লুসিবাড়ি

কানাই আর নীলিমাকে নিয়ে ট্রাস্টের লঞ্চ যখন লুসিবাড়ির ঘাটে গিয়ে ভিড়ল, নদীতে তখন ভাটার টান। জল এত নীচে যে দ্বীপের ধার বরাবর টানা বাঁধটাকে পাহাড়ের মতো উঁচু মনে হচ্ছিল। বাঁধের ওপারের কিছুই দেখা যাচ্ছিল না লঞ্চ থেকে। ডাঙায় নেমে পাড় বেয়ে ওঠার পর নীচে তাকিয়ে তবে অবশেষে দেখা গেল গ্রামটাকে। সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিতে আঁকা একটা ম্যাপ যেন খুলে গেল মাথার ভিতর, আর কানাই দেখতে পেল গোটা লুসিবাড়িটা ওর চোখের সামনে ছড়িয়ে রয়েছে।

লম্বায় প্রায় দু’ কিলোমিটার দ্বীপটা দেখতে অনেকটা শখের মতো। দক্ষিণ থেকে শুরু হয়েছে ঘন ম্যানগ্রোভ জঙ্গল। চওড়ায় পঞ্চাশ কিলোমিটার সেই গভীর বন শেষ হয়েছে একেবারে বঙ্গোপসাগরের প্রান্ত পর্যন্ত গিয়ে। আর এই পঞ্চাশ কিলোমিটারের মধ্যে আর একটি দ্বীপেও কোনও জনবসতি নেই। আশেপাশে দ্বীপ আরও বেশ কয়েকটা আছে বটে, কিন্তু চারটে নদী চারদিক থেকে ঘিরে লুসিবাড়িকে তাদের থেকে আলাদা করে রেখেছে। নদীগুলোর মধ্যে দুটো মাঝারি মাপের, আর একটা এতই ছোট যে ভাটার সময় জল প্রায় থাকেই না। কিন্তু দ্বীপের ছুঁচলো দিকটা–মানে শাঁখের একেবারে মুখের কাছটা–যে নদীতে গিয়ে শেষ হয়েছে, তার থেকে বড় নদী এই ভাটির দেশে কমই আছে। সে নদীর নাম রায়মঙ্গল।

জোয়ারের সময় লুসিবাড়ি থেকে দেখলে রায়মঙ্গলকে নদী বলে মনেই হয় না, মনে হয় যেন ওটা সাগরেরই অংশ, একটা উপসাগর, নিদেন একটা বিশাল নদীমুখ। আসলে পাঁচটা নদী এসে মিশেছে এখানে, ফলে একটা বিশাল মোহনার সৃষ্টি হয়েছে যার এপার ওপার প্রায় দেখাই যায় না। এখন ভাটার সময় অবশ্য দূরে দূরে অন্য নদীর মুখগুলো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে–সেগুলোকে মনে হচ্ছে যেন বিরাট বড় গোল একটা সবুজ গ্যালারির মধ্যে মধ্যে লোক যাতায়াতের জন্য দৈত্যাকার প্রবেশপথ। তবে কানাই জানে যে জোয়ারের সময় এই পুরো অঞ্চলটারই চেহারা বদলে যাবে একেবারে। জঙ্গল, নদী আর নদীমুখ সবই চলে যাবে ঘোলাটে জলের নীচে। ওপরে জেগে থাকবে মাত্র কয়েকটা কেওড়া গাছের মাথা। ওগুলো না থাকলে মনে হত যেন চোখের সামনের আদিগন্ত এই জলরাশির কোনও শুরু শেষ নেই। জোয়ারের তারতম্য অনুসারে এই দৃশ্য কখনও অপূর্ব, কখনও ভয়ংকর। ভাটার সময় যখন বাঁধের অনেক নীচে নেমে যায় জল, তখন লুসিবাড়িকে মনে হয় বিশাল এক মাটির জাহাজের মতো, স্থির হয়ে ভাসছে। কিন্তু জোয়ার এলেই পরিষ্কার দেখা যায় নদীর জল দ্বীপের মাটির অনেক ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই যে দ্বীপকে মনে হচ্ছিল বিশাল জাহাজ, সেটাকে তখন মনে হয় যেন একটা ছোট্ট থালা, টলমল করে ভাসছে জলের ওপর। যে-কোনও সময় সেটা উলটে গিয়ে ঘুরতে ঘুরতে চলে যাবে নদীর তলায়।

