ক্ষয়ক্ষতি
খাঁড়ির মুখ থেকে ফকির যখন ডিঙিটাকে ঠেলে বের করল, তখন সবে মাত্র সাড়ে পাঁচটা বেজেছে। বাতাসের বেগ বেড়েছে, কিন্তু আকাশের বেশিরভাগটাই পরিষ্কার দেখে একটু ভরসা পেল পিয়া। এমনকী শুরুর দিকে একটু সুবিধাই হল ওদের, যেদিকে ওরা যেতে চাইছিল ঢেউ আর হাওয়ার টানে সেই দিকেই তরতর করে এগোতে লাগল নৌকো। ফলে, মনে হচ্ছিল যেন একজোড়া বাড়তি দাঁড় কেউ জুড়ে দিয়েছে ডিঙিটার সঙ্গে।
নৌকোর মুখের দিকে পিঠ করে বসেছিল পিয়া, তাই প্রথম দিকটায়, হাওয়া যখন ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল ওদের, তখন পেছন থেকে আসা ঢেউগুলোকে ও দেখতে পাচ্ছিল। তখনও পর্যন্ত জলের ওপর উঁচু-নিচু ভাঁজের মতো মনে হচ্ছিল সেগুলোকে, ওপরে কোনও ফেনা টেনাও ছিল না। একটার পর একটা ঢেউ নিঃশব্দে গড়িয়ে এসে তুলে ধরছিল ডিঙির পেছনটা, তারপর আবার নামিয়ে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল সামনে।
আধঘণ্টাখানেক পর জিপিএস মনিটরে নিজেদের অবস্থানটা একবার দেখে নিল পিয়া। মনে হল দুশ্চিন্তার কিছু নেই। হিসেব করে দেখল এই গতিতে যদি এগোনো যায় তাহলে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই গর্জনতলায় পৌঁছে যাবে সম্ভবত ঝড় আসার আগেই।
কিন্তু এক একটা মিনিট যেতে লাগল আর সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে লাগল হাওয়ার বেগ। আকাশের কোণের কালো দাগটাও দ্রুত ছড়িয়ে যেতে লাগল চারদিকে। এদিকে ওরা যেখানে আছে সেখান থেকে একটানা সোজা পথে গর্জনতলায় যাওয়া যাবে না। এ খড়ি সে খুঁড়ি হয়ে এঁকেবেঁকে চলতে হচ্ছে ওদের। আর প্রত্যেকটা বাঁক নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে হাওয়ার দিক। একেক সময় এমনভাবে ঝাঁপটা এসে লাগছে যে একপাশে একেবারে কাত হয়ে যাচ্ছে ডিঙিটা। বাতাসের বেগ বাড়ার সাথে সাথে ঢেউগুলোও উঁচু হতে শুরু করেছে। মাথায় এখন তাদের সাদা ফেনার ঝুঁটি। বৃষ্টি নামেনি, কিন্তু হাওয়ার তোড়ে গুঁড়ি গুঁড়ি জলের ছিটে এসে লাগছে সারা গায়ে। ভিজে চুপ্পুড় হয়ে গেছে পিয়ার জামাকাপড়। একটু পরে পরেই জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিতে হচ্ছে, না হলে খড়খড়ে নুনের পরত জমে যাচ্ছে ঠোঁটের ওপর।
