ট্রাস্ট
লুসিবাড়ি দ্বীপটা এমনিতে ছোট হলেও বেশ কয়েক হাজার লোক বাস করে এখানে। অধিবাসীদের মধ্যে অনেকেই সেই ১৯২০ সালে আসা আদি বাসিন্দাদের পৌত্র-প্রপৌত্র। কিন্তু তা ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ঢেউয়ের মতো এসেছে মানুষ। একদল এসেছে ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর, আবার অনেকে এসেছে ১৯৭১-এ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। এমনকী তার পরেও এ দ্বীপে লোক এসে বসত করেছে। তারা এসেছে আশেপাশের দ্বীপ থেকে বাস্তুহারা হয়ে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য সরকার অনেক সময় জোর করে এ অঞ্চলের কিছু দ্বীপ খালি করে দিয়েছে; এই শেষ শ্রেণীর বাসিন্দারা সেই সরকারি ব্যবস্থার শিকার। এই সবকিছু মিলিয়ে লুসিবাড়ির জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। ফলে এক টুকরো জমিও এখন আর খালি পড়ে নেই এখানে। ঘন সবুজ ফসলখেতের কথা মুড়ি দিয়ে পড়ে রয়েছে গোটা দ্বীপটা, তার মাঝে মাঝে ছোট ছোট কিছু মাটির ঘর, আর খেতের এদিক থেকে ওদিক কাটাকুটি খেলার দাগের মতো চলে গেছে কয়েকটা পায়ে হাঁটা পথ। কয়েকটা চওড়া রাস্তা আবার ইট-বাঁধানো, দু’ধারে সারি দিয়ে লাগানো ঝাউগাছের ছায়ায় ঢাকা। তবে এ হল ওপর ওপর দেখা। এ দেখায় বাংলাদেশের আর পাঁচটা গায়ের সাথে লুসিবাড়ির কোনও তফাত মিলবে না। এমনিতে বোঝাই যাবে না এই শান্ত চেহারার গ্রামটার জীবনপ্রণালী নির্ভর করছে একটি মাত্র ভৌগোলিক উপাদানের ওপর। সে হল এখানকার বাঁধ। পুরো গ্রামটাকে বেড় দিয়ে থাকা প্রাকারের মতো সে বাঁধ রোজ দু’বেলা লুসিবাড়িকে বাঁচায় বানভাসি থেকে।
বাদাবন ট্রাস্টের কম্পাউন্ডটা মূল লুসিবাড়ি গ্রাম থেকে কিলোমিটার খানেক দূরে, শাঁখের মতো দ্বীপটার গোল দিকে। এখানেই একটা ছোট বাড়িতে নীলিমা থাকে। অতিথি অভ্যাগত কেউ এলে তাদেরও সেই বাড়িতেই থাকতে দেওয়া হয়।
কানাই আর নীলিমা যখন এসে পৌঁছল তখন সন্ধে গড়িয়ে গেছে। ওরা বোট থেকে নেমেছিল দ্বীপের অন্য দিকটায়, চড়ার ওপরে। সেটা সুসিবাড়ি গ্রামের কাছে। সেখান থেকে যখন রওয়ানা হয়েছে তখনই সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। ঘাটের কাছ থেকে তারপর একটা রিকশাভ্যান ভাড়া করতে হয়েছে ট্রাস্টে আসার জন্য। এই রিকশাভ্যান জিনিসটা আগের বার এখানে দেখেনি কানাই। এখন এখানে এটার খুব চল হয়েছে। মালপত্র, গোরু-ছাগল, মানুষ সবকিছুই নিয়ে যাওয়া যায় ভ্যানে করে। পেছনের পাটাতনটায় ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে প্যাসেঞ্জাররা, আর মাঝে মাঝে খানাখন্দে পড়ে ভ্যান লাফিয়ে উঠলে এ ওকে ধরে টাল সামলায়।
“এটাতে আমাদের সবাইকে ধরবে তো?” ভ্যানটার দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল কানাই।
“কেন ধরবে না? উঠে পড়, আমরা ধরে থাকব তোকে, ভয়ের কিছু নেই,” নীলিমা অভয় দিল।
যাত্রা শুরু হল। কানাইয়ের সুটকেসটা চাপানো হয়েছে একটা সবজির ঝুড়ির ওপর, তার একপাশে আবার কয়েকটা হাঁস মুরগি, তারস্বরে চেঁচাচ্ছে সেগুলো। খানিক চলার পর একটা ইট-ফেলা রাস্তার ওপর এসে পড়ল ভ্যানটা। ভাল করে বসানো হয়নি ইটগুলো, মাঝে মাঝেই দু’-একটা উঠে গেছে, গর্ত গর্ত হয়ে আছে সে জায়গাগুলো। ভ্যানের চাকা একেকবার সে গর্তের মধ্যে পড়ছে, আর ছিটে-গুলির মতো শূন্যে ছিটকে যাচ্ছে লোকগুলো। কানাই তো একবার পড়েই যাচ্ছিল, কোনও রকমে ওর জামা-টামা ধরে সামলাল অন্য যাত্রীরা।
“আমাদের গেস্ট হাউসটায় তুই থাকতে পারবি তো রে কানাই?” নীলিমার গলায় চিন্তার সুর। “খুব সাধারণ ব্যবস্থা কিন্তু। কোনও স্পেশাল কিছু আশা করিস না। তোর জন্যে একটা ঘর সাফসুতরো করে রাখা হয়েছে। রাতের খাবারও রাখা থাকবে টিফিন ক্যারিয়ারে। আমাদের একজন ট্রেনি নার্সকে বলা আছে, ও-ই তোর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করবে। তোর কিছু দরকার হলে ওকেই বলতে পারিস। মেয়েটার নাম ময়না। ও নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে ওখানে আমাদের জন্যে।”
নামটা কানে যেতেই ভ্যানের চালক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, “মাসিমা কি ময়না মণ্ডলের কথা বলছেন?”
