ডিঙিতে

ফকিরের নৌকোটা লম্বায় প্রায় মিটার পাঁচেক হলেও খুব একটা চওড়া নয়। এমনকী ঠিক মাঝখানটাতেও দু’জনের বেশি লোকের পাশাপাশি বসার জায়গা নেই। ডিঙিটাকে পিয়ার মনে হল ঠিক যেন একটা বস্তিবাড়ির ভাসমান সংস্করণ–ছেঁচা বাঁশ, টুকরো-টাকরা কাঠ আর ভেঁড়াখোঁড়া পলিথিন দিয়ে কোনও রকমে জোড়াতাড়া দেওয়া। নৌকোর বাইরের দিকের তক্তাগুলোতেও কোনওকালে পালিশ পড়েছে বলে মনে হয় না, ফঁক-ফোকরগুলো আলকাতরা দিয়ে বোজানো; যাতে জল চুঁইয়ে না ঢুকতে পারে। ডিঙির ওপরে কতগুলো পুরনো চায়ের পেটির প্লাইউড পাতা, কয়েকটাতে চা কোম্পানির নামটা এখনও পড়া যায়। পেরেক-টেরেকেরও কোনও বালাই নেই, তক্তাগুলি স্রেফ একটা তাকের মতো কাঠের ওপর পর পর রাখা। ইচ্ছে করলেই এদিক সেদিক নাড়াচাড়া করা যায়। নীচের গোল মতো অংশটায় জিনিসপত্র রাখার জায়গা। ডিঙির সামনের দিকে কোনাচে জায়গাটায় কিছু বুনো ঘাস আর জংলা গাছের ডালপালা জড়ো করা, কয়েকটা কাঁকড়া সেগুলোর মধ্যে নড়াচড়া করছে। এখানেই রাখা থাকে ফকিরের সারাদিনের শিকার। ডালপালা আর ঘাসগুলো দিয়ে জায়গাটাকে স্যাঁতস্যাঁতে রাখা হয়েছে। ওগুলো না থাকলে কাঁকড়াগুলো বোধহয় নিজেদের মধ্যে ছেঁড়াছিঁড়ি শুরু করে দিত।

নৌকোর ছইটাও তৈরি করা হয়েছে হেঁচা বাঁশ, কঞ্চি আর বাখারি দিয়ে। ছোট্ট ছইটা, কোনওরকমে দুটো লোক তার মধ্যে রোদ-বৃষ্টি থেকে মাথা আড়াল করতে পারে। জল আটকানোর জন্য ভেতরে আবার একটা ধূসর ছিট ছিট প্লাস্টিক দেওয়া। সেটার ওপরের লেখাগুলো চেনা লাগল পিয়ার–ওটা আসলে একটা ছেঁড়া মেলব্যাগ। ও নিজেই কতবার এরকম ব্যাগ ব্যবহার করেছে আমেরিকা থেকে চিঠিপত্র পাঠানোর জন্য। ডিঙির একেবারে পেছনের দিকে, বাঁকানো ল্যাজের মতো অংশটা আর ছইয়ের মাঝে ছোট একটা প্ল্যাটফর্ম মতো করা। পোড়া দাগ ধরা একটা তক্তা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে সেটা। ছইয়ের ভেতরে তক্তার নীচে আরও একটা খোপ। সেটাই এই নৌকোর ভাড়ার। জায়গাটা কাঠের দেওয়াল দিয়ে আলাদা করা। নীল একটা পলিথিন যেমন তেমন ভাবে পাতা আছে জল আটকানোর জন্য। ভেতরটায় সুন্দর করে গোছানো আছে কিছু শুকনো জামাকাপড়, রান্নার বাসনপত্র, সামান্য কিছু খাবার-দাবার আর খাওয়ার জল। খুপরিটার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা ভজ করা কাপড় বের করে আনল ফকির। ভাঁজ খুলতে দেখা গেল সেটা একটা শস্তার ছাপা শাড়ি।

