» » » » বিদায় লুসিবাড়ি

বর্ণাকার

বিদায় লুসিবাড়ি

গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে হাসপাতালের রাস্তা ধরে কানাই যখন হাঁটতে শুরু করল লুসিবাড়ি তখন ভোরের কুয়াশায় ঢাকা। এই সাতসকালেও দেখা গেল একটা সাইকেল ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে গেটের সামনে। সেটাকে নিয়ে আবার গেস্ট হাউসে ফিরল কানাই। পিয়া আর ভ্যানওয়ালার সঙ্গে হাত লাগিয়ে মালপত্রগুলো তুলে ফেলল ভ্যানের পিছনে। মালপত্র বলতে খুব একটা বেশি কিছু না–কানাইয়ের সুটকেস, পিয়ার পিঠব্যাগ দুটো, আর গেস্ট হাউস থেকে ধার করা বালিশ কম্বলের একটা বান্ডিল।

বেশ জোরেই চলছিল ভ্যানটা। খানিকক্ষণের মধ্যেই গ্রামের সীমানায় এসে পড়ল ওরা। বাঁধের কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎ সামনের দিকে ইশারা করল ভ্যানওয়ালা। “ওই দেখুন, কী যেন একটা হচ্ছে ওখানে, ওই বাঁধের ওপরে।”

ভ্যানের তক্তার ওপর পা ঝুলিয়ে পেছন ফিরে বসেছিল কানাই আর পিয়া। ভ্যানওয়ালার কথা শুনে গলা বাড়িয়ে কানাই দেখল বাঁধের একেবারে ওপরে বেশ কিছু লোক জড়ো হয়েছে। মনে হল ওপারে কিছু একটা হচ্ছে কোনও প্রতিযোগিতা বা ওইরকম একটা কিছু। ভিড়ের সবাই মন দিয়ে দেখছে, কেউ কেউ মাঝে মাঝে চিৎকার করে উঠছে, মনে হল যেন উৎসাহ দিচ্ছে কাউকে। মালপত্র ভ্যানে রেখে কানাই আর পিয়াও উঠল বাঁধের ওপর, কী হচ্ছে দেখে আসতে।

ভাটা পড়ে গেছে। চড়াটার একেবারে শেষে নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে মেঘা। পাশে ফকিরের ডিঙি। সেটাই দেখা গেল সম্মিলিত জনতার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। নৌকোর ওপর দাঁড়িয়ে ফকির আর টুটুল। তাদের পাশে হরেন আর তার সেই তেরো-চোদ্দো বছরের নাতি। একটা মাছধরা সুতোকে প্রাণপণে টেনে ধরে আছে ওরা। টানটান সুতোটা চিকচিক করছে আলো লেগে, তীব্র গতিতে জল কেটে এঁকেবেঁকে ছুটছে ডাইনে বাঁয়ে।

লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল একটা শঙ্করমাছ গেঁথেছে ফকিরের বঁড়শিতে। কানাই আর পিয়ার চোখের সামনেই হঠাৎ ছাই রঙের চ্যাপটা জীবটা এরোপ্লেনের মতো ছিটকে উঠে এল জল থেকে। ফকিররা সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে গিয়ে ধরল সেটাকে। মনে হল যেন বিশাল একটা ঘুড়িকে টেনে নামিয়ে আনার চেষ্টা করছে। হাতে গামছা জড়িয়ে সর্বশক্তিতে মাছটাকে ধরে রেখেছে ওরা। আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে আসছে প্রাণীটার আছাড়ি পিছাড়ি। শেষ পর্যন্ত ডিঙির কিনার দিয়ে ঝুঁকে পড়ে দায়ের এক কোপে মাছটার ভবলীলা সাঙ্গ করল ফকির।