“হ্যাঁ।”
“ওকে তো আপনি এখন গেস্ট হাউসে পাবেন না মাসিমা। আপনি শোনেননি কী হয়েছে?”
“কী হয়েছে?”
“ওর বর ফকির তো আবার কোথায় চলে গেছে। এবার আবার ছেলেটাকেও সঙ্গে নিয়ে গেছে। ময়না বেচারি এখন চারদিকে খুঁজে খুঁজে মরছে।”
“সত্যি? তুই ঠিক জানিস?”
“হ্যাঁ মাসিমা,” অন্য কয়েকজন যাত্রীও মাথা নেড়ে সমর্থন করল ভ্যানওয়ালাকে।
জিভ দিয়ে চুক চুক শব্দ করল নীলিমা। “বেচারি ময়না। লোকটা একেবারে ওকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খেল।”
মন দিয়ে সব শুনছিল কানাই। নীলিমার মুখে চিন্তার ছায়া দেখে জিজ্ঞেস করল, “তোমার তো খুব মুশকিল হয়ে যাবে তা হলে, না?”
“না রে। আমরা কিছু একটা ব্যবস্থা ঠিক করে নেব। আমি ভাবছি ময়নার কথা। এই বরটার জ্বালায় তো পাগল হয়ে যাবে মেয়েটা।”
“লোকটা, মানে, ওর বরটা কে?”
“ওকে তুই চিনবি না–” বলতে বলতে মাঝপথে থমকে গেল নীলিমা। কানাইয়ের হাতটা খামচে ধরল। “দাঁড়া, দাঁড়া, আমারই খেয়াল ছিল না। তুই তো ওকে চিনবিই। মানে
ওকে ঠিক না, ওর মাকে তুই চিনিস।”
“ওর মাকে?”
“হ্যাঁ। কুসুম বলে একটা মেয়ের কথা তোর মনে আছে?”
“কেন মনে থাকবে না?” কানাই বলল। “খুব মনে আছে। আগের বার যখন এসেছিলাম। তখন ও-ই তো এখানে আমার একমাত্র বন্ধু ছিল।”
“হ্যাঁ।” ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল নীলিমা। “আমারও মনে পড়ছে, তোরা একসঙ্গে খেলাধুলা করতিস। তো এই ছেলেটা, ফকির, ও হল সেই কুসুমের ছেলে। ওর সঙ্গে আমাদের ময়নার বিয়ে হয়েছে।”
“এই ফকিরকেই কি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না?”
“হ্যাঁ, ওকেই পাওয়া যাচ্ছে না।”
“আর কুসুমের কী খবর? ও কোথায় আছে এখন?”
লম্বা একটা শ্বাস ছাড়ল নীলিমা। “কুসুমও কোথায় একটা পালিয়ে গিয়েছিল; বোধহয় তুই ফিরে যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই। তার পর বহু বছর কোনও খোঁজখবর নেই, শেষে একদিন ফিরে এল আবার। ওর কথা ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়।”
“কেন? কী হয়েছিল ওর?”
চোখ বন্ধ করল নীলিমা। যেন মনের থেকে আড়াল করে রাখতে চাইছে কুসুমের স্মৃতিটাকে। “ওকে মেরে ফেলেছিল।”
“মেরে ফেলেছিল? কারা? কেন?”
“সেসব তোকে পরে বলব,” নিচু গলায় বলল নীলিমা। “এখন নয়।”
“আর ওর ছেলে?” কানাই নাছোড়বান্দা। “কত বড় ও তখন? কুসুম মারা যাওয়ার সময়?”
