প্ল্যাটফর্মের ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়া পিয়ার পিঠের দিকে সাগ্রহে তাকিয়ে রইল কানাই। বিয়ে-টিয়ে এখনও করেনি যদিও, কিন্তু নিজেকে ও বলে “রেয়ারলি সিঙ্গল”–কদাচিৎ সঙ্গিনীহীন। গত কয়েক বছরে বেশ কিছু মহিলা ওর জীবনে এসেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্পর্কগুলো একটা মধুর আন্তরিকতায় শেষ হয়েছে–অথবা টিকে রয়েছে। শেষবারের বিচ্ছেদের ঘটনাটা অবশ্য খুব একটা মধুর হয়নি। মেয়েটি ছিল বিখ্যাত এক কমবয়সি ওড়িশি নৃত্যশিল্পী। সপ্তাহ দুয়েক আগে প্রচণ্ড রেগেমেগে কানাইয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সে ওকে ফোনে আর যোগাযোগ করতে বারণ করেছিল। ব্যাপারটা তখন খুব সিরিয়াসলি নেয়নি কানাই। কিন্তু তারপরে যখন মেয়েটির মোবাইলে ফোন করল, দেখল সেটা ও ওর ড্রাইভারকে দিয়ে দিয়েছে। ঘটনাটায় বেশ জোরালো একটা ধাক্কা খেয়েছিল কানাইয়ের অহমিকা। তারপর থেকেই সেই ভাঙা অহংকারকে জোড়া দিতে ও যে-কোনও একটা সংক্ষিপ্ত সম্পর্কে জড়ানোর চেষ্টা করছে–এমন একটা সম্পর্ক, যার শুরু আর শেষের চাবিকাঠি ওরই হাতে থাকবে। কিন্তু এ যাবৎ সে চেষ্টায় বিশেষ কোনও ফল হয়নি। লুসিবাড়ি ভ্রমণের সময়টায় কানাই ভেবেছিল এই বান্ধবী খোঁজার চেষ্টায় একটা সাময়িক বিরতি দেবে। তবে এটাও ও জানে যে জীবনে অনেক সম্ভাবনারই জন্ম হয় খুব অপ্রত্যাশিত ভাবে। যেমন, পিয়ার সঙ্গে আজ ট্রেনের আলাপটা। এরকম প্রায় ঘঁচে-ফেলা আদর্শ একটা সিচুয়েশন খুব সহজে মেলে না : নদিন পরে ওকে ফিরতেই হবে, কাজেই কেটে পড়ার রাস্তাও পরিষ্কার। আর পিয়া যদি ওর নিমন্ত্রণ রাখতে লুসিবাড়ি শেষপর্যন্ত যায়, তা হলে হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলারও কোনও মানে হয় না।

ট্রেনের ভিড় পাতলা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল কানাই। তারপর প্ল্যাটফর্মে নেমে এসে সুটকেসটা দুপায়ের মাঝে রেখে ধীরেসুস্থে চারিদিকে তাকাল।

নভেম্বর শেষ হয়ে আসছে। মিঠে রোদ্দুর আর ঠান্ডা বাতাসে বেশ একটা খড়খড়ে ভাব। হাওয়া বইছে, তবে খুব জোরে নয়। কিন্তু কীরকম যেন একটা ক্লান্ত মরকুটে ভাব স্টেশনটার, যেন ক্ষয়টে মাটি-বেরোনো ঘাসহীন একটা শহুরে পার্ক। চকচকে রেললাইন বরাবর স্তরে স্তরে জমে আছে পেচ্ছাপ পায়খানা আর যত রাজ্যের আবর্জনা; আর প্ল্যাটফর্মটাকে দেখে মনে হচ্ছে কেমন যেন মাটিতে গেঁথে বসে গেছে মানুষের পায়ের চাপে।

এই স্টেশনে প্রথম ও এসেছিল তিরিশ বছরেরও বেশি আগে, কিন্তু এখনও কানাই পরিষ্কার মনে করতে পারে কেমন আশ্চর্য হয়ে ও মাসি-মেসোকে জিজ্ঞেস করেছিল, “এখানে এত লোক থাকে?”

মজা পেয়ে হেসেছিল নির্মল। “তুমি কী ভেবেছিলে? শুধু জঙ্গল থাকবে?”

“হ্যাঁ।”

“লোকজন ছাড়া ওরকম জঙ্গল শুধু সিনেমাতেই হয়। এখানে একেকটা জায়গা আছে যেখানে একেবারে কলকাতার বাজারের মতো ভিড়। আর কোনও কোনও নদীতে যত নৌকো দেখতে পাবে, গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডেও তত ট্রাক থাকে না।”

নিজের সমস্ত গুণের মধ্যে কানাইয়ের সবচেয়ে গর্ব ওর স্মৃতিশক্তি নিয়ে। লোকে যখন এতগুলো ভাষা জানার জন্য ওর প্রশংসা করে, কানাইয়ের ধরাবাঁধা জবাব হল পরিষ্কার কান আর ভাল স্মৃতিশক্তি থাকলেই যে-কোনও ভাষা শেখা যায়; আর ওর সৌভাগ্য যে এ দুটোই ওর আছে। তাই এতগুলো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও নির্মলের গলার স্বর আর কথা বলার ধরন স্পষ্ট মনে আছে দেখে বেশ একটু আত্মতৃপ্তি অনুভব করল কানাই।

শেষ যেবার নির্মলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল সেবারের কথা মনে পড়তে বেশ একটু হাসিই পেল ওর। সেটা সত্তরের দশকের শেষ দিক, কানাই তখন কলকাতায় কলেজে পড়ে। ক্লাসে যেতে দেরি হয়ে গেছে বলে ও তাড়াহুড়ো করে হাঁটছিল। ইউনিভার্সিটির ফুটপাথে পুরনো বইয়ের দোকানগুলোর সামনে দিয়ে প্রায় দৌড়ে যাওয়ার সময় একটা লোকের গায়ে গোঁত্তা খেল কানাই। ভদ্রলোক দোকানে দাঁড়িয়ে একটা বই উলটে পালটে দেখছিলেন। কানাইয়ের আচমকা ধাক্কায় বইটা হাত থেকে উড়ে গিয়ে পড়ল পথের পাশে জমা জলে। “রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াতে পারো না বোকাচোদা”–বলে লোকটাকে খিস্তি করতে গিয়েই মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে মেসোর হকচকিয়ে যাওয়া চোখদুটো ওর নজরে এল।

“আরে কানাই নাকি?”

