ডলফিনগুলোর ধীর নিয়মিত শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দে একটু ঝিমুনি মতো এসে গিয়েছিল পিয়ার। হঠাৎ যেন স্বপ্নের মধ্যে থেকে ভেসে আসা প্রচণ্ড একটা গুমগুম আওয়াজে চটকাটা ভেঙে গেল। চোখ খুলে উঠে বসতে বসতেই আবার চারদিক চুপচাপ। প্রতিধ্বনির রেশটুকুও নেই আর। ডিঙির গায়ে জলের ধাক্কায় মৃদু একটা ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শুধু কানে আসছে। ফটফটে জ্যোৎস্নায় তারাগুলোকে দূরে ক্ষুদে ক্ষুদে আলোর বিন্দুর মতো মনে হচ্ছে।
নৌকোটা দুলতে শুরু করল হঠাৎ। তার মানে ফকিরও জেগে আছে। মাথাটা একটু তুলে পিয়া দেখল ডিঙির ঠিক মাঝখানটায় আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছে ফকির। উঠে পড়ে কাঁকড়ার মতো হামা দিয়ে গিয়ে ওর পাশে বসল পিয়া। “কীসের আওয়াজ ওটা?” ভুরুদুটো একটু তুলে মাথা ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল ইশারায়। একটু হাসল ফকির, কিন্তু সোজাসুজি কোনও জবাব দিল না। হাতটা তুলে অস্পষ্টভাবে পাড়ের দিকে ইশারা করল একবার। তারপর থুতনিটা হাঁটুর ওপর রেখে বিকেলে ওরা যে দ্বীপটায় গিয়েছিল সেটার দিকে চেয়ে রইল একদৃষ্টে। এতদূর থেকে জলের ওপর হালকা জরির নকশার মতো লাগছে এখন দ্বীপটাকে।
শুশুকগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে নৌকোটার চারপাশে। দু’জনে বসে চুপচাপ সেই শব্দ শুনল খানিকক্ষণ। একটু পরে পিয়া শুনতে পেল খুব আস্তে আস্তে গুনগুন করছে ফকির। একটু হেসে ও বলল, “সিং। লাউডার। সিং।” আরও বার দুই বলার পর নিচু গলায় গাইতে শুরু করল ফকির। আগের দিন যে গানটা গাইছিল তার থেকে এ সুরটা একেবারে অন্যরকম–মাঝে মাঝে প্রাণোচ্ছল, কয়েকটা কলি আবার ধীর, শান্ত। পিয়ার মনে হল যেন নিজের মনের ভাবের ছায়া দেখতে পাচ্ছে ওই সুরে। ফকিরের গান আর তার ফাঁকে ফাঁকে ডলফিনদের শ্বাসের শব্দ শুনতে শুনতে কেমন একটা তৃপ্তিতে ভরে উঠল ওর মনটা। এই মায়াময় পরিবেশে নৌকোর ওপর একজন বিশ্বাসী মানুষের পাশে বসে ওই শুশুকদের চলাফেরার শান্ত শব্দ শোনা–এর চেয়ে সুখ আর কী আছে?
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল ওরা দু’জন। পিয়ার মনে হল ফকির যদিও চেয়ে আছে সামনের তীরের দিকে, কিন্তু আসলে কিছুই দেখছে না ও। ঘুম এসে গেছে নাকি? যেমন অনেক সময় মানুষ আধো-ঘুমে থাকলেও দেখে মনে হয় জেগে আছে। নাকি নিজের ভাবনাতেই ডুবে আছে ও? হারিয়ে যাওয়া কোনও স্মৃতির ছেঁড়া সুতো জোড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে মনে মনে?
