তীরে ভেড়া
অবশেষে কুমিরমারি। সেখানেই সেদিন মরিচঝাঁপির কথা প্রথম শুনলাম আমি। দুটো দ্বীপের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। যে স্কুলটায় গিয়েছিলাম সেখানকার মাস্টারমশাইদের মধ্যেও অনেকেই দেখেছেন যখন রিফিউজিরা আসে। হাজারে হাজারে লোক নাকি এসেছে–বড় নৌকোয়, ছোট নৌকোয়–যে যা পেয়েছে। তাতে করেই গিয়ে উঠেছে মরিচঝাঁপিতে। মাস্টারমশাইদের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যেও নাকি কেউ কেউ ভিড়ে গেছে ওদের সঙ্গে, বিনে পয়সায় জমি পাওয়া যাবে সেই আশায়। সবাই আশ্চর্য হয়েছে উদ্বাস্তুদের বুকের পাটা দেখে। কেউ কেউ আবার বলেছে এই নিয়ে পরে গন্ডগোল বাঁধতে পারে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের জায়গা, সরকার কি আর এমনি ছেড়ে দেবে? তাড়িয়ে ছাড়বে ওদের ওই দ্বীপ থেকে।
আমি আর এই নিয়ে মাথা ঘামাইনি তখন। আমার কী যায় আসে?
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে হরেন আর আমি ধীরে সুস্থে রওয়ানা হলাম লুসিবাড়ির উদ্দেশে। নৌকো করে যাচ্ছি বাড়ির পথে, এমন সময় হঠাৎ ঝড় উঠল। দেখতে না দেখতে তুমুল হাওয়ার তোড় হুড়মুড় করে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমাদের ওপর–অদ্ভুত রণমূর্তিতে ক্ষ্যাপা মোষের মত আক্রমণ করল আমাদের। এজন্যই এখানকার লোকে মনে করে যে অলৌকিক কিছু একটা আছে এই ঝড়গুলোর পেছনে। কয়েক মিনিট আগে পর্যন্ত যে নদী একেবারে শান্ত ছিল সেখানে এখন উথাল পাথাল ঢেউ, মোচার খোলার মতো নৌকোটাকে তুলে আছড়াচ্ছে। খানিক আগেও যে নৌকোকে নাড়াতে দম বেরিয়ে যাচ্ছিল হরেনের, সে এখন হু হু করে ছুটে চলেছে আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে।
“এবার কি তা হলে শেষ, হরেন?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
“না সার,” ও বলল, “এর থেকেও কত বড় ঝড় পার করে দিয়েছি–”
“কবে?”
“সত্তর সালে। আগুনমুখা ঝড়ে পড়েছিলাম। সে যদি আপনি দেখতেন তা হলে তো এটাকে কোনও ঝড়ই মনে হত না আপনার। কিন্তু সে অনেক লম্বা গল্প সার। এখন আগে কোনওরকমে পাড়ে নিয়ে গিয়ে তুলি নৌকোটাকে।” ডান হাত তুলে একটা দ্বীপের দিকে দেখাল হরেন।
“মরিচঝাঁপি, সার। ঝড় থামা পর্যন্ত ওখানেই গিয়ে অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।”
আমি আর কী বলব? পেছন থেকে হাওয়ার চাপ থাকায় একটু পরেই গিয়ে পাড়ে ঠেকল নৌকো। সেটাকে ঠেলে ডাঙায় তুলতে হরেনের সঙ্গে হাত লাগালাম আমিও। তারপর ও বলল, “সার, কোথাও একটা গিয়ে উঠতে হবে আমাদের। কোনও চালা-টালার নীচে।”
“এখানে কোথায় গিয়ে উঠব হরেন?”
