসিতে ফেটে পড়ল কানাই। “প্রাণীবৈজ্ঞানিক তীর্থযাত্রা?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ,” পিয়া বলল। “কলকাতায় আমার মাসতুতো বোনেরাও হেসেছিল কথাটা শুনে, কিন্তু সত্যি জানেন, এক বর্ণও বাড়িয়ে বলছি না, এবার কলকাতায় তীর্থেই এসেছিলাম আমি।”
“আপনার মাসতুতো বোনেরা?” জিজ্ঞেস করল কানাই।
“হ্যাঁ। আমার মাসিমার দুই মেয়ে। দু’জনেই আমার চেয়ে বয়সে ছোট। একজন স্কুলে পড়ে, আরেক জন কলেজে। বেশ ব্রাইট, স্মার্ট দুটো মেয়ে। ওরা বলল কলকাতায় যেখানে যেখানে আমি যেতে চাই, বাড়ির গাড়িতে করে নিয়ে যাবে আমায়। ড্রাইভার আছে, কোনও অসুবিধা হবে না। ওরা মনে হয় ভেবেছিল আমি টুকটাক কেনাকাটা করতে চাইব। তাই যখন বললাম আমি কোথায় যেতে চাই ওরা অবাক হয়ে গেল : বটানিকাল গার্ডেনস! ওখানে কী করতে যাবে?”
“ঠিক প্রশ্ন। বটানিকাল গার্ডেনের সঙ্গে ডলফিনের কী সম্পর্ক?” কানাই প্রশ্ন করল।
“সম্পর্ক আছে,” বলল পিয়া। “নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরিতে এই বটানিকাল গার্ডেনের ভার ছিল খুব দক্ষ কয়েকজন প্রকৃতিবিদের ওপর। তাদেরই একজন ছিলেন এই গ্যাঞ্জেটিক ডলফিনের আবিষ্কর্তা উইলিয়াম রক্সবার্গ।
“কলকাতার এই বটানিকাল গার্ডেনে বসেই ১৮০১ সালে রক্সবার্গ সেই বিখ্যাত প্রবন্ধ লেখেন, যাতে তার নদীজলের ডলফিন আবিষ্কারের কথা জানতে পারে সারা পৃথিবী। এই ডলফিনের নাম তিনি দিয়েছিলেন ডেলফিনাস গ্যাঞ্জেটিকাস (কলকাতার বাঙালিরা এই প্রাণীকে বলে শুশুক’)। পরে অবশ্য জানা গেল খ্রিস্টীয় প্রথম শতকেই রোমান পণ্ডিত প্লিনি দ্যা এল্ডার এই ভারতীয় ডলফিনদের বিষয়ে লিখে গেছেন। তাঁর বইয়ে তিনি এই প্রাণীদের প্লাটানিস্টা বলে উল্লেখ করেছেন। এই তথ্য জানার পর পরিবর্তন করা হল রক্সবার্গের দেওয়া নাম। জুওলজিক ইনভেন্টরির তালিকায় এই শুশুকরা এখন প্লাটানিস্টা গ্যাঞ্জেটিকা রক্সবার্গ ১৮০১। বহু বছর পরে, জন অ্যান্ডারসন নামে বটানিকাল গার্ডেনে রক্সবার্গের এক উত্তরসূরি বাথটাবের মধ্যে একটা ডলফিনের বাচ্চা পুষেছিলেন। কয়েক সপ্তাহ বেঁচে ছিল বাচ্চাটা।
“কিন্তু মজার ব্যাপার কী জানেন,” বলল পিয়া, “বাথটাবে ডলফিন পুষলেও অ্যান্ডারসন কিন্তু জানতেন না যে এই প্লাটানিস্টারা চোখে দেখতে পায় না। ওরা যে কাত হয়ে সাঁতার কাটে সেটাও উনি লক্ষ করেননি।”
“তাই বুঝি?”