এর পর যা ঘটতে লাগল তাতে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল পিয়া। প্রথমে টুটুলকে নৌকোর সামনের দিকে পাঠিয়ে দিল ফকির। তারপর পিয়ার ব্যাগগুলো ঠেসেটুসে ঢোকাল ছইয়ের মধ্যে। এবার নিজে বেরিয়ে এসে পিয়াকে ভেতরে যেতে ইশারা করল। পিয়া কোনওরকমে গুঁড়িসুড়ি মেরে ঢুকে যাওয়ার পর ছইয়ের সামনের দিকে পর্দার মতো শাড়িটাকে টাঙিয়ে দিল ফকির।

ব্যাপারটা মাথায় ঢুকতে বেশ খানিকক্ষণ লাগল পিয়ার। আসলে ওর জন্য একটা ঘেরা জায়গা বানিয়ে দিয়েছে ফকির, একটা আড়াল করে দিয়েছে, যাতে ও নিশ্চিন্তে ভেজা জামাকাপড় পালটে নিতে পারে। এতক্ষণে একটু অস্বস্তি হল পিয়ার। ওর নিজের সংকোচ হওয়ার আগেই ফকিরই চিন্তা করেছে কী করে ও আড়াল রেখে জামাকাপড় পালটাবে। একটু হাসিও এল ঠোঁটের কোনায়, কারণ ছাত্র অবস্থায় তো ওকে অনেক বছরই ছেলেদের সঙ্গে এক ডর্মিটরিতে থাকতে হয়েছে, এমনকী এক বাথরুম শেয়ার করতে হয়েছে। কাজের প্রয়োজনেও পুরুষদের সঙ্গে এক বাড়িতে কাটাতে হয়েছে অনেক সময়। তা সত্ত্বেও ফকিরের এই আচরণ পিয়ার মনকে কোথাও একটা ছুঁয়ে গেল। ফকির যে ওকে শুধু জামাকাপড় পালটানোর জন্যে একটা জায়গা করে দিয়েছে তা তো নয়, সাথে সাথে একটা সহজ সামাজিকতায় ওকে গ্রহণ করেছে, কথা না বলতে পারলেও বুঝিয়ে দিয়েছে পিয়া কেবল নামহীন ভাষাহীন কোনও বিদেশি নয়, সুন্দরবনের এই জেলের কাছে ও আপন লোক। কিন্তু ফকিরের মতো একজন মানুষ, যে হয়তো এর আগে কোনও বিদেশির এত কাছাকাছি আসেইনি, তার পক্ষে এটা সম্ভব হল কী করে?

জামাকাপড় বদলানো হয়ে যাওয়ার পর শাড়িটাকে হাত দিয়ে একবার ছুঁয়ে দেখল পিয়া। বহুদিন ধোপ খেয়ে খেয়ে পাতলা আর নরম হয়ে এসেছে কাপড়টা। ঠিক এইরকম শাড়ি পরত পিয়ার মা, ওদের আমেরিকার বাড়িতে। এই রকম নরম, কোঁচকানো, ব্যবহারে ব্যবহারে পাতলা হয়ে আসা সেই শাড়ির ছোঁয়া এখনও ওর স্মৃতিতে লেগে আছে। মাঝে মাঝে খুব রাগও হত মায়ের ওপর। মনে হত সব সময় এই রকম রং-জ্বলা পুরনো একটা কাপড় পরে থাকলে ওর বন্ধুরা কী ভাববে? ওরা হয়তো মনে করবে পিয়ার মা জামাকাপড় পরে না, একটা বিছানার চাদর গায়ে জড়িয়ে থাকে।