দ্বীপের সরু দিকটা থেকে একটা মাটির চড়া বের হয়ে জলের মধ্যে বেশ কিছুটা চলে গেছে। বাতাসের গতিপথ বোঝার জন্য অনেকসময় বড় নৌকো বা জাহাজের মাস্তুলে যে হালকা উইন্ডসক ঝোলানো থাকে, এই চড়াটাও যেন অনেকটা সেরকম–স্রোতের দিক বদলের সাথে সাথে সরে সরে যায়। তবে স্থান পালটালেও গোড়াটা কিন্তু সবসময়ই লেগে থাকে দ্বীপের সঙ্গে। নৌকোর মাঝি বা লঞ্চওয়ালাদের অবশ্য খুব সুবিধা হয়েছে ওটা থাকায়, আলাদা করে আর জেটির দরকার হয় না; মালপত্র কি প্যাসেঞ্জার নামানোর জন্য চড়াটাই ওরা ব্যবহার করে। এমনিতে লুসিবাড়িতে কোনও ডক বা জেটি তৈরি করাও যায়নি নদীর তীব্র স্রোতের জন্য।

দ্বীপের সবচেয়ে বড় গ্রামটার নামও লুসিবাড়ি। গ্রাম শুরু হয়েছে চড়াটার একেবারে গোড়ার দিকটায়, বাঁধের আড়ালে। বাঁধের ওপর থেকে প্রথম দর্শনে লুসিবাড়িকে বাংলাদেশের আর পাঁচটা গ্রামের মতোই লাগে–সেই পরপর ছাঁচের বেড়ার ঘর, খুপরি খুপরি দোকান, খড় বা হোগলাপাতায় ছাওয়া। কিন্তু একটু ভাল করে নজর করলেই সাধারণ গ্রামের সাথে তফাতটা চোখে পড়ে।

গ্রামের ঠিক মাঝখানে রয়েছে একটা বড় মাঠ। রুলে-টানা নিখুঁত চতুর্ভুজ না হলেও মোটামুটি চৌকোনাই বলা চলে। মাঠের একধারে অনেকটা জায়গা জুড়ে হাট–গায়ে গায়ে লাগা পরপর সব দোকানঘর। শনিবার জমজমাট হাট বসে, সপ্তাহের অন্যদিন খালি পড়ে থাকে চালাগুলো। হাটের ঠিক উলটোদিকে স্কুল। মাঠের ধার ঘেঁষে যেন প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে স্কুলের বাড়িটা। নতুন লোকেদের কাছে এই স্কুলটাই এ গাঁয়ের সবচেয়ে বড় চমক। এমনিতে খুব কিছু বিশাল না হলেও, চারপাশের ঝুপড়ি বস্তি আর কুঁড়েঘরের মধ্যে স্কুলবাড়িটাকে হঠাৎ দেখলে আকাশছোঁয়া প্রকাণ্ড একটা গির্জার মতো মনে হয়। বাড়িটাকে ঘিরে ইটের পাঁচিল, মেনগেটে স্কুলের নাম আর প্রতিষ্ঠার বছর লেখা–স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিলটন হাই স্কুল, ১৯৩৮। সামনের দিকে একটা লম্বা ঢাকা বারান্দা, মাঝে মাঝে পলকাটা থাম, দরজা-জানালার ওপরের দিকগুলো তিনকোনা নিওক্লাসিকাল ঢঙের। খানিকটা আরবি ধরনের খিলান আর সে আমলের স্কুলবাড়ির স্থাপত্যের আরও দু-একটা টুকিটাকি চিহ্ন এদিক ওদিকে। ঘরগুলো বড় বড়, প্রচুর আলো-হাওয়া, লম্বা লম্বা জানালাগুলিতে খড়খড়ি বসানো।

স্কুলের কাছেই একসারি গাছের আড়ালে রয়েছে আরেকটা ঘেরা চত্বর। জায়গাটার ঠিক মাঝখানে একটা বাড়ি, স্কুলবাড়ির থেকে অনেকটা ছোট। এমনিতে চোখের আড়ালে থাকলেও, এটার চেহারা অনেক বেশি নজরকাড়া। পুরো কাঠের তৈরি বাড়িটা মিটার দুয়েক উঁচু কয়েকটা খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ধাঁচটা অনেকটা পাহাড়ি বাংলোর মতো, ভাটির দেশে একটু যেন বেমানান। চালাটা খাড়াই পিরামিডের মতো–সারি সারি খুঁটি, পিলার, জানালা আর পিল্পের ওপর বসানো। দেওয়াল জোড়া বিশাল বিশাল জানালা, মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত খড়খড়ি দেওয়া। পুরো বাড়িটার চারদিক ঘিরে ঢাকা বারান্দা। সামনে একটা শালুক ফুলে ভরা পুকুর, পাড় ঘেঁষে ইট বাঁধানো পথ–শ্যাওলা-ধরা।