“আরে তুমি!” নিচু হয়ে মেসোকে প্রণাম করার সময় জলে-পড়া বইটাও তুলে নিল ও। বিধ্বস্ত মলাটটায় চোখ পড়ল কানাইয়ের–ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের Travels in Mughal Empire.

দোকানদার ততক্ষণে চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে–”এত দামি বইটার বারোটা বাজিয়ে দিলেন মশাই, এটার দাম দিয়ে যেতে হবে আপনাকে।” মেশোর কাঁচুমাচু মুখের দিকে একঝলক তাকিয়েই কানাই বুঝতে পারল এত পয়সা মেশোর সঙ্গে নেই। ঘটনাচক্রে ও নিজে সেদিনই কিছু টাকা পেয়েছিল–একটা প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে কাগজে, তার পারিশ্রমিক। পকেট থেকে ওয়ালেট বার করে দাম মিটিয়ে বইটা নির্মলের হাতে গুঁজে দিল কানাই। পুরো ব্যাপারটাই ঘটে গেল লহমার মধ্যে। অপ্রস্তুত মেসোকে কোনও কৃতজ্ঞতার কথা বলার সুযোগ না দেওয়ার জন্য ও তড়বড় করে বলল, “আমাকে এখন দৌড়োতে হবে, ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে।” একলাফে জল-জমা একটা গর্ত পেরিয়ে সেখান থেকে হাওয়া হয়ে গেল কানাই।

এরপর কতবার ওর মনে হয়েছে আবার কখনও ঠিক এভাবেই দেখা হয়ে যাবে মেশোর সঙ্গে–দোকানে দাঁড়িয়ে কোনও দামি বই নেড়েচেড়ে দেখবে নির্মল, সে বই হয়তো তার কেনার সামর্থ্য নেই, আর কানাই তখন এসে বইটা মেসোকে কিনে দেবে। কিন্তু সেরকম কিছু আর ঘটেনি। কলেজ স্ট্রিটের সেই দুপুরের প্রায় দু’বছর পরে দীর্ঘদিন রোগে ভুগে লুসিবাড়িতে মারা গেল নির্মল। মৃত্যুশয্যায় মেসোর ওর কথা মনে পড়েছিল, নীলিমার কাছ থেকে পরে শুনেছে কানাই। নিজের কোনও একটা লেখা কানাইকে পাঠিয়ে দিতে বলেছিল। কিন্তু মারা যাওয়ার বেশ কয়েকমাস আগে থেকেই মেসোর কথাবার্তা অসংলগ্ন হয়ে গিয়েছিল, তাই নীলিমা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি কী করবে। নির্মল যাওয়ার পর সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেছিল–যদি কোথাও কিছু থেকে থাকে। কিছুই পাওয়া যায়নি। নীলিমারও তাই মনে হয়েছিল ওসব লেখা-টেখার কথা হয়তো প্রলাপের ঘোরেই বলা। শেষের দিকে এমনিতেই তো অকারণে বিড়বিড় করত মানুষটা।

কিন্তু মাসদুই আগে একদিন সকালে দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কের ফ্ল্যাটে হঠাৎ মাসির একটা ফোন পেল কানাই। নীলিমা ফোন করেছিল গোসাবার একটা বুথ থেকে–লুসিবাড়ির কাছেই আধা শহর-আধা গঞ্জ একটা জায়গা। ফোনটা যখন বাজল, কানাই তখন ব্রেকফাস্টের অপেক্ষায় খাওয়ার টেবিলে বসে।

“কানাই বলছিস?”

দু’-একটা এটা সেটা কথা, কুশল প্রশ্নের পরেই ওর মনে হল মাসির গলায় কেমন একটা বাধোবাধো সুর। যেন কী একটা বলতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। “কিছু হয়েছে নাকি মাসি?

তুমি কি কিছু বলবে আমাকে?” কানাই জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ রে, একটা কথা বলার ছিল,” নীলিমার স্বর একটু অপ্রতিভ।

“কী ব্যাপার? বলো না।”

“আমি ভাবছিলাম, মানে, তুই যদি একবার কয়েকদিনের জন্য লুসিবাড়িতে আসতে পারিস খুব ভাল হয় রে কানাই। তুই কি পারবি?”

একটু অবাকই হল কানাই। ঠিকই, নীলিমার ছেলেপুলে নেই, নিকট আত্মীয় বলতে একমাত্র ও-ই, কিন্তু এরকম দাবি মাসি আর কখনও করেছে বলে মনে পড়ল না ওর। নীলিমা বরাবরই একটু চাপা প্রকৃতির, কারও কাছে কোনও অনুগ্রহ চাওয়া তার স্বভাবে নেই। “কেন বলো তো?” আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল কানাই।

ফোনের ওপারে কয়েকমুহূর্ত কোনও শব্দ নেই। তারপর নীলিমা বলল, “তোর মনে আছে কানাই, অনেক বছর আগে আমি বলেছিলাম নির্মল তোর জন্য একটা লেখা রেখে গেছে?”

“হ্যাঁ, মনে তো আছেই। কিন্তু সে লেখাটা তো পাওয়া যায়নি?”

“সেটাই তো,” বলল নীলিমা। “মনে হয় শেষপর্যন্ত পেয়েছি। তোর নাম লেখা একটা মোটা প্যাকেট খুঁজে পাওয়া গেছে।”

“কোথায় পেলে?”

“নির্মলের পড়ার ঘরে। আমি যেখানে থাকি, ট্রাস্টের গেস্টহাউসে, তার ছাদের ওপর। ও মারা যাওয়ার পর এত বছর ধরে ঘরটা তালাবন্ধ পড়েছিল। কিন্তু এবার ওটা ভেঙে ফেলতে হবে, বাড়িটা আর একতলা বাড়াব। দু’একদিন আগে সেজন্য ঘরটা পরিষ্কার করতে গিয়ে পেলাম প্যাকেটটা।”

“ভেতরে কী ছিল?”

