ভোরবেলা ঘুম ভাঙতে পিয়া দেখল মুখ মাথা ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে রাতের শিশিরে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, সকালের দিকটায় জলের ওপর রোজ যেমন কুয়াশা থাকে আজকে তার চিহ্নমাত্র দেখা যাচ্ছে না। আগের রাতে এত গরম ছিল, তার জন্যেই নিশ্চয়ই এরকম হয়েছে। এখন অবশ্য বেশ ভালই হাওয়া চলছে, এমনকী নদীতে ঢেউও উঠছে অল্প অল্প। মনে হচ্ছে কালকের অসহ্য গরমটা আজকে আর ভোগ করতে হবে না।
ফকির এখনও অঘোর ঘুমে। তাই চুপচাপ নিজের জায়গায় শুয়ে শুয়ে ভোরের শব্দ শুনতে লাগল পিয়া: দুরে কোথায় একটা পাখি ডাকছে, ঝরঝর করে হাওয়া বইছে জঙ্গলের ডালপাতার মধ্যে দিয়ে, ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ উঠছে জোয়ারের জলে। চারপাশের বিভিন্ন আওয়াজে কান খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে আসার পর অন্যরকম একটা শব্দ শুনতে পেল পিয়া, যে সমস্ত আওয়াজগুলো এতক্ষণ ধরে কানে আসছিল সেগুলোর সঙ্গে এটা যেন ঠিক খাপ খায় না। ফোঁস করে হাঁফ ছাড়ার মতো ছোট্ট একটা শব্দ, অনেকটা যেন কেউ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে থেমে থেমে। কিন্তু ইরাবড়ি ডলফিনের আওয়াজের সঙ্গে কোনও মিল নেই এ শব্দের। চট করে উপুড় হয়ে গিয়ে দুরবিনটার দিকে হাত বাড়াল পিয়া। মাথার ভেতর থেকে কেউ যেন বলে উঠল আওয়াজটা গ্যাঞ্জেটিক ডলফিনের প্ল্যাটানিস্টা গ্যাঞ্জেটিকা। কয়েক সেকেন্ড পরেই জলের মধ্যে ডিগবাজি খাওয়া পাখনাবিহীন একটা মসৃণ পিঠ চোখে পড়ল পিয়ার নৌকো থেকে প্রায় দুশো মিটার সামনে। মিলে গেছে! এত তাড়াতাড়ি ধারণাটা সত্যি প্রমাণিত হতে উত্তেজিত হয়ে উঠল পিয়া। একটা নয়, অন্তত গোটা তিনেক ডলফিন চক্কর কেটে বেড়াচ্ছে ডিঙিটার আশেপাশে।
উত্তেজনায় উঠে বসল পিয়া। এই ক’দিনের মধ্যে গ্যাঞ্জেটিক ডলফিন চোখেই পড়েনি, মনটা তাই একটু খুঁতখুঁত করছিল ওর–আর আজকে এই সক্কাল সক্কাল, এ তো একেবারে মেঘ না চাইতেই জল। তাড়াতাড়ি জিপিএস-এ একটা রিডিং নিয়ে ডেটাশিট বের করার জন্যে পিয়া পিঠব্যাগটার দিকে হাত বাড়াল।
ডেটাশিটে কয়েকটা এন্ট্রি করার পর হঠাৎ কেমন যেন একটা ধন্দ লাগল পিয়ার; মনে হল কোথায় যেন গড়বড় হচ্ছে একটা। হিসেব করে দেখল অস্বাভাবিক রকম কম সময়ের ব্যবধানে ডলফিনগুলো ভেসে উঠছে জলের ওপর। খুব বেশি হলে দু’এক মিনিট পর পরই ভুস করে উঠে শ্বাস ছাড়ছে, আবার ডিগবাজি খেয়ে তলিয়ে যাচ্ছে নদীর মধ্যে। আর একাধিকবার, শ্বসের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে একটা কুঁইকুই শব্দও কানে এল পিয়ার।
নাঃ, একটা কিছু গন্ডগোল নিশ্চয়ই আছে। এমনিতে তো এই প্রাণী কখনও এরকম ব্যবহার করে না। ডেটাশিটটা পাশে সরিয়ে দূরবিনে চোখ রাখল পিয়া।