“ওইখানটায় সার। একটা ঘর দেখা যাচ্ছে।”
আর কথা না বাড়িয়ে ওর পেছন পেছন দৌড়োলাম। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছে, আমার চশমার কাঁচ বেয়ে ধারা নামছে জলের, কোনওরকমে শুধু হরেনের পিঠটার দিকে নজর রেখে দৌড়ে চলেছি সামনের দিকে।
একটা চালাঘরের সামনে গিয়ে পৌঁছলাম আমরা। দরমার বেড়া আর গোলপাতার ছাউনি দেওয়া ঘর। দরজার কাছে এসে হরেন একটা হাঁক ছাড়ল, “ঘরে কেউ আছ নাকি গো?
খুলে গেল দরজাটা। আমি গিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। চোখ পিটপিট করতে করতে চশমা খুলে কাঁচটা মুছছি, এমন সময় শুনতে পেলাম কে যেন বলছে, “সার? আপনি!”
নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একজন অল্পবয়সি মহিলা হাঁটু গেড়ে বসে প্রণাম করছে আমাকে। আমি চিনি না ওকে, কিন্তু ও আমাকে চেনে। তাতে অবশ্য আমি বিশেষ আশ্চর্য হইনি। বহু বছর এক জায়গায় শিক্ষকতা করলে পথেঘাটে যার সঙ্গেই দেখা হয় এই একই ব্যাপার ঘটে। ছাত্রছাত্রীরা বড় হয়ে যায়, স্মৃতিশক্তি তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে পারে না। নতুন নতুন মুখগুলিকে তাদের পুরনো চেহারার সঙ্গে মেলাতে পারি না।
“সার, আমি কুসুম,” মেয়েটি বলল।
এত দূরে এই মরিচঝাঁপিতে ঝড় বাদলের মধ্যে আশ্রয় খুঁজতে এসে শেষে কুসুমের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। “অসম্ভব!”
চশমাটা শুকিয়ে গেছে ততক্ষণে। নজর করে দেখলাম একটা বাচ্চা ছেলে উঁকি মারছে মেয়েটির পেছন থেকে। “ওটা আবার কে?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
“ও আমার ছেলে, ফকির।”
একটু ঝুঁকে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে গেলাম, কিন্তু ছুট্টে পালাল ছেলেটা। মায়ের আঁচলের তলা থেকে উঁকি দিয়ে দেখতে লাগল।
“খুব লাজুক, সার,” হেসে বলল কুসুম।
হঠাৎ আমার খেয়াল হল হরেন তখনও বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝলাম আমাকে সম্মান দেখানোর জন্য ভেতরে ঢোকেনি ও। মনে মনে একটু খুশিও হলাম, আবার বিরক্তিও লাগল। খুশি হলাম, কারণ মানুষের শ্রদ্ধার মূল্য বুঝবে না দুনিয়ায় এরকম সাম্যবাদী কেউ কি আছে? কিন্তু রাগ হল এই কথা ভেবে যে, ও কি জানে না এইরকম হাত-জোড় করা ভাব আমি পছন্দ করি না?
দরজা দিয়ে মাথা বের করে দেখলাম ওই অঝোর বৃষ্টির মধ্যে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে ও। “কী ব্যাপার কী হরেন?” আমি বললাম। “ভেতরে এসো, ভেতরে এসো। এখন কি এইসব আদিখ্যেতার সময় নাকি?”
ভেতরে এল হরেন। খানিকক্ষণ কারও মুখে কোনও কথা নেই–বহুদিন পর চেনা মানুষদের সঙ্গে দেখা হলে অনেক সময় যেমন হয়। কুসুমই মুখ খুলল প্রথম, “তুমি?” হরেন তার স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে বিড়বিড় করে কী যে জবাব দিল কিছুই বোঝা গেল না। তারপর বাচ্চাটাকে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে কুসুম বলল, “এই যে ফকির, আমার ছেলে।” ছেলেটার চুলে হাত বুলিয়ে হরেন বলল, “বেশ বেশ!”