“নিশ্চয়ই ওইসব প্রবন্ধ, কবিতা-টবিতা যা লিখেছিল এত বছর ধরে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, আমি জানি না। আমার মনে হয় ও থাকলে তোকেই প্রথম ওগুলো পড়াতে চাইত। আমার লিটারারি জাজমেন্টের ওপর ওর কখনওই কোনও ভরসা ছিল না, আর আমিও সত্যি সত্যিই কিছু বুঝি না ওসব। তাই ভাবছিলাম তুই যদি একবার আসিস। হয়তো তুই লেখাগুলো ছাপানো-টাপানোরও ব্যবস্থা করতে পারবি। তোর তো অনেক পাবলিশারের সঙ্গে জানাশোনা আছে।”

“তা আছে,” কানাই বলল। মাথার মধ্যে কেমন সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল ওর।

“কিন্তু এখন লুসিবাড়িতে যাওয়া—এতদূরে–দিল্লি থেকে যেতেই তো দু’দিন লাগবে। মানে, গেলে ভালই লাগবে, কিন্তু–”

“তুই এলে আমি খুব খুশি হব, কানাই।”

নীলিমার কথা বলার এই শান্ত অথচ দৃঢ় ভঙ্গিটা কানাই খুব চেনে। কিছু একটা করবে বলে মনস্থির করলেই ওর কথা বলার ধরনটাই যেন পালটে যায়। কানাই বুঝতে পারছিল মাসি সহজে ছাড়বে না। ওদের পরিবারে তো নীলিমা তার জেদের জন্যই বিখ্যাত। আর ওই ছিনে-জেঁকের মতো লেগে থাকার ক্ষমতা আছে বলেই ও আজকের এই বাদাবন ট্রাস্ট গড়ে তুলতে পেরেছে। গ্রামের মানুষদের নিয়ে যেসব এনজিও কাজ করে, তাদের মধ্যে এই ট্রাস্টকে এখন আদর্শ বলে জানে সবাই।

“প্যাকেটটা ডাকে পাঠিয়ে দেওয়া যায় না, মাসি?” শেষ চেষ্টা কানাইয়ের।

“এরকম একটা জিনিস আমি ডাকে পাঠাব? কোথায় হারিয়ে যাবে তারপর!”

“মানে, ব্যাপারটা কী জানো তো, এখন আমাদের খুব কাজের চাপ। এক্কেবারে দম ফেলার সময় পাচ্ছি না।”

“তুই তো সব সময়ই ব্যস্ত।”

“সেটা ঠিকই।” কানাইদের ফার্মটা ছোট হলেও চড়চড় করে উন্নতি করছে। এই কোম্পানি ওর নিজের হাতে গড়া, আর ও-ই এটার হর্তাকর্তা-বিধাতা। দিল্লির বিভিন্ন দূতাবাস, বহুজাতিক সংস্থা আর দাঁতব্য প্রতিষ্ঠানের কাজে যে সমস্ত বিদেশি লোকজনেরা আসে, ওর কোম্পানির লোকেরা তাদের জন্য অনুবাদ আর দোভাষীর কাজ করে। এই ধরনের আর কোনও সংস্থা দিল্লিতে নেই বলেই এ লাইনে ওদের প্রায় একচেটিয়া দখল, আর চাহিদাও প্রচণ্ড। ফলে অফিসের লোকেদের সবাইকেই মুখে রক্ত তুলে খাটতে হয়; কানাইকে পরিশ্রম করতে হয় সবচেয়ে বেশি।

“তুই তা হলে আসছিস তো?” নীলিমা আবার জিজ্ঞেস করল। “প্রতি বছরই বলিস আসবি, কিন্তু শেষপর্যন্ত আর আসিস না। আমারও তো বয়স হচ্ছে, নাকি?”

একটু আগেও কানাই ভাবছিল কোনওরকমে কাটিয়ে দেবে নীলিমাকে, কিন্তু মাসির গলায় অনুনয়ের সুরটা শুনে মত পালটাল ও। বরাবরই কানাই নীলিমার একটু ন্যাওটা। মা মারা যাওয়ার পর টানটা আরও বেড়েছে। চেহারায়, স্বভাবে ওর মায়ের সঙ্গে এই মাসির খুবই মিল। মাসির জন্য কানাইয়ের শ্রদ্ধায়ও কোনও খাদ নেই। নিজের ব্যবসাটা গড়ে তুলতে গিয়ে ও হাড়ে হাড়ে বুঝেছে বাদাবন ট্রাস্টের মতো একটা প্রতিষ্ঠানের জন্য কী ঝড়টা সামলাতে হয়েছে নীলিমাকে। আর ওর ব্যবসার তুলনায় নীলিমার কাজ ছিল আরও অনেক কঠিন, কারণ বাদাবন ট্রাস্ট লাভের জন্য কাজ করে না। প্রথমবার লুসিবাড়িতে গিয়ে তো ও নিজের চোখেই দেখেছে কী নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটায় ভাটির দেশের মানুষরা। আর ওরা যাতে একটু অন্তত ভাল থাকতে পারে তার জন্যই নিজের জীবনটা বিলিয়ে দিয়েছে মাসি। নীলিমার এই গুণটার কোনও তুলনা খুঁজে পায় না কানাই। কেন এই জীবন মাসি বেছে নিল তারও কোনও ব্যাখ্যা ও খুঁজে পায় না। নিজের কাজের জন্য নীলিমা কোনও স্বীকৃতি পায়নি তা নয়–এই গত বছরই তো রাষ্ট্রপতির সম্মানপদক আর বড়সড় একটা উপাধি পেল। কিন্তু তাও কানাই ভাবে, যে পরিবেশ থেকে তার মাসি এই বাদাবনে এসেছিল, তাতে তার পক্ষে লুসিবাড়িতে এতগুলো বছর কাটিয়ে দেওয়াটা একটা আশ্চর্য ঘটনা। মা-র কাছ থেকে কানাই শুনেছে, তার মামাবাড়িতে আরাম-বিলাসের কোনও কমতি ছিল না। আর সে তুলনায় লুসিবাড়িতে তো সাধারণ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যেরও কোনও ব্যবস্থা নেই।

বন্ধুদের কাছে কানাই কতবার গল্প করেছে, তার মাসি কত স্বার্থত্যাগ করেছে সাধারণ মানুষের জন্য–যেন নীলিমা কোনও স্বর্ণযুগের এক চরিত্র, যে যুগে বড়লোকদের মধ্যে এত সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা ছিল না। এই সমস্তকিছুই মনের মধ্যে কাজ করছিল বলে মাসির অনুরোধটা শেষপর্যন্ত ফেরাতে পারল না কানাই।

“ঠিক আছে, তুমি যখন যেতে বলছ, তা হলে তো করার আর কিছু নেই, যেতেই হবে।” একটু অনিচ্ছার সঙ্গেই ও বলল। “দিনদশেকের জন্য যাওয়ার চেষ্টা করছি। আমাকে কি আজকালের মধ্যেই রওয়ানা হতে বলছ?”