ডলফিনগুলোর অস্বাভাবিক ব্যবহারের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কয়েক বছর আগে পড়া একটা প্রবন্ধের কথা মনে পড়ে গেল ওর। প্রফেসর জি পিলেরি নামের এক সুইস সিটোলজিস্টের লেখা। মিষ্টি জলের শুশুকদের বিষয়ে গবেষণায় অগ্রগণ্য সুইজারল্যান্ডের এই অধ্যাপক; অন্যতম পথিকৃৎ-ও বলা যায়। যতদূর মনে পড়ল সত্তরের দশকের কোনও এক সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল প্রবন্ধটা। পাকিস্তানের সিন্ধু নদে তার গবেণার কাজ করছিলেন পিলেরি। ওখানকার কয়েকজন জেলেকে কিছু টাকাপয়সা দিয়ে রাজি করিয়েছিলেন একজোড়া প্ল্যাটানিস্টা ধরে দেওয়ার জন্য একটা ছেলে শুশুক আর একটা মেয়ে শুশুক। ডলফিন ধরার সেই কাহিনি বিস্তারিতভাবে লিখেছিলেন অধ্যাপক তার ওই প্রবন্ধে। খুব একটা সহজ ছিল না কাজটা। কারণ গ্যাঞ্জেটিক ডলফিনদের শরীরের ধ্বনি-প্রতিক্ষেপক রাডার এতই নির্ভুল যে নদীতে জাল নামানো মাত্র ওরা সেটা টের পেয়ে যায়। শেষে অনেক মাথা খাঁটিয়ে জেলেরা শুশুকগুলোকে লোভ দেখিয়ে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গেল যেখানে ওপর থেকে জাল ফেলে ওদের ধরা যায়।
জোড়া ডলফিন ধরা তো পড়ল৷ পিলেরির পরবর্তী কাজ হল পাকিস্তান থেকে তাদের সুইজারল্যান্ডে নিজের গবেষণাগারে নিয়ে যাওয়া। সে প্রক্রিয়া এতই জটিল আর অদ্ভুত, যে পড়তে পড়তে হো হো করে হেসে উঠেছিল পিয়া। প্রথমে তো প্রাণীগুলোকে ভেজা কাপড় দিয়ে জড়ানো হল। তারপর মোটরবোটে করে নিয়ে যাওয়া হল এক গাড়ি-চলা পথের কাছে। সেখান থেকে একটা ট্রাক ভাড়া করে প্রথমে একটা রেলস্টেশনে যাওয়া হল, তারপর ট্রেনে করে করাচি। আর এই পুরো সময়টা ধরে কিছুক্ষণ পর পরই সিন্ধু নদের জল দিয়ে ভিজিয়ে দেওয়া হচ্ছিল শুশুকগুলোর সারা গা। করাচি স্টেশনে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল একটা ল্যান্ড-রোভার। তাতে করে প্রাণীগুলোকে নিয়ে যাওয়া হল একটা হোটেলে। সেখানে বিশেষভাবে তৈরি করা একটা সুইমিং পুলে রাখা হল ওদের। তারপর কয়েকদিনের বিশ্রাম। বিশ্রাম শেষে আবার ল্যান্ড-রোভারে চড়িয়ে ডলফিনযুগলকে নিয়ে যাওয়া হল করাচি এয়ারপোর্টে। সোজা টারম্যাক পর্যন্ত গাড়িতে করে নিয়ে গিয়ে একটা সুইসএয়ার প্লেনে উঠিয়ে দেওয়া হল ওদের। দুই শুশুককে নিয়ে সেই প্লেন পাকিস্তান থেকে সরাসরি বরফ-জমা সুইজারল্যান্ডে না গিয়ে মাঝপথে আথেন্সে থামল কিছুক্ষণ। সেখান থেকে অবশেষে জুরিখ। এয়ারপোর্ট থেকে হটওয়াটার বটল আর কম্বল চাপা দিয়ে গরম অ্যাম্বুলেন্সে করে ডলফিনদুটোকে নিয়ে যাওয়া হল বার্নের এক প্রাণিগবেষণাকেন্দ্রে। সেখানে বিশাল একটা চৌবাচ্চা আগে থেকে বিশেষ ভাবে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল ওদের জন্যে। এমন ব্যবস্থা করা ছিল যাতে সে চৌবাচ্চায় জলের উষ্ণতা মোটামুটি সিন্ধু নদের জলের তাপমাত্রার সমান থাকে সব সময়।
আল্পস পাহাড়ের এই সিন্ধু নদে গবেষণার সময়ই প্ল্যাটানিস্টাদের স্বভাবের একটা অদ্ভুত দিক লক্ষ করেন পিলেরি। যে অভ্যাসের কথা তার আগে কেউ জানত না। দেখা গেল এ জাতের ডলফিনরা আবহাওয়ার পরিবর্তনের প্রতি খুবই সংবেদনশীল। বায়ুর চাপের রদবদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় ওদের ব্যবহার। বার্ন এবং আশেপাশের অঞ্চলে ঝড় বাদলা হলেই কেমন অস্বাভাবিক হয়ে যায় ওদের আচরণ।
