পরদিন

খুবই ধীর গতিতে চলছিল মেঘা। গর্জনতলার দিকে দু’ভাগ পথ এগোনোর পর দূরে একটা ডিঙি চোখে পড়ল–গত কয়েক ঘণ্টায় এই প্রথম।

ঝকঝকে পরিষ্কার দিন; একটু ঠান্ডা আছে, তবে হাওয়া নেই। ঝড় কেটে যাওয়ার পর জল আস্তে আস্তে নামতে শুরু করেছে, কিন্তু জঙ্গলের বেশিরভাগটাই ডুবে রয়েছে এখনও। যতদূর চোখ চলে একটানা একটা সবুজ গালিচায় ঢেকে রয়েছে নদীর বুক, আর জঙ্গলের যে কয়টা গাছ জলের ওপর জেগে রয়েছে একটা পাতাও লেগে নেই তাদের গায়ে–উলঙ্গ গুঁড়িগুলো শুধু দাঁড়িয়ে আছে ভিড় করে। পুরো জায়গাটা ডুবে যাওয়ায় নদীর পাড়গুলো আর দেখা যাচ্ছে না, ফলে দিক ঠিক করে বোট চালানো দ্বিগুণ কঠিন হয়ে গেছে। তাই ভোরবেলা লুসিবাড়ি ছেড়ে বেরোনোর পর থেকেই প্রায় শামুকের গতিতে এগোচ্ছে মেঘা।

দিগন্তের কাছে ভেসে থাকা নৌকোটাকে হরেনই চিনতে পারল প্রথম। ছইটা উড়ে যাওয়ার ফলে নৌকোর চেহারাটা এতই পালটে গেছে যে কানাই বা ময়না কেউই ওটাকে ফকিরের ডিঙি বলে বুঝতেই পারেনি। কিন্তু এই ডিঙি হরেনের নিজের হাতে বানানো, ফকিরকে দিয়ে দেওয়ার আগে নিজে বহু বছর চালিয়েছে হরেন; এক নজর দেখেই নৌকোটাকে চিনতে ওর কোনও অসুবিধা হয়নি তাই। “ওটা ফকিরের নৌকো,” হরেন বলল। “আমি পরিষ্কার চিনতে পারছি। ঝড়ে ছইটা উড়িয়ে নিয়েছে, কিন্তু ওইটাই ফকিরের নৌকোটা।”

“কে আছে নৌকোর মধ্যে?” কানাই জিজ্ঞেস করল। কোনও জবাব এল না হরেনের কাছ থেকে।

লঞ্চের একেবারে গলুইটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল কানাই আর ময়না। ইঞ্চি ইঞ্চি করে ডিঙি আর বোট এগোচ্ছে পরস্পরের দিকে; মনে হচ্ছে যেন জমাট বেঁধে গেছে মাঝখানের জলটুকু। খানিকক্ষণ যাওয়ার পর কানাই বুঝতে পারল একটাই মানুষ বসে রয়েছে নৌকোর ওপর, সে পুরুষ কি মহিলা বোঝার কোনও উপায় নেই, কারণ পা থেকে মাথা পর্যন্ত তার পুরো শরীরটাই ঢেকে রয়েছে কাদায়।

বোটের রেলিং-এর গায়ে শক্ত করে এঁটে বসে আছে ময়নার হাত। কানাইয়েরও তাই। ময়নার হাতের গাঁটগুলোও ওর নিজের হাতের গাঁটগুলোর মতো ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে, লক্ষ করল কানাই। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে ওরা, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন একটা গভীর ফাটল দু’জনকে দু’জনের থেকে আলাদা করে রেখেছে। তীক্ষ্ণ চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে দু’জনেই বোঝার চেষ্টা করছে কে আছে ডিঙির ওপরে।

“ওই মেয়েটা,” অবশেষে বলল ময়না। ফিসফিস করে বলতে শুরু করা কথাগুলো চিৎকার হয়ে ছড়িয়ে গেল তারপর–”আমি দেখতে পেয়েছি–ফকির নেই নৌকোতে।” দু’হাত মুঠো করে শাখাগুলো কপালে আছড়ে আছড়ে ভাঙতে লাগল ময়না। ভাঙা শাখার টুকরোয় কেটে গিয়ে একফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ল কপাল বেয়ে।

আরও আঘাত থেকে বাঁচাতে ওর হাত দুটোকে শক্ত করে টেনে ধরল কানাই। বলল, “ময়না, দাঁড়াও! একটু অপেক্ষা করে দেখো…”

স্থির হয়ে গেল ময়না। ভূতগ্রস্তের মতো চেয়ে রইল সামনের দিকে। এগিয়ে আসা নৌকোটা যেন মায়াবলে বেঁধে রেখেছে ওকে।

“ও নৌকোতে নেই! ও নেই… ও আর নেই.” হঠাৎ দুমড়ে গেল ময়নার পা দুটো, ডেকের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল ও। একটা হুলুস্থুলু পড়ে গেল লঞ্চে, চেঁচিয়ে নগেনকে ইঞ্জিন বন্ধ করতে বলে সারেঙ-এর ঘর থেকে দৌড়ে নেমে এল হরেন। কানাই আর হরেন দু’জনে ধরাধরি করে ময়নাকে একটা কেবিনে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল বাঙ্কের ওপর।

কেবিন থেকে ডেকে বেরিয়ে এসে কানাই দেখল ডিঙিটাকে মেঘার পাশে নিয়ে চলে এসেছে পিয়া। টলমলে ডিঙিটার ওপর কোনওরকমে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও, হাতে জিপিএস মনিটরটা, যেটা দেখে দেখে দিক ঠিক রেখে এতটা এসে পৌঁছেছে। বোটের পেছনদিকটায় গিয়ে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল কানাই। দুজনের কেউই কোনও কথা বলল না, কিন্তু বোটে পা রাখতে রাখতেই দুমড়ে মুচড়ে গেল পিয়ার মুখটা, মনে হল ও যেন পড়ে যাবে এক্ষুনি। ধরার জন্য কানাই দু’হাত বাড়াতেই হুমড়ি খেয়ে এসে পড়ল পিয়া, মাথাটা রাখল কানাইয়ের বুকের ওপর। আস্তে আস্তে নরম গলায় কানাই জিজ্ঞেস করল, “ফকির?”