“না না,” নীলিমা তাড়াতাড়ি বলল। “এক্ষুনি আসার কোনও দরকার নেই।”

“তা হলে অবশ্য অনেক সহজ হয়ে যায় ব্যাপারটা আমার পক্ষে,” স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল কানাই। সেই ওড়িশি শিল্পীর সঙ্গে ওর টক-ঝাল সম্পর্কটা তখন একটা ইন্টারেস্টিং মোড় নিচ্ছিল। সেই মুহূর্তে তার ছন্দপতন ঘটানোর মতো একটা ত্যাগ স্বীকার করতে মন চাইছিল না। শেষপর্যন্ত সেটা করতে হল না ভেবে খুশি হল কানাই। “ঠিক আছে। মাস দুয়েকের মধ্যেই পৌঁছে যাব আমি। এদিকটা একটু গুছিয়ে নিয়েই তোমাকে জানাব।”

“ওকে। আমি অপেক্ষা করে থাকব।”

আর এখন, এই ক্যানিং স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে কানাই দেখল শেডের নীচে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে তার মাসি–প্রায় জনাবিশেক লোক তাকে ঘিরে রয়েছে। তাদের কেউ কেউ নীলিমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে, আর কেউ রয়েছে বৃত্তের বাইরের দিকে, ভিড় ঠেলে ভেতরে পৌঁছতে পারছে না। চুপচাপ হেঁটে গিয়ে কানাই ভিড়টার পাশে দাঁড়াল। লোকগুলোর কথাবার্তা শুনে মনে হল এরা কেউ এসেছে কিছু কাজের খোঁজে, আর উঠতি নেতাগোছের কিছু লোক এসেছে নীলিমার সাহায্যের আশায়। কিন্তু জটলাটার বেশিরভাগ লোকই স্রেফ শুভাকাঙ্ক্ষী। তারা শুধু নীলিমাকে একবার চোখের দেখা দেখতে চায়, তার সান্নিধ্যের ছোঁয়া নিতে চায়। আর কিছু না।

এই ছিয়াত্তর বছর বয়সে নীলিমা বোস আকারে প্রায় গোল, তার টোল-পড়া গোল ঘঁদের মুখে পূর্ণিমার চাঁদের আদল। গলার স্বর নরম, কিন্তু চেরা বাঁশের গায়ে টোকা দিলে যেমন আওয়াজ বের হয় সেরকম, একটু ভাঙা। ছোট্টখাট্টো মানুষটি, মাথার চুল এখনও যথেষ্ট কালো–পেছনদিকে পুঁটলি করে বাঁধা। পরনে সর্বদাই বাদাবন ট্রাস্টে বোনা সুতির কাপড়, পাড়ে বাটিকের কাজ করা। এরকমই একটা আটপৌরে সরু কালো পাড় শাড়ি পরে নীলিমা চলে এসেছে, কানাইকে রিসিভ করতে।

এমনিতে নীলিমার ব্যবহারে সব সময়ই একটা আলগা প্রশ্রয়ের ভাব থাকে, কিন্তু দরকার পড়লেই বেরিয়ে আসে ভেতরের কঠিন মানুষটা–সে সময় তাকে অমান্য করার সাহস কারও নেই। কারণ সবাই ভাল করেই জানে, সব মা-মাসিদের মতোই নীলিমা একদিকে যেমন স্নেহময়ী, তেমনি দোষীদের কখনও ছেড়ে কথা বলা তার ধাতে নেই।

. ভিড়ের বাইরে কানাইয়ের চেহারাটা নজরে আসতেই হাতের ইশারায় লোকগুলোকে থামিয়ে দিল নীলিমা। আর জটলাটা যেন মন্ত্রবলে দু’ভাগ হয়ে গিয়ে কানাইয়ের জন্য পথ করে দিল।

“কানাই! কোথায় ছিলি এতক্ষণ? আমি তো ভাবছি ট্রেন মিস করলি বোধ হয়”–প্রণাম করার জন্য নিচু হতেই হাত দিয়ে ওর চুলগুলো এলোমেলো করে দিল নীলিমা।

“ঠিক সময়েই পৌঁছে গেছি তো৷” একহাতে মাসিকে জড়িয়ে ধরে দাঁড় করাতে করাতে কানাই ভাবছিল কী রকম বুড়িয়ে গেছে নীলিমা এই ক’বছরে। মাসির কনুইটা ধরে ধীরে ধীরে স্টেশনের গেটের দিকে এগোল ও। জটলার লোকগুলো মালপত্র নিয়ে আসতে লাগল পেছন পেছন।

“তুমি আবার খামকা ক্যানিং পর্যন্ত ঠেঙিয়ে আসতে গেলে কেন বলো তো? আমি ঠিকই পৌঁছে যেতে পারতাম।” এ কথাটা অবশ্য নিছক ভদ্রতার খাতিরেই বলা, কারণ একা খুঁজে খুঁজে লুসিবাড়ি যেতে হলে বেশ একটু মুশকিলেই পড়তে হত ওকে। আর ক্যানিং-এ এসে যদি দেখত ওকে নিতে কেউ আসেনি, মেজাজটা একেবারে খাট্টা হয়ে যেত কানাইয়ের।

নীলিমা অবশ্য অতশত বোঝেনি। “ভাবলাম চলে আসি। লুসিবাড়ি থেকে মাঝে মধ্যে বেরোতে পারলে ভালই লাগে। কিন্তু সে যাকগে, ট্রেনে কোনও অসুবিধা হয়নি তো? বোর হসনি তো একা একা?”

“না না। আসলে একটা ইন্টারেস্টিং মেয়ের সঙ্গে আলাপ হল, কথা বলতে বলতে চলে এলাম। আমেরিকান মেয়ে একটা।”

“তাই? এখানে কী করতে এসেছে?” জিজ্ঞেস করল নীলিমা।

“ওই ডলফিন-টলফিন জাতীয় প্রাণীদের ওপর রিসার্চ করছে। আমি ওকে বলেছি পারলে একবার লুসিবাড়ি ঘুরে যেতে।”

“বেশ করেছিস। আসবে আশা করি।”

“হ্যাঁ, আশা করি,” বলল কানাই।

চলতে চলতে আচমকা থমকে গিয়ে কানাইয়ের কনুইটা খামচে ধরল নীলিমা। উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, আমি তোকে নির্মলের একটা লেখা পাঠিয়েছিলাম, তুই কি পেয়েছিলি?”

“হ্যাঁ,” মাথা নাড়ল কানাই। “সেটাই তো ট্রেনে পড়তে পড়তে এলাম। মেসো আমার জন্য যে প্যাকেট রেখে গেছে ওটা কি তার মধ্যে পেলে?”

