কুসুম
গেস্ট হাউসটার ছাদে দাঁড়ালে একটানা অনেকটা অবধি চোখে পড়ে। বেশ খানিকটা দূরে হ্যামিলটন হাই স্কুল, তারও পরে নির্মলদের আগেকার বাড়ির জায়গাটা পর্যন্ত এখান থেকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল কানাই। সে বাড়িটার জায়গায় এখন একটা হস্টেল উঠেছে স্কুলের ছাত্রদের জন্য, কিন্তু কানাইয়ের মনে নির্মলের সেই বাংলোর ছবি এখনও স্পষ্ট। নামে ‘বাংলো’ হলেও আকারে প্রকারে বাড়িটা আসলে ছিল স্রেফ একটা গুমটি। পুরোটা কাঠের তৈরি, ইট কি সিমেন্টের বালাই নেই। মাটি থেকে একটু ওপরে হাত-খানেক উঁচু কয়েকটা খুঁটির ওপর যেন কোনওরকমে দাঁড় করানো ছিল সেই বাড়ি। মেঝেটাও ছিল এবড়ো খেবড়ো মতো। শীতে বর্ষায় আবার তার ঢাল বদল হত। কানাইয়ের মনে আছে বর্ষাকালে কেমন স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যেত মেঝেটা, একটু দেবে যেত নীচের দিকে। শীতকালে হাওয়া শুকনো হয়ে এলে আবার টানটান যেমনকে তেমন।
সাকুল্যে দুখানা মাত্র ঘর ছিল সেই ‘বাংলোয়। একটা শোয়ার ঘর, আরেকটাকে বলা যেতে পারে স্টাডি মতন, নির্মল আর নীলিমা দুজনেই সেখানে তাদের লেখাপড়ার কাজকর্ম করত। ওই ঘরেই একটা খাট পাতা হয়েছিল কানাইয়ের জন্য। সব সময় মোটা সুতির মশারি ফেলা থাকত তার ওপর। নির্মলদের বড় খাটটাতেও থাকত। যত না মশার জন্য, তার চেয়েও অন্যান্য প্রাণীর জন্য মশারিটা বেশি জরুরি ছিল সে সময়। রাতে তো বটেই, এমনকী দিনের বেলাতেও মশারি খাটানো না থাকলে সাপ-খোপ কি কাঁকড়াবিছে বালিশের তলায় বা বিছানার চাদরের নীচে ঢুকে বসে থাকত। পুকুরের পাড়ে একটা কুঁড়েতে নাকি একদিন তক্তপোশের ওপর একটা মরা মাছ পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছিল। সে বাড়ির বউ এসে গল্পটা বলেছিল। একটা আস্ত কইমাছ কে জানে কখন কানে হেঁটে এসে উঠেছে, তারপর বিছানার ওপরেই মরে পড়ে রয়েছে।
রাত্তিরে মশারি গোঁজার আগে সব কোনা-খামচাগুলো একবার ভাল করে দেখে নিতে হত। এইসব রোজকার সাধারণ কাজের মধ্যেও মাঝেমধ্যেই ছোটবড় নানা উত্তেজনার খোরাক থাকত ভাটির দেশে। লুসিবাড়িতে আসার কিছুদিন পর একবার তো মশারি খাটাতে গিয়ে আরেকটু হলেই বিপদে পড়েছিল নীলিমা। রাত্রিবেলা, ঘরে একটা মাত্র মোমবাতি। সেটা আবার রাখা আছে ঘরের অন্য প্রান্তে, জানালার তাকের ওপর। নীলিমা একেই বেঁটেখাটো, তার ওপর চোখেও বেশ পাওয়ার, কম আলোতে ভাল দেখে না। খাটের চারকোনায় চারটে বাঁশের খুঁটি আটকানো, সেগুলির থেকেই মশারিটা ঝোলানো হত। খুঁটি অবধি ভাল করে হাত যায় না, পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে কোনওরকমে, আন্দাজে আন্দাজে মশারির দড়িগুলি বাঁধছিল নীলিমা। আচমকা একটা দড়ি যেন জ্যান্ত হয়ে ছিটকে এল। সঙ্গে ফোঁস করে একটা আওয়াজ। নীলিমা তো পড়ি কি মরি করে কোনওরকমে মারল এক লাফ। হাতটা টেনে নেওয়ার আগেই চটাস করে লেজের একটা ঝাঁপটা লাগল তালুর মধ্যে। তারপর একেবেঁকে দরজার তলা দিয়ে সাপটা যখন বেরিয়ে যাচ্ছে ও দেখল সেটা একটা বেশ বড়সড় চিতিবোড়া। যথেষ্ট বিষাক্ত সাপ। সাধারণত মাঝারি গাছের ডালপালার মধ্যে এদের বাস। মশারি খাটানোর বাঁশটাকেও তাই নিজের জায়গা মনে করে বেশ গুছিয়ে বসেছিলেন বাবাজি।