কী দেখবে ফকির ফিরে তাকালে? একটা কুঁড়েঘরের ছবি মনে এল পিয়ার ক্যানিং-এর আশেপাশে যেরকম দেখেছে–মাটির দেওয়াল, খড়ের চাল, হেঁচা বাঁশের। দরজা। ফকিরের বাবাও হয়তো একজন জেলে পাকানো দড়ির মতো হাত পা, বহু বছরের রোদে জলে পোড়খাওয়া মুখ; ওর মা-র চেহারা শক্ত সমর্থ, কিন্তু ক্লান্তির ছাপ তাতে–দিনের পর দিন ঝুড়ি ঝুড়ি মাছ আর কঁকড়া বাজারে বয়ে নিয়ে যাওয়ার হাড়ভাঙা খাটুনি স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে চেহারায়। ছোট্ট ফকিরের খেলার সাথীর কোনও অভাব নেই, চারদিকে একগাদা বাচ্চা-কাচ্চা দৌড়ে বেড়াচ্ছে। সংসারে স্বাচ্ছল্য নেই, কিন্তু পরিবারের মধ্যে উষ্ণতার কোনও অভাব নেই। এরকম পরিবারের কথা বাবার মুখে শুনেছে পিয়া: অভাব আর দারিদ্রই সেখানে একসাথে বেঁধে রাখে সকলকে।
বিয়ের আগে কি কখনও ওর বউয়ের মুখ দেখেছে ফকির? ওর নিজের বাবা মা-র কথা শুনেছে পিয়া, তারা নাকি বিয়ের আগে দেখেছিল পরস্পরকে, এমনকী কথাও বলেছিল। অন্য সব আত্মীয়স্বজনদের সামনে অবশ্য। কিন্তু ওরা তো শহরের লোক, মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত। ফকিরদের গ্রামে নিশ্চয়ই বিয়ের আগে বর-কনেকে ওরকম দেখা করতে দেয় না। হয়তো বিয়ের যজ্ঞের সময়ই প্রথম ওরা দেখেছে দুজন দুজনকে। হয়তো তার পরেও চোখ তুলে তাকায়নি ওর বউ, যতক্ষণ না রাতে ওদের কুঁড়ের মাটির দেয়াল দেওয়া ঘরে গিয়ে শুয়েছে পাশাপাশি। তখনই হয়তো প্রথম ভাল করে চেয়ে দেখেছে বরের দিকে, মনে মনে ধন্যবাদ দিয়েছে ভাগ্যকে, এরকম জোয়ান, টানা টানা চোখের সুন্দর বর জুটিয়ে দেওয়ার জন্য। হয়তো এরকম বরেরই স্বপ্ন দেখে এসেছে ও বরাবর, এর জন্যেই এতদিন প্রার্থনা করেছে ভগবানের কাছে।
উঠে পড়ল পিয়া, আবার গিয়ে শোবে। ডিঙির সামনের দিকে পেতে রাখা বিছানায় গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে মনোযোগ দিল ডলফিনগুলোর দিকে। ভরা জোয়ার এসে গেছে, কিন্তু এখনও দহটা ছেড়ে যায়নি ওরা। তার মানে রাতে ওরা শিকারে বেরোয় না। কাল তা হলে ভাটা শেষ হলে দেখতে হবে তখন ওরা কী করে।
শুয়ে শুয়ে কল্পনা করতে লাগল পিয়া আধোঘুমে দহটার মধ্যে পাক খেয়ে যাচ্ছে ডলফিনগুলো, জলের মধ্যে ভেসে আসা প্রতিধ্বনি শুনছে কান পেতে, ছবি আঁকছে–ত্রিমাত্রিক সব ছবি, যার অর্থ একমাত্র ওরাই উদ্ধার করতে পারে। খুব ভাল লাগে পিয়ার ওদের জগৎটার কথা ভাবতে: যেখানে ‘দেখা’ আর ‘শোনা’য় কোনও ফারাক নেই, যেখানে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগই অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র উপায়।
সে তুলনায় নিজের জগতে—এখানে–কত লক্ষ যোজন দূরত্ব ওর আর ফকিরের মধ্যে। ওই জ্যোৎস্নার নদীর দিকে চেয়ে কী ভাবছে ফকির? জঙ্গলের কথা? কঁকড়ার কথা? কোনওদিনই জানতে পারবে না পিয়া। শুধু যে ভাষার ব্যবধানের জন্য তা নয়, জানতে পারবে না কারণ মানুষদের জগৎটাই এরকম। একমাত্র মানুষই পৃথিবীতে আসে অন্যের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখার ক্ষমতা নিয়ে। ফকির আর ও, ওরা দু’জন দু’জনকে যতটা জানে, তাতে ওরা যদি দুটো গাছ কি পাথরও হত তফাত বিশেষ কিছু হত না। সেভাবে ভাবলে একদিক থেকে এটাই তো ভাল, এই কথা না বলতে পারাটা–অন্তত এটুকু তো বলা যাবে যে নিজেদের কাছে সৎ আছে ওরা। কারণ ডলফিনরা যেমন তাদের প্রতিধ্বনির আয়নাতেই পৃথিবীটাকে দেখে, তার সঙ্গে তুলনা করলে মানুষের ভাষা তো শুধু কিছু কৌশল, চোখের দিকে তাকিয়েই মনের কথা পড়ে নেওয়া সম্ভব–এই ভুল ধারণার বাহন মাত্র।