“না না, এই লেখাটা তো বহুকাল আগের। একটা সময়–বেশ কিছুদিন–তোর মেসো সারাদিন কেমন মনমরা হয়ে থাকত। তখন আমি ভাবলাম যদি কিছু একটা কাজে ওকে জড়িয়ে রাখা যায় তা হলে হয়তো মনটা একটু ভাল লাগবে। তাই বললাম সুন্দরবন নিয়ে টুকটাক কিছু লিখতে তো পারো। ভেবেছিলাম পরে ওগুলোকে আমাদের ব্রোশিওর-টোশিওরে লাগিয়ে দেব। কিন্তু শেষপর্যন্ত ও যেগুলো লিখল, সেগুলো একটু অন্য ধাঁচের। তোর ভাল লাগতে পারে ভেবে তোকে পাঠিয়েছিলাম।”

“ও। আমার কেন জানি মনে হয়েছিল ওই প্যাকেটের থেকে বের করে ওগুলো তুমি। পাঠিয়েছ।”

“না না। প্যাকেটটা আমি খুলিইনি,” বলল নীলিমা। “যেমন আঠা লাগিয়ে বন্ধ করা ছিল সেরকমই আছে। আমি জানি নির্মল চেয়েছিল তুই-ই ওই লেখাগুলো প্রথম পড়িস। আমাকেও ও তাই বলেছিল, মারা যাওয়ার ঠিক আগে।”

কানাই একটু ভুরু কোঁচকাল। “তোমার কখনও কৌতূহল হয়নি?”

মাথা নাড়ল নীলিমা। “কানাই, তুই যখন আমার বয়সে পৌঁছবি, দেখবি যেসব ভালবাসার মানুষরা চলে গেছে তাদের স্মৃতিমাখানো জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে কীরকম মন খারাপ লাগে। সেজন্যই আমি তোকে আসতে বলেছিলাম।”

স্টেশন চত্বর ছেড়ে ধুলোভরা একটা রাস্তায় নেমে এল ওরা। রাস্তার দু’ধারে গায়ে গায়ে লাগানো পানবিড়ি তেলেভাজার দোকান, আরও কত ছোটখাটো দোকান।

“কানাই, তুই যে শেষপর্যন্ত এসেছিস তাতে আমি কী খুশি যে হয়েছি–” নীলিমা বলল। “কিন্তু একটা কথা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না।”

“কী কথা?”

“তুই ক্যানিং দিয়ে কেন আসতে চাইলি? বাসন্তী হয়ে এলে কত সুবিধা হত। আজকাল তো এই রুটে কেউ আসেই না প্রায়।”

“তাই নাকি? কেন আসে না?”

“নদীর জন্য। নদীটা একেবারে পালটে গেছে তো।”

“পালটে গেছে? কীরকম?”

কানাইয়ের মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে নীলিমা বলল, “একটু অপেক্ষা কর, দেখতে পাবি এক্ষুনি।”

“যে-কোনও বড় নদীর কাছে গেলেই পুরনো দিনের কোনও না কোনও স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে।”

মেসো এর পর ওকে যে লম্বা লিস্টি শুনিয়েছিল তা পরিষ্কার মনে আছে কানাইয়ের :

মানাওসের অপেরা হাউস, কার্নাকের মন্দির, প্যাগানদের দশ হাজার প্যাগোডা… ক্যানিংকেও ওই তালিকায় তুলে দিয়েছিল মেসো, ভেবে হাসি পেল কানাইয়ের। “আমাদের এই মাতলার পাশের ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন হল পোর্ট ক্যানিং।”

ক্যানিং বাজার অঞ্চলের চেহারাটা একই রকম রয়ে গেছে দেখল কানাই–সরু সরু গলি, ঘেঁষাঘেষি দোকানপাট, নোনাধরা ঘরবাড়ি। ছোট ছোট দোকানে নানারকম পেটেন্ট ওষুধ বিক্রি হচ্ছে, ব্যথাবেদনা আর পেটের রোগের। বিচিত্র সব নাম ওষুধগুলোর হজমোজাইন, দৰ্দোসাইটিন। বাড়িঘরের মধ্যে চোখে পড়ার মতো আছে একমাত্র কিছু সিনেমা হল। বিশাল বিশাল হল সব, বালির বস্তার মতো কুৎসিত চেহারা নিয়ে চেপে বসে আছে জায়গাটার ওপর। যেন মাতলা যাতে শহরটাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে না পারে সেইজন্যই ওগুলিকে বসিয়ে রাখা হয়েছে এখানে।

একটা ইটবাঁধানো রাস্তায় গিয়ে শেষ হয়েছে বাজারটা। রাস্তাটা চলে গেছে শহর থেকে নদীর দিকে; কিন্তু খানিকটা গিয়েই শেষ হয়ে গেছে–নদীতে পৌঁছনোর বেশ কিছুটা আগেই। রাস্তার একদম শেষপ্রান্তে এসে কানাই বুঝতে পারল নীলিমা কেন বলছিল নদী পালটে গেছে। ওর স্মৃতিতে যে মাতলা আছে সে এক বিশাল নদী, সেরকম আর কখনও ও জীবনে দেখেনি। কিন্তু এখন সামনে বেশ কিছুটা দূরে যেটা দেখা যাচ্ছে সেটাকে বড়জোর একটা সরু খাল বলা যেতে পারে। ভাটা অনেকক্ষণ শুরু হয়ে গেছে, আর প্রায় কিলোমিটারখানেক চওড়া খাতের ঠিক মাঝখান দিয়ে তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে মাতলা। জলের ধার বরাবর সদ্য জমা পলি রোদে চকচক করছে, মনে হচ্ছে যেন পরতে পরতে জমে থাকা গলন্ত চকলেট। মাঝে মাঝেই এখানে ওখানে নদীর গভীর থেকে দু’-একটা বুদবুদ ভেসে উঠেই ফেটে যাচ্ছে, বৃত্তাকার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে বার্নিশ করা জলের ওপর। বুদবুদের শব্দগুলো যেন অস্ফুটে বলা কোনও কথার মতো মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন পৃথিবীর গভীর থেকে ভেসে আসা কোনও কণ্ঠস্বর আপন মনে বকবক করে চলেছে।

“ওই দেখ,” নীলিমা বলল দুরের দিকে একটা আঙুল দেখিয়ে। ভাটার মাতলার ওপর দিয়ে জল ছিটিয়ে এগিয়ে আসছে একটা নৌকো। মিটার নয়েকের বেশি লম্বা নয়, কিন্তু শখানেকের বেশি মানুষ গাদাগাদি করে উঠেছে ওটার ওপর। কানায় কানায় ভর্তি নৌকোটা, কিনারাগুলো জলের ওপর কোনওরকমে মাত্র ইঞ্চি ছয়েক জেগে রয়েছে। নদীর ধারে এসে নৌকোর গতি কমতেই মাঝিদের একজন একটা লম্বা তক্তা বের করে পাড়ের কাদায় খুঁজে দিল। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল কানাই। কী হবে এখন? এতগুলো লোক এই তলতলে কাদার সমুদ্র পেরিয়ে পাড়ে এসে পৌঁছবে কী করে?