কানাইয়ের মনে পড়ল, ১৯৭০ সালে এ বাড়িটা ছিল একেবারে নির্জন, শুনশান। গাঁয়ের প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় হলেও, আশেপাশে ঘরবাড়ি বিশেষ ছিল না তখন। খানিকটা যেন সম্ভ্রমের বশেই দ্বীপের অন্য বাসিন্দারা এই কুঠিবাড়িটার থেকে একটু দূরে দূরে থাকত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবই পালটে গেছে। একনজরেই বোঝা যায় এই উঠোন দিয়ে এখন যথেষ্ট লোক চলাচল হয়। আঙিনার চারপাশ ঘিরে গজিয়ে উঠেছে নতুন ঘরবাড়ি, পান-বিড়ির গুমটি আর মিষ্টির দোকান। পাশের আঁকাবাঁকা রাস্তাটা গমগম করছে ফিল্মি গানের সুরে, বাতাসে সদ্য-ভাজা জিলিপির গন্ধ।

আড়চোখে তাকিয়ে কানাই দেখল নীলিমা মহিলা সমিতির দুই কত্রীর সঙ্গে ট্রাস্টের কাজকর্ম নিয়ে কথা বলছে। পাশ থেকে চুপি চুপি সরে এল ও। বাইরের গেটটা ঠেলে ঢুকে পড়ল চত্বরটায়, তারপর শ্যাওলা-ঢাকা পথ দিয়ে মূল বাড়িটার দিকে এগোল। আঙিনাটায় ঢোকামাত্র একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল কানাইয়ের। বাইরে এত আওয়াজ, কিন্তু ভেতরে তার কিছুই প্রায় শোনা যাচ্ছে না। হঠাৎ মনে হল সময়টা যেন থমকে থেমে গেছে। বাড়িটাকে এই মনে হচ্ছে খুব পুরনো আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে আনকোরা নতুন। কাঠগুলো বহু বছরের রোদে জলে অনেক পুরনো কোনও গাছের বাকলের মতো একটা রুপোলি রং নিয়েছে। সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ায় প্রায় স্বচ্ছ মনে হচ্ছে সেগুলোকে খানিকটা গিলটি-করা ধাতুর ওপরের পাতলা ছালের মতো। পড়ন্ত বিকেলের আকাশের ছায়ায় গোটা কুঠিটা একটা নীলচে আভা ছড়াচ্ছে।

খুঁটিগুলোর সামনে এসে বাড়ির নীচের দিকটা একবার উঁকি দিয়ে দেখল কানাই। একরকম রয়ে গেছে আলোছায়ার জ্যামিতিক নকশাগুলো। কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে কুঠির দরজার সামনে যেতেই যেন মেসোর গলা শুনতে পেল ও।

“ওদিক দিয়ে ঢোকা যাবে না, মনে নেই?” নির্মল বলছিল। “সামনের দরজার চাবি তো কবেই হারিয়ে গেছে। বাড়ির পেছনের দিক দিয়ে ঘুরে গিয়ে ঢুকতে হবে আমাদের।”

আগেরবার কোথা দিয়ে গিয়েছিল মনে করে করে বারান্দা ধরে এগোতে লাগল কানাই। ব্যালকনির কোনাটা ঘুরে কুঠির পেছন দিকটায় গিয়ে একটা ছোট দরজা। আলতো করে ঠেলতেই খুলে গেল পাল্লাদুটো। ঘরে ঢুকেই প্রথম যে জিনিসটা কানাইয়ের চোখে পড়ল সেটা হল কাঠের সিট-ওয়ালা পুরনো ঢঙের একটা কমোড়। পোর্সেলিনের। তার পাশেই বিশাল একটা লোহার বাথটাব, ধারটা গোল করে বাঁকানো, পায়াগুলো নখওয়ালা থাবার প্যাটার্নে ঢালাই করা। মাথার কাছে একটু ঝুঁকে আছে ঝাঁঝরি, নরম বোঁটার ওপর ঝিমিয়ে পড়া ফুলের মতো।