প্রথম মোহনাটাতে গিয়ে পৌঁছতেই বিশাল বিশাল সব ঢেউয়ের মুখে গিয়ে পড়ল ওদের ডিঙি। এতক্ষণ যেসব ঢেউয়ের মোকাবিলা করে এসেছে সেগুলো এদের তুলনায় একেবারে শিশু। একেকটা ঢেউ ফণা তুলে এগিয়ে আসছে, আর দাঁড় টেনে ডিঙিটাকে তার ওপর দিয়ে নিয়ে যেতে দম বেরিয়ে যাচ্ছে ওদের। অর্ধেক রাস্তা পেরোতে এখন যেন দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন সমতলের সোজা একটা রাস্তাকে তুলে নিয়ে কেউ উঁচুনিচু পাহাড় আর উপত্যকার ওপর দিয়ে পেতে দিয়েছে।
মোহনাটা পেরোনোর পর জিপিএস-এ আরেকবার রিডিং নিল পিয়া। কাজটা করতে খুব বেশি সময় লাগেনি, কিন্তু তাতেই এত পরিশ্রম হল যে দম ফিরে পেতে ওর প্রায় মিনিটখানেক সময় লেগে গেল। হিসেব করে যা পাওয়া গেল সেটাও খুব একটা উৎসাহিত হওয়ার মতো কিছু না। গতি যে কমেছে সেটাই বোঝা গেল আরেকবার, দেখা গেল প্রায় শামুকের মতো বেগে এখন এগোচ্ছে ওদের নৌকো।
মনিটরটা জায়গায় রেখে সবে দাঁড়ের দিকে হাত বাড়িয়েছে পিয়া, এমন সময় কী যেন একটা জিনিস ওর গাল ঘেঁষে কোলের ওপর উড়ে এসে পড়ল। চোখ ফিরিয়ে দেখল জঙ্গলের গাছের একটা পাতা। বাঁদিক থেকে এসেছে পাতাটা। সেদিকে এক পলক তাকাল পিয়া। দেখল বিশাল একটা নদীর একেবারে মধ্যিখানে রয়েছে ওদের ডিঙি। মানে, পাড় থেকে নৌকো পর্যন্ত প্রায় দু’কিলোমিটার পথ পাতাটাকে উড়িয়ে নিয়ে এসেছে হাওয়ায়।
খানিক এগিয়ে আরও একটা বাঁক নিতে হল নৌকোটাকে। হাওয়ার দিকে পেছন ফিরে এখন দাঁড় টানতে হচ্ছে পিয়াকে। যেদিক থেকে ঢেউ আসছে সেদিকটা চোখে পড়ছে না বলে কেমন অদ্ভুত অস্বস্তিকর লাগছে ব্যাপারটা। কোনোক্রমে ঢেউয়ের মাথায় পৌঁছনোর পর জলের গিরিশিরার ওপর টালমাটাল একটা গা-গোলানো মুহূর্ত, তারপরেই আবার টলমল করতে করতে প্রায় চিত হয়ে নেমে আসা–ব্যালান্স রাখতে পিয়াকে দুহাতে নৌকোর কাঠ আঁকড়ে থাকতে হচ্ছে। নীচের দিকে নামতে থাকা ডিঙির মুখের দিক থেকে হুড়হুড় করে উথলে আসছে জল, মনে হচ্ছে যেন ঝপাস করে বালতিভর্তি জল কেউ ঢেলে দিচ্ছে পিঠের ওপর।
ঢেউয়ের ওপর দিয়ে ক্রমাগত এই ওঠানামার ধাক্কায় আস্তে আস্তে আলগা হতে শুরু করেছে ফকিরের ডিঙির প্লাইউডের পাটাতন। মচমচ খটখট আওয়াজ উঠছে সেগুলো থেকে। হঠাৎ বাতাসের একটা ঝাঁপটায় একটুকরো প্লাইউডকে যেন ছিঁড়ে নিয়ে চলে গেল নৌকোর গা থেকে। মুহূর্তের মধ্যে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল সেটা। কয়েক মিনিট পরে আরও একটা টুকরো পাক খেতে খেতে উড়ে চলে গেল, তারপরে আরও একটা। ডিঙির খোলের মধ্যেটা এখন পরিষ্কার চোখে পড়ছে। ফকির যেখানে ওর কাঁকড়াগুলো জড়ো করে রেখেছে সে জায়গাটাও এখন দেখতে পাচ্ছে পিয়া।
