ভাটির দেশ
লঞ্চে
ক্যানিং বাজারের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বাড়িটার সামনে এসে থমকে গেল পিয়া। কাজের সূত্রে ওকে বনেজঙ্গলে নদীনালায় ঘুরতেই হয়, তাই বহু বছরের অভিজ্ঞতায় ফরেস্ট বা ফিশারিজ ডিপার্টমেন্টগুলোর সম্পর্কে একটা তিতিবিরক্ত ভাব জন্মে গেছে পিয়ার মনে। এখানে আসার সময়ও ও ভাবছিল হয়তো দেখবে কতগুলো ঘুপচি নোংরা অফিসঘরে কিছু লোক বসে কলম পিষছে। কিন্তু তার বদলে ঝকঝকে রং-করা বাংলোটা দেখে একটু হকচকিয়েই গেল পিয়া। তবুও, গেট ঠেলে ঢুকতে ঢুকতে মনটাকে শক্ত করে নিল ও : হাজার হোক সরকারি অফিস, কত আর তফাত হবে?
কিন্তু যেরকম ভেবেছিল শেষপর্যন্ত ততটা খারাপ দাঁড়াল না ব্যাপারটা। হ্যাঁ, দারোয়ানকে পেরিয়ে অফিসঘরের ভেতর ঢোকার জন্য ঝাড়া একঘণ্টা অপেক্ষা করতে হল, কিন্তু একবার ঢোকার পরে একেবারে ঝটপট হয়ে গেল সব কাজ। দেখা গেল কাকার যোগাযোগে কাজ হয়েছে–ঢুকতে না ঢুকতেই একজন ওকে সোজা নিয়ে গেল সিনিয়র রেঞ্জারের কাছে। ক্লান্ত চেহারার নম্র ভদ্রলোক এটা সেটা দু-একটা ভদ্রতার কথা বলার পর জুনিয়র অফিসারকে বললেন ওর ব্যাপারটা দেখে দিতে। সে ভদ্রলোকের পেছন পেছন ঘুরতে হল বেশ খানিকক্ষণ–এ করিডোর, ও করিডোর, বড় ঘর থেকে ছোট ঘর, আরও ছোট ঘর, এ টেবিল, সে টেবিল। মধ্যে মধ্যে দীর্ঘ চা-পানের বিরতি আর পানের ছোপ-লাগা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করার পালা চলল বেশ কিছুক্ষণ, কিন্তু সব মিলিয়ে ঘণ্টাচারেকের মধ্যেই দরকারি সমস্ত কাগজপত্র হাতে পেয়ে গেল ও।
জয়ের আনন্দে আত্মহারা হয়ে অফিস থেকে বেরোতে গিয়েই একটা ধাক্কা খেল পিয়া। সরকারি নিয়মকানুনের পালা এখনও শেষ হয়নি। সার্ভের কাজের জন্য জলেজঙ্গলে যেতে হলে ওকে একজন ফরেস্ট গার্ড নিতেই হবে। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল পিয়ার। আগের অভিজ্ঞতায় ও দেখেছে এইসব সরকারি লোকজন সঙ্গে থাকলে অনেক সময় বেশ অসুবিধাই হয়, কখনও কখনও সার্ভের থেকে ওদের দিকেই বেশি মনোযোগ দিতে হয়। একা যেতে পারলেই সবচেয়ে ভাল হত–শুধু নৌকো চালানো আর রাস্তা দেখানোর জন্য একটা লোক থাকলেই চলত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সে সম্ভাবনা দূর অস্ত। এমনকী ইতিমধ্যে ওর জন্য একজন গার্ড ঠিকও হয়ে গেছে, সে-ই ওকে পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবে, নৌকো ভাড়া করে দেবে, অন্যান্য যা যা দরকার সেসব ব্যবস্থাও করবে। যাক, এ নিয়ে আর ঝামেলা করে লাভ নেই, অন্তত পারমিট-টারমিটগুলো তো তাড়াতাড়ি পাওয়া গেছে।