কিন্তু এই শাড়িটা কার? ওর বউয়ের? বাচ্চাটার মা-র? দু’জনে কি একই লোক? প্রশ্নগুলো মনে আসছিল বটে, কিন্তু উত্তর জানার কোনও উপায় নেই বলে যে খুব একটা আফশোস হচ্ছিল পিয়ার, তাও ঠিক নয়। একদিক থেকে বাঁচোয়া; একটা মানুষের জীবনের খুঁটিনাটি জানার সাথে সাথে কিছু দায়িত্বও তো চলে আসে। তার থেকে অন্তত অব্যাহতি পাওয়া গেল।

ছইয়ের ভেতর থেকে গুঁড়ি মেরে বেরিয়ে এল পিয়া। নৌকোর নোঙর তোলা হয়ে গেছে, দাঁড় হাতে তুলে নিয়েছে ফকির। ওরও স্নান সারা হয়ে গেছে। চুল-টুল আঁচড়ে একেবারে ফিট বাবুটি হয়ে গেছে এর মধ্যে। মাঝখানে সিঁথি কাটা, চুলগুলি পেতে আছে মাথার ওপর। মুখে গলায় নুনের গুঁড়োগুলো না থাকায় খুব ছেলেমানুষ মনে হচ্ছিল ফকিরকে, এক্কেবারে একটা কলেজ-পালানো দুষ্টু ছেলের মতো লাগছিল। স্নান করে জামাকাপড়ও পালটে নিয়েছে ও। একটা ঘিয়ে রঙের টি শার্ট গায়ে দিয়েছে, পরনে একটা কাঁচা লুঙ্গি। দূরবিন দিয়ে পিয়া ওকে যে লুঙ্গিটা পরে থাকতে দেখেছিল সেটা আপাতত মেলা আছে ছইয়ের ওপর।

সূর্য এর মধ্যে পাটে বসেছে। দিগন্ত থেকে যেন একটা রঙের ধূমকেতু ছিটকে উঠে ডুব দিয়েছে ঠিক মোহনার মাঝখানে। একটু পরেই রাত নামবে, রাত কাটানোর মতো একটা কোনও জায়গায় গিয়ে পৌঁছতে হবে তার মধ্যে। দিনের আলোতেই এই নদী-খাঁড়ির ভুলভুলাইয়ায় পথ খুঁজে পাওয়া কঠিন, রাতের অন্ধকারে এইটুকু ডিঙি নিয়ে তো দিশাহারা হয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে। তবে ফকির নিশ্চয়ই কোনও একটা নিরাপদ জায়গার কথা মনে মনে ভেবে রেখেছে। এখন যত তাড়াতাড়ি সেখানে গিয়ে পৌঁছনো যায় ততই মঙ্গল।

নৌকো চলতে শুরু করার পর উঠে দাঁড়াল পিয়া, দূরবিন চোখে তুলে নিয়ে কাজ শুরু করল ফের। জরুরি সব যন্ত্রপাতি সঙ্গেই আছে, কোমরের বেল্টের সাথে লাগানো। দূরবিনে চোখ রাখতেই মনে হল যেন স্নিগ্ধ বৃষ্টি এসে ধুয়ে দিল চারপাশের দৃশ্যপট, চেনা কাজের ছন্দে মনের অস্থিরতা কমে এল ধীরে ধীরে। দূরবিন চোখে ঘড়ির কাটার মতো নদীর দিকে নজর রাখছিল পিয়া, আস্তে আস্তে ঘাড় ঘোরাচ্ছিল–ডানদিক থেকে বাঁদিক, বাঁদিক থেকে ডানদিক, যেন কোনও বাতিঘরের সিগনাল, আলো দেখিয়ে যাচ্ছে যন্ত্রের মতো। নৌকোর দুলুনিতে কোনও অসুবিধাই হচ্ছিল না ওর। এত বছরের চর্চায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে ওর শরীর, অভ্যাসগত প্রতিবর্তে জলের দোলার সাথে সাথে এখন সংকুচিত প্রসারিত হয় হাঁটুর পেশি। ভারসাম্য রাখার জন্য আর আলাদা করে চেষ্টা করতে হয় না।