“আর তোমার বাড়ির কী খবর?” জিজ্ঞেস করল কুসুম। “ছেলেপুলেরা নিশ্চয়ই সব বড় বড় হয়ে গেছে?”
“ছোটটার পাঁচ বছর হল, “হরেন বলল। “আর বড়টার এই চোদ্দো চলছে।” হাসল কুসুম। তারপর ঠাট্টার সুরে বলল: “বল কী গো? তা হলে তো প্রায় বিয়ের বয়স হয়ে গেল বলতে গেলে।”
“না,” হঠাৎ একটু জোরেই বলে উঠল হরেন। “যে ক্ষতি আমার হয়েছিল ওর বেলায় সেটা হতে দেব না আমি।”
কথাটা লিখলাম একটা উদাহরণ হিসেবে, অনেক অস্বাভাবিক সময়েও মানুষ কেমন তুচ্ছ সব বিষয়ে কথা বলে সেটা বোঝানোর জন্য।
“কাণ্ডটা দেখো একবার,” আমি বললাম। “এতদিন পরে খোঁজ পাওয়া গেল কুসুমের, আর আমরা কিনা হরেন আর তার ছেলেমেয়েদের নিয়েই কথা বলে যাচ্ছি তখন থেকে।”
একটা মাদুর পাতা ছিল মাটিতে, তার ওপরে বসে পড়লাম আমি। কুসুমকে জিজ্ঞেস করলাম কোথায় ছিল ও এতদিন, আর কী করেই বা এই মরিচঝাঁপিতে এসে পৌঁছল।
“কী বলব সার,” বলল কুসুম। “সে অনেক বৃত্তান্ত।”
বাইরে থেকে বাতাসের গর্জন কানে আসছে, বৃষ্টিরও থামার কোনও লক্ষণ নেই। “এমনিতেও তো কিছুই করার নেই এখন,” আমি বললাম। “তার থেকে তোর গল্পটাই বল, শুনি।”
হাসল কুসুম। “ঠিক আছে সার। আপনাকে আর না বলি কী করে? যা যা ঘটেছিল সবই বলছি।”
মনে আছে, সে কাহিনি বলতে গিয়ে গলার স্বর বদলে গেল কুসুমের, কথা বলার ঢঙে ছন্দ যোগ হল–স্পষ্ট তার লয় আর মাত্রা। নাকি সে আমারই স্মৃতির ছলনা? কে জানে। সে যাই হোক, ওর সেই কথাগুলি এখন বন্যার স্রোতের মতো নেমে আসছে আমার মনে। তার সঙ্গে তাল রেখে পক্ষীরাজের মতো উড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে আমার কলমকে। মূর্তিমতী বাগদেবী সেদিনের সেই কুসুম; আমি তার লিপিকর মাত্র।
“মা কোথায়, খোঁজ কেউ পারে কি বলতে? আঁধারে হাতড়ে মরি, পথ জেনে নিতে অনেককে শুধোলাম। কেউ বলে শুনি, ধানবাদ নামে কোনও শহরেতে কোথা মাকে ওরা নিয়ে গেছে। সেখানে কী করে যেতে হবে জানি না তো। জিজ্ঞাসা করি, অচেনা বা চেনা লোক যাকে পাই পথে। এই গাড়ি সেই গাড়ি রেলগাড়ি ধরে, অবশেষে পৌঁছই ধানবাদে গিয়ে।
