বনবিবির মহিমা
কুসুমের বাড়ি ছিল কাছেই একটা দ্বীপে। সাতজেলিয়ায়। ওর বাবা মারা গিয়েছিল জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে। ঘটনাটা ঘটেছিল বনবিভাগের নিষিদ্ধ এলাকায়, আর ওর বাবার কোনও পারমিটও ছিল না। তাই কোনও ক্ষতিপূরণ পায়নি কুসুমের মা। সংসার প্রায় চলে না, রোজগারেরও কোনও সংস্থান নেই, এইরকম সময় একদিন গ্রামের জোতদার দিলীপ চৌধুরি এসে বলল তার সঙ্গে শহরে গেলে একটা কাজ জোগাড় হতে পারে। হাতে যেন চাঁদ পেল কুসুমের মা।
গাঁয়ের আরও অনেক মেয়েকেই কাজ জুটিয়ে দিয়েছে দিলীপ, তাই এ প্রস্তাবে আপত্তির আর কী থাকতে পারে? কুসুমকে আত্মীয়দের কাছে রেখে একদিন সকালে দিলীপের সঙ্গে চলে গেল সে, কলকাতার ট্রেন ধরতে। দিলীপ ফিরে এল একা। কুসুমকে বলল তার মা খুব ভাল একটা বাড়িতে কাজ পেয়েছে, কদিন পরে ওকেও নিয়ে যাবে। খুব বেশিদিন লাগল না; মাসখানেক পরেই দিলীপ এসে বলল মা বলে পাঠিয়েছে ওকে কলকাতায় তার কাছে নিয়ে যেতে।
এই সময় হরেন নস্কর জানতে পারল ব্যাপারটা। হরেন কুসুমের বাবার সঙ্গে কাজ করত। ওর মা-র সঙ্গেও শ্বশুরবাড়ির সূত্রে তার দূর সম্পর্কের একটা আত্মীয়তা ছিল। সে এসে বলল ভুলেও যেন কুসুম দিলীপের ফাঁদে পা না দেয়। ও লোক ভাল নয়। মেয়ে পাচার করাই হল ওর ব্যবসা। কুসুমের মাকে কী কাজ জুটিয়ে দিয়েছে সে খবর কি ও রাখে? নিশ্চয়ই সোনাগাছির কোনও বেশ্যাবাড়িতে পচছে বেচারি। আর কুসুমের দিকে তো আরও বেশি করে নজর যাবেই দিলীপের। কমবয়সি মেয়েদের বেচতে পারলে অনেক বেশি পয়সা আসে। দিলীপের হাতে পড়লে ও হয় কলকাতার কোনও বেশ্যাপট্টিতে, নয়তো বোম্বের কোনও খারাপ জায়গায় গিয়ে ঠেকবে। হরেনই তারপর কুসুমকে লুসিবাড়িতে নিয়ে এসে মহিলা সমিতির হাতে তুলে দিল। ঠিক হল স্থায়ী একটা কিছু ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত সমিতির সদস্যারাই ওর দেখাশোনা করবে।
মাসকয়েক যেতে না যেতেই লুসিবাড়ি দ্বীপটাকে নিজের হাতের তেলের মতো চিনে গেল কুসুম। আর কানাই আসার পর ও-ই হল তার মুরুব্বি। কুসুমই কানাইকে গাঁয়ের সব খবরাখবর দিত–কে কীরকম লোক, কে কার ছেলে বা মেয়ে, গায়ে কোথায় মোরগ লড়াই হচ্ছে, কোথায় কী পুজো হচ্ছে, কার বাচ্চা হল, কে মারা গেল–সব। আর কানাই ওকে বলত শহরের গল্প, ওর স্কুলের কথা, বন্ধুদের কথা। কুসুমের গল্পগুলোর তুলনায় নিজের গল্পগুলো সাদামাটা, ম্যাড়ম্যাড়ে মনে হত কানাইয়ের। কুসুম কিন্তু খুব মন দিয়ে শুনত। মাঝে মাঝে এটা ওটা প্রশ্ন করত।
“আচ্ছা, আমি যদি তোর সঙ্গে শহরে চলে যাই কেমন হয়?” একদিন জিজ্ঞেস করল : কুসুম। “তুই কোথায় থাকিস দেখব বেশ।”
কানাই চুপ করে গেল। এরকম একটা প্রশ্ন যে কুসুম করতে পারে সেটা ভাবতেই পারেনি ও। মেয়েটা কিচ্ছু বোঝে না নাকি? ওকে কলকাতার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুললে কী হবে কল্পনা করতেই সিঁটিয়ে গেল কানাই। মনে মনে পরিষ্কার শুনতে পেল মায়ের গলার ঝাঝালো সুর। আর পাড়ার লোকেরাই বা কী বলবে? “নতুন ঝি নিয়ে এলেন নাকি দিদি? বাসন মাজা কাপড় কাঁচার লোক তো ছিলই একটা আপনাদের। আরও একটা?”