ওর কাজের এই ব্যাপারটাই পিয়ার সবচেয়ে পছন্দের : সারাক্ষণ ভেসে ভেসে বেড়ানো, মুখে জোলো বাতাসের ঝাঁপটা, সতর্ক চোখ নদীর দিকে, আর হাতের কাছে সব জরুরি জিনিসপত্র যা যা দরকার। পিয়ার কোমরে সবসময় বাঁধা থাকে পর্বতারোহীদের বেল্ট, ক্লিপবোর্ড থেকে শুরু করে ছোটখাটো যন্ত্রপাতি সব হুকের সঙ্গে ঝোলানো। সবচেয়ে দরকারি যে যন্ত্রটা ও কখনও কাছছাড়া করে না সেটা হল ছোট্ট একটা হাতে-ধরা মনিটর। গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমে যে-কোনও জায়গায় নিজের নির্ভুল অবস্থান জানা যায় এটা দিয়ে। পিয়া যখন চোখে দূরবিন এঁটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুশুক খুঁজতে থাকে, তখন নিখুঁতভাবে এই যন্ত্র রেকর্ড করে যায় ওর পথ, প্রতিটি সেকেন্ডের, প্রতিটি মিটারের হিসেব রেখে চলে। এমনকী খোলা সমুদ্রেও এটার সাহায্যে অভ্রান্ত ভাবে দিক নির্ণয় করা যায়। হয়তো কোনও একদিন কোনও এক সময় এক জায়গায় একটা শুশুকের পাখনার একটু আভাস দেখা গিয়েছিল, প্রয়োজন হলে ঠিক সেই বিন্দুতে আবার ফিরে আসা যায় যদি এই যন্ত্র হাতে থাকে।

এই জিপিএস মনিটর ছাড়াও পিয়ার সঙ্গে আছে একটা রেঞ্জফাইন্ডার আর একটা ডেস্থ সাউন্ডার। প্রথম যন্ত্রটা দিয়ে কোনও বস্তুর দূরত্ব মাপা যায়, আর দ্বিতীয়টা কাজে লাগে জলের গভীরতা মাপতে। এই সব ক’টা যন্ত্রই পিয়ার কাজের জন্য খুব জরুরি, কিন্তু সবচেয়ে দরকারি হল ওর গলায় ঝোলানো ওই দূরবিন। ওটা কিনতে গিয়ে প্রায় ফতুর হয়ে গিয়েছিল পিয়া, কিন্তু তাতে ওর কোনও দুঃখ নেই। কারণ দূরবিন ছাড়া এ ধরনের রিসার্চ একেবারেই কানা। বহু বছরের ব্যবহারে যন্ত্রটার বাইরের ঔজ্জ্বল্য কমেছে, লেন্সের ঢাকনাগুলো রোদে আর নুনের গুঁড়োর আঁচড়ে আঁচড়ে ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে এসেছে, কিন্তু জলনিরোধক আবরণ যেটা আছে সেটা খুবই কাজের। এই ছয় বছর ধরে একটানা ব্যবহার করার পরেও তাই একেবারে ঠিকঠাক কাজ করে যাচ্ছে পিয়ার এই বিশ্বস্ত দূরবিন। শক্তিশালী লেন্সগুলো এখনও বহুদূরের জিনিসকে যেন নাকের কাছে নিয়ে চলে আসে। ডানদিকের আইপিসটার সঙ্গে আবার একটা কম্পাস লাগানো আছে। ফলে দূরবিনটা চোখ থেকে না নামিয়েই দৃষ্টিপথ ঠিক রাখতে পারে পিয়া, জলের দিকে নজর রাখতে পারে অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে নিখুঁত অর্ধবৃত্ত। ১৮০ ডিগ্রি। বেশিও নয়, কমও নয়। এটা যখন কিনেছিল তখন ও সদ্য ক্যালিফোর্নিয়ার স্ক্রিপস ইন্সটিটিউশন অব ওশ্যেনোগ্রাফিতে ভর্তি হয়েছে গ্র্যাজুয়েশন করতে। খুব জোর হলে বছর খানেক হয়েছে। সে ভাবে বলতে গেলে সে সময় এরকম একটা দূরবিনের দরকারই ছিল না ওর। তবে পিয়ার মনে কোনও দ্বিধা ছিল না। পড়াশোনা শেষ হলে কী করবে সেটা তখন থেকেই মনে মনে ও স্থির করে নিয়েছিল। দুরবিন কেনার কথা মনে হতে তাই বাজারের সেরাটাই কেনার ইচ্ছে হয়েছিল ওর। বেশ কিছুদিন ধরে বহু ক্যাটালগ ঘেঁটেঘুঁটে অবশেষে মানি অর্ডার করেছিল কোম্পানিতে।