“ও তো তখন একেবারে বাচ্চা। বছর পাঁচেক বয়স। ওদের এক আত্মীয়, হরেন, ওকে নিয়ে গিয়ে মানুষ করল।”
হঠাৎ চোখের সামনে একটা বিশাল বাড়ি কানাইয়ের মনোযোগ কেড়ে নিল। “ওখানে ওটা কী মাসি?”
“ওটা হাসপাতাল,” বলল নীলিমা। “আগের বার দেখিসনি তুই?”
“না। এটা তৈরি হওয়ার পর তো আর আসিনি আমি।”
হাসপাতালের গেটের কাছে অনেকগুলো লাইট লাগানো, প্রত্যেকটার চারদিকে মনে হচ্ছে একেকটা আলোর পুঞ্জ জমে আছে। জীবন্ত মনে হচ্ছে সেগুলোকে ঘুরছে, নড়াচড়া করছে। ভ্যানটা গেট পেরিয়ে ঢোকার সময় কানাই দেখল সেই জ্যোতিপুঞ্জগুলি আসলে খুদে খুদে কতগুলি পোকার ঝক। মেঘের মতো জমে আছে আলোর কাছে।
প্রত্যেকটা বালবের নীচে কিছু স্কুলের ছেলেমেয়েও বসে আছে। কোলের ওপর বইখাতা নিয়ে ওই আলোয় পড়াশোনা করছে তারা।
“এগুলো ইলেকট্রিক আলো?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল কানাই। ৫৪
“হ্যাঁ রে।”
“কিন্তু আমি যে শুনেছিলাম লুসিবাড়িতে ইলেকট্রিসিটি আসেনি এখনও?”
“বিজলি বাতির ব্যবস্থা শুধু আমাদের এই কম্পাউন্ডটুকুর মধ্যে। মাত্র কয়েক ঘণ্টা থাকে আলো, সূর্য ডোবার পর থেকে রাত ন’টা পর্যন্ত,” নীলিমা বলল।
এই বিদ্যুৎ আসলে আসে একটা জেনারেটর থেকে। একজন পৃষ্ঠপোষক যন্ত্রটা ট্রাস্টকে দান করেছিলেন। প্রতিদিন সন্ধেবেলা কয়েক ঘণ্টার জন্য চালানো হয় জেনারেটরটা। হাসপাতালের কর্মীদের সেটা সবচেয়ে ব্যস্ততার সময়। তাড়াতাড়ি কাজকর্ম সেরে তারা রাতের নিস্তব্ধতার জন্য প্রস্তুত হয়। আশেপাশের স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েরাও ওই আলোর টানে সন্ধের সময় হাসপাতালের সামনে চলে আসে। বাড়িতে পড়ার চেয়ে এখানে এই ইলেকট্রিকের আলোয় পড়ার অনেক সুবিধা। তা ছাড়া কেরোসিন মোমবাতির খরচটাও বাঁচে।
“আমাদের এখন ওইখানে যেতে হবে,” সামনের একটা বাড়ির দিকে দেখিয়ে বলল নীলিমা। দোতলা গেস্ট হাউসটা হাসপাতালের কাছেই, মাঝে শুধু একটা পুকুর আর একসারি নারকেল গাছ। চুনকাম করা ছোট্ট স্কুলের মতো দেখতে ঝকঝকে বাড়িটায় বেশ একটা মন ভাল করে দেওয়া ভাব রয়েছে। অতিথিদের থাকার জায়গা দোতলায়। একতলায় নীলিমার সংসার। নির্মলের সঙ্গে এখানেই থেকেছে ও, সত্তরের দশকের শেষ দিক পর্যন্ত। এ বাড়িরই ছাদের ওপর ছিল নির্মলের পড়ার ঘর। ওর সমস্ত কাগজপত্র এখনও ওখানেই রাখা আছে।
ভ্যান থেকে নেমে কানাইয়ের হাতে একটা চাবি দিল নীলিমা। “এই নে, এটা তোর মেসোর ছাদের ঘরের চাবি। ঘরে ঢুকেই ডেস্কের ওপর দেখতে পাবি ওই খামটা রাখা রয়েছে। আমিই তোকে নিয়ে যাব ভেবেছিলাম, কিন্তু ভীষণ ক্লান্ত লাগছে রে।”
“কিছু ভেবো না মাসি, আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব। সকালে দেখা হবে তা হলে তোমার সঙ্গে।”
সুটকেসটা নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছিল কানাই, এমন সময় নীলিমা আবার ডাকল পেছন থেকে। “জেনারেটর কিন্তু ন’টায় বন্ধ হয়ে যায়, খেয়াল রাখিস। অন্ধকারের মধ্যে মুশকিলে পড়বি না হলে।”