বহুদিন আগে পড়া প্রবন্ধ থেকে প্ল্যাটানিস্টাদের স্বভাবের এই খুঁটিনাটিগুলো মনে করার চেষ্টা করছিল পিয়া। হঠাৎ, দূরবিনটা একটু সরতেই নদী থেকে ওর নজর গিয়ে পড়ল দিগন্তের দিকে, দক্ষিণ-পুর্ব কোণে। অন্য কোথাও মেঘের কোনও চিহ্ন নেই, কিন্তু ঠিক ওই কোণ বরাবর গিয়ে রং পালটে গেছে আকাশের, অদ্ভুত ইস্পাত-ধূসর চেহারা নিয়েছে সেখানটায়।
চোখ থেকে দূরবিন নামিয়ে নিল পিয়া। আকাশ থেকে চোখ ফিরিয়ে ডলফিনগুলোর দিকে তাকাল, তারপর ফের দেখল আকাশের দিকে। হঠাৎ পুরো বিষয়টা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল ওর চোখের সামনে। কিছুনা ভেবেই চিৎকার করতে শুরু করল ও, “ঝড় আসছে, ফকির, ঝড় আসছে! এক্ষুনি মেঘার কাছে ফিরে যেতে হবে আমাদের।”
হরেনের আঙুল বরাবর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে তাকাল কানাই। সেখানে দিগন্তের কাছে স্পষ্ট চোখে পড়ছে একটা কালচে ছোপ, ধেবড়ে যাওয়া কাজলের মতো। “যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক তাড়াতাড়িই এসে গেল,” কবজি উলটে ঘড়ি দেখল হরেন। “সাড়ে পাঁচটা বাজে এখন। খুব বেশি হলে আর ঠিক আধঘণ্টা অপেক্ষা করতে পারব আমরা। তার চেয়ে দেরি করলে লুসিবাড়িতে আর ফেরা হবে না।”
মানতে চাইল না কানাই। “এভাবে ওদের ঝড়ের মুখে ফেলে রেখে আমরা নিরাপদে ফিরে চলে যাব? তা কী করে হয় হরেনদা?”
“কিছু করার নেই কানাইবাবু,” জবাব দিল হরেন। “হয় আধঘণ্টার মধ্যে ফিরে যেতে হবে, নয়তো এই ভটভটিসুদ্ধ এখানেই ডুবে মরতে হবে সবাই মিলে। শুধু আমার কি আপনার কথা আমি ভাবছিনা, আমার বাচ্চা নাতিটাও তো সঙ্গে আছে। আর নিরাপদে ফেরার কথা বলছেন? আমরাও যে ঝড় সামলে ঠিকমতো ফিরতে পারব কোনও গ্যারান্টি নেই তার।”
“কিন্তু এখানে কাছাকাছি কোনও আড়াল-টাড়াল নেই? যেখানে ঝড় থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেতে পারে?”
দিগন্তের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত আঁক কেটে গেল হরেনের তর্জনী। “কানাইবাবু, তাকিয়ে দেখুন চারদিকে। কোথাও কোনও আড়াল চোখে পড়ছে আপনার? এই সব ছোট ছোট দ্বীপগুলো দেখছেন তো আশেপাশে? ঝড় এলে প্রত্যেক ক’টা কয়েক ফুট জলের তলায় চলে যাবে। যদি এখানে থাকি, হয় মাঝনদীতে ডুববে আমাদের ভটভটি, নয়তো গিয়ে আছড়ে পড়বে পাড়ের ওপর। একেবারে কোনও আশা থাকবে না বাঁচার। কাজেই, ফিরতে আমাদের হবেই।”
“আর ওদের কী হবে?” জিজ্ঞেস করল কানাই। “ওরা বাঁচবে কী করে?”
কানাইয়ের কাঁধে হাত রাখল হরেন। বলল, “শুনুন। খুব একটা সহজ হবে না ব্যাপারটা, কিন্তু এরকম সময় কী করতে হয় ফকির সেটা খুব ভাল করে জানে। এই ঝড়ের মুখ থেকে বেঁচে কেউ যদি ফিরতে পারে, তা হলে ও-ই পারবে। ওর দাদুও একবার গর্জনতলায় এরকম সাইক্লোনের মধ্যে থেকে বেঁচে এসেছিল। এ ছাড়া আর কী বলব বলুন? এখন সবটাই আমাদের হাতের বাইরে।”