সদ্য ভাঁজ-ভাঙা খাকি পোশাক-পরা ছুঁচোমুখো গার্ড লোকটা বিনয়ী হাসি হেসে সামনে এসে দাঁড়াল। মানুষটাকে দেখে অবশ্য খুব একটা খারাপ মনে হল না। কিন্তু যেই ও রাইফেল আর কার্তুজের পেটিটা বের করল, কেমন একটু অস্বস্তি লাগল পিয়ার। বন্দুক-টন্দুকের আবার কী দরকার? অফিসারের সঙ্গে কথা বলার জন্য সোজা অফিসঘরে ফিরে গেল ও। অফিসার বুঝিয়ে বললেন যেহেতু ওকে টাইগার রিজার্ভের মধ্যে দিয়েই যেতে হবে, তাই বন্দুক ছাড়া একেবারেই চলবে না। কারণ যে-কোনও সময়েই অ্যাটাক হতে পারে। কী আর করা যাবে। পিঠব্যাগ কাঁধে তুলে গার্ডের পেছন পেছন ফরেস্ট অফিস থেকে বেরিয়ে এল পিয়া।
খানিকদূর যেতে না যেতেই লোকটার হাবভাব অন্যরকম হয়ে গেল। একটু আগের বিগলিত হাসি-টাসি কোথায় মিলিয়ে গেল, চুপচাপ গম্ভীরভাবে ও পিয়াকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে চলল। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে সেসব জানানোর ধার দিয়েই গেল না। একটু বাদে বাঁধের ওপর একটা চায়ের দোকানে এসে থামল ওরা। একটা ডাকাত-ডাকাত চেহারার লোক সেখানে বসেছিল। ওদের কথাবার্তা পিয়া কিছু বুঝছিল না, কিন্তু যদূর মনে হল লোকটার নাম মেজদা। গাঁট্টাগোট্টা চেহারা, বিশাল থলথলে মুখ, গলায় আবার অনেকগুলো চকচকে চেন আর মাদুলি ঝুলছে। মেজদা বা গার্ড কেউই ইংরেজি বলতে পারে না, কিন্তু আশেপাশের দু’-একজনের ভাঙা ভাঙা অনুবাদে পিয়া যা বুঝল তা হচ্ছে–মেজদা একটা লঞ্চের মালিক। আর নাকি খুব ভাল গাইড, সুন্দরবনের নদীনালা সব ওর নখদর্পণে।
মেজদার লঞ্চটা একবার দেখতে চাইল পিয়া, কিন্তু জানা গেল সেটা এখন সম্ভব নয়। লঞ্চটা নাকি বেশ কিছুটা দূরে নোঙর করা আছে। সেখানে নৌকো করে যেতে হবে। ভাড়া যা বলল সেটাও যথেষ্ট বেশি। পিয়া পরিষ্কার বুঝতে পারছিল এই লোকগুলির মধ্যে যোগসাজস আছে। একটা শেষ চেষ্টা চালাল ও এদের খপ্পর থেকে বেরিয়ে অন্য লঞ্চওয়ালার খোঁজ করার, কিন্তু খুব একটা লাভ কিছু হল না। মেজদা আর গার্ডকে দেখে ধারেকাছে ঘেঁষলই না কেউ।
পিয়া ভেবেচিন্তে দেখল ওর সামনে দুটো রাস্তা খোলা আছে এখন। এক হল ফরেস্ট অফিসে ফিরে গিয়ে এদের নামে কমপ্লেন করা, আর নয়তো এরা যা বলছে তাতেই রাজি হয়ে গিয়ে সার্ভের কাজ শুরু করে দেওয়া। কিন্তু সারাটা দিন যে অফিসটায় কাটিয়েছে সেখানে ফিরে যেতে আর মন চাইল না। শেষপর্যন্ত মেজদার লঞ্চ ভাড়া করাই ঠিক করল ও।