যা দেখে গিয়েছিল তার থেকে একটুও বদলায়নি জিনিসগুলো, শুধু আর একটু বেশি মরচে ধরেছে। ছোটবেলায় প্রথমবার এসে ঘরের জিনিসপত্রগুলো যেন চোখ দিয়ে গিলছিল ও, মনে পড়ল কানাইয়ের। সেবার লুসিবাড়িতে এসে থেকেই নির্মল আর নীলিমার মতো ওকেও পুকুরেই স্নান করতে হচ্ছিল, ঝাঁঝরিটা দেখে তাই প্রচণ্ড লোভ হয়েছিল ওটার নীচে গিয়ে দাঁড়ানোর।

“এটা হল সাহেবি চৌবাচ্চা, বুঝলে? সাহেবরা এটাতে বসে স্নান করে”, টাবটা দেখিয়ে ওকে বলেছিল নির্মল। বাথটবের এই বর্ণনাটা কানাইয়ের মন্দ লাগেনি। কিন্তু মেসো এমন করে কথাটা বলেছিল যেন ও এক্কেবারে গেঁয়ো, এসব কখনও দেখেনি। মনে মনে তখন একটু রাগই হয়েছিল কানাইয়ের। “আমি জানি, এটা বাথটাব,” নির্মলকে বলেছিল ও।

বাথরুমের অন্যদিকের আরেকটা দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতর দিকটায় যাওয়া যায়। পাল্লাটা ঠেলা দিয়ে খুলে গুহার মতো বিশাল একটা ঘরে এসে পড়ল কানাই। ঘরের দেওয়ালগুলো কাঠ দিয়ে বাঁধানো। খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে সামান্য আলো এসে পড়েছে। ভেতরে। আলোর সেই রেখাগুলির মধ্যে ঘন ধুলো যেন জমাট বেঁধে আছে। মাঝখানে পড়ে আছে লোহার তৈরি বিরাট একটা পালঙ্কের কাঠামো। দেওয়ালে দেওয়ালে মোটা ফ্রেমে বাঁধানো বিশাল বিশাল সব পোর্ট্রেট ঝুলছে–লম্বা পোশাক-পরা মেমসাহেব, হাঁটু অবধি ব্রিচেসওয়ালা সাহেব। বহুদিনের অযত্নে রং জ্বলে ঝাপসা হয়ে এসেছে ছবিগুলো। ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে একটা পোর্ট্রেটের সামনে এসে থেমে গেল কানাই। ছবিটা একটা কমবয়েসি মেয়ের, লেস-লাগানো পোশাক পরা। ছোট ছোট হলুদ ফুলে ভরা একটা ঘাসজমির ওপর পা মুড়ে বসে আছে মেয়েটা, খাড়াই উঠে গেছে পেছনের জমি, তার খাঁজে খাঁজে বেগনি রংয়ের ঝোঁপড়া গাছ। দূরে পাহাড়ের মাথায় বরফ জমে আছে। ছবির নীচে ময়লাটে একটা পেতলের পাতের ওপর লেখা, ‘লুসি ম্যাককে হ্যামিলটন, আইল অব অ্যারান।

“লুসি হ্যামিলটন কে ছিল?” কানাই যেন নিজের ছেলেবেলার গলার আওয়াজ শুনতে পেল।

“ওর নামেই নাম দেওয়া হয়েছে এই দ্বীপটার।”

“ও এখানে থাকত? এই বাড়িটায়?”

“না। ইউরোপ থেকে এখানে আসার পথেই জাহাজডুবি হয়ে মারা গিয়েছিল। এ বাড়িটা ও চোখেই দেখেনি। কিন্তু ওর জন্যই যেহেতু এটা বানানো হয়েছিল, লোকে তাই এটাকে বলত লুসির বাড়ি। পরে মুখে মুখে সেটা হয়ে গেল লুসিবাড়ি। আস্তে আস্তে গোটা দ্বীপটার নামই লুসিবাড়ি হয়ে গেল। এই বাড়িটাকে কিন্তু আর কেউ ওই নামে ডাকে না। লোকের কাছে এটা এখন হ্যামিলটনের কুঠি।”

“কেন?”

“কারণ এটা বানিয়েছিল যে সাহেব তার নাম ছিল স্যার ড্যানিয়েল ম্যাকিনন হ্যামিলটন, লুসির কাকা। হ্যামিলটন সাহেবের নাম দেখনি তুমি স্কুলের দরজায়?”

“উনি কে ছিলেন?”

“ওনার কথা জানতে চাও তুমি?”

“শোনো তা হলে,” গাঁট-পাকানো তর্জনী তুলে বলেছিল মেসো। “শুনতে চেয়েছ যখন, তা হলে বলি। মন দিয়ে শুনবে। একবর্ণও কিন্তু বানানো গল্প নয়।”