নৌকোয় ততক্ষণে অবশ্য তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। মহিলারা শাড়ি গুটিয়ে, আর পুরুষরা যার যার লুঙ্গি, প্যান্ট হাঁটুর ওপর তুলে কাদায় নামার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তক্তা বেয়ে লোকগুলো এবার এক এক করে নামতে লাগল। হাঁ করে দেখছিল কানাই, মাটিতে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকে কীভাবে আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে থকথকে কাদায়। ঘন ডালের বাটিতে চামচ রাখলে সেটা যেমন ধীরে ধীরে ডুবতে থাকে, কাদায় ডুবন্ত যাত্রীদের ঠিক সেরকম মনে হচ্ছিল। বেশ কয়েকটা দীর্ঘ মুহূর্ত–কাদা একেকজনের প্রায় পাছা পর্যন্ত পৌঁছনোর পর শুরু হল ওদের সামনের দিকে এগোনোর পালা। প্রত্যেকের পা-ই কাদার নীচে, মানুষগুলোর শুধু ধড়টুকু দেখা যাচ্ছে–শরীরে মোচড় দিতে দিতে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগিয়ে আসছে শুকনো ডাঙার দিকে।

ভুরু কুঁচকে ওদের দিকে তাকিয়ে ছিল নীলিমা। “এদের দেখেই তো আমার হাঁটুতে ব্যথা করছে। আগে আমিও পারতাম রে এরকম কাদা ঠেলে আসতে, কিন্তু এখন আর পায়ে সে জোর নেই। আর মুশকিল কী জানিস তো? নদীতে জলও ভীষণ কমে গেছে আজকাল। ভাটার সময় তো থাকে না বললেই চলে। তোকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আজকে আমরা ট্রাস্টের লঞ্চ নিয়ে এসেছি, কিন্তু আরও অন্তত ঘণ্টা দুয়েকের আগে লঞ্চ এই অবধি আসতেই পারবে না।” একটু অভিযোগের দৃষ্টিতে বোনপোর দিকে তাকাল নীলিমা। “তুই যদি বাসন্তী দিয়ে আসতিস কত সহজ হত জার্নিটা বল তো?”

“আমি তো জানতাম না,” খেদের সুর কানাইয়ের গলায়। “তুমি যদি একবার বলতে… আমি তো এই রুটে এসেছি কারণ ১৯৭০-এ যখন লুসিবাড়ি গেলাম তখনও আমরা ক্যানিং হয়েই গিয়েছিলাম।”

চারিদিকে তাকিয়ে দৃশ্যগুলো যেন মনের মধ্যে গেঁথে নিচ্ছিল কানাই। ওর স্পষ্ট মনে পড়ল আকাশের গায়ে বিরাট একটা সারসের মতো দেখতে নির্মলের সিলুয়েট। পাখির উপমাটা মনে এসেছিল মেসোর পোশাক আর ছাতাটার জন্য। নদীর হাওয়ায় নির্মলের ধুতি-পাঞ্জাবি পতপত করে উড়ছিল পালকের ডানার মতো। আর সরু ছাতাটাকে মনে হচ্ছিল ঠিক যেন লম্বা ছুঁচলো পাখির ঠোঁট।

“ঠিক এই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে ছিল, আমরা যখন নৌকোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”

“কে, নির্মল?”

“হ্যাঁ। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, হাতে ছাতা।”

হঠাৎ ওর কনুইটা শক্ত করে চেপে ধরল নীলিমা, “চুপ কর, চুপ কর কানাই, আর বলিস না।”

থমকে থেমে গেল কানাই। “এখনও তোমার এত মন খারাপ হয়ে যায় মেসোর কথা শুনলে? এত বছর পরেও?”

নীলিমা যেন শিউরে উঠল। “এই জায়গাটায়–ঠিক এই জায়গাটাতেই ওকে পাওয়া গিয়েছিল, জানিস? এই ক্যানিং-এর বাঁধের ওপর। তারপর আর কয়েকমাস মাত্র বেঁচে ছিল। নিশ্চয়ই বৃষ্টিবাদলের মধ্যে বাইরে বাইরে ঘুরেছিল–নিউমোনিয়া হয়ে গিয়েছিল তো।”

“আমি তো এতসব জানতাম না! কিন্তু মেসো ক্যানিং এসেছিলই বা কেন?”

“এখনও ঠিক জানি না কেন এসেছিল। শেষের দিকে ওর চালচলন কীরকম খাপছাড়া হয়ে গিয়েছিল–সব সময় যেন একটা চাপের মধ্যে থাকত। রিটায়ার করল হেডমাস্টার হয়ে, আর মাত্র কয়েকমাসের মধ্যেই চোখের সামনে কেমন বদলে গেল চেনা মানুষটা। যখন তখন কিছু না বলে কয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যেত। আর সে সময়টাতেই মরিচঝাঁপির গণ্ডগোলও শুরু হয়েছে, আমি তো ভয়ে কাঠ হয়ে থাকতাম।”

“তাই নাকি?” কানাই একটু অবাক। “মরিচঝাঁপির ব্যাপারটা কী যেন? আমার ঠিক মনে নেই।”

“মরিচঝাঁপি ছিল ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের একটা দ্বীপ। রিফিউজিরা এসে দখল করে নিয়েছিল। সরকার যেই বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল, অমনি শুরু হয়ে গেল মারদাঙ্গা। গভর্নমেন্ট ওদের জোর করে মধ্যভারতের একটা উদ্বাস্তু শিবিরে ফেরত পাঠাতে চাইছিল। প্রচুর বাস-ট্রাক বোঝাই করে মানুষগুলোকে নিয়ে যাচ্ছিল সেখানে। এদিকে সারা তল্লাটে তো নানা গুজব ছড়াতে লাগল। আমি ভয়ে কাঁটা হয়ে আছি–নির্মলকেও যদি নিজের মনে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতে দেখে ওরা, কী যে হবে! শেষে মনে হয় ওকেও জোর করে ওরকম একটা বাসেই তুলে দিয়েছিল।”

“তাই নাকি?”