“কলকাতায় তোর ভাল লাগবে না,” খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল কানাই। “ওখানে গিয়ে মানাতে পারবি না তুই।”
কুসুমের কাছ থেকেই শুনেছিল কানাই একটা যাত্রার দল আসছে লুসিবাড়িতে, বনবিবির পালা করবে। বনবিবির গল্পের কথা দুয়েকবার শুনেছে কানাই এখানে এসে, কিন্তু পুরো গল্পটা ঠিকমতো ওর জানা ছিল না। কুসুমকে জিজ্ঞেস করতে ও প্রায় আঁতকে উঠল, “সে কী রে? তুই বনবিবির গল্প জানিস না?”
“না।”
“ভয় পেলে তালে কাকে ডাকিস তুই?”
প্রশ্নের মানেটা ঠিক ধরতে না পেরে অন্য কথা পেড়েছিল কানাই। কিন্তু কথাটা ঘুরতেই থাকল ও মাথার মধ্যে। একটু বাদে নির্মলকে গিয়ে ও ধরল বনবিবির গল্প বলার জন্য।
নির্মল পাত্তাই দিল না। “ছাড়ো তো। এসব এখানকার লোকেদের বানানো উদ্ভট গল্প। এগুলি নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না। যত্তসব গাঁজাখুরি কল্পনা।”
“গল্পটা বলোই না আমাকে।”
“হরেনকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো,” বলেছিল নির্মল। “দেখবে ও বলবে, বনবিবি এই পুরো জঙ্গলটার দেবী। বাঘ, কুমির, আরও সব জন্তু জানোয়ার সবাই এখানে বনবিবির কথা শুনে চলে, এই সব। এখানকার অনেক বাড়ির সামনে ছোট ছোট মন্দিরের মতো দেখনি? ওগুলির মধ্যে বনবিবির মূর্তি আছে। তোমার মনে হতে পারে যে এরকম একটা জায়গায় বাস্তব সমস্যাগুলো নিয়ে মাথা ঘামানোটাই গ্রামের লোকের পক্ষে বেশি স্বাভাবিক, কিন্তু এরা সব এই দেবী, পির আর যত সব আজগুবি অলৌকিক জিনিসেই বিশ্বাস করে।”
“কিন্তু গল্পটা আমাকে বলো না,” কানাই নাছোড়বান্দা। “কী নিয়ে গল্পটা? কী ঘটনার কথা আছে ওটাতে?”
“যেমন থাকে সব এরকম গল্পে,” অধৈর্য হয়ে হাত ওলটাল নির্মল। “দেবদেবী, পির ফকির, জন্তু জানোয়ার, দত্যি দানো–এই সব। অনেক লম্বা গল্প। তার চেয়ে এক কাজ করো। যাত্রাটা দেখে নাও, তাহলেই জেনে যাবে গল্পটা।”
যাত্রার মঞ্চ বানানো হয়েছিল লুসিবাড়ির বড়ো ময়দানে, হ্যামিলটনের কুঠি আর স্কুলের মাঝামাঝি জায়গায়। সাদামাটা একটা মঞ্চ, একদিনও লাগেনি তৈরি করতে। চারিদিকে বাঁশের ভারা মতে বেঁধে খানিকটা ওপরে কয়েকটা তক্তা পেতে দেওয়া হল। ওইটাই মঞ্চের মেঝে। পালা চলার সময় পেছনদিকের একটা বাঁশ থেকে একটা রংচং করা কাপড় ঝুলিয়ে দেওয়া হল। দর্শকদের জন্য সেইটাই হল দৃশ্যপট, আর অভিনেতাদের জন্য পর্দা। তার আড়ালে তারা বিড়ি টানে, খাওয়া-দাওয়া করে, পোশাক বদল করে। আলোকসম্পাতের জন্য ঝুলিয়ে দেওয়া হল কয়েকটা হ্যাঁজাক বাতি, আর সংগীতের জন্য একটা ব্যাটারিতে চালানো ক্যাসেট রেকর্ডার আর লাউডস্পিকার।
লুসিবাড়িতে রাত নামে তাড়াতাড়ি। মোমবাতি কি লম্ফর দাম তো কম নয়; খরচ বাঁচানোর জন্য তাই হিসেব করে আলো জ্বালানো হয়। সূর্যের আলো থাকতে থাকতেই রাতের খাওয়া সেরে নেয় সবাই, আর রাতের অন্ধকার নেমে এলে নিঝুম হয়ে যায় সারা গাঁ। সে নিস্তব্ধতা ভাঙে কদাচিৎ দূর থেকে জলের ওপর দিয়ে ভেসে আসা জানোয়ারের ডাকে। ফলে, রাতে কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজন হলে লুসিবাড়িতে সেটা একটা বিশেষ ঘটনা। কয়েকদিন আগে থেকেই ছেলেবুড়ো সকলে মেতে ওঠে। আসল অনুষ্ঠানের চেয়ে প্রস্তুতিপর্বের উৎসাহটাও কম নয়। যাত্রা যখন শুরু হল, রাতের পর রাত জেগে বনবিবির পালা দেখল গাঁয়ের সমস্ত লোক। কুসুম আর কানাইও।