রাত্তিরে খাটে শুলেই কানাইয়ের মনে হত গোটা ছাদটা যেন জ্যান্ত হয়ে উঠেছে। চালার মধ্যে থেকে থেকেই অদ্ভুত সব আওয়াজ পাওয়া যেত–কখনও হয়তো কিছু একটা খচমচ করে দৌড়ে গেল, অথবা ফোঁস করে উঠল কোথাও, সঙ্গে সঙ্গে হয়তো একটা প্রবল কিচমিচ। মাঝে মধ্যেই ঠপ করে চালা থেকে নীচে পড়ত প্রাণীগুলো। পড়েই অবশ্য লাফিয়ে উঠে বেরিয়ে যেত দরজার তলা দিয়ে, কিন্তু মাঝে মধ্যে সকালে ঘুম থেকে উঠে কানাই দেখত একটা মরা সাপ কি কয়েকটা পাখির ডিম পড়ে আছে মেঝের ওপর, আর পিঁপড়েরা ভোজ লাগিয়ে দিয়েছে। কখনও কখনও একেকটা আবার সোজা মশারির ওপর এসে পড়ত। পড়েই এমন নড়াচড়া শুরু করত যে মশারি টাঙানোর খুঁটিগুলো পর্যন্ত দুলতে থাকত। এইরকম ক্ষেত্রে একটাই উপায় ছিল। বালিশটা নিয়ে চোখ বুজে এক ঝাঁপটা মারতে হত মশারির চালে। সাপ, ইঁদুর, বিছে যাই হোক না কেন, ওই এক ঝাঁপটাতেই পগার পার হয়ে যেত তারা। কয়েকটা অবশ্য শূন্যে ছিটকে উঠে আবার মশারির ওপর এসে পড়ত। সেরকম হলে ফের বালিশ হাতে রণাঙ্গনে নামতে হত কানাইকে।
বাংলোর পেছন দিকে একটা খোলা উঠোন মতো জায়গা ছিল, সেখানেই লুসিবাড়ি মহিলা সমিতির মিটিং-টিটিং হত। ১৯৭০ সালে কানাইকে যখন নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল এখানে, তখনও মহিলা সমিতি এত বিরাট হয়নি, টিমটিম করে চলছিল কোনওরকমে। সপ্তাহে কয়েকবার করে সমিতির সদস্যারা জড়ো হত নীলিমার বাড়ির উঠোনে। সেলাই-ফোঁড়াই, কাপড় বোনা, সুতো রং করা–এইসব নানান রোজগারমূলক কাজকর্ম নিয়ে আলাপ আলোচনা হত। সাধারণ গল্পগুজবও হত নানা রকম। আর ঘরের কথা উঠলেই অনেক সব জমানো ক্ষোভ-দুঃখের কথাও চলে আসত অনিবার্য ভাবেই।
শুরুর দিকে গাঁয়ের মেয়েদের এইসব ঘরোয়া পাঁচালি শুনতে অসহ্য লাগত কানাইয়ের। সমিতির মিটিং শুরু হলেই ও তাই বেরিয়ে পড়ত বাড়ি থেকে। ঘুরে বেড়াত এদিক ওদিক। কিন্তু তার একটা সমস্যাও ছিল। লুসিবাড়িতে কানাইয়ের সমবয়সি কোনও বন্ধু ছিল না। আর সেরকম কোনও যাওয়ার জায়গাও ছিল না। ওর বয়সের ছেলেপুলে যারা ছিল তারা হয় একেবারে সরল-সোজা, চুপচাপ অথবা অকারণে মারকুটে ধরনের। আর কানাইও মনে মনে জানত যে কয়েক সপ্তাহ পরেই ও এই নির্বাসন থেকে মুক্তি পাবে, ওদের সঙ্গে মেশার জন্য তাই বিশেষ কোনও ইচ্ছেও হয়নি। বারদুয়েক আড়াল-আবডাল থেকে ছোঁড়া ঢিল খাওয়ার পর অবশেষে ওর মনে হল বাড়ির বাইরে থেকে ভেতরেই বেশি নিরাপদ। ফলে দুপুরগুলো ওর কাটতে লাগল মাসির বাংলোর স্টাডিতে শুয়ে-বসে। উঠোনে মিটিং-এর কথাবার্তা হট্টগোলও গা সওয়া হয়ে এল আস্তে আস্তে।
এইরকম একটা মিটিঙেই প্রথম কুসুমকে দেখল কানাই। সামনের একটা দাঁত একটু ভাঙা, ছোটো করে কাটা চুল–একটু যেন আলাদা দ্বীপের অন্যসব মেয়েদের থেকে। আগের বছর টাইফয়েড হওয়ার পর ওকে নেড়া করে দেওয়া হয়েছিল। কোনওরকমে বেঁচে উঠেছিল মেয়েটা। তখনও বেশ দুবলা, সবাই আগলে আগলে রাখত ওকে। সমিতির মিটিংগুলোর সময় ও সেখানে থাকলে কেউ তাই কিছু বলত না। একই কারণে বোধ হয় সেই পনেরো-ষোলো বছর বয়সেও ফ্রক পরে ঘোরাঘুরিতেও ওর বারণ ছিল না। ওর বয়সি গাঁয়ের অন্যান্য মেয়েদের তো শাড়িই পরতে হত। ওই বয়সেও ফ্রক পরার পেছনে অবশ্য অন্য একটা কারণও থাকতে পারে। জামাগুলি তো তখনও যথেষ্ট ব্যবহারযোগ্য। শাড়ি ধরার আগে আরও যতটুকু পরে নেওয়া যায় নিঙড়ে নেওয়া যায় সবটুকু উপযোগিতা। গোটা গোটা ফ্রকগুলি কি প্রাণে ধরে ফেলে দেওয়া যায়?