শিকার ডাঙায় এনে ফেলার পর ভিড় করে সেটাকে ঘিরে দাঁড়াল সবাই। পিয়া আর কানাইও গেল দেখতে। পাখনাগুলো মেলে ধরার পর দেখা গেল প্রায় মিটার দেড়েকের মতো চওড়া মাছটা। লেজের দৈর্ঘ্য মোটামুটি তার অর্ধেক। ওরা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই একজন মাছওয়ালা দর দিল ওটাকে কেনার জন্য। রাজি হয়ে গেল ফকির। কিন্তু মাছটা নিয়ে যাওয়ার আগে দায়ের এক কোপে লেজটা কেটে নিয়ে ফকির টুটুলকে দিল সেটা। দেওয়ার ভঙ্গিটার মধ্যে এমন একটা আড়ম্বরের ভাব ছিল যে মনে হল যেন কোনও যুদ্ধ জয় করে আনা রত্নভাণ্ডার ছেলের হাতে তুলে দিচ্ছে ফকির।

“টুটুল ওটা দিয়ে কী করবে?” জিজ্ঞেস করল পিয়া।

“খেলবে-টেলবে আর কী,” জবাব দিল কানাই। “আগেকার দিনে রাজা জমিদাররা এই শঙ্করমাছের লেজের চাবুক দিয়ে অবাধ্য প্রজাদের শাসন করত। ভয়ানক যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার। কিন্তু খেলনা হিসেবে জিনিসটা মন্দ নয়। আমারও একটা ছিল ছোটবেলায়।”

টুটুল তখনও মুগ্ধ হয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে লেজটাকে, এমন সময় ভিড় ঠেলে হঠাৎ ময়না এসে দাঁড়াল ওর সামনে। ঘাবড়ে গিয়ে একছুটে মায়ের নাগালের বাইরে পালাল টুটুল, গিয়ে লুকোল ফকিরের পেছনে। ছেলের গায়ে লেগে যাবে ভয়ে দু’হাতে রক্তমাখা দা-টা মাথার ওপরে তুলে ধরল ফকির। আর মায়ের হাত এড়িয়ে বাপের চারদিকে ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগল টুটুল। ভিড়ের সমস্ত লোক হো হো করে হেসে উঠল দৃশ্যটা দেখে।

ডিউটিতে যাওয়ার জন্যে তৈরি হয়ে বেরিয়েছে ময়না। পরনে নার্সের পোশাক–নীল পাড় সাদা শাড়ি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টুটুলকে যখন ও ধরতে পারল, শাড়ি ততক্ষণে জলে কাদায় মাখামাখি। এত লোকের সামনে অপদস্থ হয়ে ঠোঁটদুটো অল্প অল্প কঁপছে ময়নার। ফকিরের দিকে ঘুরে তাকাল ও। চোখ নামিয়ে ফেলল ফকির। দা থেকে মুখের ওপর গড়িয়ে পড়া একটা রক্তের ফোঁটা মুছে নিল হাতের পেছনে।

“তোমাকে বলেছিলাম না ওকে সোজা স্কুলে নিয়ে যেতে?” ঝাঝালো গলায় বলল ময়না। “তুমি ওকে এখানে নিয়ে চলে এসেছ?”

ছেলের হাত থেকে শঙ্করমাছের লেজটা ছিনিয়ে নিল ও। বিষম খাওয়ার মতো একটা সম্মিলিত আওয়াজ উঠল ভিড় থেকে। একটানে লেজটাকে নদীর মধ্যে ছুঁড়ে দিল ময়না। মুহূর্তে স্রোতের টানে মিলিয়ে গেল ফকিরের বিজয়স্মারক। তারপর হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে চলল টুটুলকে। কান্নায় মুচড়ে গেল ছেলেটার মুখ। চোখদুটো চেপে বন্ধ করে চলতে লাগল মায়ের পেছন পেছন, যেন জোর করে দৃষ্টির আড়াল করে দিতে চাইছে চারপাশের সবকিছুকে।

কানাইয়ের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সামান্য কমে এল ময়নার চলার গতি। মুহূর্তের জন্য একবার চোখাচোখি হল দু’জনের। তারপর ছেলের হাত ধরে একদৌড়ে বাঁধের গা বেয়ে নেমে গেল ও। ময়না চোখের আড়ালে চলে যাওয়ার পর ফিরে তাকাল কানাই। দেখল ফকির একদৃষ্টে চেয়ে আছে ওর দিকে, মেপে নিচ্ছে ওকে। মনে হল কানাইয়ের সঙ্গে ময়নার নির্বাক ভাব বিনিময় নজরে পড়েছে ফকিরের–মনে মনে বোঝার চেষ্টা করছে তার মানেটা।