“স্টেশনে নামার পর অন্ধকার দেখি, কী করে এখানে আমি খুঁজে পাব মাকে? খনির শহরে সেই সেখানে বাতাসে ধোঁয়া ধুলো লোহাগন্ধ চারিদিকে ভাসে। লোকজন পথেঘাটে আদতে আলাদা, তেমন মানুষ আগে দেখিনি কখনও। লোহা দিয়ে গড়া যেন মুখের জবান। কথা বলে, শব্দ যেন বেজে বেজে ওঠে। চোখের চাহনি যেন জ্বলন্ত কয়লা, তাকালেই মনে হয় হ্যাঁকা লাগে গায়ে। একে সেখানে আমি ছেঁড়া ফ্রক পরা, ছোট মেয়ে, ভয়ে বুক দুরু দুরু করে।
“অদৃষ্ট কিন্তু ছিল সহায় আমার। অজানিতে ভগবান বাতলে দিল পথ। ঘুগনির ফেরিওয়ালা স্টেশনে সেখানে সওদা সাজিয়ে বসে খদ্দেরের আশে। কাছে গিয়ে তার সাথে কথা বলে আমি দেখি যে ভাটির দেশ তারও জন্মভূমি! নাম তার রাজেন, ছিল বাসন্তীতে বাড়ি। গরিব ঘরের ছেলে, খুবই ছেলেবেলা দেশ ছেড়ে চলে আসে পেটের ধান্দায়। একদিন কলকাতা শহরে হঠাৎই চলন্ত বাসের নীচে চাপা পড়ে সে যে এক পা খোয়াল তার। তারপর থেকে এটা ওটা ফেরি করে ট্রেনে ও স্টেশনে। ভাগ্যচক্র অবশেষে নিয়ে এল তাকে, ধানবাদ শহরে এই। এখানে কপালে জুটে গেল ঝুপড়ি এক, সেখানেই থাকে। রেললাইনের পাশে, বেশি দূরে নয়। যখন শুনল রাজেন বৃত্তান্ত আমার, বলল সাহায্য নিশ্চয় করবে আমাকে। কিন্তু ততদিন আমি থাকব কোনখানে? চলে এসো ঝুপড়িতে আমার সঙ্গেই থেকে যাবে, অসুবিধা কিছুই হবে না। তুমি তো একাই, আমি একলাই থাকি। দু’জনের জন্যে ঘরে যথেষ্ট জায়গা,বলল রাজেন। আমি ধীর পায়ে পায়ে ওর পিছু পিছু যাই রেললাইন ধরে। সেখানে গিয়ে তো ডরে বুক কেঁপে ওঠে। কে জানে কেমন ঠাঁই, নিরাপদ কিনা। সারারাত জেগে থাকি। ঝম ঝম করে ট্রেন যায়, সেই শব্দ শুনি শুয়ে শুয়ে।
“বহুদিন কেটে গেল রাজেনের ঘরে। লজ্জায় পড়িনি এক মুহূর্ত কখনও। মানুষ সে ভাল ছিল, দয়ার হৃদয়। এরকম কটা লোক খুঁজে পাওয়া যায়? ঠিক বটে, সেখানেও কানাঘুষো ছিল–”দেখ রে, ল্যাংড়া রাজু কাকে নিয়ে থাকে। সেসব কখনও আমি গায়েতে মাখিনি। বলুক যা মন চায়। কী বা যায় আসে?