যাত্রার শুরুতেই একটা চমক অপেক্ষা করে ছিল কানাইয়ের জন্য। এরকম দেবদেবীর কাহিনি আগে যা শুনেছে ও, সেগুলো শুরু হয় স্বর্গে কিংবা গঙ্গার তীরে। কিন্তু এই বাঘের দেবীর গল্পের আরম্ভটা এক্কেবারে অন্যরকম। প্রথম দৃশ্য শুরু হল আরবদেশের এক শহরে। পেছনের সিনে মসজিদ আর মিনারের ছবি আঁকা।
দৃশ্যটা মদিনার। মুসলমানদের পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। সেই শহরে বাস করত এক ধর্মপ্রাণ মুসলমান, ইব্রাহিম। সন্তানহীন ইব্রাহিম সুফি ফকিরদের মতো পবিত্র জীবন যাপন করত। শেষে দেবদূত গ্যাব্রিয়েলের কৃপায় দুটি যমজ সন্তান হল তার, বনবিবি আর শা জঙ্গলি। এই দুই ছেলেমেয়ে যখন বড় হল, তখন একদিন দেবদূত এসে বলল তাদের ভাইবোনকে আল্লা একটা কাজের ভার দিয়েছেন। এই আরবদেশ থেকে তাদের যেতে হবে আঠারো ভাটির দেশে। গিয়ে সেই জায়গাটাকে মনুষ্যবাসের উপযুক্ত করে তুলতে হবে। এই দায়িত্ব পেয়ে তো বনবিবি আর শা জঙ্গলি রওনা হল বাংলাদেশের বাদাবন অঞ্চলের উদ্দেশ্যে। পরনে তাদের সাধারণ সুফি ভিক্ষুকের পোশাক।
আঠারো ভাটির দেশে তখন দানবরাজ দক্ষিণরায়ের রাজত্ব। ভয়ংকর তার ক্ষমতা। সেখানকার সমস্ত প্রাণী, ভূত, পিশাচ–সকলে তার কথায় ওঠে বসে। আর মানুষ হল দক্ষিণরায়ের দু’ চক্ষের বিষ। কিন্তু মানুষের মাংসের প্রতি তার অসীম লোভ।
একদিন দক্ষিণরায় শুনল জঙ্গলের মধ্যে কে যেন আজান দিচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারল বনবিবি আর শা জঙ্গলি এসেছে তার রাজত্বে। ভয়ানক রেগে গিয়ে তো দক্ষিণরায় তার সমস্ত সৈন্য সামন্ত জড়ো করল। এই দু’জনকে তাড়াতেই হবে এলাকা থেকে। ভীষণ এক যুদ্ধ হল তারপর। যুদ্ধে গোহারা হেরে গেল দক্ষিণরায়। কিন্তু বনবিবির দয়ার শরীর। যুদ্ধে জিতেও দানবরাজকে মারলেন না তিনি। বরং বললেন, এই ভাটির দেশের অর্ধেকটার ওপর রাজত্ব করতে পারে দক্ষিণরায়। সেখানে জঙ্গলের মধ্যে সে তার ভূত পিশাচদের নিয়ে থাকতে পারে। বাকি অর্ধেকটা নিয়ে নিলেন বনবিবি। সেখানে বন কেটে বসত হল। শান্তি এল আঠারো ভাটির দেশে। দেশটাকে জঙ্গল আর বসত, এই দু’ভাগে ভাগ করে বনবিবি সেখানে শৃঙ্খলা নিয়ে এলেন। সুখেই কাটছিল সময়, কিন্তু মানুষের লোভই একদিন শান্তি ভাঙল আবার।
ধনা নামে একটা লোক ভাটির দেশের একপ্রান্তে বাস করত। সে একদিন ঠিক করল জঙ্গলে যাবে, ভাগ্যান্বেষণে। কিন্তু সপ্তডিঙা সাজিয়ে ধনা যখন রওনা হতে যাবে তখন দেখা গেল একজন মাল্লা কম পড়ছে। হাতের কাছেই ছিল দুখে বলে একটা ছেলে। নামেও যেমন দুখে, সারাটা জীবন সেরকম দুঃখেই কেটেছে তার। ছোট্টবেলাতেই বাবাকে হারিয়েছিল দুখে। এখন সে থাকে তার অসুস্থ বুড়ি মা-র সঙ্গে। কোনওরকমে কায়ক্লেশে তাদের সংসার চলে। দুখেকে যেতে দেওয়ার একটুও ইচ্ছে ছিল না তার মায়ের। কিন্তু অবশেষে বিদায় নেওয়ার সময় এল। মা তখন তাকে একটা পরামর্শ দিল। বলল যখনই বিপদে পড়বে, দুখে যেন বনবিবিকে স্মরণ করে। বনবিবি আর্তের সহায়, গরিবের মুশকিল আসান। তিনি নিশ্চয়ই তাকে রক্ষা করবেন।
