বাঁচা
লুসিবাড়িতে যখন পৌঁছলাম তখনও আমার শরীর বেশ খারাপ। নীলিমা হরেনকে বকাবকি করতে লাগল। বলল, “তোমার জন্যেই এরকম হল। কেন বারবার ওকে টেনে নিয়ে যাও মরিচঝাঁপিতে? দেখো তো এখন, কীরকম অসুস্থ হয়ে পড়ল মানুষটা।”
সুস্থ যে আমি ছিলাম না সে কথা ঠিক–নানারকম স্বপ্ন, কল্পনা আর ভয়ের চিন্তায় সবসময় ভরে থাকত মাথাটা। এমনও অনেকদিন হয়েছে যে বিছানার থেকে ওঠারই ক্ষমতা হয়নি–চুপচাপ শুধু শুয়ে থেকেছি আর রিলকের কবিতা পড়েছি, ইংরেজিতে আর বাংলায়।
আমার সঙ্গে অনেক নরম সুরে কথা বলত নীলিমা তখন। “কতবার বলিনি তোমাকে ওখানে না যেতে? বলো? বলিনি এইরকম অবস্থা দাঁড়াবে একদিন? তুমি যদি সত্যি সত্যি কিছু করতে চাও তা হলে তো ট্রাস্টের কাজেই সাহায্য করতে পারো। হাসপাতালটার জন্যে কিছু কিছু কাজ করতে পারো। তার জন্য মরিচঝাঁপিতে কেন যেতে হবে?”
“সে তুমি বুঝবে না নীলিমা।”
“কেন নির্মল? বলো আমাকে। কিছু কিছু গুজব আমার কানে এসেছে। সবাই নানারকম কানাঘুষো করছে। কুসুমের সঙ্গে কি এসবের কোনও সম্পর্ক আছে?”
“এটা তুমি কী বললে নীলিমা? এতগুলি বছর তো আমার সঙ্গে কাটালে–কখনও কি এ ধরনের কোনও চিন্তার কোনও কারণ ঘটেছে?”
নীলিমা কাঁদতে শুরু করল। “লোকে তো সেসব কথা বুঝবে না নির্মল। চারদিকে কুৎসিত গুজব রটছে, কান পাতা যায় না।”
“নীলিমা, এ সমস্ত গুজবে কান দেওয়া কি তোমাকে মানায়, বলো?”
“তা হলে কুসুমকে এখানে নিয়ে এসো। ও এখানে থেকে ট্রাস্টের কাজ করুক। তুমিও করো।”
কী করে ওকে বোঝাব আমি, যে ট্রাস্টের কাজ করার জন্য আমার থেকে ভাল লোক অনেক আছে। আমি তো এখানে শুধু কলম পেষার কাজ করতে পারব, যন্ত্রের মতো, দম দেওয়া খেলনার মতো। কিন্তু মরিচঝাঁপির ব্যাপারটা আলাদা। রিলকে আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন কী করতে পারি আমি ওখানে। আমারই জন্য একটা কবিতায় গোপন সংকেত রেখে গেছেন কবি–শুধু আমার জন্য। সে সংকেতের লুকোনো অর্থ খুঁজে বের করেছি আমি। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। শুধু সেই ব্রাহ্মমুহূর্তের জন্য বসে আছি আমি, অপেক্ষা করে আছি একটা ইশারার জন্য। সে ইশারা পেলে কী করব সেটা আর বলে দিতে হবে না।
কারণ, কবি নিজেই আমাকে বলে গেছেন–
‘এখানেই উচ্চার্যের মাতৃভূমি। এই তার কাল।
বল, তা ঘোষণা কর…’
দিনের পর দিন চলে গেল, সপ্তাহের পর সপ্তাহ–অবশেষে শরীরে বল ফিরে পেতে লাগলাম আমি, মনে হল আস্তে আস্তে আবার গিয়ে বসা যেতে পারে পড়ার ঘরটাতে। প্রতিদিন সকাল আর দুপুরগুলো কাটাতে লাগলাম ওখানে বিস্তীর্ণ শূন্য সেই সময়প্রান্তর পার করতাম মোহনার দিকে তাকিয়ে, বসে বসে চেয়ে দেখতাম কেমন করে আস্তে আস্তে জল নামছে, খালি হচ্ছে মোহনা, ফের ভরে যাচ্ছে, ফের খালি হচ্ছে, ফের ভরে যাচ্ছে, দিনের পর দিন, পৃথিবীর মতো ক্লান্তিহীন।