আরও একটা মোেড়। এবার পাশ থেকে আসছে হাওয়ার ঝাঁপট। নৌকোটা একেবারে কেতরে যাচ্ছে একদিকে। পিয়ার ডানহাতের দড়টা প্রায় ফুটখানেক ওপরে উঠে গেছে অন্যটার থেকে। ডিঙির পাশ দিয়ে ঝুঁকে পড়ে জলের নাগাল পেতে হচ্ছে সেদিকটায়। নৌকো কাত হয়ে যাওয়ায় ছইয়ের নীচে গড়াগড়ি খাচ্ছে ওর পিঠব্যাগ। পিয়া ভেবেছিল ছইয়ের আড়ালে শুকনো থাকবে ওটা, কিন্তু এখন আর কিছুই যায় আসে না। সব দিক থেকে এমনভাবে জলের ছিটে আসছে যে ডিঙির ওপর সবকিছুই ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। ঢেউয়ের মাথায় নৌকো আরেকবার লাফিয়ে উঠতেই শূন্যে ছিটকে উঠল পিঠব্যাগটা। ছই না থাকলে এতক্ষণে তলিয়েই যেত নদীতে। হাত থেকে দাঁড়দুটো নামিয়ে রাখল পিয়া। কোনোক্রমে হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ব্যাগটার ওপর। দূরবিন, ডেথ-সাউণ্ডার থেকে শুরু করে ওর সমস্ত যন্ত্রপাতি রয়েছে এর ভেতরে। শুধু জিপিএস মনিটরটা ছাড়া। সেটা ও আগেই প্যান্টের বেল্টের সঙ্গে লাগিয়ে নিয়েছিল। তা ছাড়াও ওর সমস্ত ডেটাশিটগুলোও রয়েছে ওই ব্যাগের মধ্যে। সেগুলোকে প্লাস্টিকে মুড়ে একটা ক্লিপবোর্ডের সঙ্গে লাগিয়ে রেখেছে পিয়া। ওগুলো গেলে গত নদিন ধরে নোট করা ওর সমস্ত তথ্য জলে যাবে।
ব্যাগটাকে কী করে বাঁচানো যায় তার একটা উপায় খুঁজছিল পিয়া, এমন সময় দাঁড় টানা থামিয়ে ফকির একটা দড়ি ছুঁড়ে দিল ওর দিকে। কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল পিয়ার মন। হাত বাড়িয়ে দড়িটা নিয়ে ব্যাগের স্ট্র্যাপের মধ্যে দিয়ে গলিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিল ছইয়ের বাঁশের সঙ্গে। যন্ত্রপাতিগুলো সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নেওয়ার জন্যে একটুখানি ফাঁক করল ব্যাগের মুখটা। মজবুত ওয়াটারপ্রুফ কাপড়ে তৈরি বলে ব্যাগের ভেতরের জিনিসপত্র মোটামুটি শুকনোই আছে দেখা গেল। নিশ্চিন্ত হয়ে ফ্ল্যাপটা বন্ধ করতে গিয়ে হঠাৎ ভেতরের একটা পকেটের দিকে নজর পড়ল পিয়ার। ওর সেলফোনটা রাখা আছে সেখানে। ইন্ডিয়ায় এসে ওটা ব্যবহার করার কথা ভাবেইনি ও, ফলে একবারও অন করাই হয়নি যন্ত্রটা। চার্জও দেওয়া হয়নি কখনও। এখন এই টালমাটাল ডিঙির ওপর বসে হঠাৎ কেমন একটা কৌতূহল পেয়ে বসল পিয়াকে। সুইচ টিপে অন করে দিল ফোনটা। চেনা সবজে আলোটা পর্দায় ফুটে উঠতেই উৎসাহিত হয়ে উঠল ও। কিন্তু এক মুহূর্ত পরেই মিইয়ে গেল সমস্ত উৎসাহ। স্ক্রিনের ওপর ভেসে ওঠা লেখায় দেখা গেল কাভারেজ এরিয়ার বাইরে রয়েছে ফোনটা এখন। যন্ত্রটা ব্যাগের পকেটে রেখে দিয়ে ফ্ল্যাপটা বন্ধ করে দিল পিয়া। তারপর আবার নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে দাঁড় তুলে নিল হাতে।