হঠাৎ খুব অস্বস্তি হতে লাগল কানাইয়ের। তাড়াতাড়ি পিয়ার দিকে ফিরে ও বলল, “চলুন, মালপত্রগুলো নামিয়ে ফেলি গিয়ে।”

ধকধক দমদম আওয়াজ তুলল ইঞ্জিন। ধীরে ধীরে লুসিবাড়ির চর ছেড়ে সরে যেতে লাগল মেঘা, আর ভটভটিটার পেছন পেছন দমকে দমকে এগোতে লাগল ফকিরের ডিঙি। মেঘার ইঞ্জিনের গতি বদলের সঙ্গে সঙ্গে এক-একবার টান পড়ছে ডিঙিতে বাঁধা দড়িতে, পরক্ষণেই আবার ঢিলে হয়ে যাচ্ছে। এই এলোমেলো গতিতে হঠাৎ ধাক্কা-টাক্কা যাতে না-লেগে যায়। সেজন্য ভটভটিতে না উঠে ডিঙিতেই রয়ে গেল ফকির। হাতে একটা লগি নিয়ে বসে রইল নৌকোর গলুইয়ে–ভটভটির খুব কাছে চলে এলে লগি দিয়ে ঠেলে সরিয়ে নিয়ে আসবে ডিঙিটাকে।

মেঘার ওপরের ডেকে সারেং-এর ঘরের পাশে দুটো উঁচু কাঠের চেয়ার রাখা, তারই একটায় গিয়ে বসেছিল কানাই। মাথার ওপর রোদ আড়াল করার জন্য একটা তেরপল টাঙানো। নির্মলের নোটবইটা কোলের ওপর খুলে রেখেছে কানাই, কিন্তু পড়ছে না। সার্ভের কাজের জন্য জিনিসপত্র গুছিয়ে তৈরি হচ্ছে পিয়া, তাকিয়ে তাকিয়ে তা-ই দেখছে ও।

গলুইয়ের সামনের দিকটা যেখানটায় একটু ছুঁচোলো হয়ে সামনে এগিয়ে গেছে, একেবারে তার কাছটায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল পিয়া। রোদ-হাওয়ার মুখোমুখি। ঠিকমতো দাঁড়িয়ে প্রথমে দূরবিনটা ঝুলিয়ে নিল গলায়, তারপর অন্য যন্ত্রপাতির বেল্টটা বাঁধতে লাগল। বেল্টের একদিকে লাগানো রয়েছে ক্লিপবোর্ড, আর অন্যদিকে ঝুলছে দু’খানা যন্ত্র–জিপিএস ট্র্যাকার আর ডেথ সাউন্ডার। বেল্ট-টেল্ট বাঁধা হয়ে গেলে তারপর দূরবিনটা তুলে নিয়ে চোখে লাগাল পিয়া। পা দুটো অনেকখানি ফাঁক করে দাঁড়িয়েছে, অল্প অল্প দুলছে ভটভটির দুলুনির সাথে সাথে। একমনে জলের দিকেই তাকিয়ে যদিও, কিন্তু কানাই বুঝতে পারছিল চারপাশে যা যা হচ্ছে–নৌকোর ওপরে কি নদীর পাড়ে–সবকিছুর প্রতিই বেশ সতর্ক রয়েছে পিয়া।