একদিন দুপুরে, দ্বিপ্রহরিক বিশ্রামের পর অন্যান্য দিনের তুলনায় খানিকটা আগেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছি নীচে, এমন সময় নীলিমার গলা কানে এল। গেস্ট হাউসে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে, গলার স্বরে বুঝতে পারলাম কে, আগের দিন রাতে ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা হয়েছিল আমার। লোকটি কলকাতার ডাক্তার, সাইকিয়াট্রিস্ট। নীলিমা বলছিল খুব ভয় পাচ্ছে ও, খুবই চিন্তায় আছে আমাকে নিয়ে। ও এমন একটা খবর জানতে পেরেছে যেটা শুনলে আমি নাকি অস্থির হয়ে পড়ব, কী করে সেটা আমার থেকে গোপন রাখা যায় সে বিষয়ে ডাক্তারবাবুর পরামর্শ চাইছিল।
“খবরটা কী?” জিজ্ঞেস করলেন ডাক্তার।
“আপনার হয়তো ব্যাপারটা সেরকম সাংঘাতিক কিছু মনে হবে না,” বলল নীলিমা। “এখান থেকে কিছু দূরে একটা দ্বীপ আছে–মরিচঝাঁপি বলে–সেইটার দখল নিয়ে গণ্ডগোল। একদল বাংলাদেশি উদ্বাস্তু ওই দ্বীপটায় এসে উঠেছে, আর কিছুতেই যেতে চাইছে না। আমার কাছে খবর আছে সরকার খুব কড়া হাতে ওদের মোকাবিলা করার জন্য তৈরি হচ্ছে এখন।”
“ওঃ, সেই উদ্বাস্তু সমস্যা!” বললেন ডাক্তার। “যতসব ঝামেলা। তো, আপনার স্বামীর তাতে কী? ওই দ্বীপে ওনার চেনাশুননা কেউ আছে নাকি? ওনার সঙ্গে ওদের সম্পর্কটা কী?”
এক মুহূর্ত চুপ করে রইল নীলিমা। তারপর গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে একটু দ্বিধার সঙ্গে বলল, “আপনাকে ব্যাপারটা আমি ঠিক বোঝাতে পারছি না ডাক্তারবাবু। আমার স্বামী যখন রিটায়ার করলেন, তারপর থেকেই ওঁর হাতে আর বিশেষ কোনও কাজ তো নেই–তাই উনি ওই মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তুদের ভালমন্দের সঙ্গে আস্তে আস্তে জড়িয়ে ফেলেছেন নিজেকে। এখন আমাদের যে সরকার আছে তারা ওদের বিরুদ্ধে কিছু করবে সেটা উনি ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারেন না। উনি সেই আগেকার আমলের বামপন্থী মানুষ। আজকালকার অনেকের মতো নন, এখনও উনি মনেপ্রাণে ওই আদর্শে বিশ্বাস করেন। এদিকে, এখন যারা ক্ষমতায় আছে তারা অনেকেই ওঁর এক সময়কার বন্ধু বা রাজনৈতিক সহকর্মী। আসলে–কী বলব–আমার স্বামী ঠিক প্র্যাকটিকাল মানুষ নন, বাস্তব জগৎটার সম্পর্কে ওঁর ধারণা খুব সীমিত। উনি বুঝতে পারেন না, একটা পার্টি যখন ক্ষমতায় আসে তাকে রাজ্যশাসনের কাজ করতে হয়। তার কতগুলি সীমাবদ্ধতা থাকে। আমি ভয় পাচ্ছি মরিচঝাঁপিতে যা ঘটতে যাচ্ছে সেটা যদি উনি জানতে পারেন, সে মোহভঙ্গের আঘাত উনি সহ্য করতে পারবেন না–ওঁর পক্ষে মারাত্মক হয়ে দাঁড়াতে পারে সেটা।”
“তা হলে সেসব ওনাকে না জানানোই ভাল,” ডাক্তারের গলা শোনা গেল। “কী করতে কী করে বসবেন, বলা তো যায় না।”
“একটা কথা বলুন ডাক্তারবাবু,” নীলিমা বলল, “কয়েকদিন কি ওঁকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা যায় না?”