হাওয়ার জোর আরও বেড়ে গেছে। নৌকোটা আরও একটু কাত হয়ে পড়েছে একপাশে। আবার প্রাণপণে দাঁড় টানতে লাগল পিয়া। কিন্তু তার মধ্যেও মোবাইল ফোনটার কথাই ঘুরে ফিরে আসতে লাগল ওর মাথায়। মনে পড়ল, বইয়ে কি খবরের কাগজে কত লোকের কথা পড়েছে নানা সময়, যারা উলটে যাওয়া ট্রেনের তলা থেকে, ভূমিকম্পে ভেঙে পড়া বাড়ির নীচ থেকে, জ্বলন্ত ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ভেতর থেকে মোবাইল ফোনে। আত্মীয় পরিজনদের জানিয়েছে তাদের বিপদের কথা।
আচ্ছা, মোবাইলটা যদি চালু থাকত তাহলে কাকে ফোন করত ও এখন? ওয়েস্ট কোস্টের বন্ধুদের? নাঃ। ওরা বুঝতেই পারত না ও কোথায় রয়েছে এখন। জায়গাটা বুঝিয়ে বলতেই অনৈকটা সময় লেগে যেত। তাহলে কানাইকে? পিয়ার মনে পড়ল, সেই ‘উপহারের’ খামটার পেছনে ঠিকানা ছাড়াও কতগুলো ফোন নাম্বার লিখে দিয়েছিল কানাই। একটা মোবাইল নাম্বারও ছিল তার মধ্যে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই দিল্লি ফেরার প্লেনে উঠে পড়েছে কানাই। হয়তো বা অফিসে পৌঁছেও গেছে। এখন ওকে ফোন করলে অদ্ভুত হত ব্যাপারটা। হয়তো এমন কিছু একটা ও বলত যে হাসিই পেয়ে যেত পিয়ার। ভাবনাটা মাথায় আসতেই ঠোঁট কামড়াল পিয়া। একটু হাসতে পারলে এখন মন্দ হত না। উথাল পাথাল ঢেউয়ের ওপর মোচার খোলার মতো দুলছে নৌকোটা। কাঠের জোড়গুলো থেকে কেমন একটা গোঙানির মতো শব্দ আসছে, যে-কোনও মুহূর্তে টুকরো টুকরো হয়ে ভেসে যেতে পারে তক্তাগুলো।
শক্ত করে চোখদুটো বন্ধ করল পিয়া, ছেলেবেলায় যেমন করত। প্রার্থনা করার মতো বিড়বিড় করে বলল, জলের মধ্যে নয়, প্লিজ। কিছু হলে শক্ত মাটির ওপরে হোক, জলে নয়; জলের মধ্যে যেন কিছু না হয়।
আরেকটা বাঁকের মুখে এসে পড়ল ওদের ডিঙি। বাঁকটা ঘুরতেই উবু হয়ে উঠে বসল ফকির। আঙুল তুলে দূরের এক চিলতে ডাঙার দিকে ইশারা করল : গর্জনতলা।
“মেঘা? হরেন?” জিজ্ঞেস করল পিয়া। ফকির মাথা নাড়ল। আরেকটু ভাল করে দেখার জন্যে পিয়া উঠে দাঁড়াল। কিন্তু এক নজরেই বোঝা গেল ফকির ভুল বলেনি–হরেনের লঞ্চটা ওখানে নেই। দ্বীপের চারপাশে ধু ধু করছে জল; ফুঁসে ওঠা ঢেউ আর তাদের মাথায় সাদা ফেনা ছাড়া আর কিচ্ছু চোখে পড়ছে না কোথাও।