লঞ্চের দিকে যেতে যেতে একটু একটু খারাপ লাগছিল পিয়ার। মনে হচ্ছিল এ লোকগুলো হয়তো ততটা মন্দ নয়, হয়তো ও ওদের ভুল বুঝেছে। হতেই পারে ওরা সুন্দরবন সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। দেখাই যাক না কতটা কাজ হয় ওদের দিয়ে।
এবারের সার্ভের জন্য পিয়া একটা ডিসপ্লে কার্ড নিয়ে এসেছে, দু’রকম ডলফিনের ছবি আঁকা–গ্যাঞ্জেটিক আর ইরাবড়ি। এই দু’রকম ডলফিনই এই অঞ্চলের নদীতে পাওয়া যায়।
ডিসপ্লে কার্ডের ছবিগুলি অবশ্য খুব একটা ভাল নয়, আঁকা ছবি, ১৮৭৮ সালের একটা প্রবন্ধ থেকে কপি করা। পিয়া নিজেই এর থেকে অনেক ভাল ভাল ছবি দেখেছে–হাতে-আঁকা ছবি, ফটোগ্রাফ, দু’রকমই। কিন্তু কেন কে জানে, এই ছবিগুলো লোককে দেখিয়েই সবচেয়ে ভাল ফল পেয়েছে ও। লোকে অনেক সহজে এগুলো দেখে চিনতে পারে। অনেক সময় এমনকী ফটোগ্রাফেও এত ভাল কাজ হয় না।
এর আগে অন্যান্য নদীতে কাজ কররার সময় এই ধরনের ডিসপ্লে কার্ডগুলো খুব কাজে দিয়েছে। যেসব জায়গায় ভাষার সমস্যা ছিল না, সেখানে কার্ডের ছবি দেখিয়ে ও জেলেদের জিজ্ঞেস করেছে এরকম প্রাণী তারা কোথায় দেখেছে, কোন কোন জায়গায় থাকে এরা, প্রাণীগুলোর স্বভাব কীরকম, বছরের কোন সময় বেশি দেখা যায়–এই সব। আর যেখানে দোভাষীর সাহায্য পাওয়া যায়নি, সেই সব জায়গায় ও জেলেদের ওই কার্ডের ছবিগুলো দেখিয়ে জবাবের অপেক্ষা করেছে। বেশিরভাগ সময়ই কায়দাটা কাজে এসেছে। প্রাণীগুলোকে চিনতে পেরেছে জেলেরা, তারপর ওকে ইশারায় দেখিয়ে দিয়েছে কোনদিকে গেলে তাদের দেখা যাবে। কিন্তু ছবি দেখে প্রাণীটাকে চিনতে পেরেছে শুধু সবচেয়ে ঝানু পোড়খাওয়া জেলেরাই। একটা গোটা ডলফিনের চেহারা আর ক’টা জেলেই বা চোখে দেখেছে? বেশিরভাগই তো দেখেছে শুধু জলের ওপর ভেসে ওঠা পিঠের পাখনা বা নাকের ফুটো। তাই ছবিগুলো দেখানোর পর অনেকসময়ই অনেক জেলে অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথা বলেছে। কিন্তু মেজদা যা বলল সেরকম প্রতিক্রিয়া পিয়া তার এতদিনের অভিজ্ঞতায় কখনও দেখেনি। কার্ডটাকে হাতে নিয়ে তো প্রথমে সেটা উলটো করে ধরল। তারপর নানাদিক থেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখার পর গ্যাঞ্জেটিক ডলফিনের ছবিটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল ওটা কোনও পাখি কি না। পিয়া কথাটা বুঝতে পারল কারণ ইংরেজিতে একটা শব্দ বারবার বলছিল মেজদা–”বার্ড? বার্ড?”