“তা যায়। সেটাই মনে হয় ভাল হবে।”
আর কিছু শোনার ছিল না আমার। পড়ার ঘরে ফিরে গিয়ে চটপট কয়েকটা জিনিস ঝোলায় পুরে নিলাম। তারপর চুপি চুপি নেমে এসে তাড়াতাড়ি হাঁটা দিলাম গ্রামের দিকে। ভাগ্যক্রমে ঘাটে একটা নৌকো ছিল তখন, তাতে করে সোজা চলে গেলাম সাতজেলিয়া–হরেনের খোঁজে।
“এক্ষুনি আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে হরেন,” দেখা হতেই ওকে বললাম। “সরকার মরিচঝাঁপি আক্রমণ করবে ঠিক করেছে, খবর পেয়েছি আমি।”
খবর ওর কাছেও কিছু কম ছিল না। নানারকম গুজব ওরও কানে এসেছে–বাসভর্তি লোক বাইরে থেকে এসে নাকি জড়ো হয়েছে মরিচঝাঁপির আশেপাশের গ্রামগুলিতে, গুণ্ডা-মস্তান ধরনের লোক সব। ভাটির দেশের মানুষ এরকম লোক আগে কখনও দেখেনি। পুলিশের নৌকো সবসময় টহল দিচ্ছে দ্বীপের চারদিকে; ঢোকা কি বেরোনো প্রায় অসম্ভব।
“হরেন, কুসুম আর ফকিরকে ওখান থেকে বের করে আনতেই হবে আমাদের। এই অঞ্চলের নদীনালা তোমার থেকে ভাল কেউ চেনে না। ওখানে গিয়ে পৌঁছনোর কোনও একটা পথ বের করা যাবে না?” ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
মিনিটখানেক কী চিন্তা করল হরেন। তারপর বলল, “আজ চাঁদ থাকবে না আকাশে। যাওয়া গেলেও যেতে পারে। চেষ্টা করে দেখি একবার।”
সন্ধের মুখে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। বেশ খানিকটা খাবার আর জল নিয়ে নিলাম সঙ্গে। খানিক পরেই অন্ধকার ঘনিয়ে এল। আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু হরেন তারই মধ্যে কী করে যেন ঠিক চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নৌকোটাকে। খুব ধীরে ধীরে চলছিলাম আমরা, একেবারে পাড় ঘেঁষে। কথাবার্তা বলছিলাম ফিসফিস করে।
“আমরা এখন কোথায় হরেন?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
ও দেখলাম একেবারে নিখুঁতভাবে বলে দিল আমাদের অবস্থান। “এই গারল পেরিয়েছি। ঝিল্লায় ঢুকেছি এবার। বেশি দূর নেই আর, একটু পরেই পুলিশের নৌকো দেখতে পাবেন।” মিনিট কয়েক পরেই দেখতে পেলাম বোটগুলোকে–সগর্জনে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সার্চলাইটের আলোয় ধুয়ে দিচ্ছে নদীটাকে। প্রথমে একটা, তারপর আরেকখানা, তারপর আরও একটা। খানিকক্ষণ পাড় ঘেঁষে চুপটি করে লুকিয়ে রইলাম আমরা। কতক্ষণ পরপর বোটগুলো আসছে সে সময়টা মনে মনে মেপে নিল হরেন। তারপর আবার রওয়ানা হলাম। খানিক চলে, খানিক থেমে একটা সময় পুলিশ-নৌকোর নজরদারির এলাকা পেরিয়ে গেলাম আমরা।
একটু বাদেই গোত্তা খেয়ে পাড়ের নরম মাটিতে গিয়ে ঠেকল আমাদের নৌকো। “এসে গেছি সার,” জানান দিল হরেন। “পৌঁছে গেছি মরিচঝাঁপিতে।”দু’জনে মিলে টেনেটুনে ডিঙিটাকে বাদাবনের আড়ালে নিয়ে গিয়ে তুললাম–যাতে জল থেকে চোখে না পড়ে। হরেন বলল দ্বীপের লোকেদের সব নৌকো পুলিশ নাকি ডুবিয়ে দিয়েছে। আমাদের নৌকোটা তাই ভাল করে ঢেকেঢুকে আড়াল করে রাখলাম, তারপর জল আর খাবার-দাবার যা যা সঙ্গে এনেছিলাম সেগুলি নিয়ে নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম কুসুমের কুঁড়েতে। সেখানে পৌঁছে আমরা তো অবাক। কুসুমের কোনও হেলদোলই নেই। দিব্বি আছে এখনও। সারা রাত ধরে আমরা ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম–এক্ষুনি ওর চলে যাওয়া উচিত দ্বীপ ছেড়ে, কিন্তু কোনও কথাই ও কানে তুলল না।
“মরিচঝাঁপি ছেড়ে কোথায় যাব? আর কোথাও তো আমি যেতে চাই না,” ওর সাফ জবাব। কী কী গুজব আমাদের কানে এসেছে ওকে বললাম, বললাম চারপাশের সব কটা গাঁয়ে বাইরে থেকে তোক এসে জড়ো হয়েছে, যে-কোনও সময়ে হামলা শুরু হয়ে যাবে। হরেন নিজের চোখে দেখেছে, বাস ভর্তি করে এসেছে সব। “কী করবে ওরা?” কুসুম বলল। “এখনও দশ হাজারের বেশি লোক আমরা এখানে আছি। ভরসা করে থাকতে হবে। হাল ছাড়লে চলবে কেন?”