ব্যাপারটা তখনও হজম করার চেষ্টা করছে পিয়া, এমন সময় ডিঙির ছইয়ের নীচে লাগানো পলিথিনটা হঠাৎ পটপট করে উঠল হাওয়ার টানে-সেই ছাই রঙের পলিথিনটা, মার্কিন মেলব্যাগের থেকে কেটে নেওয়া, প্রথম দিন ডিঙিতে পা দিয়েই যেটা চোখে পড়েছিল পিয়ার। ছইয়ের বাতার নীচ থেকে হঠাৎই খুলে বেরিয়ে এল প্লাস্টিকটা, হাওয়ার টানে ফুলে উঠল পালের মতো। সঙ্গে সঙ্গে মচমচ করে উঠল নৌকোর কাঠগুলো। দাঁত নখওয়ালা হিংস্র একটা জন্তুর মতো ঝড়টা যেন ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে চাইছে নৌকোটাকে।
হাওয়ার তোড়ে ফুলে ওঠা প্লাস্টিকের টুকরোটার বাঁধনে টান পড়তেই ডিঙির পেছনদিকটা উঁচু হয়ে উঠল। সামনের দিকটা নিচু হয়ে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল জলের ওপর। দাঁড়-টাড় ফেলে এক লাফ দিয়ে ফকির এগিয়ে গেল বাঁধন খুলে প্লাস্টিকটাকে আলগা করে দেওয়ার জন্যে। কিন্তু দড়ি কাটতে কাটতেই হঠাৎ মড়মড় করে প্রচণ্ড একটা শব্দ শোনা গেল এক ঝটকায় ডিঙির গা থেকে ভেঙে বেরিয়ে গেল ছইটা, হাওয়ার তোড়ে উড়ে গেল শূন্যে। পেছন পেছন ঘুড়ির লেজের মতো উড়ে চলে গেল দড়িদড়ায় জড়ানো পিয়ার পিঠব্যাগ। দেখতে দেখতে কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্লাস্টিকের টুকরো, নৌকোর ছই, যন্ত্রপাতি ডেটাশিট আর কানাইয়ের উপহার সমেত পিয়ার ব্যাগ-ট্যাগ সমস্ত নিয়ে জবড়জং জিনিসটা এত দূরে চলে গেল যে কালো আকাশের গায়ে ছোট্ট একটা বিন্দুর মতো দেখাতে লাগল সেটাকে।
রায়মঙ্গলের মোহনা থেকে মেঘা যখন লুসিবাড়ির দিকে মোড় নিল, ঘড়ির কাঁটা তখন প্রায় এগারোটার ঘর ছুঁয়েছে। জল থইথই করছে চারদিকে–অদ্ভুত অর্ধস্বচ্ছ জল। সিসার মতো কালো আকাশের নীচে সেই বাদামি জল থেকে যেন নিয়নের মতো আভা বেরোচ্ছে, মনে হচ্ছে নদী যেন ভেতর থেকে জ্বলছে।
যে ক’টা মোহনা ওরা এখনও পর্যন্ত পার হয়ে এসেছে, তাদের সবার থেকে বেশি এই মোহনার বিস্তার; এত বড় বড় ঢেউও আগে দেখা যায়নি। সে ঢেউয়ের মুখে পড়তেই ভটভটির ইঞ্জিনের ছন্দ বদলে গেল–একটানা ঘ্যানঘ্যানে একটা আওয়াজ তুলে ফুলে ওঠা জল কেটে এগোতে লাগল মেঘা। লঞ্চের মুখে ফেটে যাওয়া ঢেউ সমানে লাফিয়ে উঠতে লাগল শূন্যে, উড়ে আসা জলের কণায় ধুয়ে যেতে লাগল সারেঙের কেবিনের কাঁচের জানালা।
কানাই প্রায় সমস্ত সময়টাই সারেঙের কেবিনে হরেনের পাশের সিটটাতে বসেছিল। হাওয়ার জোর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কথা কমে আসছিল হরেনের, ক্রমশ আরও গম্ভীর হয়ে উঠছিল মুখটা। রায়মঙ্গলের বড় মোহনায় পড়ার পর কানাইয়ের দিকে তাকিয়ে ও বলল, “প্রচুর জল ঢুকছে লঞ্চে। ইঞ্জিনে একবার যদি ঢুকে যায় তাহলে কিন্তু আর কোনো আশা নেই। আপনি বরং একবার নীচে গিয়ে দেখুন কিছু করতে পারেন কিনা।”