পিয়া এত আশ্চর্য হয়ে গেল যে ও নিজে ছবিটা আবার নতুন করে দেখল। ওটার সঙ্গে পাখির সাদৃশ্যটা কোথায় সেটাই বোঝার চেষ্টা করল খানিকক্ষণ ধরে। শেষে যখন ডলফিনটার লম্বা নাক আর সরু ছুঁচোলো দাঁতগুলোর দিকে মেজদা আঙুল দিয়ে দেখাল, তখন পিয়ার মাথায় ঢুকল ব্যাপারটা। ইশনিস্ট ড্রয়িং-এর মতো ওর চোখের সামনেও যেন ডলফিনের ছবিটা পালটে যেতে থাকল। পিয়ার মনে হল ও যেন মেজদার চোখ দিয়ে ছবিটা দেখছে। কেন লোকটা ভুল বুঝেছিল সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারল ও এতক্ষণে–জন্তুটার গোলগাল শরীরটা অনেকটা ঘুঘুপাখির মতো, আর লম্বা চামচের মতো ঠোঁটটার সঙ্গে বকজাতীয় পাখির কিছুটা সাদৃশ্য রয়েছে। তা ছাড়া গ্যাঞ্জেটিক ডলফিনের সেরকম কোনও পিঠের পাখনাও নেই। বেচারা মেজদার আর কী দোষ! কিন্তু ডলফিনকে পাখি বলে ভুল করা–ব্যাপারটা এত হাস্যকর যে তাড়াতাড়ি কার্ডটা ফেরত নিয়ে হাসি লুকোনোর জন্য অন্যদিকে মুখ ঘোরাল পিয়া।
নৌকোয় যেতে যেতে বারবারই ঘটনাটা মনে পড়ছিল, আর নিজের মনে হেসে ফেলছিল পিয়া। কিন্তু মেজদার লঞ্চের চেহারাটা চোখে পড়তেই ওর মুখের হাসি মুখেই মিলিয়ে গেল। লঞ্চ বলে যেটাকে চালাতে চেষ্টা করছে লোকগুলো, সেটা আসলে একটা জরাজীর্ণ ডিজেল স্টিমার। টুরিস্টদের জন্য সারেং-এর ঘরের পেছনে কয়েকটা চেয়ার পাতা, মাথার ওপরে ঝুলকালো একটা তেরপল। এর থেকে তো একটা আউটবোর্ড মোটর লাগানো ফাইবারগ্লাসের ডিঙি নিলেই ভাল হত। ওরকম ছোট নৌকোতেই সার্ভের কাজ করতে বেশি সুবিধা। মেজদা আর গার্ডের কথায় রাজি হয়ে যাওয়ার জন্য এতক্ষণে একটু অনুশোচনা হল পিয়ার। কিন্তু আর ফেরার উপায় নেই এখন।
তক্তা বেয়ে লঞ্চে উঠতে উঠতে ডিজেলের গন্ধটা সপাট একটা থাপ্পড়ের মতো মুখে এসে লাগল পিয়ার। ওপরে জনা কয়েক ছোকরা হেলপার লঞ্চের ইঞ্জিনটা খুলে মেরামত করার চেষ্টা করছিল। অবশেষে সেটা যখন চালু হল, যা আওয়াজ বেরোল তাতে ডেকের ওপরেই কান প্রায় কালা হবার জোগাড়।
ছেলেগুলোকে ডেকে লঞ্চ থেকে নেমে যেতে বলল মেজদা। ভীষণ আশ্চর্য হয়ে গেল পিয়া। তার মানে শুধু মেজদা আর গার্ড–এই দুটো মাত্র লোক লঞ্চটা চালিয়ে নিয়ে যাবে? বেশ একটু গোলমেলে ঠেকল ব্যাপারটা। ছেলেগুলো যখন এক এক করে লঞ্চ থেকে নেমে গেল কেমন একটু ভয় ভয় করতে লাগল পিয়ার। দুশ্চিন্তাটা আরও বাড়ল মেজদার মূকাভিনয় দেখে। ব্যাপারটা হল, ঘটনাচক্রে পিয়া আর মেজদা একই রংয়ের পোশাক পরেছিল–নীল ট্রাউজার্স আর সাদা শার্ট। ও নিজে প্রথমে খেয়াল করেনি ব্যাপারটা, কিন্তু মেজদা ঠিক লক্ষ করেছিল। নানারকম ইশারায়, অঙ্গভঙ্গিতে নিজের দিকে আর পিয়ার দিকে দেখিয়ে ওদের মধ্যে মিল-অমিলগুলো ও বোঝানোর চেষ্টা করছিল–দু’জনের একইরকম পোশাক, একইরকম গায়ের রং, কালো চোখ আর ছোট করে কাটা কোঁকড়া চুল। তবে সবশেষে যে ভঙ্গিটা মেজদা করল সেটা বেশ একটু গোলমেলে আর অশ্লীল মনে হল। একবার নিজের