সূর্য যত ওপরে উঠতে লাগল ততই বাড়তে থাকল জলের ওপর থেকে ঠিকরে আসা আলোর তীব্রতা। বেলার দিকে একটা সময়ে সেই জোরালো বিচ্ছুরণে মুছে গেল জল আর আকাশের সীমারেখা। সানগ্লাস পরেও নদীর দিকে বেশিক্ষণ চোখ রাখা যায় না। পিয়া কিন্তু নির্বিকার। কী আলো, কী হাওয়া, কিছুতেই যেন কিছু আসে যায় না ওর। ভটভটির ঝাঁকুনি সামলানোর জন্য হাঁটুদুটো একটু ভাজ করে দাঁড়িয়ে কাজ করে যাচ্ছে একটানা, শরীরটা অল্প দুলছে পাশাপাশি, মনে হচ্ছে যেন খেয়ালই করছে না ঢেউয়ের দুলুনি। এতক্ষণে একটাই শুধু আপোশ করেছে–রোদ আড়াল-করা একটা টুপি বের করে পরে নিয়েছে মাথায়। তেরপলের আড়ালে বসে আলোর বিপরীতে ছায়ার মতো পিয়ার শরীরটা দেখতে পাচ্ছিল কানাই, চওড়া কানাওয়ালা টুপি আর যন্ত্রপাতি-ঝোলানো বেল্ট সমেত অনেকটা আমেরিকান কাউবয়দের মতো মনে হচ্ছিল ওর চেহারাটাকে।

বেলার দিকে হঠাৎ একবার একটু উত্তেজনার সঞ্চার হল বোটে। শোনা গেল ডিঙি থেকে চিৎকার করছে ফকির। ইশারায় হরেনকে ইঞ্জিন বন্ধ করতে বলে ডেকের পেছন দিকটায় দৌড় লাগাল পিয়া। কানাইও ছুটল পেছন পেছন, কিন্তু যতক্ষণে ও গিয়ে পৌঁছেছে তখন আর দেখার মতো কিছুই নেই।

“কী হল বলুন তো?”

একটা ডেটাশিটের ওপর ব্যস্ত হয়ে কীসব লিখে চলছিল পিয়া, মুখ তুলে তাকাল না। “ফকির একটা গ্যাঞ্জেটিক ডলফিন দেখতে পেয়েছে,” লিখতে লিখতেই জবাব দিল ও। “ভটভটির ডানদিকে, শ’ দুয়েক মিটার পেছনে। এখন আর চেষ্টা করে লাভ নেই, দেখতে পাবেন না। এতক্ষণে সাবধান হয়ে গেছে ওটা।”

পিয়ার গলায় সামান্য একটু হতাশা লেগে রয়েছে মনে হল কানাইয়ের। “এটাই কি প্রথম আজকে?”

“হ্যাঁ,” উৎসাহের সুরে জবাব দিল পিয়া। “এটাই প্রথম। তাতে অবশ্য আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। যা আওয়াজ।”

“ওরা কি ভটভটির শব্দে ভয় পেয়ে গেছে মনে হয়?”

“হতেই পারে,” পিয়া বলল। “আবার এরকমও হতে পারে যে আওয়াজটা মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত জলের নীচে ডুব দিয়ে থাকছে। যেমন ধরুন এই ডলফিনটা–আমরা ওটাকে পেরিয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে আসার পর জল থেকে মাথা তুলল ও।”

“আচ্ছা, আগে কি এখানে আরও বেশি ডলফিন দেখা যেত?”

“সে তো যেতই,” বলল পিয়া। “এইসব অঞ্চলের নদী-নালায় বিভিন্ন প্রজাতির জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী একসময় গিজগিজ করত। পুরনো তথ্য ঘাঁটলেই সে বিষয়ে নানা খোঁজখবর পাওয়া যায়।”

“তারা সব গেল কোথায়?”

“ব্যাপারটা কী জানেন, পরিবেশের পরিবর্তনের জন্যেই মনে হয় ডলফিনের সংখ্যা ক্রমশ কমে এসেছে এখানে। হয়তো আচমকা বড় রকমের কিছু একটা ঘটেছিল কোনও সময়।”

“তাই?” বলল কানাই। “আমার মেসোরও এইরকমই একটা ধারণা ছিল।”

“ধারণাটা ভুল ছিল না,” পিয়া একটু গম্ভীর। “একটা স্থায়ী বসবাসের জায়গা ছেড়ে যদি চলে যেতে শুরু করে এইরকম প্রাণীরা, বুঝতে হবে কোথাও খুব, খুব সাংঘাতিক কিছু একটা গোলমাল হয়েছে।”

“সে গোলমালটা কী হতে পারে বলে মনে হয় আপনার?”