“কিন্তু ফকিরের কী হবে?” জিজ্ঞেস করলাম আমি। “ভালমন্দ একটা কিছু যদি ঘটে যায়, ও তা হলে কী করবে?”
“ঠিক বলেছেন সার,” আমার সঙ্গে সুর মেলাল হরেনও। “তুই যদি না যেতে চাস, তা হলে ফকিরকে অন্তত দিয়ে দে আমার সঙ্গে। কয়েকটা দিন অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে রাখি, তারপর এখানকার ঝামেলা-টামেলা মিটে গেলে আবার এসে দিয়ে যাব।”
বোঝা গেল এই নিয়ে আগে থাকতেই ভেবে রেখেছিল কুসুম। বলল, “ঠিক আছে তা হলে, তাই করা যাক। ফকিরকে নিয়ে যাও তোমরা, সাতজেলেতে নিয়ে কয়েকদিন রাখো, তারপর এখানকার ঝড়ঝাঁপটা থামলে নিয়ে এসো আবার।”
কথা বলতে বলতে ফর্সা হয়ে গিয়েছিল আকাশ। আর ফেরা যাবে না এখন। হরেন বলল, “রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। অন্ধকার না হলে পুলিশ বোটের নজর এড়িয়ে বেরোতে পারব না।”
এবার আমার পালা ওদের অবাক করে দেওয়ার। বললাম, “হরেন, আমি কিন্তু থেকেই যাচ্ছি।”
ভীষণ আশ্চর্য হয়ে গেল ওরা। বিশ্বাসই করতে পারছিল না। বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগল কেন আমি থেকে যেতে চাই, কিন্তু আমি সেসব কথা এড়িয়ে গেলাম। কত কিছুই তো ওদের বলতে পারতাম আমি লুসিবাড়িতে আমার জন্য যে ওষুধের ব্যবস্থা করা আছে সে কথা বলতে পারতাম, নীলিমার সঙ্গে ডাক্তারের কথোপকথনের কথা বলতে পারতাম অথবা দিনের পর দিন কী শূন্যতাবোধ নিয়ে সময় কাটিয়েছি আমার পড়ার ঘরটায় সেই কথাও বলতে পারতাম। কিন্তু এসব কিছুর বিন্দুমাত্র গুরুত্ব আছে বলে মনে হল না আমার। ঘটনা হল মরিচঝাঁপিতে আমার থেকে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে এতটুকু কোনও সংশয় ছিল না আমার মনে। এই নোটবইটা দেখিয়ে বললাম, “আমাকে থাকতেই হবে রে, একটা জরুরি লেখা লিখে ফেলতে হবে এখানে বসে।”
আর সময় নেই। মোমবাতিটা দপদপ করছে। পেনসিলটা ছোট্ট হয়ে গেছে ক্ষয়ে ক্ষয়ে। আমি শুনতে পাচ্ছি ওরা এগিয়ে আসছে। আশ্চর্য মনে হচ্ছে হো হো করে হাসতে হাসতে আসছে ওরা। হরেন এক্ষুনি বেরিয়ে যেতে চাইবে জানি, কারণ রাত আর বেশি বাকি নেই। ভাবতেই পারিনি এই গোটা নোটবইটা লিখে শেষ করে ফেলতে পারব আমি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখছি পুরোটা ভরেই গেল। এটাকে এখানে রেখে আর লাভ নেই। ঠিক করেছি দিয়ে দেব হরেনের সঙ্গে, যাতে কোনও না কোনও সময় তোমার হাতে গিয়ে পৌঁছয় এটা, কানাই। আমি নিশ্চিত জানি সারাজীবনে জগতের যেটুকু মনোযোগ আমি আকর্ষণ করতে পেরেছি, তার থেকে অনেক বেশি তুমি পারবে। এই খাতা নিয়ে কী করবে সেটা তুমিই ঠিক কোরো। আমি সবসময় তরুণদের ওপর ভরসা রেখে এসেছি। আমার প্রজন্মের মানুষদের তুলনায় তোমরা আদর্শের দিক দিয়ে ঋদ্ধতর হবে, কম শুভনাস্তিক হবে, কম স্বার্থপর হবে–এ আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।