“অবশেষে একদিন রাজেনই মায়ের খোঁজ নিয়ে এল। নাকি এক জায়গায় ট্রাক-ড্রাইভাররা সব আসে প্রতিদিন, খাঁটিয়ায় বিশ্রাম করে সেথা, আর ভাড়া করে মেয়েদের। সেখানেই নাকি মা আমার কাজ করে। রাজেনের সাথে একদিন গোপনেতে গিয়ে দেখা করি। মাকে তো দেখেই বুকে ঝাপাই তখনি। কিন্তু মুখে কথা নেই–বাক্যহারা আমি; এ কী দেখি, মা তো নয়, মায়ের কঙ্কাল: কুঁকড়ে গেছে শুকনো মুখ, রোগা জীর্ণ দেহ। সে চেহারা দেখে কষ্টে ভেঙে গেল বুক। ফিসফিসে গলা মার, অস্ফুটে বলল, “দেখিস না, কুসুম, চোখ বন্ধ করে ফেল। এ চেহারা মুছে ফেল মন থেকে তোর। আগেকার আমাকেই মনে রেখে দিস, সেই যবে তোর বাবা বেঁচে ছিল আর, কষ্ট ছিল, তবু ছিল ভরা সংসার। সবই সেই দিলীপের দোষ। সে রাক্ষস, মিথ্যেবাদী, বলেছিল খুঁজে দেবে কাজ ভাল কোনও জায়গায়। শেষে এইখানে নিয়ে এসে ঠেকিয়েছে। এর চেয়ে ভাল ছিল দেশে পড়ে থেকে শাকপাতা খেয়ে কোনও মতে বেঁচে থাকা, সে তবু মানের। দিলীপ দানব সেই আনল আমাকে, বেচে দিল অন্য সব পশুদের কাছে। তুই হেথা থাকিস না, ফিরে যা, ফিরে যা। কিন্তু মন তবু চায় একবার আরও দেখে নিই তোর মুখ জনমের মতো। যাওয়ার আগেতে শুধু আর একটি বার দেখা করে যাস এই অভাগীর সাথে।
“সে রাতের মতো আমি ফিরি ঝুপড়িতে। হপ্তা এক-দেড় পরে রাজেন আবার নিয়ে গেল আমাকে সে মায়ের ডেরায়। তখনই রাজেন দিল বিয়ের প্রস্তাব। বলে মাকে, অনুমতি দাও যদি তুমি, কুসুমকে বউ করে রেখে দিই কাছে। নতুন জীবন হবে ওর, আর আমি দুঃখ সুখ ভাগ করে নেব ওর সাথে।অবশেষে দেখি মা-র মুখে হাসি ফোটে: এর চেয়ে সুসংবাদ কী বা হতে পারে? কী ভাগ্য কুসুম! বনবিবির দয়ায় বর পাবি, ঘর পাবি এর চেয়ে সুখ কিছু যে কপালে আছে ভাবিনি কখনও।রাজেন বলল, ‘মা গো, তোমাকেও সাথে নিয়ে যাব চুরি করে। এখানে কিছুতে আমরা তোমাকে আর দেব না থাকিতে। এ তোমার জায়গা নয়। কিছুদিন আরও থাক যদি প্রাণে তুমি বাঁচবে না আর। মা-কে সাথে করে নিয়ে ফিরি সেইদিনই রাজেনের ঝুপড়িতে। সে যে কত সুখ! তার পর বিয়ে হল রাজেন ও আমার। মা দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিল আমাদের। তখন কি জানতাম এ মা-র মুকতি? তিন মাসও তারপর কাটল না আর: আমাদের সুখী দেখে মা নিল বিদায়। সে মা-র নিয়তি ছিল–কী বা করা যাবে? আরও দু’বছর যদি বাঁচত পরাণে, দেখে যেত ফকিরকে ছেলেকে আমার।