“কোথা থেকে শুরু করি বলুন তো?” একটু শুকনো হেসে জিজ্ঞেস করল পিয়া। “বাদ দিন সেসব কথা। এই ইতিহাস ঘাঁটতে শুরু করলে চোখের জল সামলানো মুশকিল।”

খানিক পরে একটু জল খেয়ে নেওয়ার জন্যে পিয়া চোখ থেকে দূরবিনটা নামাতে কানাই বলল, “তো, আপনার কি তা হলে এটাই কাজ? এরকমভাবে সারাদিন জলের দিকে তাকিয়ে থাকা?”

কানাইয়ের পাশে এসে বসে পড়ল পিয়া। বোতল কাত করে খানিকটা জল গলায় ঢেলে বলল, “হ্যাঁ। সেটারও অবশ্য একটা পদ্ধতি আছে, কিন্তু বেসিক্যালি কাজটা তাই-ই। জলের দিকে তাকিয়ে থাকা। কিছু দেখতে পেলে ভাল, না পেলেও আফশোস খুব একটা নেই। সেটাও একটা তথ্য। সবটাই কাজে লাগে।”

না বোঝার ভাব করে মুখ বাঁকাল কানাই। বলল, “যার কাজ তাকে সাজে। আমি হলে তো পুরো একটা দিনও এই কাজ করে উঠতে পারতাম না। ভীষণ একঘেয়ে মনে হত।”

বোতলের জলটা শেষ করে ফেলল পিয়া। হাসল আবার। “সেটা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু এই কাজের ধরনটাই তাই, জানেন? হয়তো অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে বসে আছেন কিন্তু কিছুই ঘটছে না, আবার কখনও হয়তো সাংঘাতিক ব্যস্ততা। আর সে ব্যস্ততাটাও মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য। এই কাজের ছন্দটার সঙ্গে মানিয়ে নিতে খুব কম লোকই পারে। আমার তো মনে হয় দশ লাখে একটা পাওয়া যায় সেরকম লোক। সে কারণেই এখানে ফকিরের মতো একটা লোককে পেয়ে খুব আশ্চর্য হয়েছি আমি।”

“আশ্চর্য হয়েছেন? কেন?”

“ডলফিনটাকে কেমন স্পট করল ও দেখলেন তো?” বলল পিয়া। “যেন সব সময়ই জলের দিকে নজর রেখে চলেছে ও। নিজের অজান্তেই। এর আগেও অনেক অভিজ্ঞ জেলের সঙ্গে কাজ করেছি আমি, কিন্তু এরকম অদ্ভুত ইন্সটিংক্ট আমি কারওর মধ্যে দেখিনি। নদীর বুকের ভেতরটা পর্যন্ত যেন দেখে নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে ওর।”

পিয়ার কথাটা হজম করতে এক মুহূর্ত সময় লাগল কানাইয়ের। “তা হলে ওর সঙ্গেই কাজ চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আপনার?”

“ওর সঙ্গে আবার কাজ করার ইচ্ছে তো আমার আছে বটেই,” বলল পিয়া। “আমার মনে হয় ফকিরের সঙ্গে মিলে কাজ করতে পারলে অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারা যাবে।”

“মনে হচ্ছে আপনার কিছু একটা লং-টার্ম প্ল্যান রয়েছে?” মাথা নাড়ল পিয়া। “সত্যি বলতে কী, সেরকম ইচ্ছে একটা আছে। একটা প্রজেক্টের কথা আমার মাথায় ঘুরছে, সেটা যদি হয় তা হলে বেশ কয়েক বছরই হয়তো এখানে থেকে যেতে হবে আমাকে।”

“এখানে? মানে এই সুন্দরবনে?”