একদিন সমিতির মিটিং-এ গাঁয়ের এক বউ সবিস্তারে তার দুঃখের কথা শোনাচ্ছিল। কিছুদিন আগের এক রাতের ঘটনা, বলছিল বউটি। তার সোয়ামি গিয়েছিল মাছ ধরতে, ঘরে শুধু সে আর বাচ্চারা। সবাই গভীর ঘুমে। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, একখানা লম্ফ শুধু টিমটিম করে জ্বলছে। এমন সময় গলা পর্যন্ত মাল টেনে টলতে টলতে ঘরে এসে ঢুকল তার শ্বশুর। হাতে এক বিশাল রামদা। বাচ্চাগুলির সামনেই দাটা গলার কাছে চেপে ধরে ছেলের বউয়ের কাপড়ে টান দিল সে। বউ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতেই লোকটা দায়ের এক কোপ মারল তার হাতে। বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটা প্রায় দু’-আধখান হয়ে গেল। শেষমেশ জ্বলন্ত লক্ষটা বুড়োর গায়ে ছুঁড়ে মেরে সে যাত্রা রক্ষা পেল মেয়েটি। এদিকে বুড়োর লুঙ্গিতে তো গেল আগুন ধরে। বেশ খানিকটা পুড়েও গেল। তাতেই শ্বশুরবাড়ির লোকেরা খেপে গেল। ঘাড় ধরে বউকে বাড়ির বাইরে বের করে দিল। বেচারির স্বামীর ঘর করা শেষ হল স্রেফ নিজের আর ছেলেমেয়েদের ইজ্জত বাঁচাতে চেয়েছিল বলে।
গল্পের এই জায়গায় এসে গলা চড়তে লাগল বউটির। যেন ঘটনাটা প্রমাণ করার জন্যই প্রায় চিৎকার করে সে বলতে লাগল, “এই যে, এইখানে কোপ মেরেছিল আমাকে, এইখানে, এইখানে।”
কানাই আর থাকতে না পেরে দরজা দিয়ে গলা বাড়িয়ে দেখতে গেল। যে বউটি গল্প বলছিল তাকে দেখা যাচ্ছিল না। বাকি সকলে তার দিকেই তাকিয়ে ছিল বলে কানাইকে কেউ নজর করল না। শুধু একজন ছাড়া কুসুম। বাকিদের থেকে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে ছিল সে। চোখে চোখ পড়ল দু’জনের। মুহূর্তের জন্য মনে হল ওরা যেন সৃষ্টির আদিমতম সময়ে কোনও প্রান্তরের দুদিক থেকে পরস্পরের দিকে চেয়ে রয়েছে, একে অন্যকে মেপে নিতে চাইছে, বুঝে নিতে চাইছে কতটা ভয়ংকরের সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে অন্য প্রান্তে। মনে হচ্ছিল দু’জনের মধ্যেকার এই দূরত্বটুকুর মধ্যেই হয়তো গোপন রয়েছে আজকের এই আবেগের সূত্র–এই বীভৎস হিংসার বীজ। এই পারস্পরিক সমীক্ষার ফলাফল কিন্তু সাধারণ ভয় বা বিতৃষ্ণা ছিল না, দু’জনের দৃষ্টিতেই ছিল একে অপরের সম্পর্কে এক সজাগ কৌতূহল।
কানাইয়ের যদূর মনে পড়ে, কুসুমই ওর সঙ্গে প্রথম এসে কথা বলেছিল। সেই দিন নয়, অন্য আরেক দিন। সকাল বেলায়। বাংলোর মেঝেতে বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে একটা বই পড়ছিল কানাই। পরনে স্রেফ একটা খাকি হাফপ্যান্ট। বইটা রাখা ছিল ওর কোলের ওপর। হঠাৎ মনে হল দরজার বাইরে থেকে কে যেন ওকে উঁকি মেরে দেখছে। বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে ও দেখল হাঁটা চুল আর ছেঁড়া ফ্রক-পরা ধীর গম্ভীর একটা চেহারা দাঁড়িয়ে রয়েছে দরজার সামনে। খানিকটা ঝগড়াটে গলায় চোখমুখ কুঁচকে ওকে জিগ্যেস করল, “কী করছিস তুই এখানে বসে?”