“কত মাস কেটে গেল সেই ধানবাদে। মাঝে মাঝে দু’জনেই ভাবি ফিরে যাই, এ খনির দেশ ছেড়ে। এ তো নয় ঘর। এখানের সব কিছু বড় ভিনদেশি। লোহার ওপরে হুঁটি, মনে পড়ে খালি, ভাটির দেশের কাদা জন্ম থেকে জানা। এখানে রেলের লাইন চারিদিক বেড়ে, দেখি আর ভাবি সেই রায়মঙ্গল, কতদূরে চেনা সেই বানভাসা নদী। স্বপ্নে দেখি ঝড় আসে উথাল পাথাল, বাদাবন থরথর হাওয়ার বেগেতে। ছোট ছোট দ্বীপ কত নদী দিয়ে ঘেরা, সোনালি শেকলে যেন বাঁধা পড়ে থাকে। জোয়ারের কথা ভেবে দু’চোখে জোয়ার, মনে পড়ে মোহনার থইথই জলে ভেসে যায় নিচু দ্বীপ, মনে হয় যেন জলের নীচেতে কত মেঘ জমে আছে। রাত্রে দেশের কথা মনে করি আর গল্প করি, স্বপ্ন দেখি। সকালে আবার ফিরে আসি ফের সেই লোহা কয়লার জগতে। মনের দুখ মনে রাখি চেপে।
“এভাবেই চলে গেল চারটি বছর। তারপর সে জীবনও শেষ হয়ে গেল: চলতে শুরু করল ট্রেন, রাজেন তখনও পায়নি পয়সা তার যাত্রীদের থেকে। ইঞ্জিনের তেজ বাড়ে, রাজেনও দৌড়ায়। হঠাৎ মোচড় লাগে খোঁড়া পায়ে তার, হোঁচটে ছিটকে পড়ে চাকার নীচেতে। কী আর বলার আছে? সময়ের আগে চলে গেল। কখনও তো
ভাবিইনি আমি এভাবে হঠাৎ করে ছেড়ে চলে যাবে। সান্ত্বনা, ফকির আছে দান রাজেনের। তাকে বুকে নিয়ে ফের ভাবি চলে যাব চেনা দেশে, চেনা ঘরে ফিরব আবার। কিন্তু ভয় লাগে প্রাণে, বাচ্চা কোলে নিয়ে কার কাছে হাত পেতে দাঁড়াব সেখানে? যদি কিছু নাই জোটে কী করে সংসার চালাব? আবার যদি দিলীপের পায়ে গিয়ে পড়তে হয় তা’লে কী হবে আমার?
“মনে হয় বনবিবি দেখেছিল সবই, নিজের আসন থেকে। কারণ একদিন হঠাৎ খবর পাই বিরাট মিছিল যাবে এ শহর দিয়ে, পুবদেশ পানে। পরদিনই এল তারা, মানুষের ঢল নেমে এল ধানবাদে। রেললাইন ধরে দেখি ক্লান্ত মুখ সব ধুলোয় ধূসর পা টেনে টেনে চলে। কাঁধে ছানাপোনা, বোঁচকা কুঁচকি যত, সারা সংসার টেনে নিয়ে হেঁটে চলে ভূতের মতন। কোথায় চলল এরা? কোথা থেকে আসে? সবাই অচেনা মুখ, এ শহরে আগে এদের কাউকে আমি দেখিনি কখনও। দাঁড়িয়ে দেখছি আমি সেই জনস্রোত, হঠাৎ পড়ল চোখে বয়স্কা মহিলা আমার মায়ের মতো–পা হড়কিয়ে পড়ে। তাকে নিয়ে আসি। ওদের দলের আরও কেউ কেউ আসে মহিলার সাথে। জল আর খাবার দিই, দেখি কী ভীষণ ক্লান্ত সব। বিশ্রামের খুবই দরকার। রহো, ব্যয়ঠো, বলি আমি হিন্দি ভাষায়, বিশ্রাম নিতে বলি ওদের সেখানে। জবাব আসে বাংলায়, আমি তো অবাক। চেনা শব্দ, চেনা ভাষা–কানে মধু ঢালে। কে তোমরা? কোথা থেকে আসছ এভাবে? কোথায়ই বা যেতে চাও? শুধোলাম আমি। “তুমি আমাদের বোন। বলি শোনো তবে, দীর্ঘ কাহিনি সেই,’ বলে শুরু করে।