“হ্যাঁ।”

“সত্যি?” কানাইয়ের ধারণা ছিল সামান্য কয়েকদিনের জন্যেই ইন্ডিয়ায় এসেছে পিয়া। কিন্তু ও যে এদেশে বেশ কিছুদিন থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে তাও কোনও শহর-টহরে নয়, সমস্ত অসুবিধা সত্ত্বেও এই ভাটির দেশের জলকাদার মধ্যে সেটা জানতে পেরে বেশ একটু অবাকই হয়ে গেল কানাই।

“আপনি ভাল করে ভেবে নিয়েছেন তো? এইরকম একটা জায়গায় থাকতে পারবেন আপনি বছরের পর বছর?” ও জিজ্ঞেস করল।

“কেন পারব না?”কানাইয়ের প্রশ্নটা শুনে একটু অবাকই হল পিয়া। “না পারার তো কিছু নেই।”

“আর এখানে থাকলে এই ফকিরের সঙ্গেই কাজ করবেন?”

মাথা নাড়ল পিয়া। “খুবই খুশি হব যদি তা সম্ভব হয়। কিন্তু সেটা আমার মনে হয় ফকিরের ওপরই নির্ভর করছে।”

“অন্য আর কেউ কি আছে যার সঙ্গে আপনি কাজটা করতে পারেন?”

“সেটা এক ব্যাপার হবে না কানাই,” পিয়া বলল। “ফকিরের পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা অসাধারণ। সকলের এরকম থাকে না। গত ক’দিন ওর সঙ্গে কাজ করতে যে কী ভাল লেগেছে সেটা আমি আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না। এত সুন্দর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা আমার খুব কমই হয়েছে।”

কানাইয়ের মনের ভেতরে কোথায় হঠাৎ একটা ঈর্ষার তীক্ষ্ণ খোঁচা লাগল। নিজেকে সামলাতে না-পেরে একটু ব্যঙ্গের সুরে বলল, “আর এই পুরো সময়টায় ও যা যা বলেছে তার একটা বর্ণও আপনি বুঝতে পারেননি। ঠিক বলছি?”

“পারিনি,” সম্মতিতে মাথা নাড়ল পিয়া। “কিন্তু মজার ব্যাপারটা কী জানেন? আমাদের দু’জনের মধ্যে এত বিষয়ে মিল যে ভাষার ব্যবধানটার জন্য অসুবিধাই হয়নি কোনও।”

“শুনুন পিয়া,” স্পষ্ট গলায় খানিকটা কর্কশভাবে বলল কানাই। “নিজের সঙ্গে ছলনা করার চেষ্টা করবেন না। ফকির আর আপনার মধ্যে কোনও মিল কোনওকালে ছিল না, এখনও নেই। ফকির একটা জেলে, আর আপনি একজন সায়েন্টিস্ট। যে জীবজগৎ আপনার কাছে গবেষণার বিষয়, ওর চোখে সেটা খাবার জিনিস। জীবনে কখনও চেয়ারে বসেনি ও, আমি দিব্যি গেলে বলতে পারি। কল্পনা করতে পারেন প্লেনে চড়লে ওর কী অবস্থা হবে?” জেটপ্লেনের সারি সারি চেয়ারের মধ্যে দিয়ে লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে ফকির হেঁটে যাচ্ছে দৃশ্যটা কল্পনা করেই হেসে ফেলল কানাই। “আপনাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র কোনও মিল নেই পিয়া। থাকতে পারে না। আপনারা দুজনে দুটো আলাদা দুনিয়ার মানুষ, আলাদা জগতের। আপনার ওপর বজ্রাঘাত হতে যাচ্ছে বুঝতে পারলেও আপনাকে সেটা জানানোর কোনও উপায় নেই ফকিরের হাতে।”

ঠিক তক্ষুনি, কানাইয়ের কথার সূত্র ধরেই যেন, হঠাৎ ফকিরের চিৎকার শোনা গেল– ভটভটির ইঞ্জিনের শব্দের ওপর গলা চড়িয়ে চেঁচিয়ে বলছে, “কুমির! কুমির!”

“কী বলল ওটা?” ডেকের পেছনদিকে দৌড়ে গেল পিয়া। কানাইও দৌড়াল ওর সঙ্গে সঙ্গে।

ডিঙির ওপর ছইয়ের গায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে নদীর ভাটির দিকে ইশারা করছে ফকির। “কুমির!”