“হ্যাঁ।”
“সেই বাথটাবটা খুঁজে পেলেন নাকি?” আরও একটু ভাত নেওয়ার জন্য হাত বাড়াল কানাই।
হেসে ফেলল পিয়া। “না। তবে তাতে বিশেষ দুঃখ হয়নি আমার। ওখানে যে যেতে পেরেছি তাতেই আমি খুশি।”
“তো, এর পরে কোথায় গেলেন তীর্থ করতে?” জিজ্ঞেস করল কানাই।
“সেটা শুনলে আরও আশ্চর্য হবেন আপনি,” পিয়া বলল। “সল্ট লেক।”
চোখ কপালে উঠে গেল কানাইয়ের। “মানে, আমাদের সল্ট লেক উপনগরী?”
“উপনগরী তো আর চিরকাল ছিল না,” দ্বিতীয় কলাটার খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে জবাব দিল পিয়া।
“১৮৫২ সালে জায়গাটা ছিল স্রেফ একটা জলা জমি৷ তারই মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েকটা পুকুর আর দিঘি। সে বছর জুলাই মাসে একবার বিশাল এক বান এল,” বলে চলল পিয়া। “ফুলে ফেঁপে উঠল গোটা বদ্বীপের সব নদী। জলের তোড় ঢুকে এল অনেক ভেতর পর্যন্ত। কলকাতার আশেপাশে সমস্ত জলা আর বাদা ভেসে গেল। তারপর জল যখন নামতে শুরু করল, সারা কলকাতায় গুজব ছড়িয়ে গেল শহরের পুবদিকের এক নোনা জলের ঝিলের মধ্যে নাকি এক দল বিশাল সামুদ্রিক জীব আটকা পড়ে রয়েছে। সে সময় কলকাতার বটানিকাল গার্ডেনের সুপারিন্টেডেন্ট ছিলেন ইংরেজ প্রকৃতিবিদ এডওয়ার্ড ব্লিথ। খবরটা শুনে তো তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। কারণ ঠিক তার আগের বছরেই মালাবার উপকূলে এভাবে আটকা পড়েছিল একটা তিমি মাছ। সাতাশ মিটার লম্বা সে মাছটাকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলেছিল সেখানকার গ্রামের লোকেরা। ছুরি, কুড়ুল, বর্শা যে যা পেয়েছিল হাতের কাছে তাই নিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল প্রাণীটার ওপর। ওখানকার এক ইংরেজ পাদরিকে সেই তিমি মাছের টাটকা আর শুকনো মাংস নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছিল লোকে, বলেছিল সে নাকি খুব সুস্বাদু মাংস। এই জীবগুলোকেও যদি ঠিকমতো পরীক্ষা করার আগেই কেটেকুটে খেয়ে নেয় সবাই? এই ভেবে তাড়াতাড়ি সল্ট লেকের দিকে রওনা হলেন ব্লিথ সাহেব।
“প্রাণীগুলোর মরা-বাঁচা নিয়ে সাহেবের যে বিশেষ দুশ্চিন্তা ছিল তা নয়, তবে ওদের মারার কাজটা উনিই নিজের হাতে করতে চেয়েছিলেন, এই যা,” বলল পিয়া।
“আকাশে তখন চড়চড়ে রোদ, গোটা জলাটার থেকে যেন ভাপ উঠছে। বাড়তি বানের জলটাও নেমে গেছে। সল্ট লেকে পৌঁছে সাহেব দেখলেন ছোট একটা এঁদো পুকুরে প্রায় গোটা বিশেক প্রাণী কিলবিল করছে। গোল ধরনের মাথা, সারা শরীর কালো, শুধু পেটের দিকের রংটা সাদা। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ প্রাণীগুলো একেকটা চার মিটারেরও বেশি লম্বা। ডোবাটায় জল তখন এতই কম যে প্রাণীগুলোর সারা শরীর ডুবছে না, পিঠের ছোট পাখনাগুলোর ওপর দুপুরের রোদ পড়ে পিছলে যাচ্ছে। খুবই বিপদে পড়েছে প্রাণীগুলো। এমনকী একটা কাতর আর্তনাদের মতো শব্দও পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। প্রথমটায় ব্লিথের মনে হল ওগুলি বোধহয় খাটো পাখনাওয়ালা পাইলট তিমি, গ্লোবিসেফ্যালাস ডিডাকটর। আটলান্টিক মহাসাগরে এদের বেশি দেখা যায়। বছর ছয়েক আগে ব্রিটিশ শারীরতত্ত্ববিদ জে ই গ্রে এই তিমি আবিষ্কার করেছিলেন। নামকরণটাও গ্রে সাহেবেরই।
“ইনি কি গ্রেজ অ্যানাটমির সেই গ্রে?” কানাই জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ। ইনিই তিনি।”
“ডোবাটার চারপাশে ততক্ষণে বহু লোক জড়ো হয়ে গেছে। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে ব্লিথ দেখলেন তারা কেউ প্রাণীগুলোকে মারে-টারেনি। অনেকে বরং সারা রাত ধরে খাটা-খাটনি করেছে ওদের বাঁচানোর জন্য। সরু একটা খালের মধ্যে দিয়ে টেনে নিয়ে গিয়ে জন্তুগুলোকে নদীতে ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। মনে হল তিমি মাছের মাংসের প্রতি এখানকার গ্রামের লোকেদের বিশেষ আসক্তি নেই। প্রাণীগুলিকে মেরে যে তেল বের করা যেতে পারে সেটাও বোধহয় এদের জানা নেই। ব্লিথ শুনলেন অনেকগুলো প্রাণীকেই এর মধ্যে নদীতে ছেড়ে দিতে পেরেছে গ্রামবাসীরা। বেশ কয়েক ডজনের বড় একটা ঝাক নাকি ছিল এই ডোবায়। তার থেকে এই কয়েকটা এখনও রয়ে গেছে। যে গতিতে উদ্ধারকাজ চলছে, সাহেবের মনে হল খুব বেশি সময় আর হাতে নেই। অবশিষ্ট প্রাণীগুলোর মধ্যে থেকে সব চেয়ে ভাল দেখে দুটোকে বেছে নিলেন ব্লিথ। সঙ্গীদের বললেন পাড়ে খুঁটি পুঁতে । তার সঙ্গে শক্ত দড়ি দড়া দিয়ে সেগুলোকে বেঁধে রাখতে। ভাবলেন পরদিন উপযুক্ত যন্ত্রপাতি নিয়ে এসে ঠিকমতো ব্যবচ্ছেদের বন্দোবস্ত করা যাবে।
“কিন্তু পরদিন সকালে ফিরে এসে সাহেব দেখলেন সব ভো ভা। দুটো তিমির একটাও সেখানে নেই,” পিয়া বলল। “গ্রামের লোকেরা দড়ি কেটে জলে ছেড়ে দিয়েছে তাদের। কিন্তু ব্লিথও দমবার পাত্র নন। শেষ যে ক’টা প্রাণী সেখানে ছিল, তাদের মধ্যে থেকে দুটোকে ডাঙায় তুলে এনে চটপট কেটেকুটে ফেললেন। তারপর দীর্ঘক্ষণ ধরে হাড়গুলোকে পরীক্ষা করে সাহেব সিদ্ধান্তে এলেন এগুলো একেবারে নতুন প্রজাতির প্রাণী। এদের নাম উনি দিলেন ইন্ডিয়ান পাইলট হোয়েল, গ্লোবিসেফ্যালাস ইন্ডিকাস৷
“এইখানে আমার একটা থিয়োরি আছে,” মুচকি হেসে পিয়া বলল। “ব্লিথ যদি সেদিন সল্ট লেকে না যেতেন তা হলে উনিই একদিন ইরাবড়ি ডলফিন আবিষ্কার করতে পারতেন।”
ডান হাতের তর্জনী থেকে একটা ভাতের দানা চেটে নিল কানাই। “কেন?”