“বই পড়ছি।”
“আমি দেখেছি–সেদিন তুই সব শুনছিলি।”
“কী হয়েছে তাতে?” কাঁধ ঝাঁকাল কানাই।
“আমি বলে দেব।”
“বলগে যা।” কিন্তু বাইরে সাহস দেখালেও ভেতরে ভেতরে ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল কানাইয়ের। যদি সত্যি সত্যি বলে দেয়। প্রসঙ্গটা অন্য দিকে ঘোরাতে তাড়াতাড়ি একপাশে সরে কুসুমের বসার জন্য জায়গা করে দিল ও। কানাইয়ের পাশেই এসে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল মেয়েটা। একেবারে গা ঘেঁষে। হাঁটুর ওপর চিবুক। খুব কাছ থেকে ওর দিকে তাকিয়ে দেখার সাহস হল না কানাইয়ের, কিন্তু টের পাচ্ছিল মেয়েটার শরীরে ঠেকে আছে ওর শরীর ওর কনুইয়ের সঙ্গে, পায়ের সঙ্গে, হাঁটুর সঙ্গে ঘষা খাচ্ছে কুসুমের কনুই, পা, হাঁটু। ওর বাঁদিকের বুকের ওপর একটা ছোট্ট তিল নজরে এল কানাইয়ের। খুবই ছোট্ট একটা তিল, কিন্তু কিছুতেই ও আর সেটার থেকে চোখ সরাতে পারছিল না।
“দেখি, তোর.বইটা দেখা তো আমাকে”, বলল কুসুম।
বইটা ছিল একটা ইংরিজি রহস্য গল্প। কানাই তাই পাত্তাই দিল না ওর অনুরোধকে। “এটা দেখে তুই কী করবি? কিছুই বুঝবি না।”
“কেন বুঝব না?”
“তুই ইংরেজি পড়তে পারিস?” জিগ্যেস করল কানাই। “না।”
“তালে দেখতে চাইছিস কেন?”
জবাব না দিয়ে কয়েকমুহূর্ত প্যাটপ্যাট করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল মেয়েটা। তারপর ডানহাতটা ওর নাকের সামনে এনে আস্তে আস্তে মুঠোটা খুলে জিগ্যেস করল, “এটা কী জানিস?”
একটা ঘাসফড়িং। তাচ্ছিল্যের ভাব করে কানাই বলল, “না জানার কী আছে। এ তো সব জায়গায় পাওয়া যায়।”
“তা’লে দেখ”, বলেই খপ করে ফড়িংটা নিজের মুখের ভেতরে পুরে দিল কুসুম।
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাতের বইটা নামিয়ে হাঁ করে মেয়েটার দিকে চেয়ে রইল কানাই। “তুই খেয়ে ফেললি ওটাকে?”
হঠাৎ হাঁ করল কুসুম। সঙ্গে সঙ্গে ঘাসফড়িংটা একলাফে বেরিয়ে সোজা কানাইয়ের মুখের ওপর এসে পড়ল। চমকে চেঁচিয়ে উঠে পেছন দিকে উলটে পড়ে গেল কানাই, আর খিলখিল করে হাসতে লাগল মেয়েটা।
“কী বোকা রে! ওটা তো এমনি একটা পোকা। ভিতু কোথাকার।”