ঘাড় নেড়ে উঠে দাঁড়াল কানাই। একটু কুঁজো হয়ে দাঁড়াতে হচ্ছিল, যাতে নিচু ছাদে মাথা না ঠুকে যায়। দরজা খোলার আগে লুঙ্গির খুঁটটা কোমরে গুঁজে নিল ও।
“সাবধান,” পেছন থেকে বলল হরেন। “ডেকটা কিন্তু ভীষণ পিছল হয়ে আছে।” হাতল ঘোরাতেই হাওয়ার তোড়ে হাত থেকে যেন ছিনিয়ে নিয়ে গেল পাল্লাটাকে; দড়াম করে খুলে গিয়ে সেটা ধাক্কা মারল কেবিনের দেওয়ালে। লাথি মেরে পা থেকে চটিগুলোকে সারেঙের ঘরের ভেতর ছুঁড়ে দিয়ে দরজাটার মোকাবিলা করার জন্যে তৈরি হল কানাই। পাশ থেকে ঘুরে গিয়ে কাঁধ দিয়ে ঠেলা মারতে হল হাওয়ার উলটোদিকে সেটাকে বন্ধ করার জন্যে। রেলিং-এ পিঠ ঠেকিয়ে এক পা এক পা করে তারপর নীচে নামার মইটার দিকে এগোতে লাগল ও। মইটা একেবারে খোলা হাওয়ার মুখোমুখি। তার প্রথম ধাপটায় পা রাখতেই কানাইয়ের ওপর যেন আছড়ে পড়ল ঝড়ের তাড়স। চটিদুটো না রেখে এলে নির্ঘাত পা থেকে খুলে নিয়ে চলে যেত হাওয়ায়। বাতাসের এমনি টান যে কানাইয়ের মনে হল মুহূর্তের জন্যে হাত আলগা হলেই হাওয়ায় মইয়ের থেকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে নীচের উথাল পাথাল জলের মধ্যে ফেলে দেবে ওকে। শেষ ধাপটা থেকে নেমে গুহার মতো খোলটার ভেতরে ঢুকতেই প্রায় তিন সেন্টিমিটার জলের মধ্যে ডুবে গেল কানাইয়ের পায়ের পাতা। অন্ধকার হয়ে আছে ভেতরটা। খোলের প্রায় শেষ বরাবর, যে খোপের মধ্যে ডিজেল ইঞ্জিনটা বসানো আছে, তার পাশে নগেনকে দেখতে পেল কানাই। একটা প্লাস্টিকের বালতি দিয়ে নগেন প্রাণপণে খোলের ভেতর থেকে জল তুলছে আর বাইরে ফেলছে।
গোড়ালি-ডোবা জলের মধ্যে দিয়ে কানাই আস্তে আস্তে এগোল সেদিকে। “আরেকটা বালতি আছে?”
জবাবে আঙুল তুলে একটা টিনের দিকে দেখাল নগেন। তেলতেলে জলের ওপরে ভাসছে টিনটা। সেটার হাতলটা ধরে জলে ডোবাতে যেতেই ভটভটিটা হঠাৎ একপাশে কাত হয়ে গেল। উলটে পড়ে যেতে যেতে কোনওরকমে সামলে নিল কানাই। কোনও রকমে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ও দেখল টিনে করে জল তোলাটা যতটা সোজা হবে মনে করেছিল তত সহজ নয় ব্যাপারটা। মেঘার দুলুনিতে খোলের ভেতরে জমা জল এমনভাবে নড়ছে যে মনে হচ্ছে যেন ওদের সঙ্গে খেলা করছে জলটা। ওরা দুজনে মিলে সমানে এদিক ওদিক লাফ ঝপ করে যাচ্ছে, কিন্তু যতটা কসরত করছে বালতি ততটা ভরতে পারছে না। খানিক বাদে জল তোলা থামিয়ে পাড়ের দিকে ইশারা করল নগেন। বলল, “লুসিবাড়ির কাছাকাছি এসে গেছি আমরা। ওখানেই যাবেন তো আপনি?”