একেবারে যেন শোনাই গেল না পিয়ার গলা: “পারল না, ও পারল না…”

ঝড় প্রায় শেষ হওয়ার সময় ঘটল ঘটনাটা, পিয়া জানাল। প্রচণ্ড ভারী, বিরাট একটা গাছের গুঁড়ি উড়ে এসে লেগেছিল ফকিরের গায়ে। এত জোরে আঘাতটা এসেছিল যে পিয়ার মনে হচ্ছিল ও-ও যেন চেপটে যাচ্ছে গাছের গায়ে। শাড়ির বাঁধনটা থাকায় মারা যাওয়ার সময়ও ডাল থেকে পড়ে যায়নি ফকির। ফকিরের মুখটা প্রায় লেগে ছিল পিয়ার কানের সঙ্গে, তাই ওর শেষ কথা ক’টা শুনতে পেয়েছিল পিয়া। নিশ্বাস ফুরিয়ে যাওয়ার আগে শুধু একবার ময়না আর টুটুলের নাম করেছিল ফকির। জন্তু জানোয়ারদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ওর শরীরটাকে ময়নার শাড়িটা দিয়ে বেঁধে গাছের ওপরেই রেখে এসেছে পিয়া। বাঁধন কেটে নামানোর জন্যে আবার গর্জনতলায় ফিরে যেতে হবে ওদের।

* * *

ফকিরের প্রাণহীন শরীরটা বোটে করে লুসিবাড়িতে নিয়ে এল ওরা। সেই সন্ধ্যাতেই সারা হয়ে গেল দাহকার্য।

ঝড়ে লুসিবাড়ির মানুষদের ক্ষয়ক্ষতি খুব বেশি হয়নি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি যাদের হতে পারত, আগাম সতর্কবার্তা পাওয়ার দরুন আগেভাগেই তারা হাসপাতালে এসে আশ্রয় নিতে পেরেছিল। ফলে খানিকক্ষণের মধ্যেই গোটা দ্বীপ জেনে গেল খবরটা। অনেক লোক এসেছিল ফকিরের শেষ কাজে।

দাহকার্যের সময় এবং তারপরেও সারাদিন ময়নার সঙ্গে ওর ঘরেই ছিল পিয়া; চেনাশোনা আত্মীয়-পড়শিরা অনেকে ভিড় করেছিল সেখানে। মেয়েদের মধ্যে একজন জল এনে দিল পিয়াকে, গা-হাত পা ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে নেওয়ার জন্যে। আরেকজন একটা শাড়ি নিয়ে এল ওর জন্যে, সাহায্য করল সেটা পরে নিতে। সকলের বসার জন্যে মাদুর পেতে দেওয়া হল ঘরের মেঝেতে। পিয়া গিয়ে তাতে বসতেই কোত্থেকে টুটুল এসে হাজির হল পাশে। ওর কোলের ওপর দুটো কলা রেখে চুপ করে পাশটিতে এসে বসল, মুখে কোনও কথা নেই। টুটুলকে জড়িয়ে ধরে বুকের কাছে টেনে নিল পিয়া, এত কাছে যে ওর বুকের ধুকপুকটুকুও টের পাচ্ছিল নিজের পাঁজরের পাশে। পিয়ার মনে পড়ল উড়ে আসা গাছের গুঁড়িটা কী প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা মেরেছিল ফকিরের খোলা পিঠের ওপর, মনে পড়ল কাঁধের ওপর ফকিরের থুতনির ভার, ফকিরের ঠোঁটদুটো ওর কানের কত কাছে ছিল সে কথা মনে পড়ল–এত কাছে যে যতটা না কথার শব্দ, তার চেয়ে বেশি ঠোঁটের নড়াচড়া থেকেই ও বুঝতে পেরেছিল যে নিশ্বাসের সঙ্গে বিড়বিড় করে বউ আর ছেলের নাম করছে ফকির।

পিয়ার মনে পড়ল নিজের বুকের নিস্তব্ধতায় মনে মনে কী কথা দিয়েছিল ও ফকিরকে, কেমন করে ওই প্রচণ্ড ঝড় বাদলের মধ্যে মুখের কাছে জলের বোতলটা শুধু এগিয়ে ধরতে পেরেছিল ও, তা ছাড়া শেষ মুহূর্তটাতে আর কিছুই করতে পারেনি ফকিরের জন্যে। মনে পড়ল গভীর ভালবাসার কথা ক’টা মনে করিয়ে দেবে বলে মনে মনে কেমন হাতড়াচ্ছিল ও এবং আগেও বহুবার যেমন হয়েছে তেমনই, মুখে কিছু বলা হলেও, কেমন করে যেন ফকির জেনে গেছে পিয়া কী বলতে চেয়েছিল ওকে।