ধনার নৌবহর তো যাত্রা শুরু করল। ভাটির দেশের এ নদী সে নদী এ খাল সে খাল দিয়ে অবশেষে গিয়ে পৌঁছল কেঁদোখালির চরে। এখন, কেঁদোখালির চর ছিল দক্ষিণরায়ের রাজত্বের মধ্যে। কিন্তু মাল্লারা সেটা জানত না। তারা তো গিয়ে নৌকো ভেড়াল সেখানে। দক্ষিণরায় কিন্তু আগে থেকেই খোঁজ পেয়ে গিয়েছিল। ধনা আর তার দলবলের জন্য কিছু চমকেরও ব্যবস্থা করে রেখেছিল সে। চরে নেমেই তারা দেখল গাছে গাছে বড় বড় সব লোভনীয় মধু-টসটসে মৌচাক। কিন্তু যেই সেগুলির দিকে এগিয়ে যায়, মৌচাক আর দেখা যায় না। সেটা তখন একটু দূরের কোনও গাছে ঝুলছে। সারাদিনে একটা মৌচাকও জোগাড় করতে পারল না ধনা। নাকানিচোবানি খেয়ে গেল একেবারে। তারপর সেই রাতে স্বপ্নের মধ্যে ধনাকে দেখা দিয়ে দক্ষিণরায় দু’পক্ষের স্বার্থরক্ষার জন্য একটা প্রস্তাব দিল। ধনা তার নৌকোয় যে ছেলেটাকে এনেছে সেই ছেলেটাকে চাইল দক্ষিণরায়। বহুদিন হল মানুষের মাংস জোটেনি। দুখেকে খাওয়ার জন্য তাই নোলা সক সক করছে তার। তার বদলে সে ধনাকে নৌকো বোঝাই করে ধনসম্পদ দেবে।
লোভে পড়ে এ প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল ধনা। যেই না রাজি হওয়া, সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলের সব ভূত দানো পিশাচ, এমনকী মৌমাছিরা পর্যন্ত মধু আর মোম’ নিয়ে এসে ধনার নৌকো ভরে দিল। সবগুলো নৌকো টইটম্বুর হয়ে গেল মোমে আর মধুতে। এবার ধনার কথা রাখার পালা। দুখেকে ডেকে সে বলল জঙ্গল থেকে কিছু কাঠ নিয়ে আসতে। কী আর করে দুখে, নৌকো থেকে নেমে জঙ্গলে ঢুকল। খানিক পরে কাঠ নিয়ে যখন ফিরে এল তখন দেখল যা ভয় পেয়েছিল তাই হয়েছে। একটা নৌকোরও কোনও চিহ্ন নেই। সে একা দাঁড়িয়ে আছে চরে–সামনে তার বিশাল নদী আর পেছনে জঙ্গল। এই সময়ে হঠাৎ দূরে একটা হলুদ কালো ঝলক চোখে পড়ল দুখের। দেখে এক বিরাট বাঘ। নদীর অন্য পারে ঝোঁপের আড়ালে আড়ালে এগিয়ে আসছে ওর দিকে। বাঘটা আর কেউ নয়, দক্ষিণরায় স্বয়ং। পৃথিবী ঝাঁপিয়ে প্রচণ্ড এক গর্জন ছেড়ে সেটা লাফ দিল দুখের দিকে। বাঘের ওই বিশাল ভয়ানক
চেহারা দেখে তো তার প্রাণপাখি উড়ে যাওয়ার দশা। ভয়ে জ্ঞান হারাতে হারাতে মায়ের উপদেশের কথা মনে পড়ল দুখের। মনপ্রাণ দিয়ে সে ডাকতে লাগল, “ও বনবিবি, ও দয়াবতী, আমাকে রক্ষা করো, আমার সহায় হও।”
তখন বহুদূরে ছিলেন বনবিবি। কিন্তু ভক্তের ডাক শুনে এক লহমায় নদী পেরিয়ে পৌঁছে গেলেন তার কাছে। দুখেকে নিজের কোলে তুলে নিয়ে তার শুশ্রূষা করতে লাগলেন তিনি। আর তার ভাই শা জঙ্গলি প্রচণ্ড প্রহার করে তাড়িয়ে দিলেন দক্ষিণরায়কে। দুখেকে তার বাড়ি নিয়ে গিয়ে নিজের হাতে সেবা শুশ্রূষা করে তাকে সুস্থ করে তুললেন বনবিবি। তারপর দুখের যখন ঘরে ফেরার সময় হল, প্রচুর মধু আর মোম তার সাথে দিয়ে তাকে মায়ের কাছে পৌঁছে দিলেন তিনি। দুনিয়াকে বনবিবি বুঝিয়ে দিলেন, এই হল জঙ্গলের আইন। লোভী বড়লোকেরা শাস্তি পাবে, আর সৎ গরিব মানুষেরা পাবে তার আশীর্বাদ।