“হ্যাঁ। কিন্তু তোমরা যাবে না?”
“না। আমরা এর পরের দ্বীপটাতে নামব। এই এলাকায় ঝড়ের সময় ওখানেই একমাত্র নিশ্চিন্তে গিয়ে ওঠা যায়। আপনি বরং ওপরে গিয়ে একবার দাদুকে জিগ্যেস করুন কী করে লুসিবাড়িতে আপনাকে নামানো হবে। এই হাওয়ার মধ্যে ওখানে গিয়ে নামা কঠিন হবে।”
“ঠিক আছে।” এঁচোড়-পাচোড় করে মই বেয়ে আস্তে আস্তে আবার ওপরে গিয়ে উঠল কানাই৷ পিছল ডেকের ওপর দিয়ে পা টিপে টিপে ফিরে গেল সারেঙের ঘরে।
“কী অবস্থা নীচে?” জিগ্যেস করল হরেন।
“মোহনার মাঝখানটায় যখন ছিলাম তখন বেশ খারাপই ছিল। এখন খানিকটা ভাল।”
বুড়ো আঙুল দিয়ে জানালার কাছে টোকা মারল হরেন। “ওই দেখুন, সামনে লুসিবাড়ি দেখা যাচ্ছে। আপনি কি ওখানেই নামবেন, না আমাদের সঙ্গে যাবেন?”
জবাবটা আগের থেকেই ভেবে রেখেছিল কানাই। “আমি লুসিবাড়িতেই নামব। মাসিমা একা আছেন। ওনার কাছে যাওয়া উচিত আমার।”
“ঠিক আছে। পাড়ের যতটা কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব আমি নিয়ে যাব ভটভটিটাকে। বাকিটা কিন্তু আপনাকে জলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গিয়ে উঠতে হবে।”
“আর আমার সুটকেসটার কী হবে?”
“ওটা আপনি রেখেই যান। আমি পরে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসব।”
সুটকেসের মধ্যে একটা জিনিসের জন্যেই সবচেয়ে বেশি মায়া কানাইয়ের। বলল, “ঠিক আছে। ওই নোটবইটা ছাড়া বাকি আর যা আছে সব রেখে যাচ্ছি। কিন্তু নোটবইটা সঙ্গে নিয়ে যাব। প্লাস্টিক দিয়ে মুড়ে নেব, যাতে ভিজে না যায়। ওটা আমি নিয়ে যেতে চাই।”
“এই যে, এটা নিন।” স্টিয়ারিং-এর নিচ থেকে পলিথিনের একটা ব্যাগ বের করে কানাইয়ের হাতে দিল হরেন। “কিন্তু এবার তাড়াতাড়ি করুন। প্রায় পৌঁছে গেছি আমরা।”
সারেঙের ঘর থেকে ডেকের ওপর বেরিয়ে এল হরেন। দু-এক পা এগিয়েই কেবিন। কোনোরকমে গলে যাওয়ার মতো দরজাটা ফাঁক করে চট করে ভেতরে ঢুকে পড়ল কানাই। আধো অন্ধকারের মধ্যে সুটকেসটা খুলল, নির্মলের নোটবইটা বের করল, তারপর যত্ন করে সেটাকে মুড়ে নিল পলিথিনে। প্যাকেটটা সঙ্গে নিয়ে কেবিন থেকে বেরোতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে বন্ধ হয়ে গেল ভটভটির ইঞ্জিনটা।
ডেকের ওপরে হরেন অপেক্ষা করছিল ওর জন্যে। “খুব বেশিদূর যেতে হবে না আপনাকে,” মিটার তিরিশেক দূরে লুসিবাড়ির বাঁধের দিকে ইশারা করে বলল হরেন। বাঁধের গোড়ার দিকে ঠিক যেখানটায় মোহনার ঢেউগুলো এসে আছড়ে পড়ছে দ্বীপের ওপর, একটানা একটা সাদা ফেনার রেখা দেখা যাচ্ছে। “জল খুব একটা বেশি নয়,” হরেন বলল। “কিন্তু খুব সাবধানে যাবেন।” তারপর কী মনে হতে বলল, “আর ময়নার সঙ্গে যদি আপনার দেখা হয় ওকে বলবেন ঝড়টা একটু কমলেই আমি গিয়ে ফকিরকে নিয়ে আসব।”