“আমার তাই ধারণা,” নীলিমা বলল। “পরে হয়তো কেউ ওকে চিনতে পেরে কোথাও একটা নামিয়ে দিয়েছে। তারপর ও কোনওরকমে ক্যানিং-এ চলে এসেছে। এখানেই তো ওকে দেখা গিয়েছিল–ঠিক এই বাঁধের ওপর।”

“তুমি জিজ্ঞেস করনি কোথায় গিয়েছিল?”

“জিজ্ঞেস করেছি রে কানাই। কিন্তু সে সময় ওর ঠিকমতো কোনও কথার জবাব দেওয়ার অবস্থাই চলে গিয়েছিল। মাথামুণ্ডু কী যে বকত… তারপর থেকে একবারই মাত্র সজ্ঞানে কথা বলেছিল–যখন তোকে ওই প্যাকেটটা দিতে বলল। আমি তো ভেবেছিলাম তখনও ভুল বকছে। কিন্তু পরে দেখলাম তা নয়।”

মাসিকে একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল কানাই৷ “খুব কষ্টে কেটেছে তোমার সেই সময়টা, না?”

চোখ মুছে নীলিমা বলল, “এখনও আমার পরিষ্কার মনে আছে ওকে যখন নিতে এসেছিলাম ক্যানিং-এ, সেই দিনটার কথা। ঠিক এখানটাতে দাঁড়িয়ে ও চিৎকার করছিল, ‘মাতলা জেগে উঠবে! মাতলা জেগে উঠবে!’ জামাকাপড় সব ধুন্ধুড়ে ময়লা, হাতে মুখে কাদা–সে চেহারাটা আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না।”

বহুদিনের চাপা-পড়া একটা স্মৃতি কানাইয়ের মাথার মধ্যে চাড়া দিয়ে উঠল। “মাতলা জেগে উঠবে বলছিল? মেসো নিশ্চয়ই সেই গল্পটার কথা ভাবছিল।”

“কোন গল্প রে?” একটু চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল নীলিমা।

“তোমার মনে নেই? সেই যে লাটসাহেব এখানে বন্দর বানিয়েছিল, আর পিডিংটন বলে এক সাহেব–ওই যে, সাইক্লোন’ শব্দটা যার তৈরি–সে কীরকম ভবিষ্যৎবাণী করল যে মাতলা জেগে উঠবে আর পোর্ট ক্যানিং ভাসিয়ে নিয়ে যাবে?”

“চুপ কর!” প্রায় চেঁচিয়ে উঠে হাত দিয়ে দু’কান চেপে ধরল নীলিমা। “আর বলিস না রে কানাই। এই স্মৃতিগুলো মনে এলেই আমার বুকের ভেতরটা যেন কুরে কুরে খেতে থাকে। সেজন্যই ওই প্যাকেটটা আমি নিজে খুলিনি, তোর হাতে দিয়ে দিতে চেয়েছি। ওসব কথা ভাবার মতো মনের জোরই নেই আমার।”

“সত্যি, খুবই কঠিন তোমার পক্ষে এ ঘটনাগুলো মনে করা,”কানাইয়ের গলায় অনুতাপ। “ঠিক আছে, এই প্রসঙ্গটা আমি আর তুলব না।”

দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কানাইয়ের মনে পড়ল আগেরবারেও এই বাঁধের ওপর অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল ওদের। ভাটার জন্য নয়, স্রেফ লুসিবাড়ির দিকে যাওয়ার কোনও নৌকো পাওয়া যাচ্ছিল না বলে। ও নীলিমার সঙ্গে একটা চায়ের দোকানে বসেছিল, আর নির্মলকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল বাঁধের ওপর, নৌকোর খোঁজ করতে। সে কাজে অবশ্য নির্মলের মন ছিল না খুব একটা। কলকাতার একটা বইয়ের দোকান থেকে সদ্য কেনা রাইনার মারিয়া রিলকের দুইনো এলিজির একটা অনুবাদ তার হাতে ছিল। কবিতাগুলো অনুবাদ করেছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসু–নির্মলের এক সময়কার পরিচিত। নৌকোর জন্য নদীর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল বটে, কিন্তু নির্মলের মন পড়ে ছিল ওই বইটার ওপর। নীলিমার ভয়ে খুলে পড়তে পারছিল না, তবে বুকের মধ্যে তেরচাভাবে চেপে ধরা বইটার দিকে সুযোগ পেলেই একবার তাকিয়ে নিচ্ছিল চুপি চুপি।

শেষপর্যন্ত অবশ্য নৌকোর জন্য নির্মলের ওপর ভরসা করতে হয়নি। এক মাঝি নিজের থেকেই এসে ওদের উদ্ধার করল। “আরে মাসিমা, আপনি এখানে?” গলাটা শুনে ওরা ফিরে তাকানোর আগেই বছর কুড়ি-বাইশের একটা ছেলে বাঁধের ঢাল বেয়ে দৌড়ে উঠে এসে নীলিমাকে প্রণাম করল।

“হরেন না? হরেন নস্কর তো তুই?” ছেলেটার মুখের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল নীলিমা।

“হ্যাঁ মাসিমা।” বেঁটে গাঁট্টাগোট্টা চেহারা ছেলেটার, চওড়া চ্যাপটামতো মুখ, রোদে কুঁচকে আছে চোখদুটো। পরনে খুব সাধারণ একটা লুঙ্গি আর গায়ে কাদার ছোপ লাগা গেঞ্জি।

“তুই ক্যানিং-এ কী করতে এসেছিস?” নীলিমা জিজ্ঞেস করল।

“কাল জঙ্গল করতে বেরিয়েছিলাম মাসিমা। বনবিবির দয়ায় অনেকটা মধু পেয়ে গেছি–তা প্রায় দু’বোতল হবে। তো সেইগুলোকে বেচতে এনেছি ক্যানিং-এ।”

হরেনের কথা শুনে নীলিমার কানে কানে ফিসফিস করে কানাই জিজ্ঞেস করেছিল, “মাসি, বনবিবি কে?”