কানাই ভেবেছিল বুঝি ওর একঘেয়ে লাগবে এই গেঁয়ো যাত্রা। কলকাতায় তো ওরা নাটক দেখতে যায় অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে আর সিনেমা দেখতে যায় গ্লোবে। কিন্তু যাত্রা দেখতে দেখতে কাহিনিটার মধ্যে ও ডুবে গেল। দানোটা যখন দুখের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে, সত্যিই প্রচণ্ড ভয়ে তখন কাটা হয়ে গিয়েছিল কানাই। যদিও বাঘের চেহারাটা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য হয়নি, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল সেটা ডোরাকাটা কাপড় জড়ানো আর মুখোশ পরা একটা লোক। আবার বনবিবি যখন দুখের পাশে এসে দাঁড়ালেন, তখনও কানাই কেঁদে ফেলেছিল আনন্দ আর কৃতজ্ঞতায়। সত্যিকারের কান্না। আসরের সক্কলেরই তখন চোখে জল। অবশ্য মঞ্চে বনবিবির আবির্ভাবটা যে খুব অসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে হয়েছিল তা নয়। এমনকী দুখে যখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে আর বাঘ তাকে খেয়ে নিতে যাচ্ছে, তখনও বনবিবি মঞ্চের একপাশে ঝুঁকে পড়ে মুখ থেকে পানের ছিবড়ে ফেলতে ব্যস্ত। শেষে দর্শকরাই তাড়া দিয়ে দিয়ে পাঠাল তাকে দুখের কাছে। কিন্তু এসব কিছুই কাহিনির সাবলীল গতিকে রোধ করতে পারেনি। অভিনয় শেষ হওয়ার আগেই কানাই বুঝতে পেরেছিল এ পালা তাকে আবার দেখতে হবে।
যাত্রা যেদিন শেষ হল লুসিবাড়িতে, সেদিন সে এক দেখার মতো দৃশ্য। আশেপাশের সব দ্বীপ থেকে লোক একেবারে ভেঙে পড়েছিল। প্রচণ্ড ঠেলাঠেলি। ময়দানে তিল ধারণের জায়গা নেই। গুঁতোগুঁতির মধ্যে কানাই আর ভেতরের দিকটায় ঢুকতে পারেনি। একধারে কোনার দিকে বসে দেখছিল। এতবার দেখার পর প্রথম দিকটায় একটু একঘেয়েমি এসে গিয়েছিল কানাইয়ের; বসে বসেই ও ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভেঙে দেখল ও কুসুমের পাশে বসে আছে। “কী হচ্ছে রে?” ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল কানাই। “কোন জায়গাটা হচ্ছে এখন?” কোনও সাড়া নেই। যাত্রায় একেবারে ডুবে গেছে কুসুম, কানাই যে পাশে বসে আছে সে তার খেয়ালই নেই। কী এত মুগ্ধ হয়ে দেখছে কুসুম বোঝার জন্য মঞ্চের দিকে তাকিয়ে কানাই দেখে যা ভেবেছিল তার চেয়ে একটু বেশিই ঘুমিয়েছে ও। কাহিনি অনেকদূর গড়িয়ে গেছে। ধনা আর তার দলবল কেঁদোখালির চরে পৌঁছে গেছে। এর পরেই দক্ষিণরায়ের সঙ্গে সেই চুক্তিটা হবে।
“কুসুম?” ফিসফিস করে আবার ডাকল কানাই। মুহূর্তের জন্য মুখ ফেরাল কুসুম।