প্যাকেটটা যখন এসে পৌঁছল সেটার ওজন দেখে বেশ একটু ঘাবড়েই গিয়েছিল পিয়া। সে সময়ে ও যেই ঘরটায় থাকত সেটা ছিল ইউনিভার্সিটির রাস্তার একেবারে পাশে। বইখাতা হাতে ছাত্রছাত্রীরা সব সময় সেখান দিয়ে যাতায়াত করছে। দূরবিনটা নীচের দিকে তাক করে ও ছেলেমেয়েগুলোর মুখ, ওদের হাতের বইপত্র দেখার চেষ্টা করছিল। অত উঁচু থেকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল প্রতিটা লোককে। এমনকী বইয়ের মলাটের লেখা, খবরের কাগজের হেডলাইনগুলো পর্যন্ত পরিষ্কার পড়া যাচ্ছিল। কিন্তু দূরবিনটা ঘুরিয়ে অন্যদিকে দেখতে গিয়ে বোঝা গেল যতটা সহজ মনে হয়েছিল আসলে ততটা সহজ নয় ব্যাপারটা। এ যন্ত্র হাতে একশো আশি ডিগ্রি পর্যন্ত ঘুরে দেখতে গেলে শুধু ঘাড় ঘোরালে চলবে না, একেবারে গোড়ালি থেকে শুরু করে কোমর কাধ মাথা সুদ্ধ পুরো শরীরটাই ঘোরাতে হবে। কয়েক মিনিটেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল পিয়া। হাতে ব্যথা ধরে গিয়েছিল। এই ভারী দূরবিন নিয়ে দিনে দশ বারো ঘণ্টা কী করে কাজ করে লোকে? তা হলে কি ওকে দিয়ে এ ধরনের কাজ হবে না? একটু হতাশ হয়ে পড়েছিল পিয়া।