“বনবিবি হলেন জঙ্গলের দেবী। এখানকার লোকেরা বিশ্বাস করে যে উনিই সমস্ত জঙ্গল আর জন্তু জানোয়ারকে শাসন করেন,” ফিসফিস করেই জবাব দিয়েছিল নীলিমা।

“ও!” এতবড় জোয়ান লোকটা এইরকম একটা গাঁজাখুরি গল্প বিশ্বাস করে দেখে অবাক। হয়ে গিয়েছিল কানাই। গুরগুর করে একটা হাসির দমক উঠে এসেছিল গলা বেয়ে।

“কানাই!” এক বকা দিয়েছিল নীলিমা। “এই সবজান্তা ভাবটা ছাড়ো। এটা তোমার কলকাতা শহর নয়, মনে রেখো।”

হাসির শব্দটা হরেনের কানে গিয়েছিল। নিচু হয়ে কানাইকে ভাল করে দেখে ও জিজ্ঞেস করেছিল, “এটা কে, মাসিমা?”

“আমার বোনপো। স্কুলে বাঁদরামি করেছিল বলে ওর বাবা-মা এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে, একটু শিক্ষা দিতে।”

“তা হলে ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন মাসিমা,” একগাল হেসে বলেছিল হরেন।

“আমার বাড়িতেও তো তিনটে বাচ্চা আছে; বড় ছেলেটার বয়স এর কাছাকাছিই হবে। এরকম ছেলেদের শিক্ষা দিতে খুব ভাল পারি আমি।”

“শুনলি তো কানাই?” ভয় দেখিয়েছিল মাসিমা। “এবার কোনও ঝামেলা করলে কিন্তু আমি তাই করব–একেবারে হরেনের বাড়ি দিয়ে আসব তোকে।”

সঙ্গে সঙ্গে মুখের হাসি-টাসি উবে গিয়ে কানাই একেবারে যাকে বলে সুবোধ বালক। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল ও যখন প্রসঙ্গটা এখানেই শেষ হল আর নীলিমার মালপত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল হরেন।

“আপনারা নৌকোর জন্য অপেক্ষা করছেন তো মাসিমা?”

“হ্যাঁ রে হরেন, অনেকক্ষণ ধরেই তো বসে আছি এখানে, কিছুই পাচ্ছি না।”

“তালে চলুন আমার সঙ্গে,”নীলিমাকে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়েই একটা ভারী ব্যাগ কাঁধে তুলে নিয়েছিল হরেন। “আমার নৌকো আছে, আমিই আপনাদের লুসিবাড়ি পৌঁছে দেব।”

কানাইয়ের মনে পড়ল, হরেনকে বাধা দেওয়ার একটা ক্ষীণ চেষ্টা করেছিল তার মাসি। “তোর তো অনেক ঘোরা হবে হরেন? কেন খামখা যাবি এত ঘুরপথে?”

“খুব একটা বেশি ঘোরা হবে না মাসিমা। আপনি আমাদের কুসুমের জন্য এত করেছেন, আর আমি আপনার জন্য এইটুকু করতে পারব না? আপনারা দাঁড়ান এখানে, আমি নৌকোটা নিয়ে আসি।”

চটপট পা চালিয়ে বাঁধের ওপর দিয়ে চলে গেল হরেন। ও একটু দূরে যেতেই কানাই জিজ্ঞেস করল নীলিমাকে, “লোকটা কে গো মাসি? ও কী বলছিল? কুসুম কে?”

হরেন আসলে একজন জেলে, নীলিমা ওকে বুঝিয়েছিল। লুসিবাড়ির কাছেই সাতজেলিয়া বলে একটা দ্বীপে থাকে। ওকে দেখে যেরকম মনে হয় তার থেকেও ওর বয়স অনেক কম, কুড়িও হয়নি হয়তো। কিন্তু এই ভাটির দেশের লোকেরা খুব কম বয়সেই ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়। হরেনেরও বছর চোদ্দোতে বিয়ে হয়েছিল। এই বয়সেই তাই ও তিন বাচ্চার বাপ হয়ে গেছে।

কুসুম ওদেরই গাঁয়ের একটা মেয়ে। বছর পনেরো বয়েস। লুসিবাড়ির মহিলা সমিতির কাছে ওকে দিয়ে গেছে হরেন, দেখাশোনা করার জন্য। কুসুমের বাবা জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে মারা যাওয়ার পর পেটের দায়ে ওর মা শহরে গিয়ে কাজ নিল। “মেয়েটা একা একা থাকত, কখন কী বিপদ আপদ ঘটে, তাই ওকে লুসিবাড়িতে দিয়ে গেছে হরেন,” নীলিমা বলেছিল। “কত রকমের লোকজন ওর ওপর নজর দিচ্ছিল। একজন তো ওকে বিক্রিই করে দেওয়ার তালে ছিল। হরেন না বাঁচালে কী যে হত ওর…”।

কানাইয়ের জ্ঞানতৃষ্ণা প্রবল হয়ে উঠেছিল। “কী হত মাসি?”

বিষণ্ণ হয়ে উঠেছিল নীলিমার চোখ। মানুষের যে দুঃখকষ্টের সমাধান তার হাতের বাইরে, সেগুলির কথা মনে এলেই এরকম একটা করুণ কোমল ছায়া নেমে আসে মাসির চোখে, সেটা কানাই আগেও দেখেছে। “কী হত? কুসুমকে ওর মান-ইজ্জত খোয়াতে হতে পারত। কত গরিবঘরের মেয়ের যে ওরকম সর্বনাশ হয়েছে…”

“ও,” কানাই গম্ভীরভাবে বলেছিল। একটু অকালপক্ক ও ছিল ঠিকই, তবে নীলিমার কথার ইশারা ইঙ্গিতগুলো সব বুঝতে পারেনি তখন। কিন্তু কথার ভাবটুকু যতটা ওর মাথায় ঢুকেছিল, তাতেই শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি বেড়ে গিয়েছিল।

“এখন কী করে মেয়েটা?” সাগ্রহে জিজ্ঞেস করেছিল কানাই।

“লুসিবাড়িতেই থাকে। মহিলা সমিতি ওর দেখাশোনা করে। দেখতেই পাবি গেলে।”

মাসির কথা শেষ হতে না হতেই বাঁধের গা বেয়ে দৌড় লাগিয়েছিল কানাই–একেবারে নির্মল যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে পৌঁছে ব্যগ্র চোখে নদীর দিকে তাকিয়ে খুঁজতে শুরু করেছিল কোথায় হরেনের নৌকো। এতক্ষণ পর্যন্ত লুসিবাড়ি যাওয়ার ব্যাপারে ওর মনে একটা বিরক্তি মেশানো আপত্তির ভাব ছিল, কিন্তু কুসুমের কথা শুনে সে ভাবটা একেবারে কেটে গেল।