হ্যাজাকের অস্পষ্ট আলোয় কানাই দেখল নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে আছে ও, আর দু’গাল বেয়ে গড়াচ্ছে চোখের জল। এই যাত্রা দেখতে দেখতে কান্না আসতেই পারে, তাই খুব একটা আশ্চর্য হল না কানাই। কিন্তু তারপর কুসুম যখন হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করল, তখন ওর মনে হল শুধু যাত্রা দেখে তো এরকম ভাবে কাঁদবে না। নিশ্চয়ই অন্য কোনও কারণ আছে। মুহূর্তের আবেগে, কুসুমকে সান্ত্বনা দিতে একটা হাত বাড়িয়ে দিল কানাই, ওর হাত ধরার জন্য। কিন্তু যেখানে থাকবে ভেবেছিল কুসুমের হাত সেখানে ছিল না। বদলে ওর ফ্রকের ভঁজে জড়িয়ে গেল কানাইয়ের আঙুল। ফ্রকের জট থেকে হাত ছাড়ানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল কানাই, কিন্তু বাইরে বেরিয়ে আসার বদলে কুসুমের শরীরের একটা নরম আর অপ্রত্যাশিত রকম গরম জায়গায় ঠেকে গেল ওর আঙুল। সে স্পর্শের অভিঘাতে চমকে উঠল ওরা দুজনেই, ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো।
চাপা একটা চিৎকার করে উঠে দাঁড়াল কুসুম। তারপর কোনওরকমে হোঁচট খেতে খেতে বেরিয়ে গেল অন্ধকারের মধ্যে। কানাইয়ের ইচ্ছে করছিল ছুটে যায় ওর পেছন পেছন, কিন্তু স্বাভাবিক প্রবৃত্তির বশেই মনে হল ঠিক হবে না সেটা করা। লোকে দেখলে খারাপ ভাবতে পারে। মিনিট দুয়েক তাই অপেক্ষা করল কানাই। তারপর ধীরে ধীরে উঠে অন্য আরেক দিক দিয়ে বেরিয়ে এল ভিড় ছেড়ে। অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে অনেকটা ঘুরে এসে কানাই ধরল কুসুমকে। ও তখন হ্যামিলটনের কুঠির দিকে যাচ্ছে। “কুসুম–একটু দাঁড়া। দাঁড়া একটু।”
দূরের হ্যাঁজাক থেকে যেটুকু আলো চুঁইয়ে আসছিল তাতে দেখা যাচ্ছিল কোনও রকমে হাতড়াতে হাতড়াতে হাঁটছে কুসুম, মাঝে মাঝে ঘাড় ফিরিয়ে নাক দিয়ে গড়িয়ে পড়া জল মুছে নিচ্ছে জামার কাঁধে। “কুসুম,” চাপা গলায় আবার ডাকল কানাই। “দাঁড়া একটু বলছি।” কাছে এসে ওর কনুই ধরে ফেলল কানাই। “ভুল করে হয়ে গেছে, আমি ইচ্ছে করে করিনি।”
থেমে গেল কুসুম। কানাইও দাঁড়িয়ে গেল শক্ত হয়ে। ভাবল এক্ষুনি কুসুম খিঁচিয়ে উঠবে, গালাগাল আর বকুনির তোড়ে ধুইয়ে দেবে ওকে। কিন্তু কিছুই বলল না কুসুম। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কানাইয়ের মনে হল কুসুমের মন খারাপের পেছনে ওর ভূমিকা নিতান্তই সামান্য। মনে হল শুধু একটা ছেলের ভুল করে ছুঁয়ে দেওয়া নয়, ওই কান্নার উৎস রয়েছে আরও গভীরে কোথাও।
কুঠির গেটের প্রায় সামনে চলে এসেছে ওরা এখন। এক লাফে গেটটা ডিঙিয়ে গেল কানাই। কুসুমকে ডাকল তারপর, “আয় না, চলে আয়।” এক মুহূর্ত দোনামনা করে কুসুমও ঢুকল ভেতরে। ওর হাত ধরে পুকুরপাড়ের শ্যাওলা ধরা ইটের ওপর দিয়ে দৌড়ে কুঠিতে ওঠার সিঁড়ির সামনে এসে পৌঁছল কানাই। কুসুমকে নিয়ে তুলল ঢাকা বারান্দাটায়। তারপর পুরনো কাঠের দেওয়ালটায় পিঠ দিয়ে মেঝের ওপর বসে পড়ল ওরা। ময়দানটা পরিষ্কার চোখে পড়ছে এখান থেকে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে স্টেজের ওপর দুখে শুয়ে আছে, আকুল হয়ে ডাকছে বনবিবিকে।
কুসুমই কথা বলল প্রথম। “আমিও ডেকেছিলাম। কিন্তু আসেনি।”
“কে?”