ওরা ভেতরে ঢুকে এসেছে। মোমের আলোয় ওদের মুখগুলো দেখতে পাচ্ছি আমি। ওদের হাসিতে আমি কবির সেই পংক্তিগুলি প্রত্যক্ষ করছিঃ
‘দেখো, আমি বেঁচে আছি। কোন পথ্যে? শৈশব অথবা ভাবীকাল,
কোনওটাই হ্রাসপ্রাপ্ত হয় না… অস্তিত্বের অনন্ত পর্যায়
আমার হৃদয় থেকে উৎসারিত।’
খাতাটা রাখতে গিয়ে কানাই দেখল হাত কাঁপছে ওর। লফের ধোঁয়ায় ভরে গেছে কেবিন, কেরোসিনের গন্ধ চারিদিকে; মনে হল দম বন্ধ হয়ে আসছে। শোয়ার জায়গা থেকে একটা কম্বল তুলে গায়ে পেঁচিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এল কেবিন থেকে। বাইরে বেরোতেই ধক করে কড়া বিড়ির গন্ধ এসে লাগল নাকে। বাঁদিকে ফিরে বোটের সামনের দিকটায় তাকাল কানাই।
সেখানে পাশাপাশি পাতা দুটো আরাম চেয়ার। তার একটায় বসে আছে হরেন। পা দুটো বোটের গলুইয়ের কাছে রেখে বিড়ি টানছে। কানাই কেবিনের দরজা বন্ধ করতে ফিরে তাকাল ও।
“এখনও জেগে?”
“হ্যাঁ, কানাই বলল। “এইমাত্র মেসোর খাতাটা পড়ে শেষ করলাম।”
জবাবে আবেগহীন একটা আওয়াজ করল হরেন গলা দিয়ে।
হরেনের পাশের চেয়ারটায় গিয়ে বসল কানাই। “আপনার নৌকোয় ফকিরকে নিয়ে ফিরে আসার কথা দিয়েই শেষ হয়েছে মেসোর লেখা।”
চোখটা একটু নামাল হরেন, জলের দিকে। যেন ফিরে তাকাল অতীতের ভেতর। খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, “আরেকটু আগেই বেরিয়ে পড়া উচিত ছিল আমাদের। জলের টানের সুযোগটা পাওয়া যেত তা হলে।”
“আর মরিচঝাঁপিতে তারপর কী হল? আপনি জানেন?” বিড়িতে আরেকটা টান দিল হরেন। “আর সবাই যা জানে তার থেকে বেশি কিছু আমি জানি না। সবই গুজব বলতে পারেন।”
“কী গুজব?”
অল্প একটু ধোঁয়া পাক খেয়ে বেরিয়ে এল হরেনের নাক দিয়ে। “শুনেছিলাম হামলাটা শুরু হয়েছিল তার পরের দিন। আশেপাশের গাঁ-গুলোতে যেসব গুণ্ডারা জড়ো হয়েছিল তাদের সকলকে লঞ্চে, ডিঙিতে, ভটভটিতে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মরিচঝাঁপিতে। ওরা গিয়ে সব ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিল, দ্বীপের লোকেদের নৌকো-টৌকো যা ছিল ডুবিয়ে দিল, খেতখামার সব নষ্ট করে দিল।” স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে গলা দিয়ে একটা আওয়াজ করল হরেন। “যা যা করা যায় তার কোনওটাই বাকি রাখেনি।”
“তা হলে কুসুম আর আমার মেসো–ওদের কী হল?”