“আমিও তখন যাব আপনার সঙ্গে,” বলল কানাই। “মনে করে লুসিবাড়ি হয়ে যাবেন কিন্তু।”
“ঠিক সময় মতো এসে আপনাকে তুলে নেব আমি,”হাত তুলে কানাইকে বিদায় জানাল হরেন। “আর ময়নাকে কথাটা বলতে ভুলবেন না যেন।”
“ভুলব না।”
লঞ্চের পেছনের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল কানাই। আগে থেকেই নগেন সেখানে একটা তক্তা লাগিয়ে রেখেছে। “পেছন ফিরে পা রাখুন তক্তাটার ওপরে,” কানাইকে সাবধান করে দিল নগেন। “মই বেয়ে নামার মতো দু’হাতে কাঠটাকে ধরে ধরে নামুন। নইলে কিন্তু হাওয়ার টানে উলটে পড়ে যাবেন।”
“ঠিক আছে।” পলিথিনে মোড়া নোটবইটাকে লুঙ্গির কষিতে বেঁধে নামার জন্যে প্রস্তুত হল কানাই। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে নিচু হয়ে দু’হাতে তক্তার দুটো ধার চেপে ধরল শক্ত করে। সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারল নগেনের পরামর্শ না নিলে সত্যি সত্যিই হাওয়ার টানে জলের মধ্যে গিয়ে পড়ত ও। নামার সময় হাতদুটো ব্যবহার না করলে এ হাওয়ার ঝাঁপট সামলানো অসম্ভব। পেছন ফিরে চার হাতপায়ে হামাগুড়ি দিয়ে নামতে লাগল কানাই।
সোজা হয়ে দাঁড়াল একেবারে তক্তা থেকে নামার পর। জলে নামার পর নীচের নরম কাদায় আস্তে আস্তে ডুবে যেতে লাগল পায়ের পাতা। মুহূর্তের জন্য তক্তাটাকে আঁকড়ে ধরে টাল সামলাল কানাই। কোমরের একটু নীচ পর্যন্ত জল এখানটায়। প্রচণ্ড স্রোতের টানে সোজা হয়ে দাঁড়ানোই কঠিন। নোটবইটা প্রায় বুকের কাছে তুলে নিল কানাই। তারপর সামনের বাঁধের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে খালি পায়ে খুব সাবধানে এক পা এক পা করে এগোতে লাগল জল ঠেলে। জল যখন হাঁটুর কাছাকাছি নেমে এল তখন অবশেষে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল–প্রায় চলে এসেছে এখন, বাকি জলটুকু পেরিয়ে পাড়ে গিয়ে ওঠা যাবে শেষ পর্যন্ত। পেছনে ভটভটির ইঞ্জিন চালু হল আবার। শব্দটা কানে আসতে ঘুরে তাকাল কানাই।
ঠিক এই অসতর্ক মুহূর্তটুকুর জন্যেই যেন অপেক্ষা করছিল হাওয়াটা। একপাক ঘুরিয়ে কাত করে কানাইকে ফেলে দিল জলের মধ্যে। হাবুডুবু খেতে খেতে দুটো হাত কাদার মধ্যে ঠেসে ধরল ও। তারপর টলমল করে কোনওরকমে দাঁড়িয়ে উঠেই দেখতে পেল মিটার দশেক দূরে স্রোতের টানে দুলতে দুলতে ভেসে যাচ্ছে নোটবইটা। কয়েক মিনিট ভেসে থাকার পর আস্তে আস্তে সেটা তলিয়ে গেল দৃষ্টির আড়ালে।