“বনবিবি। যেদিন বাবা মরে গেল। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, আমার চোখের সামনে একেবারে। আমি কত বার ডাকলাম বনবিবিকে…”
আর পাঁচটা দিনের মতোই ছিল সেই দিনটা। আর ঘটনাটা ঘটেছিল ভর দুপুরে–সূর্য তখন মাঝ আকাশে। বাড়িতে টাকা ছিল, খাবারও ছিল। কারণ ঠিক তার আগের দিন মাছ ধরা সেরে ফিরেছে কুসুমের বাবা। বেশ ক’দিনের জন্যে বেরিয়েছিল মাছ ধরতে। অনেক মাছ পেয়েওছিল। ক্ষতি বলতে একটাই হয়েছিল সেবার, গামছাটা বাবা হারিয়ে এসেছিল। ভাল করে খেতে চেয়েছিল বাবা। মা বসে রাঁধছিল, ভাত ডাল তরকারি। কিন্তু মাছ রাঁধতে গিয়ে দেখে জ্বালানি কাঠ শেষ হয়ে গেছে। শুনেই তো বাবা খেপে আগুন। কতদিন খাওয়া জোটেনি ঠিক মতো, সেদিন তো ভাল করে খাবেই। কিছুতেই ছাড়বে না। দুমদাম করে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। বলল এক্ষুনি ফিরবে কাঠ নিয়ে।
ওদের কুঁড়েটা ছিল বাঁধের গায়ে, সরু একটা খাঁড়ির পাড়ে। নৌকো বেয়ে অন্য পারের জঙ্গলটায় যেতে খুব বেশি হলে দশ থেকে পনেরো মিনিট লাগত। রিজার্ভ ফরেস্ট ছিল ওটা, কিন্তু জ্বালানি কাঠের দরকার হলে ওখান থেকেই নিয়ে আসত ওদের গাঁয়ের লোক। কুসুমও বেরোল বাবার পেছন পেছন; বাবা নৌকো নিয়ে ওপারে গেল, আর ও বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। উলটোদিক থেকে প্রচণ্ড হাওয়া দিচ্ছিল সেদিন, তাই এমনিতে যা লাগে তার চেয়ে বেশি সময় লাগছিল বাবার ওপারে পৌঁছতে। তারপর বাবা যখন নৌকোটাকে ঠেলে পাড়ে তুলছে, তখনই কুসুম দেখতে পেল জানোয়ারটাকে–গোটাটা দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু ঝোঁপের ফাঁকে হলুদ কালো ডোরা যেটুকু নজরে আসছিল সেটুকুই বোঝার পক্ষে যথেষ্ট।
“মানে, তুই দেখতে পেলি–” কিন্তু কানাই বাঘশব্দটা উচ্চারণ করার আগেই কুসুম ওর মুখটা চেপে ধরল হাত দিয়ে। “বলিস না, বলিস না একদম। নাম বললেই এসে হাজির হবে।”
পাড়ের ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছিল জন্তুটা। ওর এগোনো দেখেই বুঝতে পেরে গিয়েছিল কুসুম যে নদী পেরোনোর সময় ও নৌকোটাকে দেখতে পেয়েছে। কুসুমের প্রথম চিৎকারটাতেই ওর মা আর আশেপাশের পড়শিরা ছুটে বেরিয়ে এসেছিল বাঁধের ওপর। কিন্তু যাকে ডাকছিল চেঁচিয়ে সে-ই শুনতে পেল না। তখন উলটোদিকে বইছিল হাওয়া, তাই কুসুমের গলার আওয়াজ পৌঁছল না বাবার কানে।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে জনা বিশেক লোক জড়ো হয়ে গেল বাঁধের ওপরে। কুসুমের সঙ্গে ওরাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল জানোয়ারটা এগোচ্ছে বাবার দিকে। গাঁয়ে পুরুষ যারা ছিল সবাই দৌড়ল নৌকো আনতে। মেয়েরা হাতের কাছে থালা ঘটি বাটি যা পেল সব নিয়ে বাজাতে লাগল আর চিৎকার করতে লাগল যত জোরে পারে। কিন্তু কোনও লাভ হল না। হাওয়া তখন ওদের দিকে বইছিল, ওপারে তাই কিছুই শুনতে পেল না বাবা। জানোয়ারটাও ছিল তার শিকারের তুলনায় হাওয়ার উলটোদিকে এপার থেকে দেখা যাচ্ছিল চকচক করছে ওর গাটা। ও জানে হাওয়ায় ওর গায়ের দুর্গন্ধ পাওয়া যায়, তাই সেরকম ভাবেই চলাফেরা করে ও। এই উলটো হাওয়ার মুখে ওপারের অতগুলো লোক কিছুই করতে পারবে না সেটা যেন ও জানত। এত ওর সাহস, শেষটায় তো বেরিয়েই পড়ল ঝোঁপের আড়াল ছেড়ে। শিকার ধরার জন্য দৌড়তে শুরু করল পাড় ধরে; আড়াল-টাড়ালের আর পরোয়াই করল