এমনিতে বরাবরই বন্ধুবান্ধবদের তুলনায় ও দেখতে একটু ছোটখাটো। একেবারে ছেলেবেলায়, এমনকী কিশোর বয়সেও, ওর সমবয়সিদের সামনে ওকে লিলিপুটের মতো লাগত। তবে সেটা এক রকম অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল পিয়ার। কিন্তু যেদিন প্রথম ও লা জোলাতে ওর সিটোলজির ক্লাসে গেল সেদিন সহপাঠীদের সামনে ওর নিজেকে একেবারে একরত্তি একটা পুঁচকে মেয়ে মনে হচ্ছিল। “এ তো দেখা যাচ্ছে তিমির দলে পুঁটিমাছের প্রবেশ,” একজন অধ্যাপক ঠাট্টা করে বলেছিলেন। হবে না-ই বা কেন? অন্য যারা ওর ক্লাসে ছিল তারা প্রায় সকলেই পোড়-খাওয়া খেলোয়াড় গোছের ছেলেমেয়ে-ইয়া মোটা মোটা হাড়, পেশিগুলো যেন পাথর কুঁদে বের করা। বিশেষ করে মেয়েগুলো বোধহয় জন্ম থেকেই ক্যালিফোর্নিয়া কি হাওয়াই কি নিউজিল্যান্ডের সমুদ্রের ধারে ভলিবল খেলে, ডাইভিং করে, ডুবসাঁতার কেটে, নৌকো চালিয়ে বড় হয়েছে। তাদের শরীরের গড়নই তো অন্য রকম। রোদে পুড়ে পুড়ে গায়ের চামড়া প্রায় তামাটে সোনালি, তার ওপর হাতের কুচি কুচি লোমগুলো যেন চিকচিকে বালির দানা। পিয়া নিজে কোনওদিন খেলাধুলোর ধার দিয়েই যায়নি। তাতে করে অন্যদের থেকে আরও নিজেকে আলাদা মনে হত ওর। শুধু এই ছোটখাটো চেহারার জন্যই সারা কলেজে পরিচিত হয়ে গিয়েছিল ও, সবাই চিনে গিয়েছিল এই “পুঁচকে ইস্ট ইন্ডিয়ান” মেয়েটাকে।

তবে কোস্টারিকা উপকূলের কাছে জীবনে প্রথমবার সার্ভের কাজ করতে গিয়েই নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে সন্দেহ মিটে গিয়েছিল পিয়ার। শুরুর ক’টা দিন কিছুই দেখা গেল না সেবার, শুধু এ দিগন্ত থেকে ও দিগন্ত নিষ্ফলা নজর রেখেই সময় কেটে গেল। দূরবিনের ভারে পিয়াকে হাসফাস করতে দেখে মনে হয় মায়া হচ্ছিল সহপাঠীদের, রুটিন ভেঙে ডেকে বসানো বড় বাইনোকুলারটা বেশিক্ষণ ধরে,ওরা ওকে দেখতে দিচ্ছিল। যাই হোক, এ ভাবে পর পর তিন দিন কেটে যাওয়ার পর চতুর্থ দিনে দেখা মিলল এক দঙ্গল ডলফিনের। শুরুতে মনে হয়েছিল ছোট একটা দল, খুব বেশি হলে সব মিলিয়ে গোটা কুড়ি হয়তো হবে। কিন্তু ক্রমেই বাড়তে থাকল সংখ্যাটা–কুড়ি থেকে একশো, দুশো করে বাড়তে বাড়তে প্রায় হাজার সাতেকে গিয়ে দাঁড়াল। শেষপর্যন্ত এত অজস্র ডলফিন দেখা যেতে লাগল চতুর্দিকে যে গুণতে গুণতে খেই হারিয়ে ফেলল ওরা। মনে হচ্ছিল গোটা সমুদ্রটা যেন ভরে গেছে ডলফিনে, যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই একেবারে দিগন্ত পর্যন্ত থিকথিক করছে অগুন্তি ডলফিন, ঢেউয়ের চেয়েও সংখ্যায় বেশি, জলের ওপর চার দিকে শুধু অজস্র ছুঁচোলো ঠোঁট আর চকচকে তেকোনা পাখনা। ঠিক সেই সময়ে পিয়া দেখল কীভাবে হঠাৎ হালকা হয়ে গেল ওর দূরবিনটা। মানে, রাতারাতি যে ও মহা শক্তিশালী গামা পালোয়ান হয়ে গেল তা নয় (যদিও ততদিনে দড়ির মতো পাকানো পাকানো পেশি গজিয়ে গেছে ওর হাতে), কিন্তু শুধু ওই একজোড়া কাঁচ সমুদ্রটাকে আর ডিগবাজি-খাওয়া ডলফিনগুলোকে এত কাছে এনে দিয়েছিল, যে ভারী ওজনের সমস্যাটা একেবারে বেরিয়েই গেল মাথা থেকে।