জিভের দিকে আর একবার ঊরুসন্ধির দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে হো হো করে হাসতে লাগল মেজদা। এই অদ্ভুত ইশারার মানেটা ঠিক ধরতে না-পেরে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মুখটা তাড়াতাড়ি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল পিয়া। বেশ খানিকটা পরে ওর মাথায় এল যে ওটা আসলে ওদের দুজনের ভাষা আর লিঙ্গের পার্থক্যের রহস্যের বিষয়ে মেজদার নিজস্ব ভাষ্য।
কিন্তু তারপরে যে হাসির হররাটা উঠল তাতেই আরও অস্বস্তি লাগল পিয়ার। এমনিতে সরকারি নজরদারির মধ্যে ও আগে কখনও কাজ করেনি এমন নয়; মাত্র বছরখানেক আগেই ইরাবড়ি নদীতে যখন সার্ভে করছিল তখন সরকারি আদেশে (কাগজে-কলমে যদিও ‘পরামর্শ’) তিনটে বাড়তি লোককে নিতে হয়েছিল ওর নৌকোয়। লোক তিনটের হুবহু একরকম পোশাক–গল্ফ শার্ট, চেক-কাটা সারং আর স্টিল ফ্রেমের অ্যাভিয়েটর সানগ্লাস। পরে ও শুনেছিল ওরা ছিল মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের লোক–সরকারের স্পাই। কিন্তু ওদের সঙ্গে থেকে কাজ করতে ওর কখনও অস্বস্তি লাগেনি, কোনও বিপদের আশঙ্কাও হয়নি। আসলে ও যা কাজ করে, ওই ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রচণ্ড রোদের মধ্যে টলমলে নৌকোয় খাড়া দাঁড়িয়ে দুরবিন চোখে জলের দিকে তাকিয়ে থাকা আর আধঘণ্টা পর পর ডেটাশিট ভর্তি করা–সে কাজের ধরনটাই যেন একটা নিরাপত্তাবেষ্টনীর মতো ওকে সবসময় ঘিরে রাখে বলে মনে হয় পিয়ার। ইরাবড্ডি, মেকং বা মহাকাম নদীতে কাজ করার সময় অবশ্য আরও একটা জিনিস ওর পক্ষে বর্মের মতো কাজ করেছিল; সেটা হল ওর বিদেশি চেহারা। পিয়া নিজে অবশ্য তখন ব্যাপারটা লক্ষ করেনি, তবে ওর মুখের আদল, ছোট করে কাটা কালো চুল আর রোদেপোড়া গায়ের রঙে স্পষ্ট বোঝা যেত যে ও ওই অঞ্চলের লোক নয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, এই সুন্দরবনে–যেখানে ওর নিজেকে সবচেয়ে বেশি পরদেশি বলে মনে হচ্ছে, ওর সেই বিদেশি চেহারার বর্ম আর কাজ করছে না। ওর জায়গায় যদি আজ একজন সাদা চামড়ার ইয়োরোপিয়ান বা জাপানি মেয়ে থাকত তা হলে কি এই লোকগুলো এরকম ব্যবহার করার সাহস পেত? মনে হয় না। এমনকী ওর কলকাতার আত্মীয়দের সঙ্গেও এরা কোনও দুর্ব্যবহার করতে পারত না। কারণ ওদের চেহারার মধ্যে একটা উচ্চমধ্যবিত্ত কালচারের ছাপ-মারা রয়েছে। সেটাই প্রায় লেসার-গাইডেড মিসাইলের মতো এইসব জায়গায় ওদের রক্ষা করে। আর সে অস্ত্র এইসব লোকেদের ওপর কীভাবে প্রয়োগ করতে হয় সেটা ওরাও ভাল করেই জানে। ওদের সামাজিক হিসাবে কার কোথায় জায়গা সেটা পরিষ্কার বুঝিয়ে দিতে পারে। কিন্তু এই বিশাল এবং সূক্ষ্ম সমাজ সংস্থানের মধ্যে ওর নিজের জায়গাটাই পিয়া ঠিক করে জানে না, অন্যে পরে কা কথা।
আর ওর সেই অজ্ঞতারই সুযোগ নিচ্ছে এই লোকগুলো–সেটা এখন পরিষ্কার বুঝতে পারছিল পিয়া।