না। সবাই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল এপার থেকে। আশ্চর্য সেই ভয়ংকর দৃশ্য। এরকম আগে বোধহয় কেউ দেখেওনি কখনও। কারণ ভাটির দেশের এই বড় বেড়ালের চলাফেরা এক্কেবারে ভুতের মতো। তার পায়ের ছাপ দেখা যায়, গর্জন শোনা যায়, গায়ের গন্ধ পাওয়া যায়, কিন্তু তাকে দেখা যায় না সহজে। এতই কম চোখে পড়ে জন্তুটা, যে বলা হয় যারা তাকে দেখে তারা কেউ আর ঘরে ফেরে না। সেদিনের ওই দৃশ্য দেখতে দেখতে তো কয়েক জন মেয়ে অজ্ঞানই হয়ে গেল বাঁধের ওপর।
কিন্তু কুসুম অজ্ঞান হয়নি। ও হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিল। ফিসফিস করে বলছিল, “ও বনবিবি, দয়াবতী গো, আমার বাবাকে বাঁচিয়ে দাও।” চোখ বুজে ছিল কুসুম, তাই দেখতে পায়নি শেষটা। কিন্তু কান তো খোলা ছিল। হাওয়া ওদের দিকে ছিল বলে প্রতিটা আওয়াজ স্পষ্ট ভেসে আসছিল জলের ওপর দিয়ে। প্রথম কানে এল গর্জনটা, যাতে ভয়ে কাঠ হয়ে গেল বাবা। “বাঁচাও” বলে একবার চেঁচিয়ে উঠল। তারপর জানোয়ারটার থাবার ঝাঁপটে ঘাড়টা মটকে গেল বাবার। হাড় ভাঙার শব্দটা স্পষ্ট শোনা গেল। শেষে ঝোঁপঝাড়ের সড়সড় আওয়াজ এল কানে। শিকার নিয়ে বনের মধ্যে ঢুকে গেল শয়তানটা।
এই সারাটা সময় বনবিবির নাম জপ করে গিয়েছিল কুসুম। একবারও থামেনি।
হরেন এসে তুলেছিল ওকে ধুলো থেকে। “বনবিবি শুনতে পেয়েছেন তোর কথা। অনেক সময় তার কাছের মানুষদের এভাবেই ডেকে নেন উনি। তোর বাবার মতো বাউলেরাই তাই সবসময় আগে যায়,” বলেছিল হরেন।
ঘটনাটা বলতে বলতে শরীর ছেড়ে দিয়েছিল কুসুমের। কোনও রকমে কানাইয়ের কাঁধে ভর দিয়ে বসেছিল ও। কানাই টের পাচ্ছিল ওর গায়ে এসে লাগছে কুসুমের চুল। গল্পটা শুনতে শুনতে কী যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠছিল ওর গলার কাছে। ইচ্ছে করছিল দু’হাতে জড়িয়ে ধরে কুসুমকে, ইচ্ছে করছিল ওর শোক ভুলিয়ে দেয়, মুছিয়ে দেয় ওর চোখের জল। নিজের শরীর দিয়ে দেওয়ালের মতো আড়াল করে রাখে ওকে গোটা পৃথিবীর কাছ থেকে। এরকম তীব্র শারীরিক অনুভূতি এর আগে কখনও হয়নি কানাইয়ের। কাউকে আগলে রাখা, আড়াল করার এই প্রচণ্ড ইচ্ছা, সহানুভূতির এরকম সুতীব্র শারীরিক প্রকাশ কানাই এর আগে কোনওদিন এভাবে অনুভব করেনি। নিজের ঠোঁট দিয়ে কুসুমের চোখ মুছিয়ে দিল ও। এত কোমল উষ্ণ সেই অনুভূতি, যে থামতে পারল না কানাই। এক হাতে জড়িয়ে ধরে কুসুমকে বুকে টেনে নিল ও, নিজের মাথা চেপে ধরল ওর মাথায়।
হঠাৎ একটা আওয়াজ শোনা গেল। কেউ যেন দৌড়ে আসছে। মচমচ করে উঠল হ্যামিলটন বাংলোর সেগুনকাঠের সিঁড়ি। “কুসুম, কুসুম”–হরেনের গলা। চাপা হিসহিস স্বরে ও ডাকছে কুসুমকে।
“আমি এখানে,” বলে দাঁড়িয়ে উঠল কুসুম।
ওদের সামনে এসে হাঁপাতে লাগল হরেন। “কুসুম, এক্ষুনি বেরিয়ে পড়তে হবে আমাদের। আমি দিলীপকে দেখলাম, কয়েকটা লোককে নিয়ে এসেছে। তোকে খুঁজছে। এখানে থাকা আর নিরাপদ নয়। লুসিবাড়ি থেকে পালাতে হবে তোকে।”
কানাইয়ের পাশে এসে হাঁটু গেড়ে বসল হরেন। ওর ঠোঁটের ওপর একটা আঙুল রেখে বলল, “একটা কথা শুনে রাখো ছোটবাবু। যদি কেউ জানতে পারে কুসুম কোথায় গেছে আর কার সঙ্গে গেছে, তা হলে তুমিও কিন্তু খুব বিপদে পড়বে বলে রাখলাম। বুঝেছ?”
জবাবের অপেক্ষা না করে কুসুমের হাত ধরে বেরিয়ে গেল হরেন। দৌড়ে।
সেই শেষ দেখা কুসুমের সঙ্গে। পরদিন নির্মল বলল কানাইয়ের বনবাস শেষ, ওকে ফেরত দিয়ে আসা হবে কলকাতায়।