“কারণ ছ’বছর পর প্রথম ওর্কায়েলার নমুনাটা যখন উনি দেখলেন, তখন খুব বড় একটা ভুল করে ফেললেন ব্লিথ সাহেব।”
“সেটা আবার কোথায় দেখলেন উনি?”
“কলকাতায়। একটা মাছের বাজারে,” হেসে বলল পিয়া। “কেউ এসে ওনাকে বলেছিল, এরকম একটা অদ্ভুত প্রাণী বাজারে এসেছে। খবরটা শুনে তো দৌড়ে গেলেন সাহেব সেখানে। প্রাণীটাকে এক নজর দেখেই সিদ্ধান্ত করলেন ওটা আসলে একটা বাচ্চা পাইলট তিমি। ছ’বছর আগে সল্ট লেকে যে প্রাণীগুলোকে দেখেছিলেন, সেই জাতের। ওই সল্ট লেকের প্রাণীগুলোকে কিছুতেই মাথা থেকে বের করতে পারেননি ব্লিথ।”
“তা হলে আপনার এই সাধের ডলফিনদের আবিষ্কারকর্তা ব্লিথ সাহেব নন?” জিজ্ঞেস করল কানাই।
“নাঃ,” বলল পিয়া। “একটুর জন্যে সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে গেল ব্লিথবাবুর। তার প্রায় বছর পঁচিশেক পরে কলকাতা থেকে সাড়ে ছ’শো কিলোমিটার দূরে বিশাখাপত্তনমে আরেকটা এই রকম ছোট মাপের গোল-মাথা জলজন্তুর দেহ পাওয়া গেল। এবারে তার কঙ্কালটা সোজা নিয়ে যাওয়া হল ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। সেখানে তো হইচই পড়ে গেল। লন্ডনের শারীরতত্ত্ববিদরা কঙ্কালটা পরীক্ষা করলেন। ব্লিথ সাহেব যা দেখতে পাননি, এই পণ্ডিতদের কিন্তু তা চোখ এড়াতে পারল না। দেখা গেল প্রাণীটা মোটেই পাইলট তিমির বাচ্চা নয়। এটা একটা নতুন প্রজাতির জীব–খুনে তিমি ওসিঁস ওর্সার দূর সম্পর্কের আত্মীয়! কিন্তু ওর্সার সঙ্গে অনেক অমিলও আছে। একেকটা খুনে তিমি লম্বায় দশ মিটার পর্যন্ত হতে পারে, কিন্তু এই নতুন প্রাণীটার দৈর্ঘ্য মেরেকেটে আড়াই মিটার। আবার, খুনে তিমিরা মেরু সাগরের হিম ঠান্ডা জলে থাকতে ভালবাসে, কিন্তু তাদের এই আত্মীয়ের পছন্দ নিরক্ষীয় অঞ্চলের উষ্ণ জল–তা সে নোনা জলও হতে পারে, আবার মিঠেও হতে পারে। বিশালকায় ওর্সার তুলনায় এতই নরম-সরম এই প্রাণীটা, যে এর নামকরণের সময় : পণ্ডিতদের একটা ক্ষুদ্রত্ববাচক শব্দ ভেবে বের করতে হল। নাম ঠিক করা হল ওর্কায়েলা–ওর্কায়েলা ব্রেভিরোষ্ট্রিস।
“আপনি বলতে চান এই খুনেলা তিমি একটা ধরা পড়েছিল কলকাতায়, আর-একটা বিশাখাপত্তনমে?” একটু খটকার সুর কানাইয়ের গলায়।
“হ্যাঁ।”
“তা হলে এদের ‘ইরাবড়ি ডলফিন’ বলা হচ্ছে কেন?”