“কী দেখতে পেয়েছে ও?” দূরবিন তুলে চোখে লাগাল পিয়া।

“আ ক্রোকোডাইল।”

এরকম একটা তাৎক্ষণিক উদাহরণ হাতের সামনে পেয়ে সেটা ব্যবহার করার সুযোগটা আর ছাড়তে পারল না কানাই। “আপনি নিজেই দেখুন পিয়া, যদি আমি এখন এখানে না থাকতাম আপনি বুঝতেই পারতেন না কী দেখে চেঁচিয়ে উঠল ফকির।”

দূরবিনটা চোখ থেকে নামিয়ে বোটের সামনে ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াল পিয়া। ঠান্ডা গলায় বলল, “আপনার বক্তব্য আমি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি কানাই। থ্যাঙ্ক ইউ।”

“শুনুন,” পিছু ডাকল কানাই। “পিয়া–” কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। পিয়া ফিরে গেছে নিজের জায়গায়। মাফ চাওয়ার জন্য ঠোঁটের ডগায় আসা শব্দগুলি গিলে নিতে হল কানাইকে।

মিনিট কয়েক পর কানাই দেখল বোটের সামনের দিকটায় ফের গিয়ে দাঁড়িয়েছে পিয়া, চোখের সঙ্গে সাঁটা দূরবিন, এমন মগ্ন হয়ে তাকিয়ে আছে জলের দিকে যে কানাইয়ের মনে হল ও যেন পুঁথিপড়া পণ্ডিত–কোনও পাণ্ডুলিপির পাঠোদ্ধার করার চেষ্টা করে যাচ্ছে গভীর মনোযোগে। পৃথিবী যেন নিজের হাতে লিখে রেখেছে দুপাঠ্য সেই পুঁথি। দেখতে দেখতে কানাইয়ের মনে পড়ল ও নিজে প্রায় ভুলেই গেছে কেমন লাগে কোনও কিছুর দিকে এভাবে নিবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে থাকতে। কোনও ভোগ্যদ্রব্য নয়, সুখসুবিধার উপকরণ নয়, লালসা নিবৃত্তির বস্তু নয়–এরকম আপাত-অর্থহীন কিছুর দিকে এমন নিমগ্ন হয়ে চেয়ে থাকা আর হয় না এখন। অথচ একটা সময় ছিল যখন ও-ও পারত এইভাবে মনটাকে একটা বিন্দুতে নিয়ে আসতে; ঠিক এইরকম একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকত অজানার দিকে–যেন একটা চশমার ভেতর দিয়ে। কিন্তু ওর সেই দৃশ্যবস্তু লুকোনো থাকত বিভিন্ন বিজাতীয় ভাষার গভীরে। ভাষার সেই দিগন্তছোঁয়া প্রান্তরে পৌঁছে অদ্ভুত একটা তৃষ্ণার বোধ জাগত মনে, ঠিক কোন পথ দিয়ে এসে অন্য বাস্তবেরা এক জায়গায় মিলে যায় খুঁজে বের করার ইচ্ছে হত সেটা। সে যাত্রার পথের বাধাগুলির কথাও এখন স্পষ্ট মনে পড়ল কানাইয়ের–সেই হতাশার কথা, যখন এক এক সময় মনে হত কিছুতেই ওই শব্দগুলিকে ঠিকমতো তুলে আনা যাবে না ঠোঁটে, ঠিক ঠিক ওই আওয়াজগুলো মুখ দিয়ে বের করতে পারা যাবে না কোনওদিন, যেমন দরকার ঠিক সেভাবে বাক্য জুড়ে জুড়ে কথা বলা আর হয়ে উঠবে না, চেনা ছক ভেঙে গুঁড়িয়ে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে সবকিছু। শুধুমাত্র একটা উদগ্র ইচ্ছায় তখন দ্রুতগতি হয়ে উঠত মন, আর সে উত্তেজনা মনে মনে এখনও অনুভব করছে কানাই। কাম্য বস্তুর চেহারাটা কেবল পালটে গেছে, সেই তীব্র বাসনা এখন জলজ্যান্ত একটা মেয়ের চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে, এই বোটের ওপর রক্তমাংসে গড়া সেই ভাষার শরীর।