“আমরা বাংলারই লোক, খুলনা জেলার। ভাটি দেশে ঘর ছিল, জঙ্গলের কাছে। সে ঘর জ্বালিয়ে দিল যুদ্ধের সময়। আমরা পালিয়ে আসি, বর্ডার পেরিয়ে। এদেশে ঢুকতেই পাকড়াও করল পুলিশ, বাস ভরে নিয়ে গেল উদ্বাস্তু শিবিরে। সে এক অচেনা ঠাই, এরকম আগে জীবনে দেখিনি। বড় ভয়ংকর লাগে। ধূ ধূ করে মাঠ; মাটি টকটকে লাল, রক্তে ধোয়া যেন। যারা সে দেশের লোক তাদের কাছেতে সেই একই লাল মাটি সোনার সমান, তারা তাই ভালবাসে। যেভাবে আমরা ভালবাসি কাদামাটি, বাদাবন, নোনা জল–ঠিক সেরকমই। কিন্তু আমাদের সেথা বসে না তো মন। চেষ্টা প্রাণপণ করি, তবু কীরকম মাথার ভেতরে সেই নদী ডাক দেয়, জোয়ারের টান লাগে শিরায় শিরায়। আমাদেরই বাপ কাকা বহুদিন আগে হ্যামিলটনের ডাকে সাড়া দিয়েছিল, নদীর টানের সাথে কী লড়াই লড়ে বাদাবন সাফ করে গড়েছিল গ্রাম। একই ভাবে এখনও তো গড়ে নিতে পারি নতুন বসতি আরও, ভাবি মনে মনে। ভাটির দেশেতে আরও কত খালি দ্বীপ এখনও তো পড়ে আছে–মানুষ থাকে না। আমাদেরই এক দল গিয়ে দেখে এল বড় খালি চর এক, মরিচঝাঁপিতে। তারপর বহু মাস প্রস্তুতি নিতে চলে গেল। অবশেষে বেচেবুচে সব রওয়ানা হলাম। কিন্তু সাথে সাথে দেখি, পেয়াদা পুলিশ সব লেগেছে পেছনে। ট্রেনে থিকথিক করে পুলিশের লোক, রাস্তা বন্ধ করে রাখে, আটকে দেবে বলে। তবু পিছু হটব না কিছুতে আমরা–হাঁটতে শুরু করে দিই রেললাইন ধরে।
“শুনি বসে বসে আর বুকে আশা জমে; এরা তো নিজেরই লোক, আত্মীয় আমার–একই ভাষা, রক্তে একই জোয়ারের টান, একই স্বপ্ন দেখি, মনে একই সুর বাজে। এরাও মাখতে চায় সেই কাদামাটি হাতে-পায়ে, দেখতে চায় জোয়ারের নদী। আমি কেন তবে আর দূরে সরে থাকি? কী লাভ এখানে থেকে, এই ধানবাদে? জং-ধরা শহরে এই মুখে রক্ত তুলে পরিশ্রম করে যাব আমরণ কাল? পুঁটুলি গুছিয়ে নিই, কাপড় কখানা গাঁঠরি বেঁধে তুলে দিই ফকিরের কাঁধে। রাজেনের স্মৃতি বুকে নেমে আসি পথে। অনেক দূরের পাড়ি সে মরিচঝাঁপি।
“এই হল কাহিনি, সার। এই আমার কথা। এভাবেই পৌঁছলাম এইখানে এসে।”
খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম আমরা, যে যার নিজের ভাবনা নিয়ে কুসুম আর ফকির, হরেন আর আমি। মনে মনে যেন দেখতে পাচ্ছিলাম ওরা হেঁটে আসছে, ওই হাজার হাজার মানুষ, শুধু ভাটির দেশের কাদায় আরেকবার পা রাখার জন্য। দেখতে পাচ্ছিলাম ওরা আসছে, দলে দলে ছেলেমেয়ে বাচ্চা বুড়ো সারাজীবনের সমস্ত সঞ্চয় পুঁটুলিতে করে মাথায় নিয়ে হেঁটে আসছে এই মরিচঝাঁপির দিকে। মনে হল এদের কথাই তো কবি বলতে চেয়েছিলেন, যখন লিখেছিলেন:
“পৃথিবীর প্রতিটি ধীর মন্থর ঘূর্ণন এখন কিছু উত্তরাধিকারহীন সন্তানের জনক,
যার কাছে ভূত কিছুর অর্থ নেই, আসন্নেরও মান নেই কোনও।”