“সে আরেক কাহিনি। এই ইরাবড়ি ডলফিন নামটা দিয়েছিলেন জন অ্যান্ডারসন–সেই যে সাহেব নিজের বাথটাবে শুশুক পোষার চেষ্টা করেছিলেন,” পিয়া বলল। “১৮৭০-এর দশকে অ্যান্ডারসন বার দুয়েক প্রাণিতাত্ত্বিক অভিযানে বার্মা হয়ে দক্ষিণ চিন পর্যন্ত গিয়েছিলেন। ইরাবড়ি নদীর ভাটি বেয়ে তারা যখন যাচ্ছিলেন, সেই সময়ে কোনও ওর্কায়েলা তাঁদের চোখে পড়েনি। উজানের দিকে কিন্তু প্রচুর সংখ্যায় দেখা গেল ডলফিনগুলোকে। নোনা জলের ডলফিন আর মিষ্টি জলের ডলফিনদের মধ্যে শারীরবৃত্তীয় কিছু তফাতও রয়েছে মনে হল। অ্যান্ডারসন সিদ্ধান্তে এলেন, এই নদীর ডলফিনদের নিশ্চয়ই দুটো আলাদা প্রজাতি রয়েছে: ওর্কায়েলা ব্রেভিরোষ্ট্রিস-এর এক তুতো ভাই আমদানি করলেন সাহেব–ওর্কায়েলা ফ্লিউমিনালিস৷ তার হিসেব মতো এই হল ইরাবড্ডি ডলফিন, এশিয়ার সব নদীর আসল বাসিন্দা।
“অ্যান্ডারসনের দেওয়া নামটা রয়ে গেল, কিন্তু তার সিদ্ধান্তটা টিকল না,” বলল পিয়া। “বেশ কয়েকটা কঙ্কাল পরীক্ষা করে গ্রে সাহেব রায় দিলেন দুটো নয়, ওর্কায়েলার একটার বেশি জাত হয় না। এদের মধ্যে এক দল সমুদ্র উপকূলের নোনা জলে থাকতে ভালবাসে, আর এক দল পছন্দ করে নদীর মিষ্টি জল, সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই; আর এটাও ঠিক যে এই দুই দলের মধ্যে কোনও মেলামেশা নেই, কিন্তু শারীরবৃত্তীয় কোনও অমিল এদের মধ্যে নেই। লিনিয়ান সারণিতে এই ডলফিনদের নাম শেষ পর্যন্ত হল ওর্কায়েলা ব্রেভিরোষ্ট্রিস গ্রে ১৮৮৬।
“আয়রনিটা হল ব্লিথ বেচারির কপালে কোনও কৃতিত্বই শেষ পর্যন্ত জুটল না,” পিয়া বলে চলল। “শুধু যে ওর্কায়েলা আবিষ্কারের সুযোগটা ভদ্রলোকের হাত ফসকে গেল তাই নয়, দেখা গেল সল্ট লেকের জলায় আটকে পড়া প্রাণীগুলোকেও চিনতে ভুল করেছিলেন সাহেব। ওগুলো আসলে ছিল খাটো-পাখনা পাইলট তিমিই। গ্রে দেখিয়ে দিলেন গ্লোবিসেফ্যালাস ইন্ডিকাস বলে কোনও প্রাণী জগতে নেই।”
মাথা নাড়ল কানাই। “এরকমই ছিল সে যুগে। ওর্সার তুলনায় ওর্কায়েলা যেমন, লন্ডনের তুলনায় সেরকমই ছিল কলকাতা।”
নিজের প্লেটটা বাসন ধোয়ার সিঙ্কে নিয়ে যেতে যেতে হেসে ফেলল পিয়া। “সন্দেহ মিটেছে? কলকাতা যে জলচর প্রাণীবিদ্যার একটা প্রধান কেন্দ্র ছিল সে কথা বিশ্বাস হচ্ছে এখন?”