“ঠিক কী যে হল সেটা কেউই জানে না। তবে আমি যতটা শুনেছিলাম তা হল, একদল মেয়েকে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ওরা। কুসুম তাদের মধ্যে ছিল। লোকে বলে ওদের ওপরে অত্যাচার করে তারপর নাকি নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, যাতে ভেসে যায় স্রোতের টানে। বেশ কিছু মানুষ মারা গিয়েছিল মরিচঝাঁপিতে সেদিন। সাগর টেনে নিয়েছিল ওদের সবাইকে।”
“আর আমার মেসোর কী হল?”
“অন্য অনেকের সঙ্গে ওনাকেও একটা বাসে তুলে দেওয়া হয়েছিল। ওই মধ্যপ্রদেশ না কোথায়, যেখান থেকে ওরা এসেছিল সেখানে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু কোথাও একটা এসে নিশ্চয়ই ছেড়ে দিয়েছিল ওনাকে, কারণ শেষপর্যন্ত তো উনি ক্যানিং-এ গিয়ে পৌঁছেছিলেন।”
এই পর্যন্ত বলে হরেন নিজের পকেট হাতড়াতে শুরু করল। বেশ খানিকক্ষণ চলল পকেটের ভেতর ওর খোঁজাখুঁজি। বিড়বিড় করে গালি দিতে লাগল নিজের মনে। অবশেষে পকেট থেকে যখন বিড়িটা বের করল, ততক্ষণে কানাইয়ের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে নির্মল আর কুসুমের প্রসঙ্গ থেকে কথা ঘোরানোর চেষ্টা করছে হরেন। খানিক পরে তাই বেশ একটা অমায়িক গলায় যখন জিজ্ঞেস করল, “কালকে তা হলে কখন রওয়ানা হবেন ভাবছেন?” কানাই আশ্চর্য হল না।
কিন্তু হরেনকে কথা ঘোরাতে দেবে না ও ঠিক করেছে। “আচ্ছা, একটা কথা বলুন হরেনদা, আপনিই তো আমার মেসোকে মরিচঝাঁপি নিয়ে গিয়েছিলেন; মেসো ওই জায়গাটার সঙ্গে এতটা জড়িয়ে পড়েছিলেন কেন বলুন তো? আপনার কী মনে হয়?”
“জড়িয়ে তো কমবেশি সবাই পড়েছিল তখন,” ঠোঁট ওলটাল হরেন।
“কিন্তু ধরুন, কুসুম আর ফকির আপনার আত্মীয় ছিল। ওদের জন্য আপনার ভাবনা হতে পারে–সেটা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু সারের ব্যাপারটা কী? ওনার কাছে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল মরিচঝাঁপির ঘটনাটা?”
চুপ করে বিড়ি টানতে লাগল হরেন। অবশেষে বলল, “আপনার মেসো অন্য আর পাঁচটা মানুষের মতো ছিলেন না কানাইবাবু। লোকে বলত ওনার মাথায় গণ্ডগোল ছিল। আর পাগলে কী না করে ছাগলে কী না খায়, কে বলতে পারে বলুন?”
“একটা কথা বলুন হরেনদা,” কানাই নাছোড়বান্দা, “এরকম কি হতে পারে যে মেসো কুসুমের প্রেমে পড়েছিলেন?”
উঠে পড়ল হরেন। নাকঝাড়া দিয়ে এমন একটা ভাব করল যে পরিষ্কার বোঝা গেল সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে ওর। বিরক্ত কাটাকাটা গলায় তারপর বলল, “দেখুন কানাইবাবু, আমি মুখুসুখু মানুষ। আপনি যা বলছেন সেসব কথা আপনারা শহুরে লোকেরা ভাবতে পারেন, কিন্তু আমার ওসব ভাবার মতো সময় নেই।”
টান মেরে বিড়িটা দূরে ছুঁড়ে ফেলল হরেন। ঘাঁৎ করে আগুন নেভার শব্দ কানে এল। “যান, গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন এখন,” বলল হরেন। “কাল সকাল সকাল বেরোতে হবে।”