একটা হাত তুলে কানের লতিতে আঙুল বোলাল পিয়া। আগেও এ অভ্যাসটা লক্ষ করেছে কানাই। নর্তকীর মতো মাধুর্যময় আবার একই সাথে শিশুর মতো কোমল এ ভঙ্গিটা যতবার দেখে ততবার বুকটা ধক করে ওঠে কানাইয়ের। পরের দিনই চলে যাবে পিয়া, ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল ওর।
প্লেটটা টেবিলের ওপর রেখে হাত ধুতে বাথরুমে গেল কানাই। মিনিটখানেক বাদেই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে সিঙ্কের সামনে এসে পিয়ার কনুইয়ের কাছটায় গিয়ে দাঁড়াল।
“আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে, বুঝলেন?”
“কী?” কানাইয়ের চোখের চকচকে ভাব দেখে একটু সতর্ক গলায় বলল পিয়া। “আপনার কালকের এই অভিযানে কীসের অভাব আছে বলুন তো?”
“কীসের?” কানাইয়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ঠোঁট চেপে জিজ্ঞেস করল পিয়া। “একজন ট্রান্সলেটরের,” কানাই বলল। “হরেন আর ফকির ওদের দুজনের কেউই ইংরেজি বলতে পারে না, কাজেই একজন অনুবাদক সঙ্গে না থাকলে আপনি ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন কী করে?”
“কেন? গত কয়েক দিন তো আমি দিব্যি চালিয়ে দিয়েছি।”
“কিন্তু তখন তো আপনার সঙ্গে এত মাঝিমাল্লা ছিল না।”
মাথা নেড়ে সায় দিল পিয়া। মনে হল, ঠিকই, কানাই সঙ্গে থাকলে অনেকটাই সুবিধা হবে কাজের। কিন্তু ওর ষষ্ঠেন্দ্রিয় একটা সতর্কবার্তাওপাঠাচ্ছিল। মনের গভীরে কোথায় যেন বোধ হচ্ছিল কানাইয়ের উপস্থিতি ঝামেলাও ডেকে আনতে পারে। একটু সময় নিয়ে বিষয়টা বোঝার জন্য ও জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু আপনার তো এখানে কাজ রয়েছে?”
“কাজ বলতে সেরকম কিছু নয়,” বলল কানাই। মেসোর নোটবইটা প্রায় শেষ হয়েই এসেছে। আর ওটা এখানে বসেই যে পড়তে হবে তারও কোনও মানে নেই। লেখাটা আমি সঙ্গেও নিয়ে যেতে পারি। সত্যি বলতে কী, এই গেস্ট হাউসে একটু হাঁপিয়ে উঠেছি আমি। দু-এক দিন বাইরে ঘুরে এলে মন্দ হয় না।”
স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল কানাইয়ের ব্যগ্রতাটা। তা ছাড়াও একটু বিবেক দংশনও যে হচ্ছিল না তাও নয়–কানাইয়ের আতিথেয়তা যে ত্রুটিহীন সেটা তো অস্বীকার করা যাবে না। সে উদারতার কিছুটা প্রতিদান দিতে পারলে এই গেস্ট হাউসে থাকাটা অনেক সহজ হবে ওর পক্ষে, মনে হল পিয়ার।
“ঠিক আছে তা হলে, চলে আসুন,” সামান্য একটু দ্বিধার পর বলল পিয়া। “ভালই হবে আপনি সঙ্গে এলে।”
এক হাত দিয়ে অন্য হাতের তালুতে এক ঘুষি মারল কানাই। “থ্যাঙ্ক ইউ!” কিন্তু উচ্ছ্বাসের এই প্রকাশে নিজেই মনে হল ও একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। অপ্রতিভ ভাবটা ঢাকতে তাড়াতাড়ি বলল, “আমার কতদিনের শখ একটা এক্সপিডিশনে যাওয়ার। যেদিন থেকে জানতে পেরেছি যে ইয়ংহাজব্যান্ডের তিব্বত অভিযানের সময় আমার ঠাকুর্দার কাকা তাঁর সঙ্গে ট্রান্সলেটর হিসেবে গিয়েছিলেন, সেইদিন থেকেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছি আমাকেও একদিন একটা অভিযানে যেতেই হবে।”